ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং : পর্ব ৫৬


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (June 3, 2024)
     

    রাশিয়া আর আমরা

    রাশিয়া ছোটদের জন্য কমিক্‌স বার করেছে, তারপর সেগুলো শয়ে-হাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে স্কুলে, ছোট ছেলেমেয়ের মধ্যে, যাতে বলা হচ্ছে ইউক্রেন শয়তান, আর রাশিয়া মহান। যুদ্ধটা নিতান্ত ঘোষণা করতেই হয়েছিল, নইলে ইউক্রেন বহু মানুষকে মেরে ফেলত জাতিগত বিদ্বেষে। রাশিয়ার সৈন্যেরা এত মহৎ, তারা আহত ইউক্রেনীয়দেরও সেবা করছে, ফার্স্ট-এড দিচ্ছে। অথচ তথ্য হল, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ইউনাইটেড নেশনস-এর মানবাধিকার দেখার দায়িত্বপ্রাপ্তেরা বলেছে, রাশিয়ান সৈন্যেরা যুদ্ধবন্দিদের উপর অত্যাচার করেছে ও অনেককেই খুন করেছে। পশ্চিমি মিডিয়া যে রুশ সেনানায়ককে নিরীহ নাগরিকদের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছে, তাকে রুশ কমিক্‌সে মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখানো হয়েছে। কমিক্‌স অনুযায়ী, পশ্চিমের কিছু দেশ চক্রান্ত করে কিভ-এর নব্য-নাৎসিদের যুদ্ধাস্ত্রের জোগান দিচ্ছে, কিন্তু এইসব ন্যাটো-র শয়তান আর পশ্চিমিদের দালাল আর বোড়ে মিলে কিসুই করতে পারবে না।

    এতে অবাক হওয়ার একেবারে কিচ্ছু নেই, কারণ পৃথিবীর প্রত্যেকটা রাষ্ট্র— রাষ্ট্র কেন, যে-কোনও সংগঠন, এমনকি পাড়ার ক্লাবও— তার নিজের পক্ষে যুক্তি সাজানোর সময় সত্যি-মিথ্যের মা-বাপ না-মেনে যা ইচ্ছে তা-ই প্রচার করে। যদি অমুক পাড়ার সঙ্গে তমুক পাড়ার ইটের লড়াই হয়, কিংবা চারটে পেটো মারা হয়, তাহলে পরেরদিন দুটো পাড়াই বলবে ওই ওরা আগে মারামারি শুরু করেছিল, এবং ওদের মস্তানেরা আকছার গেরস্থের মেয়ের গায়ে হাত দেয়। যে-কোনও রাজনৈতিক দল ভোটের আগে খুনোখুনির সময়ে বলবে আমরা কক্ষনও খুন করি না, সব্বাইকে বিরোধীরা খুন করে। যখন আমাদের দলের লোক মরে তখন ওরা খুন করে, আর যখন ওদের দলের লোক মরে, তখন হয় সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে খুন করে (কারণ ওদের অনাচার আর সহ্য করতে পারছিল না), কিংবা ওরা নিজেরাই খুন করে যাতে আমাদের ঘাড়ে দোষটা চাপিয়ে দেওয়া যায়। যুদ্ধ চলার সময়ে তো বটেই, অন্য সময়েও একটা দেশ তার শত্রুদেশকে অবিমিশ্র শয়তান হিসেবে উপস্থাপিত করার জন্য মিডিয়ায় প্রচার চালায়। ভারতীয় সিনেমায় পাকিস্তানি ভিলেন হলে শেষ সিনে তাকে উচ্চণ্ড মারধরটা ভাল জমে। আর যুদ্ধ চললে তো কথাই নেই, এন্তার মিথ্যে বলে বিরোধী দেশটা সম্পর্কে লোকের মনে ঘেন্না গজানোর প্রোজেক্ট চালানো একেবারে নিয়ম। যে-দেশ যুদ্ধে জেতে, ইতিহাসকে নিজের মতো গড়েপিটে ধুয়েমুছে তৈরি করে নেয়, যাতে দেখা যায় তারা সরলসাদা নির্মলকুমার, আর অন্যরা কুষ্টিকালো গব্বর সিং। হেরো দেশও নিজ-কোলে ঝোল টেনে অন্যকে দোষ দেয় বটে, কিন্তু মিনমিনিয়ে, তার গল্প অন্যের কাহিনির কাছে বেশ নাকানিচোবানি খায়। তাই জনসভা বা শিল্পসংস্কৃতি— সর্বত্র আমার শত্রুকে একমাত্রিক খারাপ হিসেবে দেখাব, এর ব্যত্যয় কোনওদিনই কারও বেলাতেই হয়নি, আজ রাশিয়ার ক্ষেত্রেই বা হবে কেন? কেউ অবশ্য বাড়তি সরল সেজে জিজ্ঞেস করতে পারেন, বাচ্চাদের টার্গেট করার কারণ কী।

    রাশিয়ানরা কখনও ট্রেনে করে শিল্প প্রদর্শনী দেশময় ঘোরাচ্ছে, যেখানে কমিক্‌সও আছে, আর কখনও মাগনা কমিক্‌স পড়তে দিচ্ছে, যাতে বাচ্চাগুলো বিনোদনের টানে মনে করে ইউক্রেনীয় মানুষদের মারলে পৃথিবীর উপকার করা হয়। যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, রুশ কমবয়সিরা সেটাকে খুব একটা সমর্থন করেনি। তা সংশোধন করতেই হয়তো এই চেষ্টা।  

    ‘ক্যাচ দেম ইয়াং’ বহুদিনের স্লোগান, এবং সক্কলের স্লোগান। সিপিএমেরও, আরএসএসেরও। শুধু ধর্মীয় সংগঠনগুলো কিছুটা পিছিয়ে আছে। যে-কেউ জানে, মগজ ধোলাই করতে গেলে মানুষকে একেবারে গোড়াতে ধরে ফেলাই ভাল, কারণ তখন মগজ অপরিণত থাকে, তাকে ধাক্কিয়ে তুবড়িয়ে নিজের ঈপ্সিত ছাঁচের ধারেকাছে এনে ফেলা যায়। তাছাড়া বাচ্চারা সাধারণত বলা-কথা লেখা-বাণী ধাঁইসে বিশ্বাস করে ফ্যালে। আর সেনাবাহিনী বা বোমারু বিমানকে ভালবাসানোর এটা শ্রেষ্ঠ সময়, কারণ কাঁচা বয়সে দেশপ্রেমিক হওয়ার এবং বীরত্বকে পুজো করার একটা বিরাট প্রবণতা থাকে, যাকে দুরন্ত অ্যাকশন ভাবছিল তা যে অমানবিক হত্যা, বুঝতে-বুঝতে বহুদিন পেরিয়ে যায়। তাই দক্ষিণপন্থী দলও বাচ্চাদের জন্যে খেলাধুলো-প্যারেড-লাঠিখেলার আয়োজন করে, তারপর ইতিউতি নিজেদের ক’ফোঁটা আদর্শ সেঁধিয়ে দিতে চায়, বামপন্থী সংগঠনও বাচ্চাদের জন্যে বিশেষ মেলা বা ফুটবল ম্যাচ লড়িয়ে দেয়, কিংবা জলসায় আবৃত্তি কম্পিটিশনে টানে, যেখানে গোড়ায় ও শেষে গণসংগীত, আর তিনটে বক্তৃতায় মার্ক্সবাদের মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়। এখনকার বাচ্চারা রেডিও শোনে না টিভিও দ্যাখে না, বাইরে খেলতেও যায় না, তাদের ঝুঁটি পাকড়াতে গেলে গ্রাফিক নভেল দিয়েই চেষ্টা করতে হবে, বা ভিডিও গেম। রাশিয়ানরা কখনও ট্রেনে করে শিল্প প্রদর্শনী দেশময় ঘোরাচ্ছে, যেখানে কমিক্‌সও আছে, আর কখনও মাগনা কমিক্‌স পড়তে দিচ্ছে, যাতে বাচ্চাগুলো বিনোদনের টানে মনে করে ইউক্রেনীয় মানুষদের মারলে পৃথিবীর উপকার করা হয়। যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, রুশ কমবয়সিরা সেটাকে খুব একটা সমর্থন করেনি। তা সংশোধন করতেই হয়তো এই চেষ্টা।

    অরওয়েল-এর ‘নাইন্টিন এইট্টিফোর’ উপন্যাসেও রাষ্ট্র ছোটদের নির্দেশ দিয়েছিল, বড়দের ওপর নজর রাখো, যাতে তারা রাষ্ট্রবিরোধী কথাবার্তা বললে বা কাজকর্ম করলে তোমরা আমাদের নালিশ করে দিতে পারো। হট করে শুনলে মনে হয় বাড়াবাড়ি, সন্তান নিজের মা-বাপকে ধরিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু যথাযথ মগজ ধোলাই করলে তাও সম্ভব। এবং আমরা যখন ছোটদের মানুষ করে তুলি, কীভাবে তা করি? একটা সমাজ কীভাবে তার ভবিষ্যৎ নাগরিকদের বড় করতে চেষ্টা করে? নিজের মূল্যবোধগুলোকে তাদের মধ্যে জোরসে ঢুকিয়ে দিয়েই তো। তার মানেই হল, এক সেট আচরণকে স্বাভাবিক ও শ্রেয় বলে তার সামনে সাজিয়ে দেওয়া, এবং প্রায় বাধ্যতামূলক ভাবে আর-এক সেট আচরণকে পাপ বলে দেগে দেওয়া। একজন গড় হিন্দু বাঙালি বাচ্চা বড় হওয়ার সময়েই জানে, গুরুজনকে নমস্কার করতে হয়, গরুর মাংস খেতে নেই, বিয়ে করতে হয়, এবং অন্য-লিঙ্গের লোককেই করতে হয়, আর সংস্কৃতি জিনিসটা পূজনীয়। এবং তার অনুসিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই এই: যে গুরুজনকে নমস্কার করে না, যে গরু খায়, যে বিয়ে না করে লিভ-ইন করে, যে সমকামী, আর যে সংস্কৃতির চেয়ে টাকাকে মূল্য দেয় বেশি— সে খারাপ। ক’টা বাড়িতে আর শেখানো হয়, আমরা এইরকম, তাই তোমাকে এগুলো বলছি, তবে কিনা অন্য-বিশ্বাসী অন্য-অনুসারী লোকও আছে, আর তারাও সমান গ্রহণীয়? ক’টা ধর্ম আছে, যে বলে, আমরা এভাবে পুজো করছি, তবে অন্যভাবে পুজোও হয়; কোন নিরাকার-উপাসক জানায় যে পৌত্তলিকেরাও কম ভক্ত নহে? আমাদের সব গল্পই হল: আমরা যেরকম, সেরকমটাই ঠিকঠাক, এমনকি আমরা মারলেও ভাল কাটলেও ভাল, আর অন্যরা খারাপ, কারণ তারা অন্য। সেই তত্ত্বটাই আগ্রাসীভাবে প্রচার করে রাষ্ট্র, যুদ্ধের মতো আপৎকালে একটু বেশি। বাচ্চাদের মুক্তমনা করে গড়ে তোলার চেয়ে, আমরা দৃঢ়বিশ্বাসী করে গড়ে তুলতেই চাই। তারা ‘এটাও হয়-ওটাও হয়’ শিখলে তো নিতান্ত ভাসমান কচুরিপানা হয়ে যাবে, তার চেয়ে তার শিকড় জম্পেশ প্রোথিত হোক আমারই নির্দিষ্ট বিশ্বাসে, এই আমাদের আকাঙ্ক্ষা। কোনও গুরুজন যদি বলে, বইটা পায়ে লাগলে নমো করতে পারো, কারণ অনেকে বিশ্বাস করে বই সম্মাননীয় আর পা হচ্ছে ইতর অঙ্গ, তবে কিনা হাত আর পায়ের মধ্যে ওরকম পার্থক্যের কোনও অর্থ নেই, তাই নমো না-ও করতে পারো— তাহলে বাচ্চা হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। তার চেয়ে ‘করো’, বা ‘কোরো না’ স্পষ্ট বললে সে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে। কিন্তু স্বচ্ছন্দ বোধ করানোই আমাদের সেরা কর্তব্য কি? শিক্ষা দেওয়া মানে কি তাকে অস্বস্তি থেকে বাঁচানো? এমনও তো মত থাকতে পারে, গোটা পৃথিবী ও জীবন যেখানে অনিশ্চয়তা ও দোলাচলে ভর্তি, সেখানে নমনীয়তার প্রথম পাঠ দেওয়াটাই তাকে ঠিক করে বড় করে তোলা? তাকে যদি বোঝানো হয়, বিশ্ব জুড়ে হরেক রকম লোক আছে, তাদের নানা রং নানা ধরন, অসংখ্য দর্শন আছে, তাদের নানা তত্ত্ব নানা বিশ্বাস, কিন্তু ভাল বা খারাপটা তোমায় অনেক শিখেপড়ে বুঝে নিতে হবে— তাহলে তার নড়নড়ে শিকড় হবে না ঝিরঝিরে সতেজ পত্রপল্লব হবে? তাকে তো বলতে হবে, তুমি বড় হয়ে ছেলেকেও বিয়ে করতে পারো, মেয়েকেও বিয়ে করতে পারো, তোমার ধর্মের লোককেও বিয়ে করতে পারো, অন্য ধর্মের লোককেও বিয়ে করতে পারো, গরুও খেতে পারো, ভিগানও হতে পারো, কাব্য ভজতে পারো, শেয়ারে মজতে পারো— তোমার পারা-র কোনও সীমা নেই, তাই স্বাধীনতাটা উপভোগ করো। তাকে বলতে হবে, দ্বিধা জীবনের অঙ্গ, অনেক বিষয়েই আজ এই মনে হয়, কাল ওই মনে হয়, তুমি নিজের মনটাকে বন্ধ করে দিও না, সবসময় জাগ্রত থাকো, আর যখন যেটা মনে হচ্ছে সৎভাবে তা-ই কোরো। তাকে বলতে হবে, বড়দাদা কমিক্‌স বিলিয়েছেন, সেটা পড়ো, কিন্তু মনে রেখো ইউক্রেনও হয়তো কিছু বলছে, সে কমিক্‌সেই হোক আর ইশতেহারেই হোক, সেটাও জেনে, ভেবে, তবে সিদ্ধান্ত নেওয়াই ভাল, তোমার নিজের দেশ মানেই যে ঠিক দেশ, সত্যবাদী দেশ, তা না-ও হতে পারে। তার মস্তিষ্কে এই জীবনের, এমনকি সত্যের— বহুবিস্তার ও বৈচিত্রের কথা সযত্নে রোপণ করে দিতে হবে, তারপর তার নিজস্ব নদী তাকে কোন স্রোতে কোন দিগন্তে নিয়ে তুলবে সে তো অন্য ব্যাপার। কিন্তু শৈশবের সদ্য-শুরু-হওয়া মানুষটাকে হাতে পেয়েছি বলে, তার মগজ-ধোলাইয়ের দিকে মন দিলে হবে না, বরং মগজ-খোলাইয়ের দিকে যেতে হবে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook