বিজয় দশমীতে দেবী প্রতিমার বিদায়বেলায় সিঁদুরখেলার সূত্রে, সিঁদুরের কথা মনে এল। সিঁদুরখেলা শব্দটি উচ্চারিত হলেই এক মনোরম দৃশ্য ফুটে ওঠে। মা দুর্গার বিদায়বেলায় কাঁসার থালায় জলের মুকুরে দেবীর প্রতিচ্ছবি। তারপর পানপাতা-ফুল-সন্দেশ সহযোগে দেবী প্রতিমার সিঁথিতে সিঁদুর, গালে সিঁদুর। এমনকী লক্ষ্মী-সরস্বতী-গণেশ-কার্তিকও সেই সিঁদুর রাগ থেকে বঞ্চিত নন। তারপর শুরু হয় সিঁদুরখেলা। সাধারণত যাঁরা সিঁদুর পরেন, তাঁরাই সিঁদুর খেলেন। এখন যদিও দেখা যায় অবিবাহিতা মেয়েরা এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সিঁদুরখেলায় যোগ দিচ্ছেন। বিশেষ সংস্কারবশত বিধবারা এ-খেলায় অংশ নিতে পারেন না। কেননা শাস্ত্রমতে ‘সিঁদুর’ শব্দটি স্বামীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিবাহকালে এয়োতির চিহ্নস্বরূপ যে-শাঁখাসিঁদুর, তার নানান ব্যাখ্যা রয়েছে। অধিকাংশ জনের মতে, স্বামীর দীর্ঘ জীবন ও কল্যাণ কামনায় বিবাহিত নারীরা সিঁদুর পরেন। আবার কেউ বলছেন লাল রং শক্তির প্রতীক। নারীবাদীরা বলছেন এ হল পুরুষতন্ত্রের সম্পত্তির চিহ্নিতকরণ। ধারালো পাথর দিয়ে ক্রীতদাসীদের চিহ্নিতকরণের এ নাকি আধুনিকীকরণ। আরও তথ্য বলছে, সিন্ধু সভ্যতার কালে নারীকে কেন্দ্র করে দুই বীরের লড়াইয়ে বিজয়ী বীর তরবারি দিয়ে নিজের রক্ততিলক ইপ্সিত নারীকে পরিয়ে দিত। সিঁদুরদান হল তারই বিবর্তন। সিঁদুর, যা আদতে মারকিউরিক সালফাইড; রাসায়নিক নাম লেড টেট্রক্সাইড, সংকেত Pb3O4। তবে জনসমাজে সিঁদুরের প্রয়োগ ও পরিচিতি, হিন্দু-সহ আরও কিছু জনজাতির বিয়ের যোগসূত্রে ও সংকেতে। বিবাহিত নারীর সিঁথির মধ্য দিয়ে সিঁদুর জনসাধারণে সর্বাধিক পরিচিত। এছাড়াও হিন্দু-সহ অন্যান্য ধর্মে সিঁদুর মঙ্গলচিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত। অনেক দেবদেবীর মাথায়, কপালে ও চরণযুগলে সিঁদুর-রাগ শোভা পায়। গ্রামে-গ্রামে ধর্মরাজের থান তো রীতিমতো তেল-ঘি-সিঁদুরে সর্বক্ষণ লাল টকটকে। বাংলার দিকে-দিকে জাগ্রত দেবদেবীর থানে বা সেখানকার মানত-বৃক্ষে অগনিত মনোবাঞ্ছা সিঁদুরে রঞ্জিত শাঁখা রূপে শাখায়-শাখায় বাঁধা পড়ে আছে। হিন্দুদের যে-কোনও মঙ্গলানুষ্ঠানে বসুধারা চিত্রণে সিঁদুরের ছোঁয়া তো অনিবার্য। আবার বেশ কিছু পূজার্চনায় মঙ্গলঘটে সিঁদুরের স্বস্তিকচিহ্ন শুভদায়ক। দুর্গাপুজোর বিজয়া দশমীর সিঁদুরখেলার মতো ছটপুজোতেও দেখি বিবাহিতাদের কপালে সিঁদুর-রাগ, সেখানে নাকের ডগা থেকে সিঁথির অন্তিম অবধি সিঁদুররেখা লাল রঙে বা কমলায়। এছাড়া, আমাদের শাক্তধর্ম ও ধারায় সিঁদুরের উজ্জ্বল ধারা ও উপস্থিতি রগরগে নজরকাড়া।
বিয়ের যোগসূত্রে মঙ্গলসূত্র নিয়ে কাটাছেঁড়ার তুলনায় বিবাহিত নারীর সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে আলোচনা হয়েছে বেশি। প্রগতিশীলরা প্রশ্ন তুলেছেন, নারীবাদীরা একে পুরুষের দখলদারিত্বের প্রমাণ হিসেবে প্রভূত দিকচিহ্ন দাখিল করে একে স্ত্রীজাতির লজ্জাচিহ্ন হিসেবে দাগিয়েছেন। তারপরও সিঁদুর সমহিমায় গড়পড়তা গৃহবধূর সিঁথিতে উজ্জ্বল হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এমনকী অনেক অসামান্যা, অনেক আধুনিকারাও সিঁদুরকে মাথায় তুলে রেখেছেন। সম্প্রতি ইসরোর চন্দ্রযান-3 -এর সাফল্যের অংশীদারিত্বে যেসব মহিলা-বিজ্ঞানীদের ছবি দেখা গেল, সেখানে দেখা গেল তাদের অধিকাংশের পরনে শাড়ি, ধারণে শাঁখা-সিঁদুর। যা সনাতনী শাঁখা-সিঁদুর পরিহিতাদের অবস্থানে এক প্রবল সমর্থন জুগিয়েছে। অন্যদিকে আধুনিকারা দীর্ঘদিন হল সাবেকি প্রথায় সিঁদুর পরেন না। তারা সোজাসুজি সিঁথিতে সিঁদুর না পরে, একটু বাঁকাবাঁকি করে পরছেন, কেউ-বা সিঁদুরকে একটু রেখেঢেকে রাখছেন। অত্যাধুনিকারা সিঁদুরকে বৈবাহিক চিহ্নের পরিবর্তে প্রসাধনী হিসেবেই ভাবতে ভালবাসেন। তাঁদের কাছে সীমন্তে সিঁদুর-রাগ আর পাঁচটা অঙ্গরাগেরই অন্তর্ভুক্ত এবং সেদিনের সাজগোজের সঙ্গে সিঁদুরের রাগ-ভাগ আনুপাতিক হারে মানানসই হওয়া জরুরি। তবে ইদানীং বিবাহকালে প্রায় সেলিব্রেটিদের দেখি ডগমগ সিঁদুর পরিহিত ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতে। আবার সিঁদুরদানের সময়ে বা আপুনি পরার সময়ে সিঁদুরের গুঁড়ো নাকে পড়লে নাকি সেই স্ত্রী স্বামী-সোহাগে পরিপূর্ণ হয়। তাই লজ্জাবস্ত্রে মোড়া টকটকে সিঁথির সিঁদুর-সহ নাসাগ্রে সিঁদুর-পড়া ছবির কদর বেশি। ইদানীং তো যে-কোনও সাদামাঠা বিয়েবাড়িও, মেকআপ-আর্টিস্ট ও ফটোশুটের দলবলের দখলে, সেখানে এহেন ছবি তোলার ও তুলিয়ে নেওয়ার তাগিদ প্রবল থেকে প্রবলতর। অর্থাৎ তার মার্কেট আছে।
সিঁদুর নিয়ে নানান সংস্কার। প্রথমত সিঁদুর সধবার চিহ্ন। সিঁদুরখেলায় শুধুমাত্র সধবার অধিকার। কুমারী মেয়েরা এ-খেলায় অংশগ্রহণ করলেও, বিধবার অধিকার নেই। এই একুশ শতকের আধুনিক সমাজচেতনায় এই বিভাজন অন্যায়, অমূলক। এই বিষয়ে ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-এ লেখিকা তিলোত্তমা মজুমদার খুব যুক্তিসঙ্গত ভাবেই লিখেছিলেন (২১/১০/২০১৮) সিঁদুরখেলা শেষমেশ এক ‘উগ্র সংস্কার’। এই খেলায় বিধবার অনধিকার নিয়ে তাঁর তোলা প্রশ্নও যথাযথ। আবার ওই পত্রিকাতেই (১৩/১১/২০১৭) শ্রীমতী অপালা সুখী দাম্পত্যের নানান টোটকা বাতলানোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ টোটকা বলেছিলেন, ‘পরিচিত কোনও বাচ্চার দুধের দাঁত যখন পতিত এবং মাটিতে পড়ার আগে সংগ্রহ করে যদি কোনও মহিলা নিজের সিঁদুরের কৌটোয় রাখে, সেই সিঁদুর ব্যবহার করলে দাম্পত্য জীবনে চরম সুখ আসবেই।’ ভাবুন, সুখের সন্ধান কত সহজ-সরল! তারপরও কেন যে এত ডিভোর্স, বধূহত্যা!
এছাড়াও সিঁদুর পরার ধরনেও নানা সংস্কার। স্নান করে সিঁদুর পরা শুভ ও মঙ্গলদায়ক। সিঁথিতে লাগানো সিঁদুর হাতের শাঁখা-পলায় ছোঁয়াতে হয়। সিঁথির মধ্যিখানে নামমাত্র সিঁদুর দাম্পত্যে ভাঙন ডেকে আনে, চুলে ঢাকা হারিয়ে যাওয়া সিঁদুরে স্বামীও হারিয়ে যায়, একদিকে এক চিলতে সিঁদুর পরলে স্বামীও দূরে সরে পড়ে। আর সিঁথিতে সিঁদুর পরা কালে তার গুঁড়ো নাকে পড়লে সে নারী স্বামী-সোহাগিনী হন। অন্য সংস্কারগুলির চেয়ে, এই সংস্কারটি সম্ভবত তার সৌন্দর্যগুণে আজও ফটোশুটের বাজারে খুবই জনপ্রিয়। তবে শাখা-সিঁদুর-আলতা এয়োতির চিহ্ন বা সংস্কার আজকের নয়। এ সাবেক-সনাতন কাল থেকে চলে আসছে। এক মামলার রায়ে (জুন ২০২০) গৌহাটি হাইকোর্ট পর্যন্ত রায় দেয়, শাঁখা-সিঁদুর পরেন না মানে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানকে মানেন না। এর অভ্যন্তরে পুরনো দিনের দাসপ্রথা কতখানি সুপ্ত আছে বা এই সিঁদুরের মধ্য দিয়ে পুরুষের কর্তৃত্বের বিষয় কতখানি, তা নিয়ে সিঁদুর-পরিহিতাদের মাথাব্যথা নেই। বরং এর পুরাণ গল্প-কাহিনিগুলি বা ধর্মীয় আখ্যান-ব্যাখান অনেক বেশি ভাবে সমাজ-মানসে এক স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। ফলে সিঁথির সিঁদুর আজও অক্ষয় রয়েছে। আধুনিক বিনোদনের দুনিয়ায় টিভি সিরিয়াল, সিনেমা ও বিশেষত যাত্রাপালার কাহিনিতে শাঁখা-সিঁদুরের মহিমা বর্ণন এক নজরকাড়া বিষয় চিরকালই। গত তিন-চার দশকের চলচ্চিত্র ও যাত্রাপালার নামকরণের দিকে নজর ফেরালে দেখা যাবে, সিঁদুরের নামে গল্প জমানো এবং তা দিয়ে দর্শক টানার এক প্রবল প্রয়াস। সে-গল্প হয়তো চড়াদাগের মেলোড্রামা, কিন্তু সাধারণের কাছে তা আদরণীয়। আর জনগণের মন বুঝে চলা গণমাধ্যম তো যারা যা চায়, তাই গেলায়। ফলে, ‘সিঁথির সিঁদুর’, ‘সিঁদুরের বন্ধন’, ‘সিঁদুরের অধিকার’, ‘স্বামীর দেওয়া সিঁদুর’, ‘শাঁখা-সিঁদুরের দিব্যি’ নামের সিনেমা এক সময়ে দিব্যি চলেছে। হিন্দিতেও ‘সিঁদুর’ শব্দযোগে একাধিক সিনেমা হয়েছে। তবে যাত্রাপালার মেঠো ময়দানে সিঁদুরকে শিরোনামে রেখে এবং চড়া রঙের পোস্টারে সিঁদুরকে নায়িকার শিরোভাগে রেখে যেভাবে প্রচার-প্রসার, তার জুড়ি মেলা ভার। যাত্রাপালা ও যাত্রাপালার নামকরণ নিয়ে ধ্রুপদী বাবু-বিবিদের এক ধরনের নাক-সিঁটকানো ভাব তো আছেই, তায় আবার শাঁখা-সিঁদুরের ছোঁয়া! কিন্তু এ-কথা অনস্বীকার্য, যাত্রার পালাকারেরা গ্রামবাংলার নাড়ী চেনেন, তাই পালার নাম রাখেন নায়িকার মিনতিতে ‘সিঁদুর নিয়ো না মুছে’, ‘সিঁদুর ভিক্ষা দাও’ বা ‘হারানো সিঁদুর ফিরিয়ে দাও’। কখনও নেপথ্যে থাকা দাম্পত্যের গল্পকে উসকে দিয়ে, ‘সিঁদুর আছে স্বামী নেই’, ‘স্বামী আগে না সিঁদুর আগে’, ‘সব সিঁদুরে সুখ মেলে না’, ‘তোমার সিঁদুরে আমার সোহাগ’। এছাড়াও প্রতিশোধের সুরে ‘সিঁদুর চুরির শাস্তি দিলাম’, ‘আমার সিঁদুরের দিব্যি’ কিংবা ‘সিঁদুর নিয়ে রক্তখেলা’। স্বস্তিদায়ক ও শান্তির বার্তাবহনে ‘মিলনমেলায় সিঁদুর খেলা’, ‘হারানো সিঁদুর ফিরে পেলাম’, ‘ফিরে পেলাম শাঁখা সিঁদুর’। হিংসা ও প্রতিহিংসার প্রেক্ষাপটে ‘সিঁদুর নিয়ে খেলা’, ‘সিঁদুর নিয়ে রক্তখেলা’, ‘পুত্রবধূর সিঁদুর চুরি’, ‘সিঁথির সিঁদুরে হায়নার থাবা’ ইত্যাদি। পরিশেষে, সম্ভবত আধুনিকা নারীদের সিঁদুরের শুচিতা ও শুদ্ধতা জানাতে ‘মেয়েরা কি জানে সিঁদুরের মানে’ বা ‘সিঁদুর পরো বঙ্গনারী’ নামের যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয়েছে দিকে-দিকে। আর দুর্গাপুজোর সিঁদুরখেলাকে কেন্দ্র করে সিনেমা, যাত্রা, সিরিয়াল সবই হয়েছে।
তবে শুধু যাত্রাপালা, চলচ্চিত্র-নামে ও বিষয়ে নয়, ছায়াছবির বেশ কিছু গানেও যোগ আছে সিঁদুরের। সর্বজনশ্রুত, ভীষণ ভাবে উল্লেখযোগ্য গান ‘সিঁথির এই একটু সিঁদুরে সব কিছু বদলে গেল/ কত না ভাগ্যে আমার এ জীবন ধন্য হল’। ‘ব্যবধান’ ছবিতে আশা ভোঁসলের গাওয়া এই গান, আজও বিয়ে বাড়ির ক্যাসেট তৈরির ক্ষেত্রে সিঁদুরদানের চিত্রায়নে শ্রেষ্ঠ উপাদান। অবশ্যই মনে আসবে কুমার শানু, শ্রেয়া ঘোষালের গাওয়া গান, ‘… পৃথিবীর যত রং লাগুক না সুন্দর/ সবচেয়ে যে মধুর সে-সিঁথির সিঁদুর’।’ এরকম আরও কিছু গানে চুলচেরা ভাবে খুঁজলে হয়তো সিঁদুরের সন্ধান মিলবে। রবীন্দ্রনাথের ‘পূজারিণী’ কবিতায় শ্রীমতী নামে দাসী যখন পূজারিণী হয়ে রাজার আদেশ অমান্য করে ভগবান বুদ্ধের পূজার্চনার পথে গেছেন বধূ অমিতার ঘরে, বধূ অমিতা তখন ‘সমুখে রাখিয়া স্বর্ণ-মুকুর/ বাঁধিতে ছিল সে দীর্ঘ চিকুর/ আঁকিতেছিল সে যত্নে সিঁদুর/ সীমন্ত সীমা পরে।’ কিংবা ‘বাঁশি’ কবিতায় কেরানির জীবনে সেই ধলেশ্বরী নদীতীরের মেয়েটির ছবি, ‘পরণে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর’। আধুনিক কবিতায় সিঁদুর স্মরণে আসছে, নির্মলেন্দু গুণের কলমে, ‘না হয় রক্ত হবে/ মাধবীর সিঁথির সিঁদুর’। মধুমঙ্গল সিনহা লিখছেন, ‘আবির গুলাল সিঁদুর সিঁথি/ ভালোবাসি আমি/ তোমার বনবীথি।’
আধুনিক উচ্চারণে সিঁদুরের ব্যাপ্তি, ব্যঞ্জনা অন্যমাত্রার হলেও, সিঁদুরের নামকরণে সিঁদুরকে কেন্দ্র করে থাকা সনাতনী ধ্যান-ধারণাই প্রাধান্য পেয়েছে। সিঁদুরের নাম ‘জবা’, ‘রাঙাজবা’, ‘রক্তজবা’ যাই হোক, এর মূলে কিন্তু শ্যামা মায়ের গলে ও পদতলে শোভা পাওয়া জবার টকটকে লাল রংকেই ইঙ্গিতে রাখা হয়েছে। সিঁদুরের নাম যখন ‘পূজা’, ‘মহাতীর্থ’, ‘মা-বৈষ্ণব’, ‘ইন্দিরা’ তখন ধর্মীয় অনুষঙ্গই মূল। আবার ‘মা’, ‘শ্রীমতী’, ‘জননী’, ‘বধূ’ সর্বনামে জড়িয়ে আছে সিঁদুরদান ও তৎপরবর্তী নারীর অবস্থান বদলের সূত্রবিশেষ। এর মাঝে ‘খুকুমণি’ আগামী নারী। এছাড়াও ‘ভাগ্যশ্রী’, ‘সোহাগ’, ‘বন্ধন’ নামে আছে সিঁদুরের সূত্রে সুখী দাম্পত্যের ব্যঞ্জনা। তবে এখন বেশিরভাগ সিঁদুরই হার্বাল, লিকুইড। প্রথমত স্বাস্থ্যসচেতনতা, দ্বিতীয়ত ঘরে-বাইরে সহজেই ব্যবহার যোগ্য। এই সময়ের ব্যস্ততমাদের মাথার কথা মাথায় রেখে, প্রস্তুতকারকরাও পণ্যের পাত্রের আকারে এনেছেন বদল। সেই চিরাচরিত লাল রঙের গোলাকৃতি সিঁদুর কৌটোর পাশাপাশি এখন কুমকুমের মতো লম্বা টিউবে লিকুইড সিঁদুর।
তবে বাঙালির ঘরে-ঘরে, ভারতের মন্দিরে-মন্দিরে ও সাধারণ গেরস্থের মা-মেয়েদের মাথায় এখনও ‘শ্রীমতী’, ‘খুকুমণি’র মতো গুঁড়ো সিঁদুরের যথেষ্ট দাপাদাপি। ‘শ্রীমতী’ সিঁদুর আজ নব্বই বছরের বেশি কাল জুড়ে আমাদের মা-কাকিমার সিঁথির সিঁদুর জুগিয়েছে। জে. এন. কুন্ডু প্রাইভেট লিমিটেডের আলতা, সিঁদুর, ‘কুমকুম’-এ ভরসা রেখেছে বাঙালি। বিশেষ বিজ্ঞাপন লাগে না, ওই গোল লাল রঙের কৌটোতে ‘শ্রীমতী’ নামখানা ও সিঁদুর-পরিহিতা ঘোমটা টানা এক সলাজ নববধূর ছবিই যথেষ্ট। আজকের বাল্যবিবাহ রোধের সমাজ সচেতনতায় খুকুমণি, বিয়ের সিঁদুর থেকে অনেক দূরবর্তিনী। তারপরও সিঁদুরের নাম ‘খুকুমণি’, এবং দেখতে-দেখতে সেই ‘খুকুমণি’র বয়স হয়ে গেল পঞ্চাশ। তাদের পণ্যের ক্যাচ লাইন ‘প্রতি গৃহ অক্ষয় হউক’। আর বিজ্ঞাপনী বক্তব্য : ‘পুজো পার্বণে, বিয়ের আচারে, বিয়ের তত্ত্বে, উপহারে, ব্যবহারে, নিত্যদিনে, বিশেষ দিনে, আপনার চির বন্ধু চির নির্ভর খুকুমণি হার্বাল ডিলাক্স সিঁদুর। তুলসী ও চন্দনে সমৃদ্ধ আপনার ডিলাক্স সিঁদুরে আপনার সলাজ মুখটি ঝলমলিয়ে উঠবে বিয়ের আসরে। আর পূজোর দিনগুলিতে শুদ্ধ চিত্তে, শুভ্র বসনে, রক্তিম সিঁথিতে, আপনি মাকে অর্ঘ্য দেবেন। আপনার পুজোর ডালিতে থাকবে খুকুমণি হার্বাল ডিলাক্স সিঁদুর। সিংহবাহিনী মা দুর্গা, কমলাসনা মা লক্ষ্মী, কিংবা তমসানাশিনী মা কালীর আশীর্বাদে অক্ষয়া সৌভাগ্যের অধিকারিণী হবেন, আর সঙ্গে থাকবে খুকুমণি হার্বাল ডিলাক্স সিঁদুর।’
প্রসাধনের জগতে কেয়া শেঠ এখন এক উল্লেখযোগ্য নাম। তাদের সিঁদুরের বিজ্ঞাপনগুলিও বেশ নজরকাড়া, বিশেষত পুজোর বিজ্ঞাপনে মা দুর্গা, মণ্ডপ, ঢাকি এবং পুজোর রীতিনীতিকে মিলিয়ে তারা যে অ্যাড-ফিল্মের মধ্য দিয়ে সংযোগ স্থাপন করেন, তা নয়নাভিরাম, শ্রুতিমধুর এবং রুচিশীল। একেবারে আধুনিক ভাষ্যে তাদের বক্তব্য, ‘কেয়া শেঠের আলতা-সিঁদুর ভালবাসার রং’। তাদের তৈরি একটি অ্যাড-ফিল্মের উল্লেখ করি :
‘কেয়া শেঠের আলতা-সিঁদুর সম্পর্কের ছোঁয়া
সারাজীবন শাঁখা-সিঁদুর আলতা দিয়ে ধোয়া ।
সোনার বরণ অঙ্গে আমার রাঙা বরণ রূপ
টাপুর টুপুর বাজল নূপুর রঙিন অপরূপ।
শঙ্খধ্বনি আগমনী আলগা এলো চুলে
বরণ করি মাকে আমার নতুন ঘরে এলে।’
এরপর কেয়া শেঠের সুদৃঢ় ঘোষণা, ‘আলতা-সিঁদুর, অটুট সম্পর্কের রং’। সঙ্গে অঙ্গীকার, ‘তোমাকে সুন্দর করে তুলব/ তোমার স্বপ্ন আমার সংকল্প।’ বিকিকিনির হাটে, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে এই বিজ্ঞাপনচিত্রও বাজার-কৌশল। কিন্তু তারই মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে নান্দনিকতা।
দুর্গাপুজোর প্রেক্ষাপটে কেয়া শেঠের এক বিজ্ঞাপনী-চলচিত্রের অংশে আছে, ‘সাজল ভুবন আলোয় আলোয়, আলতা-সিঁদুর মেয়ে/ অশ্রুজলে বিদায় দিলাম, আগমনীর পথ চেয়ে।’ মা দুগ্গার বিদায়বেলা ও সিঁদুরখেলা মিলেমিশে একাকার হয়ে এক মনখারাপের সন্ধেবেলা আসে। আপনি আস্তিক-নাস্তিক যাই হোন, মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র ঘোরে স্মৃতি ও শ্রুতির মেলবন্ধনে গলা-বুজে-আসা বাঙালির মননে এই দেবীবরণের সিঁদুরখেলাও এক বিষণ্ণতার সুর তোলে। আর তাকে ভুলতেই পারস্পরিক বিজয়ার শুভেচ্ছা, কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ। কত ছোট-বড় সম্মেলন। মানুষে-মানুষে মিলন-আনন্দে মিলিয়ে যায় সে-বিষণ্ণতা, ফিকে হয়ে যায় বিষাদের সুর ও সিঁদুর।