‘চলিলাম আমি যথা প্রাণ ধায়…’
১.
ডাক্তার আসিবার পূর্বে যে রোগী মরিয়া যাইবে তার চোখের মতো লাল লাল গোল চাঁদ উঠল আকাশে। শ্রাবণ মাসের রাখিপূর্ণিমা। শিরোমণি দাসের চোখের সামনে সূর্যোদয়ের মতো করে সেই চাঁদ দিগন্তে লালচে বেগুনি রঙ নিয়ে উদয় হল, এরপর সেই লালটুকু মুছে মুছে হলদে হল, সেই হলুদ লোপ পেতে পেতে ডিমবেগুনের মতো সাদা হল। তারপর মাঝআকাশে উঠে এসে সেই দুধসাদা চাঁদ ষোলআনি গ্রামের শিয়রে এসে রুপার পালক ঝরাতে ঝরাতে ঝিকমিক করতে লাগল। জ্যোৎস্নায় নদীতটের বালু ঝিমঝিম করছে, সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে শিরোমণিরও মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, যেন এমনি করে কতকাল আগে সেই অবোধ কৈশোরে সে এমনি তাকিয়ে থেকেছিল। অকূল ঘুমটি নদীকে জোছনায় একগাছা রুপোর জরির মতো ঝিকমিকিয়ে ভাসতে দেখে সেই কিশোরের মনে হয়েছিল সামনে অশেষ জীবন। দুঃখ আছে, ক্ষতি আছে, তবু যেন এ জীবন অপার, সীমাহীন। অত ভাবতে গিয়ে আনন্দে-আশায়-লোভে-বিস্ময়ে সেই জ্যোৎস্না-অভিভূত লুব্ধ কিশোর চোখের জল ফেলেছিল টপটপ করে, সইতে না পেরে বাড়ির দিকে দৌড় দিয়েছিল সে। ঠাকুমার ঘাম আর ধানসেদ্ধর ঘ্রাণে ভরা শাড়িতে মুখ গুঁজবে বলে। আজও তার চোখ ভরেছে জলে, এই জোছনায় ভিটেবাড়ির দিকে না গিয়ে উল্টো দিকে হনহনিয়ে রওনা হল সে।
২.
ষোলআনি ছোট্ট গ্রাম। একদা গো-মড়কেই উজাড় হয়ে যেত এমন সব গ্রাম। মৃত গ্রাম ফেলে গ্রামবাসীরা সরে যেত আরেক গ্রামের সীমানায়, নইলে নদীবক্ষের উদলা চরে। তাদের ভাঙা বসতভিটের পেছনের জঙ্গলে পোকা-চরা নির্জনতায় ঘুররর ঘুররর করে বাঁশঘুঘু ডাকত, রাতে ডাকত হুতোম। ওই জংলি গাছপালা-পশুপাখি জানত ওরা স্থির। গ্রামখাকী ওসব মড়কের ভেতর ওরা অবিভাজ্য সংখ্যার মতো, স্থির, আস্ত। অন্তত কিছুকাল আগে পর্যন্ত তাই জানত।
সেই ষোলআনিতে ব্যারামকাঠি বাজারে সারিসারি চালাঘর— মুদির দোকান— মশলাভাঙানির দোকান আর সীতাব্রতর বেড়ার হোটেল। নামেই বেড়ার হোটেল, লোকের মুখে যে নাম স্থায়ী হয় আর কী! মহাজনপাড়ায় কি আর মহাজনরা থাকে, নাকি দপ্তরিপাড়ায় দপ্তরি? বেড়ার হোটেলের বাঁশের বেড়া কবেই চুকেবুকে গেছে। মালিক সীতাব্রত শখ করে নাম রেখেছিল— দয়াময়ী ভান্ডার, তা দয়াময়ীর দয়ায় বেড়ার হোটেল নামটাই টিকে রয়েছে। এই বেড়ার হোটেলে পরোটা ভাজত শিরোমণি। বসে থাকলেও তার চেহারার দিকে চোখ পড়লে বোঝা যেত লোকটা দীর্ঘকায়, বাহু দুটিই বেঁটেখাটো লোকের পুরো হাতের মতো দীঘল। নাকটা লম্বা, মুখের আড়া লম্বাটে। তার চোখ ভাসা ভাসা, চাউনি ম্লান, বসা হনু। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন ঝিমিয়ে রয়েছে, দিবাস্বপ্ন দেখছে। দীঘলা, পলকা শরীর আর ওই শূন্যমনা চেহারার জন্য অল্পবয়সে কোত্থাও চাকরি হচ্ছিল না তার, বেগতিক দেখে বুড়ো বাপ তাকে বেড়ার হোটেলে ঢুকিয়ে দিল। বাসন ঘষবে, ময়দার কাঁই মথবে, লুচি-সিঙাড়া ভাজবে।
বেতন কম দিলেও সীতাব্রত আদরই করত তাকে। প্রথম দেখায় যত বেকুব মনে হয়েছিল শিরোমণিকে, দেখা গেল কাজের বেলায় ততটা সে নয়। তার নিজের কীসব তুকতাক ছিল— পরোটা ফোলাতে সামান্য গুঁড়ো দুধ দিয়ে মাখত, লুচির ময়দায় দিত দই। রান্নার হাতটা তার খাসা, চটপট সব শিখে নিত। ডাল-ভাত-মাছের ঝোল তো বটেই, রান্নার পুরনো লোক নিতাইয়ের দেখাদেখি নিরামিষ চচ্চড়ি-মুড়িঘন্ট-খাসির মাংস এমনকি দই-মিষ্টি-মালপোয়া সবই। জিজ্ঞেস করলে একগাল হেসে বলত, ‘ওই হামার কত্তামা-র দান, ড্যানহাতখান!’ তা তার কত্তামা-কেই বা কে শিখিয়েছিল এমন রান্না? শিরোমণি মাথা চুলকায়, নাকি মিষ্টি দইয়ের সাঁজ আসে টক দই থেকে, টক দই আসে আরেক টক দই থেকে, তা দুধকে দই বানায়, কোন আদি দম্বল তা কে-ই বা জানে? লোকের মুখে বেড়ার হোটেলের রান্নার নাম ছড়াতে দেরি হল না। কোন অজ্ঞাত মশলার স্বাদ সামান্য সিঙাড়াকে ওরকম অমৃতলৌকিক করে তুলতে পারে, মুচমুচে খোলস, ভেতরে থসথসে পুর— স্বাদের আকাশে রাঁধুনি-জিরা-মৌরি-সরিষার রকমারি বাজি পুড়ছে। শীতকালে ফুলকপি-মটরশুঁটির খাস্তা সিঙাড়া, বাকি বছর আলু-চিনাবাদামের। নাজমা বোর্ডিং-এর সফদর বিহারি বেড়ার হোটেলের সিঙাড়ার নাম রেখে দিল দিলখুশা সিঙাড়া। শুধু শিরোমণির হাতের সিঙাড়া বেচেই লাল হয়ে গেল সীতাব্রত, নিতাইকে সে ছাড়িয়ে দিল।
৩.
ছেলেকে তড়িঘড়ি বিয়ে করিয়ে দিল সোনামণি দাস। মাটিফাটা গরমে গনগনে উনুনের পাশে দিনরাত খাটছে, শরীরে উনুন জ্বলতে কতক্ষণ! বিয়েতে তেমন খরচাপাতি করতে পারল না সে। এ সংসারে সোনামণি অনেকগুলো বোনকে পেলেপুষে তারপর একদিন রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়া নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়েছে। বোনরা অবশ্য আর তাদের বিয়ে দিতে দিতে প্রায়-নিঃস্ব বড়দার খোঁজ রাখে না। সোনামণি দাসের মা, কৃষ্ণমণিকে মাঝে মাঝে ভোরবেলা থেকে ছেলের আলো-ছায়ায় ডুরে মাটির দাওয়ায় উবু হয়ে কাঁদতে দেখা যায়, হারানো মেয়েদের পুরনো শাড়ির পাড় চিরে চিরে সুতো বের করে আঙুলে জড়ায়, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে—‘খ্যাঁতা শিলামো ব্যলে সুতা তোলোচি!’ আসলে সেদিন চোখের জলে কৃষ্ণমণি চোখে ঝাপসা দ্যাখে, সুতো পরাতে সুঁই খাঁড়া করে ধরতে পারে না।
কনে পলারাণিকে দেখে প্রথমে মন খচখচ করছিল শ্বশুর সোনামণির। চেহারা না সুন্দর, না কুশ্রী, চালের রুটিতে সেঁকা দাগের মতো মুখের দু’পাশে ফিকে মেচেতার দাগ। অভাবের সংসারে বড় হয়েছে বলে ভাজা ফুটকলাইয়ের মতো রসকষহীন হাত পা, মাথায় খাটো। তা গোটা কয়েক ছেলেপুলে হলেই বদলে যায় মেয়েমানুষের স্বাস্থ্য, ও নিয়ে অত ভাবার কী আছে। ওরকম টনটনে হাত পা মানেই কর্মিষ্ঠ মেয়ে, গৃহলক্ষ্মী হবে এমন— সোনামণিকে বলে দিয়েছিল সোনামণির বউ বিরাজবালা। নাতবউয়ের খটখটে শরীরে, যাত্রাপালার মেয়েলোকের মতো বড় বড় দুদ দেখে বুড়ি অবশ্য কু-কথা কয়েছিল, তাতে কী! অন্ধকারে পলাকে ঘেঁটেঘুঁটে অবশ্য শিরোমণির খুব মনে ধরেছিল, প্রাচীন আমবাগিচায় ঢুকেছে যেন, ঘন অন্ধকারে যেখানে যা থাকবার সেখানে তাই ফলে রয়েছে, পরিপাটি, গোছানো। দিনের আলোয় হাসির আভাসটুকু ঘুমটি নদীর ওপরকার মেঘের ছায়ার মতো কেমন পলার মুখের ওপর বয়ে যায়। দাঁতের পাটি কিন্তু কুন্দফুলের মতো সাদা, হাসলে তাকে ভালই দেখায়। ক’দিন কয়লার আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলল তাদের পরস্পর-তৃষিত শরীর। কৃষ্ণমণি বুড়ি একা একা সজনেগাছের ছায়ায় বসে ফোকলা দাঁতে হাসল আর পাতার আড়ালে নিরুদ্দিষ্ট পাগলা কোকিলটাকে যেন শুনিয়ে বলল, ‘পরমান্ন জুড়ালে যোমে!’ পান খেয়ে খেয়ে ভেন্নার বিচির মতো লাল লাল দাঁত হয়েছে বুড়ির।
গরিবের ঘরে ঠান্ডা পরমান্নটুকু জমল নাকি টকে গেল বোঝা গেল না। শিরোমণি গেল বেড়ার হোটেলে দিস্তা দিস্তা লুচি ভাজতে। আর পলারাণি গেল ঘুমটি নদীতে রেণু পোনা ধরতে। বছর ঘুরতে একটা মেয়ে হল তাদের। পরের বছর আরেকটা। নিত্যদিনের দারিদ্র সইতে সইতে সকাল-সন্ধ্যার ষোলআনি মাত করে একে অন্যকে বাপান্ত করতে শুরু করল তারা, শিরোমণির মুখ তত চলে না, পলারাণি কলহ পটু মেয়েলোক। কৃষ্ণমণি এহেন শাপ-শাপান্তে একেবারে বোবাকালা হয়ে পাটকাঠিতে গোবর জড়িয়ে শুকানো ঘুঁটে জুতে দিত চুলায়, ভুলেও বলত না, কী কচলালে তেতো হয়। কখনও গলা নামিয়ে সে পুত্রবধূ বিরাজবালাকে উদ্দেশ্যমূলক ও বিবরণধর্মী ধর্মকথা শোনাত— যে পুতনা রাক্ষসী বুকে বিষ মেখে এসে কৃষ্ণ ঠাকুরকে বুকের দুধ খাওয়াতে গেছিল, ব্রজের লোকে তার রূপ দেখে প্রথম সাক্ষাতে লক্ষ্মী বলে ভুল করেছিল।
৪.
সেদিন সকালের আলো উদাসীন। বহুদূরে বৃষ্টি নেমেছে দেখা যায়, যেন ভেজা মোটা কাগজে ধূসর জলরঙ চুঁইয়ে পড়ছে আকাশ থেকে। এদিকে বৃষ্টি নামবে এমন মনে হচ্ছে না। অকাল বর্ষণের রাতের পর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় ছোট বড় গর্তে জল জমে রয়েছে, সেই জলে উঁকি দিচ্ছে এদিককার আকাশের আততায়ী নীল। স্টুডিও রূপছায়া বদলে মোবাইল সারাইয়ের দোকান হয়েছে, তৈমুর হোসেন বসে সকাল-সন্ধ্যা সেখানে, সেই তৈমুর সকালের নাশতা করতে এল হোটেলে। লুচি-তরকারি খেতে খেতে সে-ই প্রস্তাব দিল শিরোমণিকে, ‘মুণিদাদা, এত ম্যানষে তোমার হাতের রান্না খায়ে, হুটালের নাম করে আর পকেট ভারী হয় সীতুকাকার। তুমি ব্যাক্কল ছাগোলের তিন নোম্বর ছাও, দুধ না প্যায়েও খ্যালি ল্যাজা লড়াও। এ্যাটা হুটাল তুমি এ্যাকলাই খোলিন না ক্যা?’
‘হয়, হুটাল খোলমো! জলপান খিলামো। হামি তো জুমিদার।’
‘কাঙ্গালিভোজ তো দিবা কঁওনি। কচোঁ এই হাত লিয়ে তুমি নিজে কেছু করিন না ক্যা?’
এদিক ওদিক তাকিয়ে শিরোমণি দেখবার চেষ্টা করল কেউ ও কথা শুনতে পেল কি না, মালিকের কানে গেলে আর উপায় থাকবে না।
‘হামার তবিল কোন্টে যে হুটাল খুলে বসমো?’
এর উত্তরে তৈমুর তহবিল তথা মূলধন বিষয়ক একটা অশ্লীল জবাব করল, খানিক পরে শিরোমণির অপ্রস্তুত মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘রাজ্জাক মিঞা ইস্টিশোনত খোলা আসমানের লিচে পরোটা বেচে লাল হ্যয়া যাওচে, তুমি তাকে দ্যাখোচিন না? উজ্জুগই আসোল কতা। আর খ্যাটনি! তুমি তো এটে ম্যানষের হ্যয়া ব্যাগার খাটোচিন!’
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল শিরোমণি, তৈমুরকে আর দুটো গরম লুচি দিতে ইশারা করল মা-মরা ভাগ্নে রতনমণিকে। তৈমুর লুচিতে থালার কিনারার তরকারির মশলা মুছে নিতে নিতে বলল, ‘দ্যাখনের দ্যুনা এ্যাখোন। তুমি তুমার রান্না দ্যাখামিন, হামি লগদে ভিড্যু ক্যরে ইউটিউবত তোমার রান্না ছ্যাড়ে দিমো। ট্যাকা আসা আরোম্বো ক্যল্লে আদ্দেক তোমার, বাকি আদ্দেক হামার।’
মামা শিরোমণি ইউটিউবের নাম না শুনলেও দেখা গেল ভাগ্নে রতন ইউটিউব কী তা জানে। সে আওয়াজ দিয়ে উঠল, ‘হয় হয়, ইউটিউবত শ্যল মাছ দিয়ে কদু ঘাঁটি বানালেও আফির তিরিশ লাখ ম্যানুষ চায়ে দ্যাকে।’
‘দেখপেই তো। চায়ে দেখার জোমানা আসিছে।’— তৈমুর খুশি হয়ে উঠল রতনের ওপর।
অনেক বেলা অব্দি তারা পরামর্শ করল, যেসব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় কেবল যোগ আছে আর গুণ আছে, সেরকম ভবিষ্যৎ চোখের সামনে যেন নেচেই উঠল তাদের। দুপুরে তৈমুরকে ভরপেট ভাত, কোয়েলের মাংস, মুগডাল দিয়ে মাছের-মাথা খাইয়ে শিরোমণি সীতাব্রতর কাছে গিয়ে বলল, তার বেতন থেকে এ টাকা কেটে রাখতে। এ-বেলা ঝড়জল হয়ে গিয়ে মেঘ তবু ঘনিয়ে আছে। বৃষ্টিভেজা আকাশ ঘেঁষে দুটো টিয়া ভিজতে ভিজতে উড়ে গেল, হাতের কাজগুলো সারতে সারতে ভাবুক চোখে টিয়াগুলোর চলে যাওয়া দেখল সে, চাপা লাগা প্লাস্টিকের পুতুলের মতো চ্যাঙা চ্যাঙা শব্দ করতে করতে গেল তারা। সে শুনতে পেল, ট্যাকা ট্যাকা।
রাতে ফেরার পথে সব ঝাপসা লাগছিল শিরোমণির, সারাদিনের পরিশ্রমে, পরিকল্পনার উত্তেজনায়। সাইক্লোনের সময় যে বোকা জেলে তীরে ফিরে আসতে পারেনি, তার নৌকোর মতো দুলছিল তার মন। হাতের টর্চটা আলপথে এলোমেলো ফেলতে ফেলতে সে বাড়ির পথ ধরল, পাগলা কুকুর বের হয়েছে বাজারের রাস্তায়। তার বাড়ি ফেরার সময় মুখস্ত হলেও উত্তরের ঘর থেকে বুড়ি কৃষ্ণমণি ঘুমভাঙা ভয়-জড়ানো গলায় ডেকে উঠল, ‘কে অটে! অটে কে!’ সে তখনও শুনল— ট্যাকা ট্যাকা।
৫.
তবু আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে বৃহস্পতিবার দিনকে কথা পাড়ল শিরোমণি, পাত্তাই দিল না রাজ্জাক তাকে।
‘ব্যবসা-বাণিজ্য অক্তের মদ্যে থাকা লাগে। তোমার বাপদাদা চদ্দগুষ্টিত কেউ বাণিজ্যো করিচে?’
শিরোমণি মাথা নাড়ে।
‘ট্যাকাপয়সা আচে? মাথাত বুদ্দি আচে? মালুকেরে অবোশ্য দুডাই থাকে।’
সেদ্ধ আলু ময়দায় ডলে খামির তৈয়ার করতে করতে রাজ্জাক তাচ্ছিল্যের হাসি দিল, ‘নিত্যিদিন পরোটার এই ময়দা আর আলু তো কিনাই লাগে, সাথে ধ্যুনাপাতাও কিনা লাগে। কাঁচাঝাল, পিঁয়াজ, তিল, স্যরষা, বাদাম, এল্যা ভত্তার যোগাল দিতেই কিনা লাগে হয় দশ পদের মাল। তারপাছে খাওয়ার ত্যাল, শুকনা খড়ি আচে। দিনে আড়াইশ থ্যাকে তিনশ ম্যানষে খায়। দৈনিক খরচা ধরিন আঠারশ ট্যাকা। ক্যাংকা করে জোটাবিন মুণি পয়সা ছাড়া? বাপক যায়ে কও খুঁতিত থিনি সোনার মোহর ব্যার ক্যরে দেক। না হ্যলে তোমার দাদীক পিদ্দনের মালাকোনা বেচপার কও!’
বিকেলের কাস্টমাররা ভিড় করতে শুরু করবে শিগগিরই। ইস্টিশনের যাত্রীর টিফিন-ক্যারি। বাসাবাড়ির পার্সেল। রাজ্জাক হাতের ভঙ্গি করলে চিন্তিত মুখে উঠে পড়ল শিরোমণি।
বাজারের মোড়ে ফকির চিক্কুর পেড়ে ভিখ মাঙছিল। ঘড়ি-কলম সারাইয়ের দোকান আর জামাইবউ টেইলার্সের মাঝখানে রূপছায়া স্টুডিও। তা স্টুডিও তো আর নেই, মোবাইলের দোকানটার ওপরই রূপছায়ার পুরনো ধুলো ভরা সাইনবোর্ড খানা ঝুলছে। ভরদুপুরে পেছনদিকের ঘরে প্রিন্সেস বিউটির কিছু আধাশৈল্পিক ভিডিও করছিল তৈমুর। শিরোমণি সরু পাছগলিটা দিয়ে সেখানে হাজির হতে বডিসের হুক আটকাতে আটকাতে বিউটি শীল গালাগালি করে উঠে পড়ল। মণিদাদা এত বেয়াক্কেল! তার পিঠে হাত রেখে কিংবা বলা ভাল খানিকটা ধাক্কাতে ধাক্কাতে, বিরক্ত মুখে মেসার্স মন্ডল ট্রেডার্সের সামনে এসে বসাল তৈমুর, বিড়ি ধরাল। শিরোমণি প্রায় কাঁদোকাঁদো গলায় হুবহু রাজ্জাকের ভঙ্গিতে বলল, ‘হাতত ট্যাকা পয়সা আচে? মাথাত বুদ্দি আচে? হামার তো কুনুটাই নাই। বাণিজ্যোত হামার কাম কি?’
এসব লক্ষণ ঢের চেনে তৈমুর, এ হল— ‘আবার সাধিলে খাইব’। বাজারে তোতামিয়ার ডালপুরির দোকানে গিয়ে বসল ওরা দুজন। নিজের ফোনে ইউটিউবে বাদল মণ্ডলের গান দেখাল তৈমুর। শিরোমণি দেখল মফস্বলের সন্ধ্যার আসরে, সবুজ রঙ করা একটা ঘরে, ফুলহাতা একরঙা শার্টের ওপর হাফ সোয়েটার পরা বাদল মণ্ডল সুরশ্রীর হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছে— ‘বাঁশি বাজায় কে কদমতলায় ওলো ললিতে’। হারমোনিয়ামের ওপর মানিপ্ল্যান্টের লতার ফুলদানি বসানো। পাশে মৃত্যুঞ্জয় তবলা বাজাচ্ছে। ঘরোয়া ভিডিও। সে স্বগতোক্তি করল, ‘মোণ্ডল ভালই গাওচে!’
‘তুমি যে কুনু কামের লয় মুণিদাদা। গান শুনবা ক্যচি? লিচে তাকাও। এই ভিড্যু দশ হাজার ম্যানষে দেখিচে।’
মানে কী? লোকে দেখলে শিরোমণি টাকা পাবে কী করে?
ক্যান, সে কি দ্যাখে নাই, লোকে সিনেমা দ্যাখে বলে সিনেমার নায়ক-নায়িকার কত পয়সা হয়? লোকে ফুটবল দ্যাখে, লোকে যাত্রা দ্যাখে, লোকে বান্দর নাচ দ্যাখে, লোকে সার্কাস দ্যাখে, ইয়ে লোকে বিউটি শীলের নাচ দ্যাখে, লোকে যাই তাকিয়ে দ্যাখে, তাতেই পয়সা— বেকুবকে এই সমীকরণ বুঝিয়ে বিদায় করল তৈমুর।
(চলবে)
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত