একজন নয়, দুজন ড্যানিয়েল। টমাস এবং উইলিয়াম। দুজনেই ইংরেজ, চিত্রশিল্পী— কাকা ও ভাইপো। আঁকাআঁকি করে তেমন পসার জমছিল না। তাই ধনদৌলতে ভরা ‘ফরেনে’ গিয়ে কাজ করলে সুবিধে হতে পারে, এমন চিন্তা মাথায় আসে। দীর্ঘ হলেও ভারতে পৌঁছনোর জলপথ ততদিনে যথেষ্টই পরিচিত। ব্রিটিশদের আধিপত্য রয়েছে। দাদাদের সাহায্য পেলে নেটিভ-অধ্যুষিত অচেনা ওরিয়েন্টালে ঢুকে পড়তে অসুবিধে হবে না, এমন ভাবনা অযৌক্তিক ছিল না। গেলেই হয় তা হলে; তবে ব্যাপারটা অত সহজ ছিল কি? না মনে হয়। শিল্পকলা নিয়ে রোমান্সের প্রভাব খাটিয়ে প্রভুদের মন জয় করা কঠিন ছিল বলেই হয়তো তাঁরা আসার অনুমতি জুটিয়েছিলেন ‘এনগ্রেভার’ বা খোদাইশিল্পী হিসেবে। ১৭৮৬ সালে কলকাতায় পা রাখলেন দুই ড্যানিয়েল। ভারতবর্ষে রইলেন ১৭৯৩ পর্যন্ত। প্রথম দু’বছর কলকাতায়। ছবি আঁকলেন এই শহরের অনেক জায়গার। এক ডজন এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট পদ্ধতির ছবি তৈরি হল। খুব কদর হল তাঁদের। বিক্রিবাটা ভাল হওয়ায় রোজগারের টাকা কাজে এল পরবর্তী পর্যায়ের ভ্রমণের খরচ জোগাতে। দেশের তিন প্রান্তে ভ্রমণ করলেন ছবির সন্ধানে। বাংলা তো ছিলই। ১৭৮৮ থেকে ১৭৯১, গঙ্গাকে সঙ্গী করে পৌঁছলেন হিমালয়ের গাড়োয়াল অঞ্চল পর্যন্ত। ফেরার পথে রইলেন ভাগলপুরে, প্রাচ্য-বিশারদ আরেক শিল্পী স্যামুয়েল ডেভিসের সঙ্গে। বহু জায়গায় থামতে-থামতে, ছবির রসদ জোগাড় করতে-করতে কলকাতায় ফিরলেন ১৭৯২-এর ফেব্রুয়ারিতে। সে-সময়ের ভারতবর্ষে অশান্তি কম ছিল না। বহু ক্ষেত্রে যাওয়াটা সম্ভব হয়েছিল ট্রুপ মুভমেন্টের সহায়তায়। ১৭৯২, ’৯৩-তে দক্ষিণে— মাদ্রাজ, মাইসোর। তারপর বম্বে। এরপর ইংল্যান্ডে ফেরা। ছবির প্রথম পর্যায়ের কাজ কিছুটা করা হল ভারতবর্ষে। বাকিটা, ফিনিশিং, দেশে ফিরে। বিভিন্ন অঞ্চলের চোখে দেখা দৃশ্যের ফটোর মতো বাস্তবধর্মী ছবি। বিমূর্ততার ব্যাপার নেই। এই বিষয়ে কাজের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড থেকে আসা শিল্পীদের মধ্যে এঁরাই অগ্রগণ্য। এঁদের ছবি দেখেই ব্রিটিশ জনগণ প্রথমবার, অধিকৃত দূরদেশি এক ভূমির চাক্ষিক পরিচয় পায়। ১৭৯৮ থেকে ১৮০৫, এই সময়ের মধ্যে ড্যানিয়েলদের ১৪৪টি ছবি প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ডে। ২৪ জুন ২০২৪, কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দরবার হলে শুরু হয়েছে ওই সংগ্রহের একটি বড় অংশ নিয়ে চিত্র-প্রদর্শনী: India: In the eyes of Thomas and William Daniell. কলোনিয়াল ইন্ডিয়া বিষয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ড্যানিয়েলসদের সংগ্রহ রয়েছে এখানেই। শহরের অগ্রগণ্য ইতিহাসবিদ, প্রবন্ধকার, চিত্র-ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে প্রদর্শনী সম্পর্কে জানালেন শ্রী ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী। উনি প্রবীণ হেরিটেজ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সংগ্রহশালা, কলকাতা রামকৃষ্ণ মিশন, ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ, রাজ্য চারুকলা বিভাগ ও অন্যান্য সংস্কৃতির পীঠস্থানের কর্মকাণ্ডে জড়িত, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাধিক পুস্তকের প্রণেতা।
ফটোগ্রাফি-পূর্ব ছবির জগতে এইসব হাতে-আঁকা ছবি একটা সময়ের জরুরি দলিল। যে-পদ্ধতিতে ওঁরা কাজ করতেন, তার নাম অ্যাকুয়াটিন্ট। সে-প্রসঙ্গে পরে আসছি। ভারতবর্ষে ওঁদের আগমনের আগে ও পরের সময়সারণিটা একটু ঝালিয়ে নিই। মূলত ব্যবসার উদ্দেশ্যে ইউরোপীয়রা সমুদ্র পেরিয়ে আসতে শুরু করেছিল অনেক বছর আগে থেকে। একাধিক উপনিবেশ তৈরি হয়। অন্যদের তুলনায় ব্রিটিশদের পরাক্রম বেশি ছিল। তখন সম্রাট আকবরের রাজত্ব। ১৬০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পত্তন— অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী, শক্তিশালী এক ব্যবসায়ীগোষ্ঠী। ইংল্যান্ডের রানির কাছ থেকে রয়্যাল চার্টার অর্থাৎ ভারতের মানুষের সঙ্গে ব্যবসার অনুমতিপ্রাপ্ত। সামরিক শক্তিরও অধিকারী। পনেরো বছরের মধ্যে বম্বেতে এলাকা দখল। ১৬০৫, আকবরের মৃত্যু। জাহাঙ্গির মসনদে। ১৬২৮, জাহাঙ্গিরের মৃত্যু, শাহজাহানের রাজত্ব শুরু। মোগলদের সঙ্গে দেশের অন্য রাজ্যগুলির সংঘাত। শিবাজি ঝলমল করছেন। শিখরাও উজ্জ্বল। ১৭০৭, ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু— মোগলদের পতন শুরু। দক্ষিণ ভারতের রমরমা অব্যাহত। এরই মধ্যে বিজনেসের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হলেও সামরিক কার্যকলাপে বদলে গেল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ব্রিটিশরা সরে এল পূর্বদিকে, মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার চেহারাটা বদলে গেল। ১৭৫৭, পলাশীর যুদ্ধ। মোগলরা নিশ্চিহ্ন, ব্রিটিশ আগ্রাসন পুরোমাত্রায়। ১৭৭০, বাংলায় দুর্ভিক্ষ; দায়ী অবশ্যই ব্রিটিশরাজ। ১৭৭৩, ওয়ারেন হেস্টিংসের জমানা। ততদিনে ভারতীয় রাজনীতি, সমাজের সঙ্গে ব্রিটিশরা জড়িয়ে পড়েছে অঙ্গাঙ্গিভাবে।
এইখানে এসে আমরা একবার দাঁড়াব। মনে রাখব যে, সে সময়ের ভারতবর্ষ এক বৈচিত্র্যময়, চিত্তাকর্ষক দেশ। দেশি রাজশক্তিদের অনেকটাই খর্ব করেছে ব্রিটিশরা। এক ধরনের মস্তানরাজ শুরু হয়ে গেছে। দেশের সম্পদে অবাধে ভাগ বসানো চলছে। সুদূর ইংল্যান্ডে স্ফীত হয়ে উঠছে রয়্যাল রাজকোষ। ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় ধনরত্ন লুঠ অব্যাহত আছে। এদিকে অন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলো শক্তিক্ষয় করেছে। ইংল্যান্ডের জনগণের কাছে ভারতবর্ষ হয়ে উঠেছে এক স্বপ্নের দেশ। মানুষ, প্রকৃতি, সংস্কৃতির উত্তেজক সংমিশ্রণ। লোভনীয় ট্র্যাভেল ডেস্টিনেশনও বটে। নিজ দেশের তুলনায় এই আজব পরদেশে, ব্রিটিশ রাজশক্তির, পেশিশক্তির আশ্বাসে অনেক উন্নত জীবনযাত্রার সম্ভাবনা অনুভব করছে সাহেবরা। লর্ড ব্যারনদের এই প্রাচীন, উষ্ণ দেশের কুখ্যাত গরমে নাজেহাল হওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও, সাধারণ সাহেবদের কাছে আকর্ষণের শেষ ছিল না। প্রভুদের আজ্ঞাবহ কর্মী হিসেবে এসেছেন অনেকে, হয়ে উঠেছেন ক্ষমতাবান লাটসাহেব। শাসনব্যবস্থা সামলেছেন। সুকীর্তি, কুকীর্তি, দুই-ই চালিয়ে গেছেন সমানতালে। সেই ভারতবর্ষে সাধারণ মানুষমাত্রেই যে গোরা প্রভুদের মান্যতা দিয়েছে তা নয়। এত রাজা, নবাব, এত রাজ্য, দুর্গমতা, পরিবেশজনিত সমস্যা, সব কিছুর সঙ্গে ব্রিটিশকে লড়াই করে যেতে হয়েছে ক্রমাগত। সে হেন দেশের হাতে আঁকা দৃশ্যাবলিতে ঠিক কী কী দেখা গেল? বা গেল না? এবার আসছি সেই প্রসঙ্গে। প্রদর্শনীতে দুই ড্যানিয়েলের ছবি দেখলে এর স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। যদিও, এর চেয়েও উত্তেজক হয়ে উঠবে বিহাইন্ড দ্য সিন কিছু ব্যাপার। তার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক কম।
স্রেফ শিল্পসুষমার জয়গান গাওয়া এই চিত্রসম্ভার সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল না। ব্রিটিশ নাগরিকদের কাছে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার এক স্বপ্নসুন্দর ইমেজারি তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরি ছিল। দরকার ছিল বোঝানোর যে, অপরূপ এই দেশ আসলে দুর্ভাগ্যময়। সে-দেশের মানুষের দুঃখমোচনে ব্রিটিশদের মহান ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা মানুষ হচ্ছে সাহেবদের শিক্ষায়, মহানুভবতায়। তাই ছবিতে নেতিবাচক বিষয়বস্তু অদৃশ্য। ক্রমাগত যুদ্ধের ক্লেদ, প্রভুত্ববাদের লজ্জাজনক পরিচয়গুলি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন শিল্পীরা। ড্যানিয়েলদের ছবি প্রায় সবই নিসর্গমূলক। কিছুদূর থেকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার মতো। ইম্পিরিয়ালিজমের অস্বস্তি অনুভব করার সম্ভাবনা নেই। প্রকৃতির মোহময়তা, অসাধারণ স্থাপত্য, প্রাণবন্ত নগরী, সবই হাজির। সব ছবি লং শট-এ। ক্লোজ-আপের বালাই নেই। মানুষ অনেক দূরে দূরে। ঠিক যেন কমিক স্ট্রিপের ইলাস্ট্রেশন। অঙ্কনশিল্পের চূড়ান্ত নিদর্শন, নিঃসন্দেহে। পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেল, কাব্যিক টোন, নির্বিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দর্শককে চোখ ফেরানোর সুযোগ দেয় না। স্থাপত্য, প্রত্নতত্ত্বের নিরিখে এর চেয়ে জরুরি ডকুমেন্ট আর পাওয়া যাবে না। বদলে যাওয়া সময়ের কিছু প্রমাণ, তা-ও রয়েছে। ড্যানিয়েলরা প্রথম বিদেশি শিল্পী, যাঁরা এসেছিলেন দিল্লিতে। দিল্লি ততদিনে ব্রিটিশদের হস্তগত হয়েছে। ১৭৮৯ সালে আঁকা কুতুব মিনারের ছবিতে, উচ্চতম যে-অংশটি দেখা যাচ্ছে, যাকে বলে কুপোলা, তা পরে আর ছিল না। ১৮০৩ সালের ভূমিকম্পে সেটি ভূপতিত হয়। আজ আমরা যে-কুতুবকে দেখি সেটি কিঞ্চিৎ মুণ্ডহীন, এ-কথা বলা যেতে পারে। জামা মসজিদের ছবিতে সামনে দেখা যাচ্ছে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। মোগলদের আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা দেখানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এই ছবি বা অন্যান্যতে যেটি অনুপস্থিত তা হল, সেই সময়কার অজস্র সংঘর্ষের খতিয়ান। দক্ষিণ ভারতের ছবিতে স্থানের মাহাত্ম্য হাজির পুরোমাত্রায়। পাত্রপাত্রীরা যথারীতি অনুপস্থিত। থাকলেও, তাদের দেখে মানুষের জীবনের পরিস্থিতিগত ধারণা তৈরি করা সম্ভব নয়। সে-সময়ে দক্ষিণের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যুদ্ধ— ছবিতে তার বারুদের গন্ধের লেশমাত্র নেই। টিপু সুলতানের পতনের সময়টা মনে করিয়ে দিই, ১৭৯২। ততদিনে ছবির রঙের কাজ শেষ, প্রকাশিত হতে চলেছে ইংল্যান্ডে। আসলে ব্রিটিশ দর্শক কোনও দিনই খুব ট্রুথফুল একটা ইন্ডিয়ার চেহারা দেখতে উৎসাহী ছিল না। ছবিতে আপত্তিকর অংশ মুছে দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। কারণ, আঁকাই হয়নি! এক কথায়, এটা বললে ভুল হবে না যে, এই চিত্রসম্ভার সেই সত্য, যা ব্রিটিশরা দেখতে চেয়েছে ব্রিটিশের দৃষ্টিতে। সাধারণভাবে ড্যানিয়েলদের ছবির অন্যতম জরুরি ব্যাপার হল, এমন অনেক কিছুই চিত্রিত হয়েছে, যা আজ আর নেই। কলকাতার চিৎপুরে গোবিন্দরাম মিত্রের ব্ল্যাক প্যাগোডা কিঞ্চিৎ আজও চোখে পড়ে। আসল রমরমার সময়ের ডিটেল ধরা আছে ছবিতে।
দেশে ফিরেই ড্যানিয়েলরা শুরু করে দিলেন ছবির ফিনিশিংয়ের কাজ। ওঁদের অঙ্কন-পদ্ধতিটা জানিয়ে রাখি। ইউরোপীয় ছবির অঙ্কনরীতি, পিগমেন্টের চরিত্র, ব্যবহারের কায়দা প্রাচ্যের চেয়ে আলাদা। ড্যানিয়েলরা স্পটে বসে সম্পূর্ণ ছবি আঁকতেন না। স্কেচ করা হত। নোট রাখা হত রঙের বিন্যাসের। কখনও ক্যামেরা অবস্কিউরা, অর্থাৎ অন্ধকার তাঁবুতে লেন্সের সাহায্যে সাদা কাগজে ছায়াছবি ফেলে তার ওপর লাইন ড্রইং করে নিলে নিখুঁত হত। পার্সপেক্টিভজনিত সমস্যা থাকত না। একে বলা যেতে পারে আলোর রেখার ওপর ট্রেসিং করে নেওয়া। একটি দৃশ্যের ওপর একটিমাত্র ছবি হবে, তা নয়। মূল স্কেচকে এচিং করে প্রিন্ট নিলে লাইন ও টোন দুটি-ই পাওয়া যেত। তারপর বিভিন্ন শিল্পী বোলাতেন স্বচ্ছ জলরঙের প্রলেপ। একেই বলে অ্যাকুয়াটিন্ট। ড্যানিয়েলরা ছাড়া আরও অনেক ইউরোপীয় শিল্পী কাজ করেছেন ভারতবর্ষ নিয়ে। বেলজিয়ামের বালথাজার সলভিন্স-এর কথা উল্লেখযোগ্য। প্রায় একই সময়ে এসেছিলেন উনি, ওঁর সময়কাল ১৭৯১ থেকে ১৮০৩। উনিও এচিং, এনগ্রেভিংয়ের মাস্টার। সিটিস্কেপ, আর্কিটেকচার, গ্রাম শুধু নয়, ওঁর কাজে কিন্তু মানুষের আধিপত্য। শাসকদের ক্রিয়াকলাপ শুধু নয়, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রচুর ডিটেল সেখানে। তৎকালীন সমাজের চমৎকার এক দর্পণ। পুরুষরা সংখ্যায় বেশি। আর এক খ্যাতিমান শিল্পী চার্লস ও’ডয়েলের কথাও উল্লেখ করা উচিত। জন্ম মুর্শিদাবাদে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত এক সার্ভেন্টের পুত্র। ভারতীয় সমাজে একেবারে মিশে গিয়ে ছবি এঁকেছেন উনি। ১৮১৪ থেকে শুরু বলা যেতে পারে। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত Views of Calcutta-কে ওই সময়ের কলকাতা, বেঙ্গল ও পূর্ব ভারতের মাস্টারপিস ছবির নিদর্শন বললেও অত্যুক্তি হবে না। দীর্ঘদিন থেকেছেন ঢাকাতে, পটনায়। পেশাগত দিক থেকে তিনি কোম্পানির কর্মচারী। ১৮২১ থেকে ১৮৩১, তিনি ছিলেন ‘ওপিয়াম এজেন্ট’।
সে-সময়ের দেশি ছবিতে, যেমন মোগল বা রাজপুত, রং অস্বচ্ছ ও গাঢ় হত। অনেক ক্ষেত্রে সোনা বা রুপোর তবক দেওয়া। মাপেও ছোট। সেখানে রাজা-উজির, জেনানা মহল, দাস-দাসী, দরবার, প্রাসাদের ছড়াছড়ি। স্বচ্ছ রঙের ব্যবহার কম। দুই ক্ষেত্রেই ছবি আঁকার মূল উদ্দেশ্য ছিল শাসকের প্রোপাগান্ডা করা। আমরা জানি, ইউরোপের বহু ক্লাসিক কাজ হয়েছিল ধর্মীয় প্রচারের কারণে। রাজনীতির চেয়ে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের জোর ছিল বেশি। উদাহরণ হিসেবে ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলে মাইকেলেঞ্জেলোর ফ্রেস্কোর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সময়টা ১৫০৮ থেকে ১৫১২। গ্রিকো-রোমান দেবদেবী, অপ্সরা-অপ্সরীদের ভূরি-ভূরি পাথরের মূর্তি সৃষ্টি একই কারণে। আমাদের দেশে মোগল পিরিয়ডে ঈশ্বরের ছবি অনুপস্থিত। কারণ ইসলামে সাকার ভগবানের জায়গা নেই। হিন্দু মন্দিরে এর উলটো চেহারা। মন্দিরগাত্র বললে পাথর থেকে শুরু করে টেরাকোটা, দেবদেবী, সাধারণ মানুষের দাপাদাপি আজও দৃশ্যমান। ব্রিটিশদের হাত ধরে আসা ইউরোপীয় অঙ্কনশৈলী ভারতীয় চিত্রেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। রাজা রবি বর্মার তেলরং দেখলে স্পষ্ট হয়, কন্টেন্ট দেশি, প্রেজেনটেশন স্টাইল বিদেশি। সাহেবদের দেখাদেখি দেশি শিল্পীরাও শুরু করে দিলেন নতুন ধারার কাজ। পরবর্তীকালে যা ‘কোম্পানি পেন্টিং’ নামে পরিচিত।
প্রভাব পড়েছিল চৈনিক স্টাইলেরও। ওরিয়েন্টাল আর্ট একদিক থেকে যেমন স্বকীয়, অন্য দিক থেকে প্রভাবিতও বটে। বিভিন্ন ধারার মিশ্রণ বরাবরই নতুন চেহারায় আর্টকে ফিরিয়ে এনেছে। দর্শকরা পেয়েছে নতুন বিনোদন। অবনীন্দ্রনাথে মোগল, চিনা, ইউরোপীয়, আদি দেশজ, সবই হাজির। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের ছবি বদলে যায় বিপুলভাবে। আমাদের দেশেও তার প্রভাব পড়ে। বদলের আর এক কারণ আলোকচিত্রের আগমন। এক সময় হাতে আঁকা ফটোতে রিয়ালিস্টিক প্রেজেন্টেশনের কদর ছিল আকাশছোঁয়া। বিত্তবান, ক্ষমতাশালীরা আঁকিয়ে রাখতেন নিজেদের চেহারা। অমরত্বের প্রত্যাশায় নিজের জীবদ্দশায় ছবি হয়ে উঠতে চাইতেন অনেকেই। প্রথম আমলের ফটোগ্রাফের তুলনায় আঁকা ছবির জোশ অনেক বেশি থাকলেও, ছায়াযন্ত্রের ছবি সনাতনের খ্যাতিতে থাবা বসাতে শুরু করে দ্রুত। সাদা-কালো হলেও তার কদর বাড়তে থাকে বিপুলভাবে। কালার এসে পড়ার পরের ইতিহাসটা আমরা সবাই জানি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভাবতে ভাল লাগে যে, ভাগ্যিস ক্যামেরাপূর্ব একটি শিল্পজগৎ ছিল এই দুনিয়াতে।
ড্যানিয়েলে ফিরি। ওঁরা তো জানতেন না যে, লেন্সের মাধ্যমে চোখে-দেখা দৃশ্যের ওপর প্রতিফলিত আলো, কিছু রসায়ন, ছবির জন্ম দেবে। একটি ছবি তুললে অগণিত রেপ্লিকা তৈরি হয়ে যাবে সহজে। এদিকে জিয়োপলিটিকাল কারণে জরুরি যা কিছু, তা দৃশ্যবন্দি হওয়াও জরুরি। প্রচুর পরিশ্রমে, মুনশিয়ানায় তাঁরা ফুটিয়ে তুলেছিলেন ইতিহাসের অংশবিশেষ। যা নিয়ে আজ আমরা উৎসব করছি। প্রদর্শনী হচ্ছে। এ-কথা উঠতেই পারে, আদ্যিকালের কিছু জলরং নিয়ে ডিজিটাল ছবি, গুগল, ইন্টারনেটের যুগে এত আদিখ্যেতার দরকার কী? এক, সেই সময়ের চেহারা আজ আর নেই। ফটোগ্রাফও নেই। অতএব সেই সময়ের হাতে আঁকা ছবিই ভরসা। দুই, স্রেফ একটা দৃশ্যগত বর্ণনা বা প্রমাণের জন্য ছবি আঁকা হলেও, তা দেখে আমাদের শিল্পচেতনায় যে সুখস্রোত আজও অব্যাহত রয়েছে তার গুরুত্ব অপরিসীম। ফটোগ্রাফের সঙ্গে তুলনা করলে হাতের কাজ নিঃসন্দেহে কম নিখুঁত। এই সূক্ষ্ম খামতিগুলো আজকের দুনিয়ায় আরও জরুরি হয়ে উঠেছে। বেজায় ছোট হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে, সব কিছু হাতের মুঠোয় এসে যাওয়ার পরেও, প্রাপ্তির বদলে অপ্রাপ্তির জ্বালায় মুহ্যমান, অগ্রগতির অভিশাপে বিহ্বল, ক্লান্ত মানুষ খুঁজছে শান্তি। সুবিধে হচ্ছে না তেমন।
আমরা হয়তো ফিরতে চাইছি অতীতের অনাড়ম্বর অবৈভবতায়। তা সম্ভব নয়, এটিও জানা আছে। আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরতে-ঘুরতে একটি গাছের ছায়া পেলেই ধন্য হয়ে যাচ্ছি। আর্ট তেমনই এক ছায়া, বহুদিনের তৃষ্ণা নিবারক। আর্ট এমনই এক অনুভূতি যার উদ্ভব মানুষের মনের অজানা রাজ্যের গভীর রহস্যময়তায়। যা দর্শককে অবশ্যই সাহায্য করে কল্পনার পাখা মেলতে। যে-উড়ানে পরিশ্রমের, ক্লান্তির ভীতি নেই। রয়েছে নিরুপদ্রব, প্রশ্নহীন ভাললাগার আশ্বাস। ড্যানিয়েলদের ছবিতে সোশ্যাল ডকুমেন্টারির কিছু বিষয় অনুপস্থিত, অথচ প্রাকৃতিক বা মানুষসৃষ্ট প্রেক্ষাপট ভাইব্র্যান্ট। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে, আমরা সেই সময়ের মানুষের অন্তত আংশিক জীবনচিত্র তৈরি করে নিতে পারি। আর যাই হোক না কেন, যেহেতু শিল্প, আর শিল্পের প্রধান শর্তই হল ভাবনার স্বাধীনতা, আমরা আপন কল্পকাহিনির জাল বুনতেই পারি।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সিন্দুকে রয়েছে ১৪৪টি ড্যানিয়েলের বাকিগুলোও। সময়ে-সময়ে প্রদর্শিত হবে, আশা করা যায়। আলোচ্য প্রদর্শনী কতদিন পর্যন্ত চলবে জানানো হয়নি। অতএব, ঝটপট সেরে ফেলাই শ্রেয়!
ছবি সৌজন্যে: লেখক