মিথ্যে কী করে বলি রুকুবাবু? মুনি ঋষিরা এসব লিখে গেছেন।’ মনে পড়ছে শশীবাবুর কথাটা?
আবেগে, উচ্ছাসে মানুষের দুর্গাবন্দনা রূপ নিয়েছে দুর্গোৎসবে। পুজো বললেও, ব্যাপারটা স্রেফ ধর্মগন্ধী নয়। শিল্প-সংস্কৃতির আনাচে-কানাচে, পাড়ায়, বাড়িতে উদ্দাম হইচই। এতটাই এবং প্রতিবছর এমনই বিস্ময়কর এক ব্যাপার ঘটে যে, এই জন-গণ-মন ভোলানো ফেস্টিভ্যালকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি না দিয়ে পারেনি। সত্যি-মিথ্যের তর্ক থাক। সারা দুনিয়ার কাছে এই ফ্যান্টাসি ও ফানটুসি বঙ্গদেশের এক জবরদস্ত সিগনেচার। দুর্গা প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা এসে যায়। তাঁর আসা-যাওয়ার মাঝে জড়িয়ে আছে আরও অনেক কনসেপ্ট। অ্যারাইভাল ডিপার্চারের ব্যাপারটা— কীসে আসছেন এ-বছর, কীসে যাবেন, তার ফলে কী হবে— সব কিছু বিশদে বলা আছে। পুজোর পাঁচদিন না হয় চোখ বুজে বা বিস্ফারিত চোখে খুব আহ্লাদ করা গেল। তার আগে পরে যা হতে চলেছে, বছরের বাকি তিনশো ষাট দিনের ভাল-মন্দের ব্যাপারটাকে মাথায় রাখতেই হয়। ভবিষ্যদ্বাণী মিলুক না মিলুক, ঘটনা ঘটেই চলে। অথচ দুর্গা পরিবারের আসা-যাওয়ার লজিস্টিক সাপোর্টের ক্যারেক্টার রোলদের সেভাবে কেউ গুরুত্ব দেয় না।
নৌকা, গজ, ঘোটক, দোলা। রাজধানীতে, না স্লিপার ভলভো, না কি ফ্লাইটে, তা নির্ধারিত হয় কোন বার তার ওপর। প্লিজ নোট, ‘রবৌ সোমে গজরূঢ়া। ঘোটকে শনি ভৌময়ৌঃ৷ দোলায়ঞ্চ গুরৌ শুক্রে। নৌকায়ং বুধবাসরে৷’
হাতির কেতাই আলাদা। হাতিতে যাওয়া আসার ব্যাপার থাকলে শান্তি, প্রাচুর্যের ইঙ্গিত। একটা ঘ্যাম পরিস্থিতি। যদি পুষতে পারতাম, যদি তার পিঠে চেপে বাজারে যেতাম, যদি হাতি সবজি বেছে শুঁড়ে তুলে আমার কাছে অ্যাপ্রুভাল চাইত, এরপর আর ভাবতে পারিনি। এতখানি হেভিওয়েট কিছু ভাবা আমার পক্ষে অসম্ভব। অথচ দেখুন, সেই হাতিকে কেউ পাত্তা দেয় না আর। রাজসিকতার সংজ্ঞাটা বদলে গেছে যে! লোকের চয়েস গুচ্ছের তেল খাওয়া দামড়া গাড়ি। হাতির খোরাক বলে অপমান করেও লাভ নেই। এটা ঠিক যে হাতির এসি নেই। পয়সার গরম দেখাতে হলে ও’টি চাই। উষ্ণায়নকে কে অস্বীকার করবে? হাতির মন আছে। সে মন রাখা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। মন দেওয়া নেওয়াটা এখন ফোনে। হাতির ওসব নেই। তাই আনস্মার্ট। অতএব বাদ। হাতির গুরুত্ব মানুষ বোঝে জঙ্গল ছেড়ে গঞ্জে ঢুকে তাণ্ডব চালালে। অথবা ট্রেনকে চ্যালেঞ্জ করলে। তখন বনদপ্তর চেষ্টা করে তাকে ঘুম পাড়ানোর। তাদের গুলিতে নিশ্চয়ই লেখা থাকে, ‘হাতি ঘুমোল, পাড়া জুড়োল, দুর্গা এল দেশে।’
‘ছত্রভঙ্গন্তরঙ্গমে’। এবারে ঘোড়ার কথা হচ্ছে। সংস্কৃতের একটা দারুণ ব্যাপার আছে। না জানলেও, এমনই অদ্ভুত তার ধ্বনি যে ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। অনেক জানোয়ারের মধ্যে মানুষ ঘোড়া ধরেছিল সঙ্গত কারণে— দ্রুততম পোষ্য। আগে পৌঁছনোর প্রয়োজন চিরকালই ছিল। আজও আছে। চারগুণ ভাড়া দিয়ে অর্ধেক সময়ে স্বপ্ন সর্পিল ট্রেনে আমরা চাপছি বইকি! প্যাশন, সেন্টিমেন্টের জায়গায় ফ্যাশন স্টেটমেন্ট প্রাধান্য পাচ্ছে। এই পরের দুটি শব্দ একদা ঘোড়াকে এগিয়ে রাখত অন্যদের তুলনায়। একবার ভাবুন, ছত্রপতি শিবাজী একটা জেব্রা চেপে জিব্রাল্টার পেরোচ্ছেন। হয় না। অথবা ময়ূরবাহন উত্তমকুমারকে চ্যালেঞ্জ করছেন উটের পিঠে চেপে। জমে না। এই যে একটা ঝটকা, এক ধরনের স্মার্ট অস্থিরতা, দারুণ ডায়নামিক্স, আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা, হিরোর (এখানে হিরোইন) দ্যাখনদারি শো-অফ, ঘোড়া ছাড়া অসম্ভব। এদিকে অন্য এক ধরনের ঘোড়ারোগে আক্রান্ত, অকাল দৌর্বল্যে মুহ্যমান পুরুষকে এমনই এক ক্যাপসুল গিলতে হয় যার প্যাকেটে কালো ঘোড়ার ছবিই থাকে। অথচ, আজ ঘোড়ার মার্কেট নেই। একই কাজ করে, উল্লিখিত প্রত্যেকটি বিষয়ে টিকমার্ক রয়েছে, এসে গেছে মোটর বাইক। একজনের লাগে তেল মোবিল ইনশিওরেন্স, অন্যজনের স্রেফ ঘাসবিচালি। ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে চাবুক মারাটা এখন কিক-স্টার্টে। কিকের জায়গায় সুইচ। নিঃশব্দ ইন্ধন। হ্রেষা রবের পরিবর্তে ক্রমাগত বোমাবাজির মত নিরবচ্ছিন্ন একটা শব্দ। ডিজাইনাররা জানেন, মানুষ স্রেফ যেতে চায় না, দাপিয়ে যেতে পছন্দ করে। জানোয়ারের পিঠে চেপেই। বাইকের সাইড লাইটের নকশাটা নজর করুন। গুগল করলেই বুঝবেন, ‘উলফ্স আই’ মানে কী।
দোলা মানে দুলুনি। চাকাহীন যান। মানুষের ইঞ্জিন। থামা চলবে না। রিকশার তাও একজোড়া চাকা থাকে। দোলা হুডখোলা হতে পারে। পর্বততীর্থের যাত্রীরা অন্যের কষ্ট কিনে ওতে চড়ে পুণ্য করে আসেন। চারপাশ বন্ধ পাল্কিও হতে পারে। দুর্গা সম্ভবত ওটিই ব্যবহার করেন। এরোপ্লেন মাঝে মাঝে এয়ারপকেটে পড়লে একটা মোলায়েম ঝাঁকুনি হয়। ক্র্যাশ করার ভয়টা, পায় কিন্তু সবাই। দোলার ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু সহজ বাংলায়, অত্যন্ত আনস্টেবল প্ল্যাটফর্ম। দুর্গা দোলা রাইড নিয়েছেন মানে সবকিছু লণ্ডভণ্ড, ভাঙচুরের সম্ভাবনা। দোলা অথবা ডবল ডেকার যাতেই আসুন বা যান, আজকের দুনিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। বদমাশদের অতিলোভে, না কি দেবতাদের অভিশাপে এ নিয়েও তর্ক করে লাভ নেই। খরা, বন্যা, ভূকম্পের চেয়েও ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়ে চলেছি আমরা। রাশিয়া ভুলতে না ভুলতেই ইজরায়েল এসে গেছে। শপিং মলের শখের বাজারে এস্কেলেটরের প্রত্যয়ী আরোহণ, নিশ্চিন্ত অবতরণের মজা থাকতে দোলা তাবাদি হবারই কথা। তাও দুর্গা নাকি আসেন ওতে চেপে, বার মিললে। আচ্ছা নেক্সট!
‘নৌকাং জলবৄদ্ধিশ্চ শষ্যবৄদ্ধির্ভপেৎ সদা৷’ খুব সোজা। জল, নদী, শস্য, প্রাচুর্য, মাছ, ধান, চাল, পোলাও, বিরিয়ানি। আরও আছে সাইক্লোন, বন্যা, ক্লাউড ব্রেক, ড্যাম বার্স্ট, ধস, সিকিম। সেই কবে, টাইটানিক ছবি হয়ে গিয়েছিল। এত জলে সামান্য নৌকা কী আর করবে? ভেসে ভেসে এদিক-ওদিক গেল, সুন্দরবনের খাঁড়িতে কুমির সাক্ষী রেখে স্টিমার পার্টি করল, হাওয়াই-তে লাক্সারি ওশান লাইনারের সুইমিং পুলে ডুবে ডুবে শ্যাম্পেন খেল, এই অবধি ঠিক আছে। মরতে বেশি নীচে কে যেতে বলেছিল? ‘গভীরে যাও’— একটা নিরীহ গানকে অযথা সিরিয়াসলি নেওয়ায় একটা ট্যুরিস্ট সাবমেরিন গেল ফেটে। এর পরেও, আধুনিক দুনিয়ায় ‘নৌকো ছাড়া অনেকের গতি নেই’ বললে অবাক হবেন না। ক্রমাগত পরিযান চলছে ভূমধ্যসাগরে, অনেক অসম্ভব প্রণালীতে, দুর্গম সমুদ্রে, ডিঙিতে চেপে। তবে দুর্গার নৌ-যাত্রার কল্পনাটা যুক্তিসঙ্গত। কৈলাসে নয়, গোমুখের পর ন্যাভিগেবিলিটি বাড়লে নৌকোয় চড়ে প্রয়াগরাজ, বারাণসী, পাটনা, ফারাক্কা, চোঁ করে কলকাতা, বেশ ভাল জার্নি। এখন অবশ্য তাণ্ডব শিরোমণি শিব-ও আর এমনটি ভাবতে সাহস পাচ্ছেন না। গোমুখ বিলুপ্ত। দেবস্থান ভেঙে পড়ছে হুড়মুড়িয়ে। দেবতাদের কিছু যায় আসে না। অনেক ওপর থেকে দেখছেন। ঝুলে আছে তাঁদের সৃষ্ট সন্তানসন্ততিরা। কেদারনাথ, যোশীমঠ দিয়ে শুরু। সেই সন্তানেরা নিজেদের দোষারোপ করে নেওয়ায় ওনাদের ইডি, সিবিআইয়ের সমস্যা থাকছে না। কেউ কোনও ব্যাপারে মাথা দিচ্ছে না। কে, কবে, কেন উপেক্ষিত হচ্ছে, তা নিয়ে আমরাও সময় নষ্ট করব না। মোচ্ছবের প্রধান দ্রষ্টব্য— সেলিব্রিটিদের নিয়ে যেমন আছি, তেমনই থাকব।
খবরের সত্যাসত্য আমি যাচাই করিনি। করব না, আগেই কথা হয়েছে। অতিমারি জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় গুণীমানীরা নাকি এক নতুন যানের নকশা করেছেন। এর ন্যানো এডিশনের আভাষ পাবেন ‘প্রজ্ঞানে’।
ছবি এঁকেছেন দেবাশীষ দেব