সিনেমা বিতর্ক
রাত ন’টা। নীলা সিনেমা দেখে বেরিয়ে বন্ধুদের কোনও রকমে টা-টা বলে ছুটছে। ভীষণ জলতেষ্টা পেয়েছে। মলের বাইরে এসেই ফুটপাথের দোকান থেকে কনকনে ঠান্ডা এক লিটারের একটা বোতল কেনে। ছিপি খুলে গলায় ঢালতে যাবে এমন সময়ে পেছন থেকে,
‘আরে! নীলা যে!’
গলাটা ভিজিয়ে নিয়েই মুন্ডু ঘুরিয়ে দেখে, এক গাল দাড়ি নিয়ে নীলাব্জ দাঁড়িয়ে।
নীলাব্জ : একা নাকি?
নীলা : অফিসের দুজন ছিল। আমি বেরিয়ে এসেছি। জলতেষ্টা পেয়েছিল খুব।
নীলাব্জ : কেন? হলে পপকর্ন, জল এসব পাওয়া যায় তো।
নীলা : ওখানে দাম জানো এক লিটারের জলের বোতলের? ১৪০ টাকা! এদিকে বাড়ি থেকে জলের বোতল যে নিয়ে আসব, তার অনুমতি হল কর্তৃপক্ষ দেয় না। একটা ২০ টাকার বোতল ১৪০ টাকায় বিক্রি করছে ওরা।
নীলাব্জ : আর মানুষ কিনে চলেছে। এয়ারপোর্টে ১১০ নিচ্ছে এখন। মানুষের তেষ্টা পাবেই, তাই কিনতে বাধ্য। প্রথমে ট্র্যাপ করছে, তারপর মারছে।
নীলা : জানোই তো আমার একটু প্রেশার যাচ্ছে এখন। অফিসের লোকজনের সামনে বলতে চাইনি যে…
নীলাব্জ : টিকিট কত নিল?
নীলা : বাংলা বলে তাও একটু কম, ২২০ করে।
নীলাব্জ (মাথা নাড়ে) : আমাদের হাত-পা বাঁধা নীলা। গোটা দুনিয়ার সব ব্যবসার প্রফিট মার্জিন বাড়াতে-বাড়াতে আমাদের অবস্থা খারাপ। আর সরকার যা টাকা তুলছে, সব মেরে দিচ্ছে। যাকগে ছাড়ো, কী সিনেমা দেখতে গেছিলে?
ওরা দুজন ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে। সারি-সারি ট্যাক্সিগুলো ওদের দেখে ডাকাডাকি করতে থাকে। ওরা পাত্তা দেয় না, এগিয়ে যায়।
নীলা : আরে ধুর। খুবই জঘন্য একটা সিনেমা― এখন বৃষ্টি নামবে।
নীলাব্জ : ও বাবা! বিধান মিত্রের ছবি। অনেকে তো ভাল-ভাল লিখছে। দশ বছর বাদে আবার ছবি করেছেন।
নীলা : আরে ধুর! ওই ভাল-ভাল দেখেই তো দেখতে গেছিলাম। মানুষটা যেমন খারাপ, ওর কাজটাও সেরকম। কবে, কোন কালে একটা-দুটো পুরস্কার পেয়েছিল, এখনও…
নীলাব্জ : এখন কই আর? মানুষ তো একদম বাতিল করে দিয়েছে লোকটাকে। তিনজন অভিনেত্রী করবে বলেও করল না এই ছবিটা। শেষমেশ ওই নতুন মেয়েটাকে নিতে বাধ্য হল।
নীলা : লোকটা একটা পারভার্ট। একদম বাজে একটা লোক।
নীলাব্জ : সে হতেই পারে কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে সিনেমাটা খারাপ, তাই না?
নীলা : কী বলছ? তিনটে সিরিয়াস মি টু কেস; তারপর সোশাল মিডিয়াতে ওরকম ভাষায় নিয়মিত লেখে, একে তুমি ভাল বলবে? সেবার সুইমিং পুলে খালি গায়ে বিয়ার খেতে-খেতে সেই ভিডিয়োটা? ভুলে গেলে?
নীলাব্জ : আরে বাবা, আমি তো স্বর্গের টিকিটবেচা দালাল নই, ভালমানুষ-খারাপমানুষ নিয়ে আমি কী করব? বয়কট বিধান মিত্র তো বিশাল সফল একটা আন্দোলন। আমার প্রশ্ন ছিল ছবিটা কেমন দেখলে?
নীলা : জঘন্য! একদম জঘন্য! একটা ভাল কিছু করার জন্য আগে ভাল মানুষ হতে হয়।
নীলাব্জ : বালের কথা।
নীলা : কী?
নীলাব্জ : সরি, মানে আমি বলতে চাইছি, তার কোনও মানে নেই। প্রথম পয়েন্ট হল— ভাল-খারাপ ভীষণ সাবজেক্টিভ একটা ব্যাপার। দ্বিতীয় পয়েন্ট, শিল্পের ক্ষেত্রে যদি ধরে নিই, যা কিছু শাশ্বত তা ভাল, তাহলে বলো কালিদাস কেমন মানুষ ছিল? বলো শেক্সপিয়র কেমন মানুষ? যামিনী রায়? বাখ? পিকাসো? দালি? সত্যি কি ম্যাটার করে?
নীলা : কী বলতে চাইছ? এরা সব বিধান মিত্র-র মতো ফালতু লোক ছিল?
নীলাব্জ : না, আমি বলছি আমি জানি না। জানলেও তার সঙ্গে তার শিল্পের কোনও যোগ আমি খুঁজতে যাচ্ছি না। আচ্ছা শিল্প খুব জটিল জিনিস, ছেড়েই দিচ্ছি। ধরা যাক খেলোয়াড়, দুটো মার্ডার করে এসে, সে কি দারুণ একটা গোল দিতে পারে না? একটা রেপিস্ট কি দারুণ সাঁতার কাটতে পারে না? একজন দারুণ নার্স কি ভাইকে ঠকিয়ে বাবার সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিতে পারে না? এগুলো অসম্ভব?
নীলা : না, কিন্তু তা হলে ওই খুনি লোকটার খেলা আমরা কেউ দেখব না। আর ও জেলে থাকবে। বাইরে খেলে বেড়াবে না! ওই রেপিস্টের সাঁতার আমরা কেউ দেখব না!
নীলাব্জ : তুমি রেগে যাচ্ছ। আমি কিন্তু তা বলছি না। আমি বলছি, যে মার্ডার করেছে তার সাজা হোক কিন্তু তার চমৎকার গোলটাও থাকুক। মার্ডার করেছে বলে তার গোলটা ক্যানসেল করে দিয়ো না। আচ্ছা ধরো, ওই যে জলের বোতল কিনলে লোকটার কাছ থেকে, যদি জানতে পারো সে খুনি, কী করবে?
নীলা : জানলে কিনব না! আরে এত জানা সম্ভব না কি? তাহলে তো মানুষের সঙ্গে কথা বলার আগে ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দেখে কথা বলতে হবে। তর্কের খাতিরে যা তা বলছ।
নীলাব্জ : না, না আমিও একই কথা বলছি। সিনেমা দেখবে দেখো, তার পরিচালকের ক্যারেকটার সার্টিফিকেট নিয়ে তোমার কী?
নীলা : না, শিল্পের ক্ষেত্রে তা হয় না। যে শিল্পী, সে একটা কিছু সৃষ্টি করছে। সে যদি, এই বিধান মিত্রের মতো অসভ্য হয়, তাহলে তার সৃষ্টি বর্জন করা উচিত। তার সৃষ্টি ভাল হতে পারে না! তার মনটাই তো বিকৃত, নষ্ট, সেখান থেকে কী করে ভাল কিছু বেরোবে?
নীলাব্জ : তার মানে তুমি বলতে চাইছ, ভাল মনের একটা সুন্দর মানুষ যদি শিল্পকর্ম করে, তা হলেই একমাত্র ভাল শিল্প হবে, না হলে নয়। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করছে যে, একজন ভীষণ সৎ, দয়ালু, সহানুভূতিশীল মানুষ একটা থার্ড ক্লাস শিল্প কি সৃষ্টি করতে পারে না?
নীলা : তোমার খালি কথা ঘোরানোর কায়দা। এই মানুষটার কথা বলো, এই সিনেমাটার কথা বলো!
নীলাব্জ : সরি, তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিল যে সিনেমাটা আমি দেখেছি। আমার খুব একটা খারাপ লাগেনি, ইন ফ্যাক্ট ভালই লেগেছে।
নীলা দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ চুপ করে নীলাব্জর দিকে তাকায়।
নীলা : কীরকম নির্লজ্জ মানুষ তুমি নীলাব্জ? এতক্ষণ ধরে একটা ফালতু লোকের, ফালতু একটা সিনেমার হয়ে গলা ফাটাচ্ছ? তুমি হলে ওই রেপিস্টদের উকিলের মতো। যারা জানে যে তাদের মক্কেল রেপ করেছে কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত মিথ্যে সাক্ষী নিয়ে লড়ে যাবে। আরে, সোজা এনকাউন্টার করে মেরে ফেলা উচিত এই রেপিস্টগুলোকে, এইসব মামলা-ফামলার চক্করেই যাওয়া উচিত নয়। তোমাদের মতো কয়েকটা ধূর্ত শেয়াল সেখানে ওই ক্রিমিনালগুলোকে ডিফেন্ড করে।
নীলাব্জ : বাপ রে! তুমি তো ফ্যাসিস্টদের মতো কথা বলছ! স্বৈরাচারী নীলা!
নীলা : তুমি একটা রেপিস্ট!
নীলাব্জ : অ্যাঁ? এখুনি তো রেপিস্টের উকিল ছিলাম, এখন আমিই রেপিস্ট!
নীলা : তুমি, তোমার বিধান মিত্র সবাই রেপিস্ট!
নীলাব্জ : হোল্ড অন নীলা। এক, ধর্ষণের অভিযোগ কিন্তু খুব সিরিয়াস অভিযোগ! বিধান মিত্র লম্পট টাইপের লোক হতেই পারে কিন্তু ধর্ষণের কোনও অভিযোগ কিন্তু ওর বিরদ্ধে নেই। দুই, বিধান মিত্র আমার কেউ নয়। আমার বিধান মিত্রের একটা সিনেমা ভাল লাগা ইজ নট ইকুয়াল টু আমার বিধান মিত্রকে ভাল লাগে। আমি শালা চিনিই না লোকটাকে! লোকটার ভাল-মন্দর সব দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটা কিন্তু অন্যায় নীলা।
নীলা : ফাইন! মোট কথা, আমার বিধান মিত্রের ছবিটা ভাল লাগেনি।
নীলাব্জ : ফাইন! আমার শেষ প্রশ্ন, ভাল লাগেনি কেন? ছবিটা খারাপ লেগেছে না বিধান মিত্র খারাপ বলে ছবিটা খারাপ?
নীলা : এত সহজ নয় নীলাব্জ, ইট ইজ কমপ্লিকেটেড। একবার একজনকে এভাবে চিনে ফেললে তখন… যাক গে। আবার পরে দেখা হবে। বাই।
একটা মিনিবাসে উঠে পড়ে নীলা। নীলাব্জর মনে পড়ে রাত এগারোটায় একটা ক্লায়েন্ট মিটিং আছে। ধীরে-ধীরে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী