ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হিয়া টুপটাপ, জিয়া নস্টাল : পর্ব ২৮


    শ্রীজাত (August 19, 2023)
     

    অলিখিত সাম্রাজ্য বিস্তার

    ছাদ ছিল আমাদের নানা রঙের স্বপ্নের জায়গা, ছোটবেলায়। ভাড়া বাড়ি হোক বা নিজেদের, বন্ধুদের বাড়ি হোক বা কোনও আত্মীয়ের, ছাদের প্রতি এক ধরনের অদম্য টান ছিল, কেন কে জানে। কেবল ছুতো খুঁজতাম, কোনও-না-কোনও ভাবে ছাদে উঠে যাবার। তখন যদিও সব পাড়াতেই আশেপাশে মাঠ ছিল দেদার আর বিকেল হলে তাতে খেলাও জমে উঠত খুব, কিন্তু ছাদের মধ্যে কী একটা ব্যাপার ছিল, যেটা ঘরেও ছিল না, মাঠেও ছিল না। পরে মনে হয়েছে, আকাশ আর পাঁচিল একসঙ্গে কেবল ছাদেই পাওয়া যায়। মুক্তি আর বন্ধনের এই সমন্বয়, অসীম আর সীমারেখার এই জোট একমাত্র ছাদেই সম্ভব হত। তাই হয়তো ছোট থেকেই ছাদের প্রতি এক ধরনের টান জন্মে গেছিল।

    দুপুরের ছাদ আর সন্ধের ছাদটাই আলাদা করে মনে আছে আমার। কেননা সকালবেলা ছাদে যাবার বড় একটা রেওয়াজ ছোটদের অন্তত ছিল না। সকালের ছাদ মানে ফুলের টবে জল দিয়ে বেড়ানো, একটু বেলা হয়ে এলে কাপড় মেলতে যাওয়া, আরও বেলায় শুকনো কাপড় তুলে আনা, এইসব। এর মধ্যে আমাদের, মানে ছোটদের বিশেষ ভূমিকা থাকত না। আমরা জেগে উঠতাম দুপুর গড়াতে-না-গড়াতে, যখন বাড়ির সকলে বেশ একটা আদুরে ঘুমে মগ্ন। অবশ্যই ছুটির দিনগুলোর কথাই বলছি এখানে। তখনও বাঙালি বাড়িতে দুপুরে ভাতঘুমের চল ছিল, একটু গড়িয়ে না নিলে কোথায় কী যেন কম পড়ত সকলেরই। কেবল ছোটদের রুটিনে সে-ঘুমের কোনও বালাই ছিল না।

    মামাবাড়ির কথাই যদি বলি, গরমের বা পুজোর ছুটিতে ভাইবোনেরা সেখানে একজোট হতাম। সকাল থেকে সুভদ্র প্রাণীর মতো ঘুরে বেড়াতাম আর অপেক্ষা করতাম, কখন দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে বড়রা একটু বিছানায় এলাবেন আর আমরা ছাদে আমাদের অলিখিত সাম্রাজ্য বিস্তার করব। আমাদের মূল লক্ষ্য থাকত ছাদে শুকোতে দেওয়া আচারের বয়ামগুলো। এসব অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই ছোটবেলায় সকলেরই হয়েছে। দিদা ভারি যত্ন সহকারে আচার রোদে দিতেন। পাতিলেবুর টকঝাল আচার যেমন থাকত, তেমনই থাকত আম আর গুড় দিয়ে বানানো মাখো-মাখো মিঠে আচার। সেসব জিনিস কবে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তবে পাতের কোণে পড়বে, সে-অপেক্ষায় না থেকে আমরা প্রথম পর্যায় থেকেই চুরিবিদ্যায় হাত পাকাতাম। সত্যি বলতে কী, খাবার সময়ে বেড়ে দেওয়া অল্প একটু আচারের চেয়ে ওই দুপুরবেলা পা টিপে-টিপে ছাদে উঠে বয়ামের ঢাকনা খুলে হাত ঢুকিয়ে চুরি করে খাওয়া আচারের স্বাদ অনেক বেশি। চুরি করে খাওয়া চুমুর মতোই টকঝালমিষ্টি তার অভাবনীয় স্বাদ।

    সেইসঙ্গে অবশ্য ছোঁয়াছুঁয়ি, কুমিরডাঙা, চোরপুলিশ, এসবও খেলা হত। মুশকিল হচ্ছে, আচার চুরি যতটা নিঃশব্দে করা যায়, এসব খেলা ততখানি নীরবতার ধার ধারে না। তাই শব্দ হত। এবং বেশ ভাল রকমই হত। লাফ দেবার ধুপধাপ থেকে ছুটে বেড়ানোর দুমদাম, সবই পৌঁছত নীচের তলায়, যেখানে বড়রা সুখনিদ্রায় শায়িত। খেলার নেশায় অতশত মাথায় থাকত না আমাদের কারওরই, তাই ঝামেলা হত কিছু পরেই। বড় কেউ উঠে আসতেন এবং নিশ্চিতভাবে অন্ততপক্ষে কানমলাটি বরাদ্দ ছিল। মাঝপথে সেসব খেলা বন্ধ হয়ে যাবার যে-দুঃখ, তার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলে না।

    ভরদুপুরের চিলেকোঠা অভিযান কোনও বড় অ্যাডভেঞ্চারের চেয়ে কিছু কম ছিল না। সেসব অভিযান যদিও একা-একাই জমত বেশি, দলবেঁধে নয়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তেমনটাই হত, বলতে পারি। কত যে কিছু ডাঁই করা থাকত চিলেকোঠায়, যা কিছু বাতিল, যা কিছু অপ্রয়োজনীয়, যা কিছু বাড়তি, সবের ঠাঁই হত সেখানে। আর তারাই দেখতে-দেখতে আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিল এক সময়ে।

    দুপুরের ছাদের আরেক অসামান্য আকর্ষণ ছিল চিলেকোঠা। আজকের অভিধানে এই শব্দটাই অনেকটা অর্থহীন হয়ে যেতে বসেছে, কিন্তু তখন মধ্যবিত্ত পাড়ার ছাদগুলোতে চিলেকোঠা ছিল অবশ্য-সদস্য। আর ভরদুপুরের চিলেকোঠা অভিযান কোনও বড় অ্যাডভেঞ্চারের চেয়ে কিছু কম ছিল না। সেসব অভিযান যদিও একা-একাই জমত বেশি, দলবেঁধে নয়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তেমনটাই হত, বলতে পারি। কত যে কিছু ডাঁই করা থাকত চিলেকোঠায়, যা কিছু বাতিল, যা কিছু অপ্রয়োজনীয়, যা কিছু বাড়তি, সবের ঠাঁই হত সেখানে। আর তারাই দেখতে-দেখতে আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিল এক সময়ে। পুরনো অ্যালবাম, ভাঙা রেডিও, ছেঁড়া স্ট্যাম্পখাতা, বন্ধ টেবিলফ্যান, আগেকার পুজোসংখ্যা, আরও কত কী! তাদের নিয়ে একার দুপুর মন্দ কাটত না। কতদিন যে ওই চিলেকোঠাতেই বসে গল্পের বই শেষ করে দিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই।

    তবে সন্ধের ছাদের মেজাজ ছিল এক্কেবারে আলাদা। এর কথা বলতে গেলে আমার মামাবাড়িই মনে পড়ে যায়, কেননা সে-বাড়িতে সন্ধের ছাদের একটা নিয়মিত আড্ডার চল ছিল। মনে পড়ে যায়, বিশেষত গরমকালে, সন্ধে হলেই ছাদে হয় মাদুর পাতা হত, নয়তো টানটান করে সাদা চাদর। সাতটা কি সাড়ে সাতটা নাগাদ জম্পেশ করে মুড়িমাখা আর এক রাউন্ড চা দিয়ে শুরু হত সেই আড্ডা। তখন চারপাশে এত বেশি আলো ছিল না বলেই হয়তো সন্ধেবেলার ছাদকে বড্ড মোহময় আর আন্তরিক মনে হত। তার ওপর লোডশেডিং হলে তো কথাই নেই। অন্ধকার একটা পাড়াকে চারপাশে বিছিয়ে নিয়ে হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে আড্ডা।

    তখন অনেকের জমায়েত হত মামাবাড়িতে। মা-বাবা, মাসিরা, আমরা ভাইবোনেরা থাকতাম। জীবনে কোথাও কোনও তাড়া ছিল না কারও। কত রকমের গল্প যে হত সেসব আড্ডায়! পুরনো দিনের গল্প থেকে পুরাণ, বেড়ানোর গল্প থেকে ইতিহাস, সব উঠে আসত। সেই মুড়ির স্বাদও আজ আর কোথাও পাওয়া যাবে না। বিশাল এক গামলায় সকলে মিলে হাত ডুবিয়ে মুঠো করে তুলে এনে মুড়ি খাওয়ার যে এক অলীক আনন্দ, তার কোনও জুড়ি নেই। আমাদের এই সান্ধ্য আড্ডায় একটা ব্যাপার বাড়তি হত, আর তা হল গানবাজনা। আমাদের বাড়িতে গানবাজনাকে বাইরে রেখে কোনও আড্ডা বসতে দেখিনি কখনও। ছাদও তার ব্যতিক্রম নয়। মুড়ি শেষ হয়ে যাবার পর আরেক দফা চা হয়ে গেছে, আটটা সাড়ে আটটা বাজে, সে-সময়ে কেউ-না-কেউ একজন ঠিক দোতলার ঘর থেকে হারমোনিয়াম তুলে নিয়ে আসত। তারপর শুরু হত গান। মামার তৈরি বাংলা গান হত বেশি। মা গাইতেন, ছোটমাসি গাইতেন। মাঝেমধ্যে আমাদের ভাইবোনেদেরও গাইবার সুযোগ হতো। এসবের মধ্যেই সাদা চাদরে পিঠ পেতে দিয়ে আকাশের তারা দেখতে-দেখতে লেগে আসত চোখ। পরে বড় হয়ে যখন শুনলাম আমাদের প্রিয় এক গানের অন্তরায় গুলজার সাহেব লিখেছেন, ‘গরমিওঁ কী রাত যো পুরওয়াইয়াঁ চলেঁ / ঠন্ডি সফেদ চাদরোঁ পে জাগেঁ দের তক / তারোঁ কো দেখতে রহেঁ ছত পর পড়ে হুয়ে…’ তখন আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছিল সেই গান।

    আফসোস, আজ কেবল ওই গানটুকুই পড়ে আছে। ছাদগুলো মিলিয়ে গেছে জীবন থেকে।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook