তরুলতা – দুই
বিয়ে হয়ে শ্বশুরঘরে এসে বেশ মজাই হল তরুর; বর তার সঙ্গে নেই তো কী! সমবয়সি দেওর বদু আর তার থেকে বয়সে অল্প ছোট ননদ, ওই রাণীর সঙ্গে খেলা করে খুব খুশিই আছে সে। বাপের বাড়িতেও যেমন সে ছিল বড়দি, এখানেও সে তেমনই বদু আর রাণীর বড়বউদি; তবে বাইরের ছেলেপুলেদের সঙ্গে মেলামেশা করাটা শাশুড়িমায়ের একেবারেই পছন্দ নয়; বদু বা রাণীর তাই তেমন কোনও বন্ধু নেই। বাড়ির চারপাশে কত মাঠ এবং মাঠ জুড়ে কতরকম খেলা– ফুটবল, ডাংগুলি, গাদি-ধাপসা, চোর-পুলিশ; কিন্তু বদুর জো নেই ওদের সঙ্গে গিয়ে সেসব খেলবার; কিংবা গঙ্গায় গিয়ে সকলের সঙ্গে দল বেঁধে স্নান করবার। রাণীও তো তাই; মায়ের শাসনে ঘরেতেই থাকে। এই বাড়িতে জ্ঞাতিগুষ্টি অনেক; হাঁড়ি আলাদা হলেও সকলেই এর-ওর ঘরে যায়, সন্ধের আগে কুয়োপাড়ের দালানে বসে চলে মেয়ে-বউদের চুল-বাঁধা পর্ব, রং-তামাশা করে আড্ডা; কখনও তারা সিঁদুরওয়ালা ডেকে আলতা-সিঁদুর-কাঁটা কেনে; একসঙ্গে বারব্রত করে গঙ্গাস্নানে যায়; ছাদ জুড়ে বড়ি দিয়ে যে যার মাথার ওপর ছাতা খুলে পাহারায় বসে হনুমান তাড়ায়; রাণীকে নিয়ে শাশুড়িমা এসব থেকে একটু আলগা দিয়েই থাকেন; পাশের পাড়া থেকে তাঁর ন-বোন হেমলতা বা বোনাই সুরেন্দ্র কিংবা তাঁদের বড়ছেলে হরশঙ্কর এলে তখন অবশ্য খুবই গপ্পো করেন। এমনিতে তাঁর অবসর কাটে চিঠি লিখে, বই পড়ে, উল দিয়ে নকশাদার কার্পেট বুনে আর প্রতিদিন নিত্যনতুন মিষ্টি বানিয়ে; ভোর থেকে রাত অবধি এমন ঘড়ি ধরে তিনি চলেন যে, শ্বশুরমশাই মাঝে মাঝেই ওঁকে ‘বড়সাহেব’ বলে, বেশ আহ্লাদ জাগিয়ে হাঁক দেন।
তরুর শ্বশুরমশাই অবশ্য খুব আমুদে; গলা ছেড়ে হাসেন এবং অন্যদেরও হাসান। বিকেল হলেই কাচা ধুতি আর বেনিয়ান গায়ে, বাড়ির একতলার রকটায় গিয়ে বসেন; তাঁর সঙ্গে গপ্পো করতে যে রোজ কত কত লোক আসে! তিনিও ভারী সুন্দর চিঠি লেখেন; তবে তার বেশিরভাগই ইংরেজিতে; আর রাতে শোবার আগে, একটা খাতায় রোজ একেবারে নিয়ম করে ইংরেজিতে যা লেখেন, তাকে নাকি বলে ‘ডায়েরি’; বদু তাই বলেছে; তরু অবাক হয়ে দেখে যে, চোখের ওপর কোনও বই বা খাতা না রেখেও তিনি কেমন অনর্গল লিখে চলেন। তরঙ্গনাথের মতো, তাঁর নাকের নীচেও ইয়া বড় একজোড়া গোঁফ আর কপাল জুড়ে মোটা মোটা ভুরু। দেখেই মনে হয় যে, গায়ে খুব জোর। কখনওই মেজাজ দেখান না কারোর ওপর। তরুকে একলা দেখলেই জানতে চান— এখানে থাকতে ভাল লাগছে কি না! তাদের তিনজনকে কাছে বসিয়ে কত যে মজার মজার গপ্পো বলেন; ডাকাত আর বাঘের গপ্পো শুনতেই তরুর বেশি ভাল লাগে। আর ভাল লাগে ভাগলপুর, টাঙ্গাইল, যশোর, কুষ্ঠিয়া, গিরিডি, মধুপুর এসব জায়গার গপ্পোও। চাকরি ছাড়াও নানা জায়গায় ঘুরেছেন তিনি; এমনকী সাঁতার কেটে স্নানও করেছেন কত নদীতে। কত লোকের ঠিকানা থেকে, তাঁর নামে প্রায় রোজই ডাকে চিঠি আসে।
বউবরণের সময়ে তরুকে দেখেই শাশুড়িমায়ের খুব মন খারাপ হয়েছিল; কারণ তরুর গায়ের রং নাকি একটু চাপা; কিন্তু শাশুড়িমায়ের শাসনে বাড়ি থেকে বেরনো এবং নদীতে স্নান করা বন্ধ হওয়ায়, তরুর গায়ের রঙে বেশ জেল্লা ধরেছে। শাশুড়িমা রোজ তাকে হাতের লেখা মকশো করান; সেইসঙ্গে শুদ্ধ বাংলা বানানও। রাণী বলেছে, এরপরেই নাকি চিঠি লিখতে শেখাবেন তিনি; এ-ও লক্ষ করেছে তরু যে, তিনি যেমন তরুর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর-আদিখ্যেতা দেখান না, তেমনই পছন্দ করেন না তরুকে দিয়ে তাঁর নিজের হাত-পা টিপিয়ে নেয়াও। তাঁর নির্দেশেই নাপ্তিনী সরির কাছ থেকে সে শিখে নিয়েছে, স্নানের সময় গোড়ালি মাজা এবং হাত-পায়ের নখ কাটার নিয়ম। আর শিখেছে, বাসি-এড়া-ধোয়া-কাচা— পরনের কাপড়ের এমন সব ভাগ; শিখেছে, শোবার সময় পায়ের কাছের কাপড়ে গিঁট দিয়ে এক-কাতে শুয়ে ঘুমোতে। ঘুমের মধ্যে পায়ের কাপড় যাতে মাথায় না উঠে যায়! শাশুড়িমা শিখিয়েছেন সুন্দর করে ঘোমটা টানতেও; খুব অল্পদিনেই তরু এতসব শিখতে পেরেছে কারণ, বিয়ের পর সেই একদিনের জন্য অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি গেলেও, সেখানে গিয়ে আর সে থাকতে পায়নি। একটানা প্রায় বছর চারেক তার কেটেছে এ বাড়িতেই শাশুড়িমায়ের তদারকিতে।
২.
ফুলশয্যাটা কোনও রকমে নমো-নমো করে সেরে, তরঙ্গনাথ তো সেদিন ভোর না হতেই বেরিয়ে গিয়েছিল কাটিহারের ট্রেন ধরতে; বালিকা তরু কিছু বুঝে ওঠবার আগেই শুরু হল তার এই-বাড়ির ‘বউ’ হয়ে ওঠবার নানা শিক্ষা। বাবা-মা, ভাই-বোনেদের ছেড়ে কিছুটা যে সে ভুলে রইল, তার কারণ ওই বদু আর রাণী; আর খানিক তার নিজের বাড়িতে ফেরার অপেক্ষা; কারণ তার সই ‘লবঙ্গ ফুল’ সেই ঊষাময়ী, তাকে বলে দিয়েছে যে, অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি এসে চট করে আর যেতে হবে না। তরু ভেবেছিল, তাকে বোধহয় নিজের এই বাড়ি ছেড়ে, অন্য কারোর বাড়িতে গিয়ে আর কোনও দিনই থাকতে হবে না; ঊষা ফিক করে হেসে বলেছিল, ‘বড়’ হলে তরু নাকি নিজেই যেতে চাইবে তার বরের কাছে; আর ওই বরের বাড়ি যেটাকে এখন সবাই তার শ্বশুরবাড়ি বলছে, সেটাই নাকি হয়ে যাবে তার নিজের বাড়ি। কিন্তু তরু দেখল যে, আর পাঁচটা মেয়ে যে ভাবে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে বরের সঙ্গে অষ্টমঙ্গলায় যায়, তরুর ক্ষেত্রে সেসব কিছুই হল না! যা হল সে এক অ্যাডভেঞ্চারই বটে!
সাধাসিধে সাজে তরুকে তৈরি করে দিলেন শাশুড়ি; ভোরের আলো ফুটেছে কী ফোটেনি এ বাড়ি থেকে তরঙ্গনাথের জ্যাঠতুতো মেজদা, সেজোবউদি আর পাশের পাড়ায় থাকা শাশুড়িমায়ের বোন এবং বোনাই এসে গেলেন। তরুকে নিয়ে ভাড়া করা একটা ঘোড়ার-গাড়িতে চড়ে তাঁরা চলে গেলেন স্টেশনের দিকে, শিবনিবাসের ট্রেন ধরতে। বেলাবেলি সেখানে পৌঁছে তরু দেখল, সকলের মুখেই দুশ্চিন্তা এবং ভয়। এঁরা আসবার ঠিক পরে পরেই, যে দুজন আধবুড়ো লোক আলাদা আলাদাভাবে উঠোনে এসে দাঁড়াল, তাদের মধ্যে একজন তরঙ্গনাথ; আর অন্যজন তারই সঙ্গে চাকরি করা আর এক বিহারি পুলিশ। ছদ্মবেশে আসায়, তাদেরকে তো কেউই চিনতে পারেনি; পরনে আধময়লা ধুতি, গায়ে একখানা জীর্ণ দেহাতি বেনিয়ান; রোদ্দুরে মুখ-মাথা বাঁচাতেই নোংরা একটা গামছায় তা যেন বেশ ভাল করে ঢাকা এবং পায়ে ছেঁড়া-ছেঁড়া ক্যাম্বিসের জুতো; একজন অন্যজনকে নিয়ে এসেছে, তরুর বাবা কালীপদ ডাক্তারের কাছে ‘দাওয়াই’ নিতে। ডিসপেনসারি বন্ধ থাকায়, তরুদের পাশের পাড়ার ফণীকাকা বাড়ি চিনিয়ে তাদের নিয়ে এলেন; ফণীকাকা সঙ্গে থাকায়, বাইরের উটকো লোক দেখেও অন্যরা তাই আর বিশেষ মাথা ঘামায়নি। ফণীকাকা আর তরুর বাবা তাদের নিয়ে বাইরের চালাঘরের দিকে হাঁটা দিতেই, ছোটকাকা উঠে গিয়ে উঠোনের দরজাটা একটু আলগা করে ভেজিয়ে দিয়ে এলেন। গরম বলে ঘরের জানালাগুলো আগে থেকেই বন্ধ ছিল। রান্নাঘরের মেঝেতে ছেলেরা একসঙ্গে খেতে বসলে, সে দুজনও বসল; শেষে, মাথার গামছা খুলে হাত-মুখ ধোবার সময়ে চেনা গেল ওই দুজন পুলিশকে। বাক্যালাপ না করে খেয়ে উঠেই, তারা বেরিয়ে চলে গেল ওই একই পোশাকে।
অবশ্য বেরিয়ে যাওয়ার আগে, ভেতরের দিকে যে ঘরটায় তরুকে একা বসিয়ে রাখা হয়েছিল, সেখানে এসে দাঁড়াল তরঙ্গনাথ। তরুর পাশে বসে, তার কপালে চুমু খেয়ে, তার দিকে তাকিয়ে থাকল। নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে, খিলখিল করে হেসে উঠে তরু বলল,
‘ও বর, তুমি কি একটো করো নাকি গো? আমি তো ভাবলাম যে, আমাদের বিরজু ভাইয়া এসেছে; তারই কোনও দেশোয়ালি ভাইকে সঙ্গে নিয়ে!’
‘সেকি, তুমিও চিনতে পারোনি আমাকে?’
‘দূর থেকে ওই তালঢ্যাঙা চেহারাটা দেখেই সইকে তো ফিসফিস করে বলেছিলাম; কিন্তু সই যে বলল, দূর! পুলিশরা কেন আবার ছদ্মবেশ ধরবে! আর এটা নাকি কোনও ছদ্মবেশ হতেই পারে না!’
‘তরু, তুমি জানো তো যে, আজই তোমাকে আবার ওই বাড়ি ফিরে যেতে হবে?’
‘কেন? সই যে বলেছে ‘বড়’ না হলে ওখানে আর যেতে হবে না!’
‘ওখানেই ‘বড়’ হয়ে যাবে; নিজেই সব বুঝতে পারবে।’
এ কথা শুনেই ঘাড়খানা গোঁজ করে, তরু কেমন যেন গুম মেরে গেল দেখে, তরঙ্গনাথই দাঁড়িয়ে উঠল। পাঁজাকোলা করে তরুকে নিজের বুকের কাছে তুলে নিয়ে, গভীরভাবে তাকিয়ে রইল তার চোখে চোখ রেখে; অবুঝ বালিকার অভিমান ভাঙাবার সময় কি আর তার হাতে আছে! খাটের ওপর তরুকে বসিয়ে দিয়ে, তার দুই কাঁধ আলতো চেপে, কানের কাছে মুখ এনে বলল,
‘আমার সঙ্গে তোমাকেও না হয় সাজিয়ে দেব; নানা রকম ছদ্মবেশে আমরা যখন এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াব, কেউ আর চিনতে পারবে না। দেখবে কেমন মজা হবে তখন।’
মাথা থেকে খসে যাওয়া ঘোমটাটা অপটু হাতে আবার মাথায় টেনে নিয়ে তরু বলল, ‘তবে আমিও তোমার মতো পুলিশ সাজব, কেমন! ইয়া বড় গোঁফ চাই কিন্তু; সেই সঙ্গে রাণী আর বদুকেও পুলিশ সাজিয়ে দেবে তো বর?’
মৃদু হেসে তরঙ্গনাথ সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও, তার বরের ওই চলে যাওয়াটাকে তরু তেমন আমলই দিল না; মশগুল হয়ে বসেই রইল, গোঁফওয়ালা পুলিশ সাজবার আনন্দে। তরুর মা-কাকিরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন; কারণ শ্বশুরবাড়ির ওই লোকেদের সঙ্গেই তো তরুকেও রওনা করিয়ে দিতে হবে। তাঁরাই বা আর কতদিন যে এ বাড়িতে থাকতে পারবেন কে জানে! বাংলা-ভাগ পাকা হয়ে গিয়ে এই শিবনিবাস পড়েছে নাকি পুব-পাকিস্তানে! তরুর বাবা তো ভীষণই মুষড়ে পড়েছেন। ভেবেই পাচ্ছেন না যে, যেখানে স্বয়ং শিবের নিবাস, সাহেবদের চালে তা কী ভাবে মোল্লাদের দেশে গিয়ে পড়ল! সেসব কথা মাথা থেকে তাড়িয়ে, তরুকে ডেকে, কাপড় ছাড়িয়ে, মাথা আঁচড়িয়ে, সিঁথেয় সিঁদুর আর কপালে টিপ পরিয়ে দিলেন। ঊষা আর তরু দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে আবার খানিক কাঁদল; তাদের দেখে যথারীতি কাঁদতে লাগল তরুর ছোট ছোট ভাই-বোনেরাও; সেই সঙ্গে জেঠি-কাকিরাও। তরুর কানের কাছে মুখ লাগিয়ে মা শুধু বললেন, ‘পুলিশের বউ হয়েছিস তো, খুব সাবধানে থাকিস মা; শাশুড়িমা যেমন বলবেন, তেমনই চলবি।’
বাবা একটা মোটরের ব্যবস্থা রেখেছিলেন, তাঁর অতিথিদের স্টেশন থেকে আনা-নেওয়ার জন্য; সকালে স্টেশনে নেমে যে মোটরে সবাই এসেছিলেন, তাতেই আবার সে ভাবেই ফিরে গেলেন সকলে; আর কেউ না এলেও ছোটকাকা তাঁদের সঙ্গে ওই এক-ই গাড়িতে স্টেশনে চললেন। তরুর শ্বশুরবাড়ির নাম করে গাড়িতে উঠল বাগানের আম-জাম-আনারসের দুটো ঝুড়িও। স্টেশনে পৌঁছে সবার সঙ্গে একজায়গায় জড়ো হয়ে দাঁড়ালেও, কিছুটা দূরে দাঁড়ানো ছদ্মবেশী তরঙ্গনাথ আর তার সেই পুলিশ বন্ধুকেও যেন দেখতে পেল তরু; আর একটু দূরে উলটো দিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ফণীকাকাও তো! তরু যেন স্পষ্ট দেখল যে, ছোটকাকা এবং ফণীকাকার মধ্যে কী যেন একটা চোখাচোখিও হল! সেটা ভাল করে বোঝবার আগেই ট্রেন এসে যাওয়াতে, সবাইকেই উঠে পড়তে হল হুড়োহুড়ি করে। তরু নিশ্চিত যে তরঙ্গনাথরাও এই ট্রেনেই উঠেছে।
৩.
সেই যে তরু এ বাড়ি চলে এল, শিবনিবাসে আর তার ফেরা হল কই! হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ভয়ে, তরুর বাবা সপরিবার চলে গেলেন তাঁর শ্বশুরবাড়ি জলপাইগুড়িতে। সেখানেই একটা পুরনো বাড়ি কিনে থিতু হয়ে বসলেন কালীপদ ডাক্তার। সেই থেকে তরুর বাপের বাড়ি হয়ে গেল ওই জলপাইগুড়িই; যদিও তাদের শিবনিবাসের সাবেক বাড়িটা ছেড়ে কিছুতেই কোথাও গেলেন না তরুর জ্যাঠামশাই বা ছোটকাকা। ধীরে ধীরে, তরুও কখন যেন হয়ে উঠল এ বাড়ির ‘বড়খোকা’ তনু্র বউ। আর তার সেই সই, ‘লবঙ্গ ফুল’-এর জায়গাটা ক্রমেই নিয়ে নিতে লাগল ওই একই বাড়িতে থাকা অন্য তরফের তার বড় জা, সেজ জা আর কুচো জা। তারা চারজনে মিলে তৈরি করে নিল তাদের সেই চার সধবার সুখদুঃখের এক নিবিড় জগৎ। এদের সঙ্গে থাকতে থাকতে, হঠাৎই ‘বড়’ হয়ে গেল তরু। আর একটু ‘শ্যায়না’ হলেই তখন সে বরের কাছে যাবে।
আমি তরুলতা। তরঙ্গনাথের বউ। আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ির চলনবলনে কোনও মিল নেই; শাশুড়ি খুব হেসেছিলেন, কাঁচা বলে আমার সেই স্যালাড না খাওয়া দেখে। ছোটকাকা মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যান। বাপের ঘরে আমার যাওয়ার কথা উঠলেই শাশুড়িমা চুপ করে থাকেন। প্রথমবার এসে ছোটকাকা আমাকে তাঁর কোলে বসিয়ে আদর করেছিলেন; তারপর থেকে ছোটকাকা এলেই রাণী তাঁর কোলে চড়ে বসে। ছোটকাকার কথাতেই জানতে পারি যে, অষ্টমঙ্গলায় যাওয়ার জন্য তরঙ্গনাথদের সেই ছদ্মবেশ এবং ফণীকাকাকে তাতে সঙ্গী করা— এসব-ই নাকি তাঁর মাথা থেকেই এসেছিল। তবে, ছোটকাকার কাছে আমিও আর ভাঙলাম না যে, সে দিন ট্রেনে ওঠার আগে, দুদিকের দুটো প্ল্যাটফর্মে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফণীকাকা আর ছোটকাকাকে সাবধানে ইশারা করতে দেখেই আমি যে সেটা বুঝে গিয়েছিলাম। আর ওই সময় থেকেই এ-ও বুঝে গেলাম যে, আমি একজন পুলিশের বউ। মায়ের বলে দেওয়া সেই কথাটা একবারের জন্যও ভুলিনি কিন্তু!
বালিকারা প্রথম ঋতুমতী হলে, মা-কাকিমারা যে শাঁখ বাজিয়ে পাড়াপড়শিকে জানান দেন, আমার বেলায় তা আর হল না; আমার শাশুড়িমায়ের নির্দেশে শাঁখ বাজালেন তাঁর বড় জা; মানে, রাঙাদিদির শাশুড়ি। রাঙাদিদিই আমাকে সব শিখিয়ে বুঝিয়ে দিল, ‘নোংরা’ হলে কী ভাবে কী করতে হয়। আমার শাশুড়িমা শুধু ইঙ্গিত করে বললেন যে, এ-সময়ে ওই ওদের মতো এক কাপড়ে, একটা ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হবে না। তোলা জলে স্নান করতে হবে, দু-বেলা কাপড় ছাড়তে হবে। এ-ও বুঝিয়ে দিলেন যে, প্রতি মাসের এই ক’টা দিন ছুটোছুটি করে বেড়ানো একেবারেই বন্ধ। বিশেষ ভাবে এ-ও বলে দিলেন যে, বসবার আসনে, পরনের কাপড়ে বা বিছানার চাদরে রক্তের কোনও দাগ যেন না লাগে; সেইসঙ্গে সাবধান করলেন বদু বা রাণী যেন বুঝতে না পারে যে, আমি ‘বড়’ হয়েছি।
হিসি হওয়ার বদলে, সেখান দিয়ে এত রক্ত সমানে বেরিয়ে যেতে দেখে, ভয় এবং ঘেন্না দুই-ই হয়েছিল আমার; কিন্তু যখন লক্ষ করলাম যে, ‘নোংরা’ হয়েছ না বলে, শাশুড়িমা বললেন, ‘বড়’ হয়েছ, ঘেন্নাটা তখন যেন একটু কমে গেল। তবে একটু সন্দেহ হল তরঙ্গনাথের মুখটা মনে করে; ‘বড়’ হলে শ্বশুরবাড়ি যাব বলাতে সে কেমন একটু অন্যরকম হেসেছিল না! বলেছিল না ওখানেই ‘বড়’ হবে! বদু আর রাণী এ ব্যাপারে কিছু না জানলেও, তরঙ্গনাথ কি তবে সব জানে! ‘নোংরা’ এবং ‘বড়’ হওয়া দুটোই?
আমার সই ঊষা, মানে ‘লবঙ্গ-ফুল’ কাছে থাকলেই সব সমাধান হয়ে যেত। সে-ও মনে হয় জানে; না হলে ‘বড়’ এই কথাটা সে-ই বা বলেছিল কেন! মনে পড়ল, ছোটকাকিমা পেটব্যাথায় কষ্ট পেলেই, বাবার কাছ থেকে ওষুধের পুরিয়া চেয়ে নিত মা; লণ্ঠনের আলোর ওপর চাটু রেখে, ন্যাকড়া মুড়ে মুড়ে, কাকিমার কোমরে গরম সেঁকও তো করে দিত। শাড়ির কষিটা আলগা করে, হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কাকিমা বসত। হাতে করে গরম তেল নিয়ে, কোমরের নীচ থেকে কাকির আদুড়-পাছা অবধি টেনে টেনে মা তো মালিশও করে দিত, অনেক সময় ধরে।
এখন আমি বুঝে গেছি যে, প্রতিমাসে এরকমটাই হবে; আর আমি কষ্ট পাব পেট কুনকুনে ব্যথায়; সেইসঙ্গে আমার চোখ বেয়ে জল গড়াবে মায়ের কথা ভেবে; যদিও শাশুড়িমায়ের নির্দেশে এ বাড়ির নাপ্তিনী সরি-দাই এসে আমার কোমরে আর তলপেটে মালিশ করে দিয়ে যায়; আমার মা-কাকিমাদের মতো নিজেদের ছাড়া কাপড়ও কাচতে হয় না এ বাড়িতে; তবু এ সময় আমার খুব কান্না পায়; রাগ হয়; দুর্বল লাগে, চোখমুখ ফোলে, গা গুলিয়ে বমি-বমি পায়; আর কেমন যেন শিরশির করতে থাকে সমস্ত শরীর।
মা ছাড়াও, আর যাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে ইচ্ছে করে, সে কি আমার সেই ঢ্যাঙা বর, তরঙ্গনাথ?
কী জানি! হবেও বা!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র