ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছায়ায় আবৃত সূর্য


    আবীর ভট্টাচার্য (September 9, 2023)
     

    আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় দশক আগেকার কথা। স্টুডিও-ফ্লোরে তখন কানন দেবীর ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদিদি’-র (১৯৫৯) শুটিং চলছে। সাপুড়ে শাহজির ডেরায় কীভাবে দামাল-দস্যি ইন্দ্রনাথ নিজের হাতে করে সাপ ধরবে, সেই দৃশ্যগ্রহণের তোড়জোড় চলছিল। ঠিক ছিল, এর জন্যে সত্যিকারের সাপের কাছে না গেলেও, ক্লোজ-আপ শটের কারসাজি এমন হবে, মনে হবে যেন অভিনেতা স্বয়ং নিজের হাতে করেই সাপটা সরিয়ে দিল। কিন্তু ‘অ্যাকশন’ শোনামাত্রই, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইন্দ্রনাথ-বেশী সেই তরুণ তাঁর দুই হাত দিয়ে সাপের মাথাটা চেপে ধরল। সদ্য জঙ্গল থেকে ধরে আনা ময়ালটার লেজ আছড়ানো দেখে সকলের তো শিউরে ওঠার অবস্থা! এরপর পরিচালকের বকা খেয়ে সেই অভিনেতার সেদিন উত্তর ছিল, ‘বইতে তো সাপ ধরার কথাই আছে!’ সেদিনের সেই তরুণই ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী পার্থপ্রতিম চৌধুরী। স্রোতের বিপরীতে ভাসা এই মানুষটা ‘ছায়াসূর্য’ (১৯৬৩) কিংবা ‘যদুবংশ’-র (১৯৭৪) মতন আশ্চর্য সব ছবি একদা আমাদের উপহার দিয়েও আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেছেন।

    গড়পড়তা ছায়াছবি-দর্শক বরাবরই গতানুগতিক গল্পপ্রবাহের প্রতি সহানুভূতিশীল। তার বাইরে কেউ কিছু করলেই যেন একটা সযত্নে সাজানো দেওয়াল থেকে সব ইট হুড়মুড়িয়ে খসে পড়বে। নিটোল ছাঁচে ফেলা গল্প বলার এই ধরনের বাইরে এসে বাংলায় কিংবা ভারতবর্ষে আজ যাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, তাঁদের অন্যতম পূর্বসূরি যে পার্থপ্রতিম, এই কথাটা বোধ হয় সোচ্চারে বলা হয়নি কখনও।

    স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘পার্থদার ছবি মানে সেখানে চিত্রনাট্য রচনা থেকে ক্যামেরা অপারেট করা থেকে সুর, সব সে নিজে করত। যেমন সুন্দর হস্তলিপি, তেমনই আঁকার হাত। নিজে দক্ষ অভিনেতা হওয়ার সাথে অভিনয় পরিচালনারও একটা সহজাত ক্ষমতা ওঁর মধ্যে ছিল।’ অভিনেতা দিলীপ রায়ের কথা ধার করে বললে, বাঙালি পরিচালকদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় ও নির্মল দে ছাড়া একমাত্র পার্থপ্রতিমই ছিলেন যিনি ছবি তৈরির সমস্ত বিভাগে দখল রাখতেন। এছাড়াও ছিল তাঁর বহু বিচিত্র বিষয়ে পারদর্শিতা। নাট্যকার, কবি, প্রাবন্ধিক, গীতিকার— এমন আরও কত পরিচয়!

    শ্রীমতী পিকচার্সের ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদিদি’ ছায়াছবিতে ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত চরিত্রে যথাক্রমে পার্থপ্রতিম (বাঁয়ে) ও সজল ঘোষ

    ১৯৫৪-’৫৮। স্কটিশ চার্চ কলেজে কাটানো এই সময়েই পার্থপ্রতিমের ছায়াছবি ও নাট্যজগতে আগমন। ইন্টারমিডিয়েটের সময় থেকেই ওঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল পরবর্তীকালের প্রখ্যাত নাট্যকার-অভিনেতা মনোজ মিত্র-র সঙ্গে। পরে একই কলেজে তিনি বাংলা এবং মনোজবাবু দর্শনশাস্ত্র নিয়ে পড়েছিলেন স্নাতকস্তরে। আলাদা বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করলেও ওঁদের বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ থেকে যায়। নাটকের পাশাপাশি পার্থপ্রতিম যখন ছায়াছবির জগতেও পা রাখবেন বলে মনস্থির করেন, তখন তাঁর বাবা-মা আপত্তি জানাননি। শুধু শর্ত দিয়েছিলেন যাতে বি.এ. পড়াটা বন্ধ না হয়। ছেলে সেই বিষয়ে আশ্বস্ত করায়, এরপর বাবা নিজেই ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে যান তখনকার এক নামী পরিচালকের কাছে, যিনি লেকপল্লিতে থাকতেন ওঁদের কয়েকটা বাড়ি পরেই।

    সত্যজিৎ রায়-কে এক প্রকার আদর্শ মেনে চললেও পার্থপ্রতিমের হাতেখড়ি হয় আরেক মানিকদা অর্থাৎ পরিচালক অসিত সেনের ‘পঞ্চতপা’, ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’-এর মতন একাধিক ছবির সহকারী পরিচালক হিসেবে। নির্মলকুমারের কথায়, অসিত সেন তাঁর তরুণ সহকারীর উপর ছবির অভিনয় অংশে অনেকখানি নির্ভর করতেন। এই সময়ে অসিত সেন ছাড়াও রাজেন তরফদার, চিত্ত বসু, মঙ্গল চক্রবর্তী, বিজয় বসু, প্রভৃতি অনেক পরিচালকেরই ছবিতে অভিনেতা পার্থপ্রতিমের আবির্ভাব ঘটে। একইসঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে নাট্যচর্চাও। কলেজের প্রথম বর্ষেই নিজের নাটক ‘সংঘাত’ নিয়ে শিশির ভাদুড়ীর শ্রীরঙ্গম-এ সদলবলে অভিনয় করে এসে ১৯৫৭ সালে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে তিনি খুলে ফেললেন নিজেদের নাট্যদল ‘সুন্দরম’। শ্যামবাজারের কাছে একটা দিন-চুক্তিতে ভাড়া নেওয়া ঘরে যার সূচনা হয়েছিল, সেই দল আজ দেশের পুরনো প্রতিষ্ঠিত নাট্যদলগুলোর মধ্যে অন্যতম।

    সুন্দরম-এর নামকরণ নিয়ে একটা ইতিহাস আছে। নবনির্মিত দলের কী নাম হবে, সেই নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিলে তাঁরা সকলে শরণাপন্ন হন পার্থপ্রতিমের পিতা বিশ্বনাথ চৌধুরীর কাছে। পেশায় উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী, নেশায় সাহিত্যিক বিশ্বনাথবাবু শুধু নিজের বন্ধু সুভো ঠাকুরের ‘সুন্দরম’ পত্রিকার থেকে দলের নামই রাখেননি, সেই সঙ্গে দলের প্রথম সভাপতির দায়িত্বও সামলেছিলেন।

    ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮। সুন্দরম-এর প্রথম প্রযোজনায় বিশ্বরূপার মঞ্চে কাশবনের মধ্যে দিয়ে রেলগাড়ি ছুটল। নামে ‘পথের পাঁচালী’ হলেও পার্থপ্রতিমের নাট্যরূপের ব্যাপ্তি ছিল অপু-দুর্গা থেকে অপু-কাজল অব্ধি। অপু আর তার বন্ধু প্রণবের ভূমিকায় যথাক্রমে পার্থপ্রতিম-মনোজ ছাড়াও সেই নাটকের জনা পঞ্চাশেক অভিনেতাদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন, যাঁরা পরবর্তীকালে নিজ-নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল, যেমন মূকাভিনেতা যোগেশ দত্ত কিংবা পরিচালক নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়। সেই দিনগুলো মনোজবাবুর স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমি তখন মূলত গল্পই লিখতাম আর পার্থ বরাবরই আমাকে ইন্সপায়ার করত নাটক লিখতে। এমনি করেই এক প্রকার ওঁর তাড়নায় বাধ্য হয়েই আমি লিখে ফেলি আমার প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’। পার্থর নির্দেশনায় ১৯৫৯ সালে নাটকটি তরুণ রায়ের থিয়েটার সেন্টারের প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃতও হয়।’

    যৌবনে পার্থপ্রতিম
    চিত্র সৌজন্য : মনোজ মিত্র

    এ-কথা হয়তো অনেকেরই অজানা যে, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এরও বছর সাতেক আগে মনোজ মিত্রর রূপোলি পর্দায় প্রথম আবির্ভাবের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল পার্থপ্রতিমের। চিদানন্দ দাশগুপ্তর ‘বিলেত ফেরত’-এর বেশ কিছু দৃশ্য গৃহীত হয় নিউ আলিপুর কলেজে, যেখানে মনোজ মিত্র তখন অধ্যাপনা করতেন। একবার কোনও দৃশ্যে এক অভিনেতা যথা সময়ে অনুপস্থিত থাকায়, এ-ছবির সহযোগী পরিচালক পার্থপ্রতিমের অনুরোধে তাঁর বন্ধুই সেই শূন্যস্থান ভরাট করেন। নিতান্তই এক ঝলকের জন্যে দেখা গেলেও কোনও ছায়াছবির পরিচয়লিপিতে মনোজবাবুর নাম সেই প্রথম দেখা গেছিল!

    ফিরে আসা যাক ষাটের দশকে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্প ‘হয়তো’ অবলম্বনে তাঁর লিখিত চিত্রনাট্য দিনের আলো না দেখলেও, পার্থপ্রতিমকে প্রযোজক পেতে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। ‘ছিন্নমূল’ ছবির প্রযোজক বিমল দে, যিনি পরবর্তীকালে আর. ডি. বনসলের প্রযোজনা সংস্থার সর্বাধ্যক্ষ হন, ছিলেন পার্থপ্রতিমের আপন মামা। চুক্তি অনুযায়ী আর.ডি.বি-র অংশীদার না হলেও, ছবির গল্প থেকে পরিচালক নির্বাচনের মতন অনেক বিষয়েই বিমলবাবুর মতামতের একটা গুরুত্ব ছিল। আশাপূর্ণা দেবী রচিত ‘ছায়াসূর্য’ গল্পটার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু চরিত্রের সংযোজন ঘটিয়ে পার্থপ্রতিম যে-পরিবর্ধিত চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, তা আর. ডি. বনসলের পছন্দ হয়। পরিচালক-ভ্রাতা ইন্দ্রনীল চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘শ্যামবর্ণা ঘেঁটুর ভূমিকায় দাদার পছন্দ শর্মিলা ঠাকুর শুনে বনসল সাহেব বলেন যে, ও অভিনয় করতে রাজি হলে আমিও রাজি। তখন সদ্য ‘অপুর সংসার’ আর ‘দেবী’-তে অভিনয় করা শর্মিলার সঙ্গে দাদার খুব হৃদ্যতা থাকার দরুন ওঁর ‘কন্সেন্ট লেটার’ পেতে দেরি হয়নি।’

    অনন্ত দাসের কাছে শর্মিলা ঠাকুর ‘ছায়াসূর্য’-র ঘেঁটুর মেক-আপ নিচ্ছেন
    চিত্র সৌজন্য : ‘সিনেমা জগৎ’ পত্রিকা

    একটা বাচ্চা ও বেড়ালকে কেন্দ্র করে ছবির একটা দৃশ্য নিয়ে সেই সময়ে বিস্তর কথা-চালাচালি হয়। ন্যাড়া ছাদের ওপর এই দৃশ্যগ্রহণ সম্পর্কে বিশদে জানতে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় পরিচালককে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। তরুণ দত্ত সম্পাদিত এই রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার দৃশ্যই পরবর্তীকালে কলকাতার এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ব্রেথলেস’, ‘চারুলতা’-র মতন ছায়াছবির দৃশ্যের সাথে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিছু সম্পাদিত দৃশ্য হিসেবে পাঠ্যক্রমে স্থান পেয়েছিল। এবং আরও আশ্চর্যের যা, পাহাড়ী সান্যাল, মলিনা দেবী, বিকাশ রায়, অনুভা গুপ্ত, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলকুমার, রবি ঘোষদের মতন দিকপাল অভিনেতাদের নির্দেশনা দেওয়ার সময়ে পার্থপ্রতিমের বয়েস ছিল মেরেকেটে তেইশ কি চব্বিশ!

    .
    ভি. বালসারা যখন ১৯৫৪-তে স্থায়ী ভাবে কলকাতাবাসী, ততদিনে তিনি বাংলা অনেকখানি রপ্ত করে ফেলেছেন। নানান গানবাজনার রেকর্ড শোনার ফাঁকে, একদিন তিনি নির্মলেন্দু লাহিড়ীর কণ্ঠে ‘দেবতার গ্রাস’-এর আবৃত্তি শুনলেন। আর সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর শিল্পীমনে একটা নতুন প্রশ্নের উদ্ভব হল। তিনি ভাবলেন, কেমন হত যদি কবিগুরুর এই সৃষ্টি নিয়ে একটা অর্কেস্ট্রেশন করা যায়! যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। সেই দুঃসাহসী উপস্থাপনা পেশ করতে তিনি নিউ এম্পায়ারের মঞ্চের উপর বসালেন চাঁদের হাট। সেখানে মূল কবিতা পাঠ করলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। স্লাইড আকারে পর্দার উপর কবিতার বাণী ফুটিয়ে তুললেন তাপস সেন। অবাঙালি শ্রোতাদের জন্য ইংরেজিতে কবিতার সারাংশ পাঠ করলেন শম্ভু মিত্র। প্রায় আশিজন যন্ত্রসংগীতশিল্পী-সমৃদ্ধ এই সাংগীতিক রূপায়ণ কলকাতার সাংস্কৃতিক জগতে আলোড়ন তুললেও আর্থিক দিক থেকে বালসারা সাহেব ঠিক কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। সব মিলিয়ে প্রতি শোয়ের পর তাঁর প্রায় আনুমানিক দুই হাজার টাকার মতন লোকসান হতে লাগল। ফলে হাতেগোনা কয়েকটা শোয়ের পর এই প্রযোজনায় ইতি টানতে তিনি বাধ্য হন।  

    তবে ‘দেবতার গ্রাস’-কে আরও নানান আঙ্গিকে মুড়ে ভি. বালসারা পরিবেশন করেছিলেন। কখনও অরুণাভ মজুমদারের মূকাভিনয় সহযোগে তো কখনও শম্ভু ভট্টাচার্যের ব্যালে নৃত্যর সঙ্গে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে সঙ্গে করে তিনি একটা রেকর্ডও বার করেন। রবি ঠাকুরের এই কাব্যকাহিনির প্রতি তাঁর বিমুগ্ধতার রেশ কিছুতেই কাটেনি। শেষমেশ তিনি আসরে নামলেন ‘দেবতার গ্রাস’ নিয়ে একটা ছায়াছবি প্রযোজনা করতে।

    সমসাময়িক পত্রিকা থেকে জানা যায়, ‘ছায়াসূর্য’-র পর সৌমিত্র-শর্মিলা কে নিয়ে ‘বনপলাশির পদাবলী’ করার কথা ভেবেছিলেন পার্থপ্রতিম। সেই পরিকল্পনা কোনও কারণে বাস্তবায়িত না হওয়ায় ভি. বালসারা তাঁকে ‘দেবতার গ্রাস’ পরিচালনা করার প্রস্তাব দেন। ছবির দৈর্ঘ্য বাড়াতে পার্থপ্রতিম তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটা ছোটগল্প যোগ করে ‘সাজ-ও-আওয়াজ’ ব্যানারে তৈরি করলেন তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘সুভা ও দেবতার গ্রাস’ (১৯৬৪)।

    ‘সুভা ও দেবতার গ্রাস’ ছায়াছবির প্রচার-পুস্তিকা

    সমর সেনের ‘নাও’ পত্রিকায় এ-ছবির সমালোচনা করতে গিয়ে উৎপল দত্ত যা লিখেছিলেন, তাঁর বাংলা ভাষায় তরজমা করলে দাঁড়ায়, ‘ভারতবর্ষের মাস্টারপিস ছবি করিয়েদের যে ছোট্ট দুনিয়ায় এতকাল যাবৎ সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণালদের একাধিপত্য ছিল, অনাহুত পার্থপ্রতিম ‘সুভা’-র মাধ্যমে সেখানেই পদার্পণ করেছেন।’ উৎপলবাবুর মতে, সুন্দর শট নেওয়ার প্রলোভনের থেকে আরেকটু বিরত থাকতে পারলে এ-ছবি ‘পথের পাঁচালী’-র সবুজ প্রান্তরের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে সক্ষম হত।

    পার্থপ্রতিমের একাধিক ছবির কেন্দ্রবিন্দুতে বার বার স্থান পেয়েছে সমাজের এমন সব আপাততুচ্ছ, প্রান্তবর্তী চরিত্ররা, যারা প্রাত্যহিক জীবনে হয়তো আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। এক কথায় বলতে গেলে আন্ডারডগ-রাই তাঁর ছবির ভরকেন্দ্র। তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার নির্মম রূপ ফুটে উঠেছিল তাঁর সত্তরের দশকের ছবিগুলোয়। ‘যদুবংশ’, ‘শুভ, কেমন আছ?’-কে বাংলা ছায়াছবির কোন ধারায় ঠিক লাগসই ভাবে বসানো যাবে, সেই কথা ভেবে আজও যথেষ্ট বিব্রত হতে হয়!

    ৩.
    পার্থপ্রতিমের পঞ্চম প্রচেষ্টা ‘যদুবংশ’ পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়িত হতে লেগেছিল দীর্ঘ পাঁচ বছর। সরকারি, বেসরকারি প্রযোজকদের দরজায় নিষ্ফল করাঘাতের পর শেষমেশ পরিচালক নিজেই আসরে নেমে পড়েন তাঁর সীমিত পুঁজি নিয়ে। একটা পূর্ণাঙ্গ ছবির বিপুল ব্যয়ভার সামলাতে এরপর সময়ে-অসময়ে কখনও ধারকর্জ করে, কখনও-বা স্ত্রী বুলবুল চৌধুরীর গয়না বিক্রি করে, কখনও আবার চাঁদা তুলে কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে। এ-ছবির আখ্যান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তার অভিনেতৃবৃন্দের সহযোগিতার কথা না বললে। ইন্দ্রনীলবাবুর থেকে জানা যায়, “যদুবংশ’-র জন্যে অপর্ণা, ধৃতিমান, শর্মিলারা কেউ এক পয়সাও নেয়নি। এমনকী উত্তমকুমার তখন যা নিতেন তার চেয়ে অনেকগুণ কম পারিশ্রমিকেই রাজি হয়ে যান। ছবি শুরুর পর নানান দিকে অনেক টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় যখন তাঁকে দেওয়ার মতন প্রায় কিছুই বাকি নেই, তখন সব শুনে তিনি বলেছিলেন নির্দ্বিধায় শুটিং চালিয়ে যেতে। ছবি কিছুটা বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়ে লাভের মুখ দেখলে তখন টাকা মিটিয়ে দিলেই হবে। শেষমেশ দাদা সেটা দিয়ে উঠতে পেরেছিল কি না আমার জানা নেই।’

    মূল্যবোধহীন যুবসমাজের খণ্ডচিত্র ‘যদুবংশ’ আজও দর্শক ও ক্রিটিকমহলে স্মরণীয় হয়ে আছে উত্তমকুমারের অনবদ্য অভিনয়ের জন্যে। মহানায়ক-অভিনীত গণাদা নিছকই একটা পার্শ্বচরিত্র, যার পর্দায় আবির্ভাব ঘটে ছবি শুরু হওয়ার আধ ঘণ্টারও পরে। ‘যদুবংশ’-র অবশিষ্ট বিবেক গণাদার আত্মহননকে কেন্দ্র করেই এ-গল্প চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। এই চরিত্রের জন্যে পরিচালকের প্রথম পছন্দ ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি কোনও কারণে রাজি না হলে, পার্থপ্রতিম উত্তমকুমারের দ্বারস্থ হন। চিত্রনাট্য শুনেই মহানায়ক বুঝেছিলেন যে, এই ছবিতে তিনি অভিনয় দেখানোর অনেক সুযোগ পাবেন। এরপর গণনাথ-কে পর্দায় জীবন্ত করে তুলতে তিনি কখনও মাঝরাত অব্ধি শুটিং করে গেছেন তো কখনও কাক-ভোরে হাজির হয়েছেন পরিচালকের অনুরোধে।

    কলকাতায় ‘যদুবংশ’-র আউটডোরে উত্তমকুমার ও ক্যামেরাম্যান কৃষ্ণ চক্রবর্তীর সঙ্গে পার্থপ্রতিম
    চিত্রগ্রাহক : সন্তোষ ঘোষ

    কেমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সবাইকে কাজ করে যেতে হয়েছিল তা বোঝা যায় ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা শুনে, ‘ছবিতে যে একটা বাড়ি দেখানো হয়েছিল তা ছিল বরাহনগরে। রোজ যাতায়াতের খরচা বাঁচাতে আমরা অনেকেই তখন ওর কাছেই একটা কুয়োসমেত টালির ছাদের বাড়িতে থেকেছি। ছবিতে একটা রাতের দৃশ্য ছিল, যেখানে আমরা অনেকে মাঠের মধ্যে বসে আড্ডা দিচ্ছি আর ব্যাকগ্রাউন্ডে রেললাইন দিয়ে একটা ট্রেন চলে যাচ্ছে। সেই দৃশ্যগ্রহণের জন্যে পর্যাপ্ত অর্থ-সামর্থ্য না থাকায় হ্যাজাক বাতি দিয়েই তখন লাইট করতে হয়েছিল।’

    এরপরে নতুন উদ্যম নিয়ে অপর্ণা সেন কে মুখ্য ভূমিকায় রেখে নির্মিত ‘কৃষ্ণপক্ষ-র’ গানের রেকর্ড ১৯৭৩ সালে প্রকাশ পেলেও, এই ছবি নানান কারণে শেষপর্যন্ত আর মুক্তি পায়নি। তবে তাতে নিরুদ্যম না হয়ে, শুরু করেন ‘নাগরিক’, পরে যার নাম রাখা হবে ‘ক্যানভাস’। এই ছবি নিয়ে পার্থপ্রতিম লিখেছিলেন, ‘প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার নৈকট্যে প্রায় স্বপ্ন পাওয়া। চিত্রনাট্য লেখার সময় ছবির নায়ক শুভব্রতই যেন আমাকে জোর করে লিখিয়ে নিয়েছিল কথাসংলাপ, অথবা হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছিল ছবি চিত্রায়িত করার পরিবেশে। অথবা ধরুন ক-দিনের জন্যে আমিই হয়ে গেছিলাম শুভব্রত।’ বাঙালি দর্শক এমন ক্রুদ্ধ মেজাজের ছবি হয়তো গ্রহণ করবে না তিনি জানতেন, তবুও সমাজ ও সমাজব্যবস্থার প্রতি তাঁর যত ক্ষোভ, প্রতিবাদ, জ্বালা ছিল— সব যেন তিনি গলগল করে উগরে দিয়েছিলেন নায়ক ধৃতিমানের মুখ দিয়ে।

    মুক্তি না পাওয়া ‘কৃষ্ণপক্ষ’ ছায়াছবির রেকর্ড কভার
    চিত্র সৌজন্য : সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য

    ‘ক্যানভাস’-এর যাত্রাপথও খুব একটা সুগম হয়নি। আবারও একরাশ প্রতিকূলতা। অর্থ জোগানে হিমশিম। ঠিক যেন সেই ‘যদুবংশ’-এর পুনরাবৃত্তি। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা শুটিং এক সময়ে সম্পন্ন হলেও এই ছবির ভাগ্যে বাণিজ্যিক মুক্তি লেখা ছিল না। ছবির নায়ক থেকে শুরু করে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে, তাঁদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রম হয়তো কোনওদিনও দর্শকের সামনে আসবে না। সেটাই হয়তো ঘটত, যদি না কিছু মানুষ তাঁদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসে ছবির রিল জোগাড় করে, ল্যাবরেটরিতে ধোলাই করে, সেন্সরের জন্যে পাঠানো থেকে শুরু করে সব বন্দোবস্ত করতেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ নব্বইয়ের দশকে উত্তরপাড়া সিনে ক্লাবের উদ্যোগে নন্দন-২ তে ‘শুভ, কেমন আছো?’ নাম নিয়ে ভূমিষ্ঠ হল সেই ছবি। এরপর দূরদর্শন এই ছবির স্বত্ব কিনলে তখন টিভিতে তা দেখানো হয়।

    ৪.
    যে-পার্থপ্রতিম ষাটের দশকে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র ঘোষকের চাকরি অক্লেশে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তিনি ১৯৭৫-এর আশেপাশে এসে পড়লেন নিদারুণ অর্থকষ্টে। পরিচালকের অকালপ্রয়াত পুত্র তৃণাঞ্জন চৌধুরীর থেকে জেনেছিলাম সেই কঠিন দিনগুলোর কথা। তাঁর কথায়, ‘সত্তরের দশকের শেষ ভাগে বাবা প্রায় এক প্রকার বেকার বসেছিলেন। সেই সময়ে তাঁকে প্রচুর ধার-দেনা করতে হয়েছিল। এমনকী সাধের গ্রামোফোনও বিক্রি করে দিতে হয়। আর ঠিক এই কারণেই প্রবল অনীহা সত্ত্বেও তাঁকে নিরুপায় হয়ে বাণিজ্যিক ছবির জগতে যেতে হয়েছিল।’

    দ্বিতীয় ইনিংসে যে তিনি সাফল্যের মুখ দেখেননি, তা ভাবলে কিন্তু মস্ত বড় ভুল হবে। চার্লস লটন-ডিয়ানা ডার্বিন অভিনীত যে-ছবির অনুকরণে হিন্দিতে ‘তামাশা’, ‘দুলহন ওহি জো পিয়া মন ভায়ে’-র মতন ছবি হয়েছিল, সেই একই গল্পভিত্তিক সুপারহিট ‘রাজবধূ’ (১৯৮২) দিয়ে তিনি পা রাখেন বাণিজ্যিক ছবির দুনিয়ায়।

    চিরাচরিত-গতানুগতিক জীবন কিংবা ভাবনা ছিল যাঁর বরাবরের না-পসন্দ, তাঁকে বাণিজ্যিক ছবির ঘেরাটোপে ঢুকতে হল। এবং এর পরের যে-চোদ্দো বছর পার্থপ্রতিম বেঁচে ছিলেন, সেই সময়ে তিনি স্বনামে-বেনামে ছবি করলেন, কিছু বড় সাফল্যও পেলেন, কিন্তু যে-উদ্ভাবনী শক্তি ছিল তাঁর তুরুপের তাস, সেই তাস রয়ে গেল আস্তিনের ভেতরেই। প্রথাবিরোধী রীতিপ্রয়োগের জন্যে পরিচিত কিংবা কদাচিৎ অতি অলঙ্করণের দায়ে দুষ্ট পার্থপ্রতিম ‘পূজারিণী’ (১৯৮৪), ‘মনে মনে’ (১৯৮৯), ‘বৌমণি’-র (১৯৯৫) মতন ছবি করে যে কতখানি পরিতৃপ্তি লাভ করেছিলেন, তা সহজেই অনুমেয়। বক্স-অফিস, কমার্শিয়াল বাজার— এই জটিল শুভঙ্করী ধাঁধার আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে সদর্পে প্রত্যাবর্তন তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

    ‘রাজবধূ’ ছায়াছবির প্রচার-পুস্তিকা

    নিজের স্বচ্ছন্দবোধের পরিসরে ফিরতে না পারার ক্ষোভ, নিজেকে যথাযথ ভাবে প্রকাশ করতে না পারার অসন্তোষের সঙ্গে অসংযমী জীবনযাপন এই সময়ে যেন হয়ে উঠল গোদের উপর বিষফোঁড়া। আর এইসব মিলিয়েই অনিবার্য পরম্পরায় তিনি সময়ের সাথে হারিয়ে যেতে বাধ্য হন। যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁদের কণ্ঠে তাই আজও একরাশ হতাশা তাঁর প্রতিভার অপচয় নিয়ে। তাঁর জীবন যেন অসমাপ্ত এক বহু অঙ্কের নাটক, যা প্রথম দৃশ্যে অনেক সম্ভাবনা জাগিয়েও তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছয় না। তাঁর মধ্যে অন্যরকমের ছবি করার ছটফটানি যে একেবারে শেষ হয়ে গেছিল তা নয়। দীর্ঘদিনের সহকারী বিমল দে-র কাছে জানা যায় যে, অমিতাভ চৌধুরীর ‘রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা’-র উপর ভিত্তি করে পার্থপ্রতিম এক অসামান্য চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, যা খাতাবন্দিই রয়ে গেছে।

    মাধবী মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল কীভাবে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের স্মরণে ওঁরই কিছু গানের কথা দিয়ে নিমেষের মধ্যে শিল্পী সংসদের পক্ষ থেকে একটা কবিতা লিখে দিয়েছিলেন পার্থপ্রতিম। ঠিক এমনই অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে সুরও করে ফেলতে পারতেন তিনি। দিলীপ রায়ের পরিচালনায় শরদিন্দুর ‘রাজদ্রোহী’ অবলম্বনে যে-নাটক হয়েছিল, তাতে ভি.বালসারা যে সুর করে দিয়েছিলেন, তা পরিচালকের মনঃপূত হয়নি। শেষ মুহূর্তে দিলীপবাবু দ্বারস্থ হলেন পার্থপ্রতিমের, যিনি এরপর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে নাটকের উপযুক্ত এমন সুর করে দিয়েছিলেন, যা সকলের পছন্দ হয়। ভাবতে অবাক লাগে যে, ‘যদুবংশ’-র শুরুতে সেই গাড়ির হর্ন ও শিশুর কান্নার মাঝামাঝি শব্দ প্রয়োগকারী পার্থপ্রতিম কখনও প্রথাগত সংগীতশিক্ষা লাভ করেননি। নিজের একাধিক ছবিতে সুর দেওয়া ছাড়াও তিনি দীনেন গুপ্তর সঙ্গীতপ্রধান ছবি ‘সরগম’-এরও সুরকার ছিলেন। স্বপরিচালিত ছবির বাইরেও তিনি গীতিকার রূপে ধরা দিয়েছেন। অন্যতম উদাহরণ হিসেবে নাম করা যায় ‘চেনা অচেনা’ ছায়াছবি থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘শোনো শোনো গল্প শোনো’ গানটার কথা।

    সিনেমার দিকটুকু বাদ দিলে, নাট্যকার পার্থপ্রতিম যে আজ নিছকই ধূসর অতীত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ছায়াছবির মতন নাটকেও কিন্তু তিনি প্রচলিত ধ্যানধারণার শিকল ভেঙে নতুনত্বের সন্ধান করেছেন বার বার। মনোজ মিত্রের কথায়, ‘পার্থর মৌলিক নাটকগুলোর মধ্যে ‘খাঁচা’, ‘কৃষ্ণচূড়ার মৃত্যু’, ‘চার দেওয়ালের গল্প’, ‘থাকে শুধু’,  ‘শব্দরূপ ধাতুরূপ’, ‘রাজকীয় মৃত্যুদণ্ড’, ‘বৃষ্টির অক্ষরে’— নতুন নতুন দৃষ্টিকোণে সমাজ-সংসারের ওপর আলো ফেলেছে। এমন অনেক প্রসঙ্গ এসেছে, যেগুলো আমাদের নজর এড়িয়ে যায় বা সচরাচর আমাদের কাছে যথেষ্ট ইঙ্গিতময় হয়ে ওঠে না। পার্থ তাঁর সহজাত সংবেদনশীলতায় কবির মতনই জীবনকে দেখেছে, ছুঁয়েছে— হয়তো আর পাঁচজন থিয়েটার-করিয়েদের মতন নয়। পার্থর নাটকে ছোট-ছোট মুহূর্তগুলো সর্বদাই নিটোল এবং রসঘন। পার্থর অনেক লেখাই ফর্মের চমৎকারিত্বে দ্রষ্টব্য হয়ে থাকবে বহুকাল। নাটক রচনা নিয়ে সে যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছে, সমকালে আর ক-জন নাট্যকার তা করেছেন বা করতে পেরেছেন ভেবে দেখতে হবে!’

    এমনকী সিরিয়াল শব্দটা যখন ভারতীয় টেলিভিশনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়নি, তখন পার্থপ্রতিম  দূরদর্শনের জন্যে ‘চোখের আলোয়’ নামক এক নাটকের ধারাবাহিক করেছিলেন। শর্মিলা ঠাকুর ও বসন্ত চৌধুরী অভিনীত এই তেরো পর্বের ধারাবাহিক ছিল পরিচালকের সৃজনসত্তার আরও এক নতুন পরিচয়।

    ছাত্রাবস্থা থেকে জীবনের অন্তিম পর্যায় অব্ধি তাঁর কলম চলেছে অবিরাম। ‘নাটকের আবহ-সংগীত’, ‘বর্ধমানের লোকসংস্কৃতি’, ‘বুনুয়েলের ছায়াছবিতে পরাবাস্তবতা’ কিংবা ‘সুচিত্রা সেনের জনপ্রিয়তার হেতু’— এরকম নানান ধরনের বিষয় নিয়ে তাঁর মণিমুক্তোর মতন প্রবন্ধ পড়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, কেন তিনি সাহিত্যকেই পুরোদস্তুর পেশা হিসেবে বেছে নিলেন না?

    নোবেলজয়ী সাহিত্যিক টি.এস. এলিয়টের কথায়, ‘নট উইথ আ ব্যাং, বাট উইথ আ হুইম্পার’। তাই বোধহয় মাত্র ৫৮ বছরের জীবনে এরম বিপুল কর্মকাণ্ড রেখে যাওয়া সৃষ্টিকর্তাকে বঙ্গসংস্কৃতির মানচিত্রে আজ আর খুঁজেই পাওয়া যায় না! কথায় আছে, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা শিল্পীদের কোনও এক্সপাইরি ডেট হয় না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে পার্থপ্রতিমের খানিকটা বেঁচে থাকা, খানিকটা প্রাসঙ্গিকতা তাঁর কয়েকটা ছায়াছবির জোরেই। এইটুকু হয়তো কখনও শেষ হওয়ার নয়। অন্তত যতদিন না যদুবংশের যুগ শেষ হচ্ছে! 

    কৃতজ্ঞতা : গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, বিমল দে, শিবাদিত্য দাশগুপ্ত

    চিত্র সৌজন্য : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook