ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সাক্ষাৎকার : দুর্গাশিল্পী প্রদীপ রুদ্র পাল


    শুভময় মিত্র (October 24, 2023)
     

    কী আছে দুর্গাপুজোয়? কেন এই উৎসব? কেনই বা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এমন তুমুল জনজোয়ার? দুর্গার জনপ্রিয়তা অন্য সব দেবীর উপরে। তিনি এমনই এক চরিত্র, যাঁর গ্ল্যামার সর্বাধিক। অন্য সবার জন্য বরাদ্দ একদিন, দুর্গার পাঁচ। মানুষ অনেক বেশি সময় ধরে ওঁকে কাছে পেতে চায়। ভক্তি, বিশ্বাস, সেন্টিমেন্ট থেকে উঠে আসা পুজো অনায়াসে বদলে যায় উৎসবে।

    দুর্গা সম্ভবত নিজেও চান মানুষের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে, সপরিবারে। অথচ আর সবার মতো, সেই অর্থে, মা দুর্গাকে আমরা চোখে দেখিনি। কিছু কাহিনি, প্রাচীন বর্ণনা, দেবচিত্রের ভিতের উপর উনি নির্মিত হয়েছেন জনমানসে। সেটিই আমাদের কাছে দেবী-পোর্ট্রেট। মনের মধ্যে দুর্গাভাব। এই চিরন্তনতার চাক্ষিক রূপ হলেন দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী। খোদ বাংলার মানুষের সৃষ্টি। অবিকৃত চেহারায় ফিরে আসছেন যুগের পর যুগ ধরে। মৃৎশিল্পীরা তৈরি করে আসছেন মূর্তি। পরম আদরে তিনি পূজিত হচ্ছেন বাড়িতে, বারোয়ারি প্যান্ডেলে।

    এক সময়ে পর্যন্ত কুমারটুলি ছিল এই সৃষ্টিকর্মের প্রধান পীঠস্থান। আজও তাই। দুনিয়া পাল্টেছে। কালের প্রভাবে নতুন ভাবনার মিশ্রণ ঘটেছে নির্মাণের আবহে। ট্র্যাডিশনাল ঠাকুরের পাশাপাশি এসেছেন নবরূপের অজস্র দুর্গা। যার জনপ্রিয়তা উৎসবকে সীমাহীন উদ্দীপনায় পর্যবসিত করেছে। বদলে গেছে পুজো। আর্টের প্রভাবে, প্রলেপে দুর্গাদর্শনের অভিজ্ঞতাও এখন অন্যরকম। জনগণ এই বদলকে পছন্দ করেছেন। আবার, সনাতন চেহারাকে ভুলেও যাননি। দুই বিপরীত ধারার সমান্তরাল চলন মহোৎসবকে মহত্তর এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। দুর্গার আদি চেহারার অন্যতম শ্রদ্ধেয় রূপকার, কলকাতার প্রদীপ রুদ্র পালের সঙ্গে ডাকবাংলা.কমএর পক্ষ থেকে কথা বললেন শুভময় মিত্র :

    দুর্গা নিয়ে মাতামাতি শুরু করলেন কবে? কেন?

    আমরা এখনকার বাংলাদেশের বিক্রমপুরের লোক। আমার বাবা মোহনবাঁশি রুদ্র পাল কলকাতার বিখ্যাত দুর্গা-স্রষ্টা। আশির দশকে ওঁর লার্জার দ্যান লাইফ, অপরূপ দুর্গামূর্তি মানুষের সম্ভ্রম আদায় করে নিতে পেরেছিল। উনি হয়ে উঠেছিলেন এক স্বতন্ত্র ব্র্যান্ড। আমার জ্যাঠামশাই, তিনিও একজন সেলিব্রেটেড শিল্পী। তেলেঙ্গাবাগানে আমাদের স্টুডিও। প্রত্যেক বছর আমাদের প্রচুর ঠাকুর তৈরি না করে উপায় থাকত না। আজও একই ব্যাপার। এই আবহেই বড় হয়েছি আমি।

    বহু কষ্টে আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলাম আজ…

    নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। এটাই আমাদের ব্যবসা, ইন্ডাস্ট্রি। এতগুলো মানুষের অন্ন সংস্থানের ব্যাপার। বাবা প্রয়াত হয়েছেন প্রায় সাত বছর আগে। আমাদের পারিবারিক বিভাজনের পর আমি বাধ্য হয়েছি এর দায়িত্ব নিতে। আমার জীবনে, মনের মধ্যে দুর্গাছবি রয়েছে, তাছাড়া বাবা জ্যাঠাদের শিক্ষা, আমার কাজে তারই প্রতিফলন হয়। প্রত্যেক প্রতিমার চোখ আমি নিজে আঁকি। তবে একটা কথা, আমি দুর্গাঠাকুর বানাব, এমন ইচ্ছে কোনওদিনই ছিল না। 

    আপনার এতে আগ্রহ ছিল না? তাহলে?

    আমি আর্ট কলেজের ছাত্র। মাস্টার্স করেছি বরোদাতে। ‘জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারি’তে আমার প্রচুর প্রদর্শনী হয়েছে। আমি আর্ট নিয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। এসব নয়। কিন্তু উপায় ছিল না। দুর্গা তৈরির ব্যবসায় না এলে আমাদের এত বছরের প্রতিষ্ঠান হয়তো বন্ধ হয়ে যেত। দুর্গা তৈরি করে চলেছি ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে। শিল্পের তাগিদে, তা নয়!  

    সে কী! এই যে পুজোটুজো, দুর্গা, একে শিল্প বলে মানতে চাইছেন না?  

    আসল ব্যাপার কী? দুর্গা। প্রধান ফোকাস। এই মুহূর্তে কী দেখছেন? দুর্গাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে অন্য অনেক কিছু। ঠাকুর হারিয়ে যাচ্ছে। শিল্প বলতে যাই বোঝাক, তা দুর্গার অরিজিনাল উপস্থাপনাকে সরিয়ে নিজে বড় হয়ে উঠেছে। কীভাবে একে সমর্থন করব?

    আপনি এইসব এক্সপেরিমেন্টের বিরোধী? মানুষ তো পছন্দ করেছে। ইউনেস্কো (UNESCO) থেকে সম্মান এসেছে। এর দাম নেই?  

    এক্সপেরিমেন্ট আমিও করেছি। এই যে থিমের পুজো, একটা টাইটেল তৈরি করে পুজোর একটা নতুন চেহারা দেওয়া, সম্ভবত আমি তার পথিকৃৎ। এই মূহূর্তে কলকাতার থিম পুজোর বহু বিখ্যাত সেলিব্রিটি এক সময়ে আমার সহকারী ছিল।

    খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন, আমাদের নিজেদের পাড়া তেলেঙ্গাবাগান সর্বজনীন-এ ১৯৯৪ সালে আমার প্ল্যানিংয়ে একটা পুজো হয়েছিল। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ বাংলার ষোলোটি জেলার পরিচয় ছিল সেখানে। মাটি, গোবর দিয়ে প্যান্ডেল লেপা হয়েছিল বাংলার আবহকে সৎভাবে উপস্থাপনার জন্য।

    সাংঘাতিক উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আমার দুর্গা কিন্তু আদি মাতৃভাবকে মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছিল। আরও আছে। একবার সবকিছু করেছিলাম সাদা-কালোয়। দুর্গা সোনালি। অন্যরা তা নয়। কেন? দেখুন, যা হয়ে আসছে তার থেকে একটা ডিপার্চার হতেই পারে। নতুন উপস্থাপনার পিছনে একটা যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকতে হবে। কৃষ্ণ একবার দুর্গাকে পুজো করেছিলেন। এটাই ছিল সেবারের মূল ব্যাপার। সেই জন্যই সাদা-কালো। মঞ্চের ওপর কৃষ্ণকেও উপস্থাপিত করেছিলাম।


    তাহলে অধিকাংশ জায়গায় যে-দুর্গা দেখছি, তাকে আপনি কী বলবেন?

    বহুক্ষেত্রেই গিমিক। চটজলদি মানুষকে নতুন কিছু দেখিয়ে, উত্তেজিত করে, তা সে যেভাবেই হোক, একটা দ্রুত বিহ্বলতার আবর্তে ফেলে দেওয়া। ঠিক-ভুল, আমি বলার কে? আমি আমার নিজের জায়গায়, অভিজ্ঞতায় দুর্গারূপের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চাই। সম্পূর্ণ আমার নিজের সিদ্ধান্ত। তাই দুর্গাপুজোর আধুনিক স্রোতের মধ্যে আমি থাকিনি। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। ঠাকুর ছাড়া আর অন্য কোনও কিছুতে মাথা দিই না। সম্ভব নয়। বোঝেন নিশ্চয়ই, ব্যাপারটা এখন কর্পোরেটদের হাতে। তাঁরা, কারণ যাই হোক, যেমন চাইবেন, তেমনই হবে। শিল্পীকে তাঁদের বশ্যতা স্বীকার করতে হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে। উপায় নেই। একজন পেশাদার মানুষকে নিজের সার্ভাইভালের চেষ্টা করতেই হয়। আমিও করছি, আমার টার্মসে।      

    একটা উদাহরণ দিন, যা, যে-কারণে আপনার অপছন্দ হয়েছিল।
     

    দেখেছেন নিশ্চয়ই, যখন যেটা হয়, যদি লোকের চোখ টানে, চোখ বুজে সবাই সেটা শুরু করে দেয়। একবার এক জায়গায় আমি ঠাকুর করলাম। শুধু ঠাকুর। প্যান্ডেল, আনুষঙ্গিক সজ্জাতে আমার কোনও ভূমিকা ছিল না। দেখি, দুর্গার মুখের ওপর একটু আলো ফেলা আছে। বাকিটা অন্ধকার। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে পূর্ণ একটা মূর্তি তৈরি করে কী লাভ হল?’— এর কোনও উত্তর আমি পাইনি। আবারও বলছি, ঠাকুরের চেয়ে বাকি সব কিছু, বিশেষ করে আলোর ব্যবহার, পুজোকে অন্য চেহারায় নিয়ে গেছে। ঠাকুর সেখানে গৌণ। সাজের প্রয়োজনীয়তা আছে বইকি। কিন্তু, দুর্গা কই? না বলে পারছি না। ঠাকুরের মালাটা অবধি পরানো হয় না অনেক জায়গায়, শিল্প চাপা পড়ে যাবে, মানাবে না! 


    স্টাইল ছাপিয়ে যাচ্ছে কন্টেন্টকে, তাই তো?


    আদতে যখন পুজো, তখন নিষ্ঠাভরে, সম্মান করে, ট্র্যাডিশনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে করাই শ্রেয়। অনেকেই তা করে চলেছেন। জনপ্রিয়তার কথা যদি বলেন, এতটুকু কমেছে? বাগবাজার দেখুন। মানুষের ভিড়টা দেখুন। অন্য চেহারায় কিছু করতে চাইলে একটা যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকতে হবে। স্রেফ মনে হল, বা ভাবলাম এভাবে করলে খুব চলবে, করে ফেললাম। তারপর কর্পোরেট শাসিত বাজারে সাফল্য পেলাম। এই সাকসেসে আমার আগ্রহ নেই।

    আর্টের সঙ্গে সংঘাতটা কোথায়?

    সংঘাত এখনকার পুজোর মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে দর্শকদের সনাতন দুর্গা ভাবনার। দেখুন, আর যাই হোক, আর্ট বলতে যাই বোঝাক, বিকৃতির জয়গানকে সমর্থন করি কীভাবে? ঠাকুর বানানো কি এতই সোজা? শিল্প কি এত সহজ? দশ হাতের প্রোপোরশন, ব্যালান্স যিনি সামলাতে পারছেন না, তিনি শর্টকাট নিচ্ছেন। একজন ছবি আঁকতে জানেন না। অক্ষমতা ঢাকতে অনেক কিছু চাপিয়ে দিলেন। দাবি করলেন, এটাই আধুনিক। মানুষ যদি সেটাকে মান্যতা দিতে উৎসাহী হয়, দেবেন। আমি পারব না। আমি তা কোনওদিন করিনি। করতে উৎসাহী নই।  

    শিল্পের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না?

    পারলে, নিজেকে শিক্ষিত করে, পারদর্শিতা অর্জন করে যেমন প্রাণ চায় তা করা যেতেই পারে। শিল্পের অজস্র ধারা রয়েছে। ছবি আঁকা, স্কাল্পচার, কত কী! সেখানে ব্যক্তিগত মননের প্রকাশ ঘটুক। হ্যাঁ, দুর্গার ক্ষেত্রেও হোক। কিন্তু দুর্গাটা দুর্গার মতো হতেই হবে। ইন্‌স্টলেশনের মোহে দেবীপূজার বিষয় থেকে সরে যাব কেন? আগেই বলেছি, আমিও ওই সবেই বেশি উৎসাহী ছিলাম। আজও আছি। কিন্তু উপায় নেই। সময় তলানিতে ঠেকেছে।সময়টা হারিয়ে গেছে। না, দুর্গা আর নেই। এটুকু বলতে পারি, আমার মুখের কথার সঙ্গে কাজের ফারাক পাবেন না। নিজেই দেখুন। মিলিয়ে নিন। হ্যাঁ, আমি অবশ্যই রক্ষণশীল। আমাদের গৌরবময় সংস্কৃতির অন্যতম বিষয় দুর্গাপুজো, তার রূপায়নের কাজে সম্মান রক্ষার দায়িত্ব নিতেই হবে।  


    ছবি সৌজন্যেশিল্পী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook