ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • কুমার সাহনি : এক বিরল উত্তরাধিকার


    শান্তনু চক্রবর্তী (March 9, 2024)
     

    দেওয়ান-সাহেবের পুরনো হাভেলির একতলার মস্ত চাতালে রাখা চারটে অ্যান্টিক বেতের চেয়ারও যে কীভাবে সিনেমার চরিত্র হয়ে উঠতে পারে, তাঁর প্রথম ছবি ‘মায়া দর্পণ’-এই সেটা প্রমাণ করেছিলেন কুমার সাহনি। ওই চেয়ারগুলো এই দেওয়ানবাড়ির ফিউডাল আভিজাত্যের আন‌-বান‌-শান! ওতে এলেবেলে সবার বসার অধিকার নেই। বংশ, কুল, মান-মর্যাদায় যাঁরা দেওয়ানজির সমান-সমান, তাঁরাই শুধু ওই চেয়ারে বসতে পারেন। দেওয়ান-সাহেবের মেয়ে তরন তাঁদের বিলিতি টি-পট, কাপ-ডিশে করে চা খেতে দেয়। অতিথিরা চলে গেলে এলোমেলো চেয়ারগুলো টেনেটুনে সমান-সমান করে সাজিয়ে রাখে! মাঝে মাঝেই একটা ঝাড়ু দিয়ে চেয়ারের হাতল, গদি, পিঠগুলো সাফসুতরো করে রাখে। তরনদের কতকালের পারিবারিক ঐতিহ্য, মহিমা, দাপট, ইজ্জতের অদৃশ্য জমা ধুলো, সব ঝেড়েঝুড়ে না রাখলে হয়! আঙিনার (না কি দরবারের?) ওই বেতের চেয়ারগুলোর ধারেকাছে যখন দেওয়ান-সাহেব আর তাঁর মান্যবর অতিথিরা, বা তরন আর তাঁর বশংবদ কেউ থাকে না, তখনও তারা কী ত্রস্ত-বিশ্বস্ত শৃঙ্খলায় সাজানো থাকে। যেন কুচকাওয়াজ করছে।

    আসলে ছবির টাইটেল থেকেই দেওয়ান-সাহেবের বাড়িটা, তার বেলেপাথরের এক অদ্ভুত, ফ্যাকাশে হলদেটে সোনালি দেওয়ালটা কে কে মহাজনের ক্যামেরা লেন্স-এর একেবারে মুখোমুখি আটকে গেছে। নড়বার, সরবার, পাশ ফেরার জায়গাটুকু দেওয়া হয় না। টাইটেল-এর পুরোটা সময় জুড়ে সাউন্ডট্র্যাক নানারকম যান্ত্রিক শব্দে ভরে থাকে। মালগাড়ি চলে যাওয়ার ঘ্যানঘ্যানে শব্দ, রেলওয়ে ওয়াগনের শান্টিং-এর শব্দ, কারখানার ওয়ার্কশপে অনেক যন্ত্রপাতির ঘটাং ঘটাং শব্দ— সব মিলিয়ে একটা অস্বস্তিকর ঘড়ঘড়ে কর্কশ কোরাস! টাইটেল শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেই শব্দের দুর্বৃত্তপনা মিলিয়ে যায়। মহাজনের ক্যামেরা দেওয়ান-বাড়ির দেওয়াল ছুঁয়ে প্যান করতে থাকে। একটু আগের শব্দের যান্ত্রিক দৌরাত্ম্যের বদলে এখন বাণী জয়রামের নরম, মিঠে গলার ঘুমপাড়ানি গানে ওই সদ্য আলো-ফোটা ভোরের কোমলতা। গানের সুর যেন একটু-একটু পা ফেলে-ফেলে ক্যামেরাকে বয়ে নিয়ে চলেছে। সেখানে প্রচলিত লোকগানের কথায় মা-বাবার আদুরে দুলালী কোনও রাজকন্যের, সোনা-রুপো-মখমলে মোড়া সুখী রূপকথার ইশারা। আর ক্যামেরার ধীর ট্র্যাকিং-শট একের পর এক বন্ধ ঘরের জানালার কাচে জমে থাকা ধুলোময়লা, সোনার-বরণ দেওয়ালের গায়ে লেগে থাকা কালচে ছোপ ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেওয়ান-বাড়ির অন্দরমহল, দেওয়ান-সাহেবের রাজপাট-সংসারের হা-হা শূন্যতাটুকু স্পষ্ট করে দেয়। একটা ঘরের খোলা দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখা যায়, ভেতরে খাটের উপর কালচে-লাল শাড়ি পরা একটা মেয়ে তখনও ঘুমিয়ে আছে। বাণী জয়রামের গানের সুর ক্যামেরাকে সঙ্গী করে ঘরে ঢুকে পড়ে। বিছানার কাছে যায়। ক্লোজ আপ-এ যেন মেয়েটির কপাল-চিবুক ছোঁয়। ক্যামেরা আবার পিছিয়ে যায়। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েই আমরা টের পাই মেয়েটি ঘুম থেকে উঠেছে। তার পা-দুটি ঘরের মেঝে ছোঁয়। মেঝের উপর রাখা চটিজোড়া খুঁজে নেয়। এইবার তার দিন শুরু হবে, দীর্ঘ অলস দিন।

    এই মেয়েটিই তরন, এই বাড়ির রাজকন্যে। ‘মায়া দর্পণ’ তারই গল্প। তার মা নেই। একটু আগেই আমরা তার বালবিধবা পিসিকে দেখেছি। বাবার ঘরের সামনে পর্দা ঝোলানো, তখনও বন্ধ, গম্ভীর ভারী দরজাটা দেখেছি। এই বাড়িতে দেওয়ান-সাহেবের হুকুম ছাড়া কিচ্ছু হয় না। তাঁর ছেলে ওই প্রবল আধিপত্যবাদী, ফিউডাল অভিজাত-তন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে, পিতৃতন্ত্রের হাভেলি ছেড়ে সেই কোথায়, অসমের টি-এস্টেটে চলে গেছে। ছবিতে তাকে একবারও সামনে আসতে দেখি না। কিন্তু তার ওই এক টুকরো প্রতিবাদ, চিত্রনাট্যের গায়ে লেগে থাকে পুরোটাই। চিঠিতে দাদা তরনকে অসমে চলে আসতে বলে। এখানে বাবা তাকে, তাদের মতোই অনেক জমিজমা-বিষয়-সম্পত্তির মালিক, কোনও সম্ভ্রান্ত, সামন্ত পরিবারেই বিয়ে দিতে চায়। এই বাড়িতে তরনের কোনও ইচ্ছে-অনিচ্ছে, স্বপ্ন-প্রেম, উচ্ছ্বাস-আনন্দ, বাসনা-যৌনতা কিচ্ছু নেই। কখনও-সখনও তার মতোই অবসাদের ধুলোয় ভরা ছোট্ট রাজস্থানি শহরটার পথে-পথে এলোমেলো হেঁটে আসা ছাড়া তরনের কোনও বিনোদনও নেই। খাঁ-খাঁ খালি প্রাসাদটা তার যাবতীয় জমক-দেমাক-আভিজাত্যসুদ্ধু তরনকে যেন প্রায়ই গিলতে আসে। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় শুধু একবার বিছানায় উপুড় হয়ে আকুল কান্না ছাড়া, তরনকে কখনও আক্ষেপ-আফশোস করতে, এমনকী দীর্ঘশ্বাস ফেলতেও দেখা যায় না। হাভেলির এই ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত-তন্ত্রের সব কিছু মেনে আর মানিয়ে নিতে-নিতে, নিজেকে শুধুই লুকিয়ে রাখতে-রাখতে তরনের ক্লান্তি, দম আটকে আসা বোঝাতেই কুমার বার বার বিশাল বাড়িটার সিঁড়ি, বারান্দা, দেওয়ালের শট ব্যবহার করেছেন। কালার-স্কিমিং-এও একটা হলদেটে, ফ্যাকাশে, রক্তশূন্যতা নিয়ে এসেছেন।

    কুমার সাহনির এই সিনেমার দর্শন— কোনও সংলাপ, ন্যারেশন, ঘটনার নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত ছাড়াই শুধু দৃশ্য আর শব্দের ডায়ালেক‌টিক্স-এ চরিত্রদের অন্তরমহলটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা— এটাকেই তাঁর ‘আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস’ বইটির প্রবন্ধে তীব্র আক্রমণ করেছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।

    আর কুমার সাহনির এই সিনেমার দর্শন— কোনও সংলাপ, ন্যারেশন, ঘটনার নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত ছাড়াই শুধু দৃশ্য আর শব্দের ডায়ালেক‌টিক্স-এ চরিত্রদের অন্তরমহলটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা— এটাকেই তাঁর ‘আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস’ বইটির প্রবন্ধে তীব্র আক্রমণ করেছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। একজন নবীন পরিচালকের প্রথম ছবিটার আলোচনায় তিনি পরিষ্কার বলেছেন, ‘টু মি, ‘মায়া দর্পণ’ সিম্‌স আ কম্বিনেশন অফ পুওর সাইকোলজি, অ্যান্ড পুওরার স্টাইলাইজেশন।’ তাঁর হিসেবে এখানে রঙের ব্যবহারে পরিচালক যতটা কেরদানি দেখাচ্ছেন, সেটা ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। কারণ চরিত্রগুলোকে ঠিকঠাক রক্তমাংসের মানুষ করেই তিনি গড়ে তুলতে পারেননি। তার বদলে একটা উদ্ভট, বোকা-বোকা স্টাইলাইজেশন দিয়ে ব্যাপারটা সামলাতে গিয়ে, পুরোটা আরও ঘেঁটে ফেলেছেন! ‘মায়া দর্পণ’-এর ট্রিটমেন্ট থেকে অভিনয়, সবটাই তাঁর না-পসন্দ। এমনকী সেজন্য কুমারের শিক্ষাগুরু-দীক্ষাগুরুদের নিয়েও সত্যজিৎ টানাটানি করেছেন। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট-এর মাস্টারমশাই ঋত্বিক ঘটক বা স্কলারশিপ নিয়ে ফ্রান্সে গিয়ে যাঁর কাছে কুমার শিক্ষানবিশি করেছেন, সেই রবার্ট ব্রেসঁ, এঁদের কারোরই ভাল জিনিসটা তিনি রপ্ত করতে পারেননি। শুধু বাইরের চটক ও ভুলভাল ম্যানারিজমগুলোই শিখেছেন— অনেকটা এরকমই বক্তব্য ছিল সত্যজিতের।

    বড় বাজেট-বড় তারকা-চেনা ফর্মুলার মূলধারার বাইরে বেরিয়ে যিনি ভারতীয় সিনেমাকে প্রথমবার মুক্তির দিশা দেখিয়েছিলেন, সেই সত্যজিৎ এভাবেই নির্মম কলমে প্রায় ধ্বংস করেছিলেন, এদেশি সিনেমার ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম ‘ফর্ম্যালিস্ট’ ছবি তৈরির চেষ্টাকে। কিন্তু কুমারের ‘মায়া দর্পণ’কে এভাবে ভেঙে চুরমার করার পিছনে সত্যজিতের উদ্দেশ্যটা ঠিক কী ছিল? সেটা কি মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ দিয়ে শুরু হওয়া দ্বিতীয় নবতরঙ্গ বা সমান্তরাল ছবির আন্দোলনের প্রতি একটা সামগ্রিক অনীহা? তার কারণটা কি এটাই যে, এই আন্দোলনের শুরুর দিকে পদাতিকেরা ভারতীয় সিনেমায় সত্যজিতের অবদানকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখালেও, তাঁকে ঠিক গুরুঠাকুর মানেননি? তাঁর সিনেমার ধ্রুপদি ন্যারেটিভ গড়ন ছেড়ে অন্য রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ খুঁজে নিয়েছিলেন? বলা মুশকিল!

    তবে ‘ভুবন সোম’-এর সাফল্য সম্পর্কে প্রায় মিথ হয়ে যাওয়া তাঁর সাত শব্দের সারাংশে যে কষটা-তিতকুটে ব্যঙ্গের কাঁটা ছড়ানো ছিল, মণি কাউল বা কুমার সাহনির মতো ঋত্বিকের ছাত্রদের ছবি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিটাও তার থেকে খুব আলাদা রকম ছিল না। অন্তত ভঙ্গিটা কোথাও ছেলেছোকরাদের ভুল শুধরে দেওয়া, স্নেহশীল অভিভাবকের মতো ছিল না! থাকলে হয়তো তিনি দেখতে পেতেন ‘মায়া দর্পণ’-এ কুমার সাহনি কোথাও দৃশ্য আর শব্দের তুমুল শরীরীপনায় একটা ভাঙা-ক্ষয়াটে পুরনো ব্যবস্থাপনার ক্রমশ হেরে যাওয়ার গল্পই বলতে চেয়েছেন। সেখানে ‘জলসাঘর’-এর মতো বিশ্বম্ভর রায়ের হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া অভিজাততন্ত্রের জন্য একটুও মায়া-মমতা লেগে থাকে না। বরং ছবির ক্লাইম্যাক্স-এ তরন তার সব মানসিক অবদমন, পারিবারিক অবরোধ ভেঙে সেই পুরুষটির কাছেই যায় যে এই আদ্যিকালের ধুলোমাখা, আপাদমস্তক ফিউডাল শহরটার শ্রমিকদের কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়াবার, রুখে দাঁড়ানোর কথা বলে। তাদের শারীরিক মিলনের পরেই পর্দা জুড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ময়ূরভঞ্জ ছৌ-নাচের দলের রণ-নৃত্য। তার আলো-আগুনময় তীব্র এনার্জিতে তরনের বিদ্রোহ আর মুক্তি ঘটে যায়।

    তারপরেও দু’নম্বর ছবি করার জন্য সরকারি টাকা পেতে কুমার সাহনির সত্যি-সত্যিই একযুগ লেগে গিয়েছিল। ১৯৭২-এ ‘মায়া দর্পণ’-এর পরে, ১৯৮৪-তে ‘তরঙ্গ’। একমাথা সাদা চুল, আর একগাল হাসিমুখের শান্ত-সৌম্য-নরমভাষী কুমারকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, যে-কোনও আড্ডায় তিনি সারা পৃথিবীর সিনেমা নিয়ে কথা বলতেই ভালবাসতেন। তাঁর সিনেমার শিকড় আসলে কোথায়— ঋত্বিকের স্বদেশিয়ানায়, নাকি ব্রেসঁ-রসেলিনি প্রভাবিত ইউরোপীয়-পনায়, তা নিয়ে তর্ক করতেও রাজি ছিলেন। কিন্তু একান্ত ব্যক্তিগত মান-অভিমানের কথা বিশেষ বলতেন না। তবু ঘনিষ্ঠ কাউকে-কাউকে বলে ফেলেছিলেন, সত্যজিতের বইয়ের ওই তীব্র আক্রমণ, স্বদেশে ও বিদেশে পেশাগতভাবে তাঁর কতটা ক্ষতি করেছিল! দ্বিতীয় ছবির ক্ষেত্রে তিনি তাই কি কিছুটা সাবধানী ছিলেন? ‘মায়া দর্পণ’-এর মতো ফর্ম নিয়ে ভাঙচুর ‘তরঙ্গ’ ছবিতে নেই। এটা আপাতভাবে প্রথামাফিক সোজাসাপটা নিটোল টানা ন্যারেটিভের ছবি। এমনকী গানের দৃশ্যও আছে কয়েকটা। কিন্তু তারপরেও আজীবন মার্কসবাদী কুমার ‘তরঙ্গ’-এ একটা ডায়ালেকটিক্স-এর খেলা খেলেছেন। বিশেষ করে চিত্রনাট্যের স্ট্রাকচার-এ। এখানে একইসঙ্গে কয়েকটা ‘যুদ্ধ’ চলছে। একজন বৃদ্ধ অসুস্থ শিল্পপতি শ্রীরাম লাগু-র নিজের পরিবারের অন্দরে। তার জামাই অমল পালেকর ও ভাইপো গিরিশ কারনাড দুজনেই পারিবারিক ব্যবসার উত্তরাধিকার নিজেদের পকেটে পুরতে চায়। আরেকটা লড়াই কারখানার ইউনিয়নের দখল নিয়ে। সেখানে মালিকের দালাল, আপসকামী সরকারি বাম ট্রেড ইউনিয়ন আর আদর্শবাদী র‍্যাডিকাল বামপন্থীরা মুখোমুখি। এর পাশাপাশি ধান্দাবাজ-মুনাফাবাজ মালিক বনাম দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সর্বহারা মানুষদের চিরকালের শ্রেণি-সংগ্রাম তো আছেই। আবার একইসঙ্গে খানিকটা ব্রেখটীয় এলিয়েনেশন-এর কায়দায়, তিনি তরতরে গোল গল্প থেকে উঠে আসা বাস্তবের বিভ্রমটাও ভেঙে দিতে চান। দর্শককে বুঝিয়ে দিতে চান যে, এই যে ছবিতে অমল পালেকর বা স্মিতা পাটিল-এর মতো দেখতে যাঁরা চোখের সামনে ঘুরছেন, তাঁরা আসলে সমান্তরাল সিনেমার তারকা-অভিনেতা স্মিতা বা অমলই। এখানে পরিচালকের কথামতো তাঁরা বিভিন্ন চরিত্র হয়ে পরিচালকেরই মতলব হাসিল করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি এটাও বুঝিয়ে দেন যে, যতই প্রথাগত স্টাইলে গল্প বলুন না কেন, কুমার সাহনি আছেন কুমার সাহনিতেই।

    কুমার আবার তাঁর কাঙ্ক্ষিত বিশুদ্ধ সিনেমার আঙ্গিকে ফিরে আসেন ১৯৮৯-এর ছবি ‘খেয়ালগাথা’-য়। মধ্যপ্রদেশ সরকারের আনুকূল্যে তৈরি এই ছবি খেয়াল তথা হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীত-এর বায়োপিকও বলা যেতে পারে। আবার দৃশ্য-শব্দ-সংগীত-সহ সিনেমার সমস্ত উপাদানগুলো একজন চলচ্চিত্রকারের কল্পনায় মিলেমিশে ভিসুয়াল উৎসবও বলা চলে। উত্তর ভারতীয় মার্গসংগীত-নৃত্যকে জড়িয়ে থাকা আখ্যান উপকথাগুলোকে এখানে যেন জাগিয়ে তুলছেন দুর্গ প্রাসাদের প্রাচীন পাথরের বুক থেকে, জঙ্গল পাহাড়ের আদিম উদ্ভিদের শরীর থেকে। রানি রূপমতী দুর্গের খাড়াই সিঁড়ির নানা বাঁক ঘুরে উঠে আসছেন— মাথার উপরে এক টুকরো নীল ফ্রেম, একটু-একটু করে বড়ো হতে-হতে আকাশভরা সুনীল চাঁদোয়া হয়ে যায়। ভারতীয় মার্গসংগীতের বিমূর্ততা যেন ইউরোপীয় পিওর সিনেমার অরূপ-রতনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সত্যজিৎ-এর শহরে কুমারের এই নিঃশব্দ, নির্জন চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে যেন এদেশে সিনেমার ভাষা নিয়ে নিরীক্ষার উত্তরাধিকারও ফুরিয়ে গেল।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook