শাফিকা
সংসারে থিতু হল শাফিকা। কিন্তু মনের মধ্যে যে এক তোলপাড় তা আর বন্ধ হল কই! যা সে নিজেই শুধু টের পায়; মনে মনে জানে যে ‘বাবা’ অপেক্ষা করে আছেন, আবার কবে কুচি-কুচি কাগজ আঠা দিয়ে সেঁটে সেঁটে ছবি বানাবে সে; তন্ময় হয়ে দেখবে রঙের পরত; বুকের মধ্যে ডানা ঝাপটে উঠবে স্বপ্নের সেই পাখিগুলো! পাছে ধরা পড়ে তাই সে আনমনা হয় না; ফাঁকিও দেয় না ঘরের কোনও কাজে; মিঞার ভালবাসার দাবিতে দরাদরিও করে না সতিনের সঙ্গে। লক্ষ করে, মিঞার সঙ্গে সতিনের কথাবার্তা। শাফিকার অনুমান যে তার মিঞা— ইসমাইল, গরিবদের মধ্যে কিছুটা সঙ্গতি সম্পন্ন; তা ছাড়াও নিজের ভিটেতে ঘর বেঁধে আছে বলেই ধারকর্জ নেই। তালতলা মার্কেটে বেশ কিছু বাঁধা খরিদ্দার থাকায় বিক্রিও খারাপ হয় না। গরিবের সংসারে আর কী লাগে!
শাফিকা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি যে, এক বিবির সঙ্গে শান্তিতে ঘর করেও ইসমাইল কেনই বা দ্বিতীয়-নিকে করে, তাকেই ছোট-বিবি করে ঘরে তুলল! হতে পারে যে ছেলের আশায়; কারণ সতিনের তো তিনটেই মেয়ে; আর নয়তো তার মায়ের কাছ থেকে টাকা পেয়েছে, শাফিকাকে নিকে করার শর্তে; কখনও আবার এমনও সন্দেহ হয় শাফিকার যে, ইসমাইলের থেকে টাকা নিয়ে মা সু্র্মাবিবিই তাকে বেচে দেয়নি তো! যাই হোক এটুকুই সার বুঝেছে যে, মায়ের সংসারেও সে যেমন বাড়তি ছিল, এ সংসারেও তাই; একেবারে আপন বলতে যা বোঝায়, তেমন কারও মুখ মনে আসে না শাফিকার। এই সংসারে সে আসায় সতিনের একটু সুসার হয়েছে; খাটনি কমেছে; রয়ে, বসে, জিরিয়ে, ঘুমিয়ে সংসার সামলায়। দিদি নয়, শাশুড়ির মতোই ব্যবহার করে শাফিকার সঙ্গে; থেকে থেকে আড় চোখে জরিপও করে তার শরীর। নিরুপায় শাফিকা আল্লার দোয়া মাগে আর মনে মনে বলে ‘বাবা’… ‘বাবা’! গোয়াল ঘরের পাশে একটা ছাউনি মতো ঘেরায় সে থাকে; এখানেই দড়িতে ঝুলিয়ে রাখে তার খান-দুই শাড়ি, শায়া, জামা; মাদুরে জড়ানো বালিশটা আড়া থেকে নামিয়ে সে ঘুমোয়; আর একই সঙ্গে সজাগ হয়ে পাহারাও দেয় গরুগুলোকে। রসুই ঘরে নয়, তার কাজ এই গোয়াল-ঘরে। গরুদের মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে চোখে জল আসে শাফিকার। বাছুরকে মায়ের বাঁট থেকে টেনে সরিয়ে, দুধ দুইবার সময় বুকের মধ্যে পাষাণ ঠেলে ওঠে। মাছি ভনভনে গোয়ালটাকে সাফসুতরো করে ফেলেছে শাফিকা। একদিনও ভোলে না, ওদের গায়ে চট চাপা দিতে। মাটির মেজনাগুলো পরিষ্কার করে তবে তাতে জাবনা দেয়; ঢেলে দেয়, ঠান্ডা করে রাখা ভাতের ফ্যান, তরকারির চোকলা। কিন্তু তার সবচেয়ে ভাল লাগে দেওয়াল জুড়ে ঘুঁটে দিতে। গোবরের সঙ্গে খড়ের কুচি মিশিয়ে থপথপ করে দেওয়ালে চাপে; এ ভাবেই সে সাজিয়ে তোলে পলেস্তারা খসা, ইট বার করা, লাল সুরকিতে রাঙা বিরাট একটা দেওয়াল। এটাই তার ক্যানভাস; পাঁচ আঙুলের ছাপ সমেত ওই ঘুঁটেগুলোই যেন সেই টুকরো টুকরো কাগজ, যা জুড়লেই ছবি। নিজের দেওয়া ঘুঁটেগুলোর সামনে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। মনে মনে এ-ও ভাবে, কোনও দিন যদি সুযোগ আসে, ঘুঁটে দেওয়া এই দেওয়ালটাকেই সে ফুটিয়ে তুলবে ছবিতে; প্রতিদিন এইভাবেই মুক্তি পায় শাফিকা।
সতিনের তিন মেয়েই তার পায়ে পায়ে ঘোরে; আবদারও করে এটা-ওটার। যেটুকু লেখাপড়া সে শিখেছে, সেটুকু সম্বল করেই পড়তে বসায় ওদের; চুল বেঁধে দেয়; আর ওরাও শাফিকার সঙ্গে হাত লাগিয়ে শুকনো ঘুঁটেগুলোকে, সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে ঝুড়ি ভরে। শাফিকাকে এসে খবর দেয় যে, আম্মি ডাকছে; কখনও জানায় যে আব্বু এসে গেছে। সন্ধের নামাজের পর তিন মেয়ে আর সতিনের সঙ্গে একসঙ্গে বসে নবীর নির্দেশ পড়ে সকলে। সতিনের জরিপ করা কিছুটা কমেছে; তবে বেড়েছে তার প্রতি মিঞার নজর; নিরিবিলি হলেই উঠোন পাড়ে বসে, লাবণ্যময়ী শাফিকাকে সে দেখে। এ চাহনি বুঝবার বয়স শাফিকার হয়েছে; তবু দূরত্ব ঘোচে কই! কোথায় যেন সঙ্কোচে গুটিয়ে থাকে তার মিঞা ইসমাইল। বয়সে তো যথেষ্ট বড়; বিয়ে করে ঘরে তুলে সম্মানও দিয়েছে। তবুও যে কিসের সঙ্কোচ, নিকে করা এই ছোট-বিবির কাছে! বড়-বিবিকে তুই-তোকারি করলেও, শাফিকাকে কিন্তু তুমি বলেই ডাকে— সম্ভ্রমে; তবে সে-ও ঠেকায় পড়ে— ক্বচিৎ কখনও; চোখের জল মুছে শাফিকা ভাবে— মিঞার না হয় দুজন বিবি আছে, কিন্তু তার কপালে তো এই একজনই। অন্য কোনও পুরুষকে জানার আগেই তো এর সঙ্গেই তার বিয়ে হয়ে গেল! মাঝে মাঝে মনে হয় যে, মিঞা বুঝি অপরাধী হয়ে আছে ‘বাবা’র কাছেই। মায়ের সঙ্গে সাঁট করে ইস্কুল ছাড়িয়ে, ‘বাবা’কে লুকিয়ে এই যে তাকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে, এর ফলেই বোধহয় শাফিকার ওপর জোর খাটাতে পারে না ইসমাইল। শাফিকা বাধা দিলে হয়তো সে অধিকার ফলাত; কিন্তু মুখ বুজে সব মেনে নেওয়ার কারণেই, ভেতর থেকেই যেন কমজোরি হয়ে গেছে লোকটা। ইসমাইলও নিশ্চয়ই বুঝতে পারে যে ইশকুলের পাঠ আর ‘বাবার’ স্টুডিয়ো থেকে ছিনিয়ে আনায়, কতখানি মন ভেঙেছে তার! শাফিকা তাই বুঝতে চায় যে, ইসমাইলের মনে ঠিক কী বোধ হচ্ছে— অপরাধ নাকি অনুশোচনা!
২.
ছোট-বিবি হয়ে এই ঘরে এসে ওঠার পর, শাফিকার সতিন সেই প্রথম তার আবুর ঘরে গেল; কোলেরটাকে সঙ্গে নিয়ে, বাকি দুই মেয়েকে শাফিকার জিম্মায় রেখে। ইসমাইলকে বলে গেল,
— শাফিই না হয় হাত পুড়িয়ে দুটো ফুটিয়ে দেবে।
— ইসমাইল অবাক হয়ে বলল, ও পারবে!
— পারতে তো একদিন হবেই; আমি আর কতকাল টানব!
— গোয়ালের কাজ, ঘুঁটে ছাপা— এসব সামলে সময় পাবে!
— তানি, বানি তো রইল, হাতে-হাতে গুছিয়ে দেবে না হয়!
ছোট বেটিটাকে কোলে নিয়ে, সেজেগুজে ইসমাইলের সঙ্গেই বেরিয়ে গেল সতিন; কিছু পরে নাস্তা সেরে তানি-বানিও ইশকুলে। এই প্রথম আজ থেকে প্রায় মাসখানেক, সমস্ত দিনমান জুড়ে, এই ভিটেতে শাফিকা একেবারে একা। রোজকার মতো গোয়ালের কাজ শেষ করে স্নান সারল। রসুইঘরে গিয়ে আঁচ ধরিয়ে, বড় একটা ডেকচিতে ‘খিচড়া’ও বসিয়ে দিল সতিনের কথামতো। নুন মাখানো চালের সঙ্গে, ভেজানো ছোলার ডাল মিশিয়ে, আলু ফেলা এক রকম ঝরঝরে ভাত। তার সঙ্গে ধনেপাতা বাটা আর বিটনুন দিয়ে মাখা, পেঁয়াজ-টমেটোর চাটনি দিয়েই খাওয়া হয়ে যায়। রাতের কথা পরে ভাবলেও চলবে। কাঠের জ্বালের গনগনে আঁচে খিচড়াটা বসিয়ে, হাত খালি হতে না হতেই শাফিকা দেখল, দাওয়ায় দাঁড়িয়ে পা ধুচ্ছে তার মিঞা ইসমাইল। প্রথমে ভাবল বুঝি শরীর খারাপ; একটু পরেই সে দেখল যে কাচা কাপড় পরে, মাথা ছেনে, তার নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে, ডিঙি মেরে মেরে ইসমাইল তো তাকেই ডাকছে !
— শাফিকা… শাফিকা… এই ঘরে এসো…
— কী হারিয়েছে?
— কিছু না; তোমাকেই ডাকছি।
বুকের মধ্যেটা কেমন যেন ধড়পড় করে উঠল… পেটের মধ্যে কুনকুন, দু’চোখে ভয়।
মাথায় কাপড় টেনে, ভীরু পায়ে ঘরে ঢুকতেই সে দেখল যে, চৌকির ওপর উপুড় হয়ে বিছিয়ে আছে ইসমাইল। ইঙ্গিতে বলল, পিঠটা দাবিয়ে দিতে। এই প্রথম তাকে ছুঁয়ে দেখার স্বাদ। শাফিকার জড়সড় ভাবটা কাটাতে এবার সোজা হয়ে শুয়ে, শাফিকার হাতটা ধরে ইসমাইলই টেনে নিল তার নিজের দিকে। নাকে এল, বিড়ির গন্ধমাখা পুরুষ-শরীরের ঝাঁঝ; কিছুক্ষণের মধ্যেই পোষাকের বাঁধন ছিঁড়ে মিলিত হল দুজনে। অনভিজ্ঞ শাফিকার দেহে স্বীকৃতির স্বাদ এনে দিল শরীর-অভিজ্ঞ সেই ইসমাইল।
সবটুকু বুঝে ওঠবার আগেই নিবিড় লজ্জায় নুয়ে গেল শাফিকা; চোখের পাতা খুলবার শক্তিটুকুও যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। অবশ দেহটা তাই নেতিয়েই রইল ইসমাইলের পিঠ ঘেঁষে। আজার দেওয়া জানলার কাছে কুকুর ডেকে উঠতে, সম্বিত ফিরে পেল শাফিকা। মনে পড়ল যে, এ সময় তো দুপুরের খাওয়া সেরে, দু’মুঠো ভাত এঁটোকাঁটায় মেখে ওদেরও খেতে দেয় সে! হুঁশ হল যে, ‘খিচড়া’ বসানো আছে উনোনে! চোখ খুলতেই দেখে যে, পাশ ফিরে ঘুমিয়েই পড়েছে ইসমাইল! এক ঝটকায় নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে, শফিকা ছুট লাগাল রসুইঘরের দিকে। কাঠের জ্বালে এই এক সুবিধে; নতুন করে কাঠ গুঁজে না দিলেও, নিবু-আঁচেই রান্না হয়ে যায়। চট করে তাই পোড়া ধরে না।
সারাদিন আর ইসমাইলের মুখোমুখি হয়নি শাফিকা; বাপ-বেটিতে মিলেই বেড়ে নিয়ে, দুপুরের খাওয়া সেরেছে তারা। রসুইঘর খালি হলে বাসন মেজে, সাফসুতরো করে শাফিকা গোয়ালে এল, গোবর ছানতে। হাত যেন চলছে না; মনে মনে ভাবল, এই হাতেই তো হররোজ সে প্রায় একশো ঘুঁটে ছাপে; কিন্তু আজ তার এ কী হল! দানোয় পেল, না বিষ-বাতাস লেগে গেল দেহে!
৩.
সন্ধে লাগতেই শাফিকার ঘরে এসে দাঁড়াল ইসমাইল; নরম স্বরে বলল,
— ভর সন্ধেবেলা গা এলিয়েছো যে!
— মাথা ধরেছে; জ্বর জ্বর লাগছে কেমন।
— রসুই ঘরে যাও, উনোনের তাপে দেহ জুড়োবে।
ইসমাইল চলে যেতে সে বুঝল যে, এই হল সংসার। পুরুষের তাপে নেতিয়ে পড়া মেয়ে-শরীরও, উনোনের তাপেই সিধে হয়ে বসে। মাথা ছেনে, গায়ের কাপড় গুছিয়ে, রসুই ঘরে ঢুকেই সে দেখল, তানি আর বানি শাফিকাকে না ডেকেই রান্নার জোগাড়ে বসেছে; বা এমনও হতে পারে যে, তাকে হেঁকে-হেঁকে সাড়া পায়নি বলেই, তাদের বাপকে পাঠিয়েছে ডেকে তুলতে। আন্দাজ হল, ইসমাইল চায় না যে বড়-বিবি ফিরে এসে জানুক, শাফিকা থাকতেও মেয়েরা হাত পুড়িয়ে রেঁধেছে। এই বোধও তার হল যে, ছোট-বিবির সঙ্গে ‘পরিচয়’ করার সুখটাও আপাতত গোপন করেই রাখতে চায় ইসমাইল; মনে হয়, ইসমাইল তার নিজের শরীরে বাস করা, ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া সেই দুটো মনকেও এবার থেকে, দু’ভাবেই নির্দেশ দেবে; আর শাফিকাকেও তা বুঝে নিতে হবে, খুব সাবধানে। রাতের কাজ সেরে নিজের বিছানায় শুতে না শুতেই, হাত পা ছড়িয়ে গেল তার; গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে আর একটুও সময় লাগল না শাফিকার।
সকাল হতেই চনমনে বোধ হল। ঘুমের মধ্যেই যেন বেশ খানিক সমঝোতা হয়ে গেছে শাফিকার— নিজের শরীরের সঙ্গে মনের; সেই সঙ্গে, সুখ এবং সঙ্কটেরও। কী যে আনন্দ হল নিজেকে এভাবে দেখতে পেয়ে; মনে হল, এখুনি ছুটে যায়, তার সেই নিজস্ব দেওয়ালে ঘুঁটে দিতে; হাজার ঘুঁটে দেওয়ার বল, আজ যেন তার এই এক হাতের পাঞ্জায়; সত্যিই তো দানোর বল! গরিব-দশা, সতিন-ঘর, মায়ের সাঁট, ভাইদের মিথ্যে চালাচালি— সব ছাপিয়ে ভেসে উঠল ‘বাবা’র স্টুডিয়ো ঘরে শুধু তারই জন্যে বরাদ্দ সেই কোনাটা; কুচি-কুচি কাগজের সেই রঙিন টুকরোগুলো, আবার যেন স্বপ্ন হয়ে উড়ে বেড়াতে লাগল মাথার মধ্যে।
সতিন উপস্থিত না থাকলেও বড়-বিবির সংসার চলতে লাগল একেবারে তারই নিয়মে। বদল হল শুধু শাফিকা আর ইসমাইলের সমঝোতায়। দিন দু’য়েক পরে, গোয়ালপাড়ে শাফিকার ওই একটেরে ঘরটায়, আবার এসে দাঁড়াল ইসমাইল; আজ সে নিজেই এসেছে; তানি–বানি ঘুমিয়ে পড়লে ভারী রাতে। শাফিকা তো জানেই যে, ইসমাইলের এমন কোনও কথাই নেই, যা শুধু শাফিকার সঙ্গেই কওয়া যায়। যা আছে তা হল শরীরকে উপভোগ করে, আবার নিজের ঘরে ফিরে যাওয়া। তানি-বানিকে নিয়ে এক বিছানায় শুয়ে, সতিনের সঙ্গে এসব আর হয় কি না আন্দাজ নেই; ইসমাইলকে পরিপূর্ণভাবেই গ্রহণ করল শাফিকা; সেও কোনও রকম অমর্যাদা করে না শাফিকার শরীরের। সম্ভ্রমের দূরত্ব কেটে গিয়ে কোথায় যেন একটা টানও অনুভব করতে শুরু করেছে দুজনেই; জড়তা-মুক্ত শাফিকার শরীরেও জেগে উঠেছে উন্মুখ-সুখ। তবু সে জানে যে, রাশ টেনে না রাখলে, ফুরিয়ে যেতে সময় লাগবে না! আর একবার তা ফুরিয়ে গেলেই মুস্কিল; ঢিলেমি এসে যাবে, মনে এবং সব কাজেও। শান্তি আর উন্মাদনা দুই-ই যেন এই নতুন সম্পর্কের আস্বাদ; শাফিকা তাই যেমন তা সাপটে খায়, তেমনই আবার তার এই সংসারটাকেও জাপটে ধরেই বাঁচে। চোখের নীচে যে গাঢ় কালি পড়ছিল, তা-ও যেন ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল। প্রতিদিন, দ্বিগুণ উৎসাহে ঘুঁটে দিয়ে দিয়ে, দেওয়াল সাজায় শাফিকা; পলেস্তারা খসা, সুরকি-রঙা, ভাঙা ভাঙা ইটের সেই জীর্ণ দেওয়ালটাই; শাফিকার ঘুঁটে দেওয়ার জন্যই যেন তা বরাদ্দ। এটাই তো তার এখনকার এক মস্ত ক্যানভাস। আর তার সংসার বিছিয়ে আছে, আর একটু ওধারে।
৪.
মাসখানেক তার আব্বুর বাড়িতে কাটিয়ে, কোলেরটাকে নিয়ে সতিন যখন ফিরে এল, ভারী আহ্লাদ হল শাফিকার। মনে হল সংসারের এ ছবিটাই তাকে যেন সব চাইতে বেশি নিশ্চিন্ততা দেয়। ইসমাইলের আচরণেও যেন সেই ভাব। আহা! কতদিনের সঙ্গী বলে কথা! সেই কোন ছোটবেলায় নিকে করা, ইসমাইলের এই বড়-বিবি! তানি-বানি, গরু-গোয়াল, জমি-জিরেত, বিক্রি-বাট্টা, সম্পত্তি নিয়ে ভায়ে-ভায়ে কামড়াকামড়ি, পাড়া-পড়শির কূটকচালি— এমন কত কিছু নিয়েই না তাদের ‘খুদ-কুটুরি’ কথা! না সে সব শাফিকা জানে, না সে বোঝে এত কিছু! শাফিকা শুধু এটুকুই জেনেছে যে, এই ভিটে ইসমাইলের ঠাকুরদাদার করা এবং নিকা হয়ে এসে তক, বড়-বিবি সেই ঠাকুরদাদাকেও জ্যান্ত দেখেছে। আর সে জানে যে, তার ওই ঘুঁটে দেওয়ার পোড়ো দেওয়ালখানি নাকি ঠাকুরদাদার ঘরেরই অংশ; কারোর ভাগেই না পড়ায়, দেখাশোনার অভাবে ভেঙে পড়েছে। ভূত এবং সাপখোপের ভয়ে এদিকটায় কেউ আসত না। শাফিকা কিন্তু এটাই বেছে নিয়েছে; কারণ একমাত্র এদিকটাই একই সঙ্গে নির্জন এবং একটেরে; তা ছাড়া ভিটের পারে এ দেওয়ালটাই সবচেয়ে প্রশস্তও। গোবরের ঝুড়ি খালি করতে না করতেই তার কানে গেল, সতিনের ডাকাডাকি। সতিন তাকে আবার সরাসরি ডাকে না।
গলা উঁচিয়ে হেঁকেই হয়তো বলল, ‘তানি- বানি আর কোথায় খুঁজবে! কাছে পিঠে থাকলে তো!’;
বা বলল, ‘মিঞারই জ্বালা বটে! ট্রেন ধরবে, না নয়া-বিবিকে খুঁজবে!’;
খুব চটে গেলে বলবে, ‘দুটো গাই-তে আর কত গোবর হাগে, যে ঘুঁটে দিয়ে হাত-অবসর হয় না!’
বড়-বিবির হাঁকাহাঁকি আন্দাজ করেই, ঝুড়িটা কোনও রকমে গোবরতলায় নামিয়ে, রসুই ঘরের দিকে দ্রুত পা চালাল শাফিকা; কপালের ঘামটা আঁচলের খুঁটে মুছে নিতে নিতেই, ফিক করে হেসেও ফেলল; নিজেই সে নিজেকে বলল,
৫.
সতিন ফেরার পর কয়েকটা দিন আগের মতোই আড়ো-ছাড়ো হয়ে দূরে দূরে কাটালেও, আজ রাতে ইসমাইল এসে দাঁড়াল, গোয়াল পাড়ে শাফিকার ঘরের সেই বেড়ার দরজায়। গলা খাঁকারি শুনেই শাফিকা বুঝেছে যে, দরজার ওপারে তারই মিঞা ইসমাইল; তবু সাবধানের মার নেই ভেবে, পাকাপোক্ত সাড়া নিয়ে, তবেই উঠে আগল খুলল শাফিকা। সঙ্কোচে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে, শাফিকাই আজ বুকে টেনে নিল ইসমাইলকে; সোহাগ ভরে সম্বোধন করে এই প্রথম সে বলল,
শাফিকাকে বড় আদর করে, তার বুকের ওপর টেনে নেয় ইসমাইল; মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে যে, কলকাতা থেকে বড় বোতলের গন্ধতেল এনে দেবে; তার যে একঢাল চুল, তা নাকি নজর করে দেখেওছে তার মিঞা। ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে শাফিকা; বয়সে বেশ বড় হলেও তার ছিপছিপে শরীরটি কিন্তু তারুণ্যে ভরা; মুখের কাটিং একটু লম্বাপানা; জাতভাইদের মতো তার থুতনি বা চোয়ালও দাড়িতে ঢাকা নয়। মাথা ভরা কোঁচকানো চুল। নমাজের সময় টুপি পরলে অবশ্য একটু অন্য রকম দেখায়। তবে সব থেকে আগে চোখে পড়ে বুদ্ধিতে ভরপুর ওই চোখদুটো। শাফিকা এটা ভালই বুঝতে পেরেছে যে, কোনও কারসাজি বা লোক ঠকানোর বুদ্ধি সে চোখে নেই; এক বাড়িতে চারটে মেয়ে, তবুও যে ঝাঁঝ ওঠে না সংসারে, সে শুধু এই মিঞা ইসমাইলেরই সমদৃষ্টির গুণে; নুন-ভাত বেড়ে দিলেও রা কাড়ে না মিঞা। সংসারে একমাত্র পুরুষ হয়েও, তেমন কিছু বিশেষ দাবিও তার নেই। শুধু পারে না যেটা তা হল, আয় বাড়াতে। অথচ হাঁ-মুখ তো সমানেই বেড়ে চলেছে।
বড়-বিবি আবার পোয়াতি; আব্বু-বাড়ি গিয়েছিল, পেট খসাতে; সেখানে সবাই বারণ করায়, ও-কাজটি আর না করেই সে ঘরে ফিরে এসেছে। কোলেরটা আমার ট্যাঁকে ট্যাঁকেই বড় হচ্ছে; বড়-বিবিকে রোজ একটু দুধ আর ভাতের পাতে ঘি-মরিচ দিতে বলেছে ইসমাইল। এই সাত মাসেই শরীর ছেড়ে দিয়েছে তার। পঞ্চায়েত-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কার্ড করা হয়েছে। ব্যথা উঠলেই নিয়ে যেতে হবে। আমার কাজ অনেক বেড়ে গেছে; তাই টান পড়েছে হাতে-পায়ের ফুরসত-এও; ঘুঁটে দেওয়ার অবসর কমেছে বলে, মধ্যে মধ্যে দুঃখ জমে ওঠে। ‘বাবা’কেও তো দেখি না; তা প্রায় বছর খানেক হবে! এ সবের মধ্যেই এবার ছেলে হল বড়-বিবির। ইসমাইল নিজে সই করে বড়-বিবির বাচ্ছা বন্ধ করার ব্যবস্থাও নিয়েছে। ছেলে হওয়ায় অবশেষে রেহাই পেল বড়-বিবি ।
—————————————————————–
লাবণ্যে টলমল শরীরে এবার আমার কোলেও একটা খোকা বা খুকি আসছে। সে সম্ভাবনা হয়েছে বুঝেও, এখনও বলিনি কাউকে; আর একটা মাস একটু সবুর করে দেখিই না— বড়-বিবি বা ইসমাইলের আন্দাজে কিছু আসে কি না!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র