হঠাৎ করে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা ১৯.৫%-এর নিচে নেমে গেলেই শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড় করে। ৬%-এর আশেপাশে চলে গেলে তো মৃত্যুও হতে পারে। তবে এরকম অভিজ্ঞতা আমাদের রোজকার জীবনের বাইরে, তাই এই শ্বাস নেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাই না। অষ্টপ্রহর অনায়াসে যা পাচ্ছি তার কদর কে-ই বা করে! তাই বায়ু দূষণ নিয়ে উদ্বেগ কেবল অ্যাকাডেমিক স্তরে, না হলে বড়জোর ছ’মাসে একবার গাড়ির পলিউশন লেভেল চেকেই সীমিত। ওই যে নীতিকথায় আছে— অনায়াস-প্রাপ্তির কোনও মূল্য নেই। যেমন ধরুন জল। না চাইতেই পাচ্ছি, তাই স্কুলবেলায় ‘জলই জীবন’ রচনায় ফুল মার্কস পেলেও বাস্তবে আমরা মোটেই তার কদর করি না; আমাদের রোজনামচায় ‘খাবার নষ্ট কোরো না’ প্রচলিত হলেও ‘জল নষ্ট কোরো না’ খুব একটা শোনা যায় না।
তবে অন্য গোত্রের মানুষও আছেন। যেমন মড বারলো। নারীর সমানাধিকার নিয়ে আজীবন লড়াই করে চলা এই মানবাধিকার-কর্মী নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন— বিশুদ্ধ জল ও স্যানিটেশন-এর মৌলিক অধিকার নিয়েও। রাষ্ট্রপুঞ্জের উপদেষ্টা থাকাকালীন মূলত তাঁরই প্রচেষ্টায় এই সংস্থা ২০১০ সালে ঘোষণা করে যে জল মানুষের মৌলিক অধিকার। ‘ব্লু-প্ল্যানেট’ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত তিনি। বিশ্বজুড়ে বেড়ে চলা তীব্র জল-সঙ্কটের সঙ্গে প্রতিদিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এই প্রকল্পের সকলে; লড়াই চলছে সেই সব কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধেও যারা প্রাকৃতিক জলসম্পদ ও সরবরাহ কুক্ষিগত করতে চায়। প্রতিদিন দেওয়াল-লিখন স্পষ্ট হচ্ছে— বাড়তে থাকা জল-সঙ্কটের মোকাবিলা এখনই করতে না পারলে আগামী দিনে জলই হবে ‘নতুন তেল’— যা নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ বেধে গেলেও অবাক হওয়ার মত কিছু থাকবে না।
ভাবছেন কি এটা একটু বেশিই হয়ে গেল? কেপ টাউন-বাসীরা কিন্তু দ্বিমত হবেন না। দক্ষিণ আফ্রিকার সবথেকে ঘনবসতিপূর্ণ উপকূলীয় শহর কেপ টাউন। চল্লিশ লক্ষেরও বেশি মানুষের বসবাস সেখানে, পর্যটকদের কাছেও জনপ্রিয় গন্তব্য। এমন এক মেট্রোপলিসে মানুষ এই কিছুদিন আগেও লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনের বরাদ্দ জল সংগ্রহ করেছে, মাথাপিছু ৫০ লিটারের মতো, যা রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্ধারিত ন্যূনতম সীমারও নীচে। এদিকে পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন মাথাপিছু গড় ১৭৫ লিটার! অতিরিক্ত জলের চাহিদা রুখতে কেপ টাউনের রাস্তায় সেনাও মোতায়েন হয়েছে। আমরা যারা কলকাতাবাসী তারা হয়তো বিপর্যয়ের মাত্রাটা উপলব্ধি করতে পারছি না। একটু পিছনে ফিরে সেই আয়লা-বিধ্বস্ত দিনগুলোতে ফিরে যান। বিদ্যুৎ নেই, জলের পাম্প অকেজো। বালতি হাতে পাড়ার একটি মাত্র টিউবকলের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই! এবার কল্পনা করুন— প্রতিদিন লাইনে দাঁড়াচ্ছেন কিন্তু আপনার জন্য বরাদ্দ মাত্র ৫০ লিটার, তাতেই রান্না করা থেকে বাসন ধোওয়া, জামাকাপড় কাচা, বাথরুমের যাবতীয় কাজ সারতে হবে! আর পানীয় জল? সেটাও ওই মাথাপিছু রেশনেই সীমাবদ্ধ।
কেউ বলছেন এর জন্য জলবায়ু-পরিবর্তন দায়ী, কেউ বা দুষছেন দেশের সরকারকে। তবে বছর পাঁচেক আগে যে ব্যাপক খরার সাক্ষী ছিল কেপ টাউন, ভাগ্যলিখন হয়তো তখনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কেপ টাউন মূলত বৃষ্টির জলের উপর নির্ভরশীল। বাঁধ ও জলাধারে সংরক্ষিত বৃষ্টির জল মানুষের ব্যবহারযোগ্য করে তুলে তা ঘরে-ঘরে সরবরাহ করা হয়। ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি না হলে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আর প্রতিদিন যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে তাতে বৃষ্টির সময় আর পরিমাণ দুই-ই যে কমছে তা স্পষ্ট। তবে সে যাত্রায় কর্তৃপক্ষ আর মানুষের সমবেত প্রচেষ্টায় শীতকালীন-বর্ষাকাল পর্যন্ত ‘ডে জিরো’ পিছিয়ে দেওয়া গিয়েছিল।
অবশ্য কেপ টাউন একা নয়। লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে এশিয়া, তালিকা প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা জনসংখ্যা আর সঠিক পরিকল্পনার অভাব জল-সংরক্ষণ ও সরবরাহ পরিকাঠামোর উপর চাপ ফেলছে। ইউনেস্কো-র রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি মাসে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ তীব্র জল-সঙ্কটের মুখোমুখি হন। রোজকার জীবন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ-সরবরাহের উপর চাপ বাড়ে, আর ‘ডোমিনো এফেক্ট’-এর মতো প্রভাব পড়ে শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খাদ্য সুরক্ষা-য়। সত্যিই তো আমাদের দেশে কত মেয়ে পড়াশোনায় ইতি টানে, শুধুমাত্র স্কুলে পরিচ্ছন্ন শৌচালয়ের অভাবে— জলের অভাব যার প্রধান কারণ। প্রভাব পড়ে কৃষিতেও। তবে অবস্থার পরিবর্তন হয় না। শুধু কিছু দিন খবরের শিরোনামে থাকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া কৃষকের পরিবার।
২২ মার্চ ‘বিশ্ব জল দিবস’। সেই উপলক্ষে এ বছরের মার্চ মাসে নিউ ইয়র্কে হয়ে গেল রাষ্ট্রপুঞ্জের জল-সম্মেলন। ১৯৭৭-য়ে প্রথমবার হয়েছিল আর্জেন্টিনায়। তার পর এই ২০২৩। বাড়তে থাকা উষ্ণতা এবং জলবায়ু-পরিবর্তনের দীর্ঘ ছায়ায় চার দশক পরে এই সম্মেলনের আয়োজন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে ২০৫০-এ যে দেশগুলি প্রবল জল-সঙ্কটের মুখোমুখি হবে, ভারত তার অন্যতম। দেশের জনসংখ্যা তখন ছাড়াবে ১৬০ কোটির গণ্ডি। আমেরিকার ভূখণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ সমান জমিতে আজ ভারতের প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের বসবাস। আর তাঁদের সম্বল এই গ্রহের জলসম্পদের মাত্র ৪%। যে হারে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর নেমে যাচ্ছে তাতে ২০৫০-এ ১৬০ কোটি ভারতীয়র ভাগ্যে যে সেই ৪%-ও জুটবে না, তা বলাই বাহুল্য।
বরং সুস্থভাবে জীবনযাপনের জন্য জল কতটা প্রয়োজন তার সাক্ষ্য দেবেন ২০১৯ সালে চেন্নাই-য়ে ‘ডে-জিরো’ র ভুক্তভোগীরা। জল-সঙ্কট এতটাই তীব্র হয়েছিল তখন যে, মারামারি থেকে শুরু করে জল-সরবরাহের ট্যাঙ্কার ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। আসমুদ্রহিমাচল বাড়তে থাকা জলের আকাল তো আসলে মানুষের হাতেই গড়া দুর্যোগ। প্রতিদিনই আমরা কোনও না কোনও ভাবে খরচা করছি প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল। তাহলে আজকের এই সঙ্কটের ও ভবিষ্যতের বিপর্যয়ের দায় কাদের?
ইংরেজিতে একটা কথা আছে না— চ্যারিটি বিগিন্স অ্যাট হোম। নিজের চারপাশের পরিবেশটার রক্ষণাবেক্ষণ করলে বৃহত্তর সমাজেও তার ছাপ পড়তে বাধ্য। ২০১৪ সালে আমেরিকায় মিশিগানের ফ্লিন্ট শহরে পানীয় জলে সিসার পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে গিয়ে তা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠেছিল। যথারীতি সরকার প্রথমে তাতে আমল দেয়নি। পৃথিবীর সব প্রান্তেই রাজনীতিকদের ঘুম সবার শেষে ভাঙে। বরং সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন কিছু তরুণ তুর্কি— জল থেকে সিসা ফিল্টার করতে শুরু করলেন ভ্রাম্যমাণ ‘ওয়াটার বক্স’— যা প্রতি মিনিটে ১০ গ্যালন জল পরিশুদ্ধ করে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে থাকল।
আমরা কলকাতাবাসীরা এখনও পর্যন্ত ভাগ্যবান। জল নিয়ে এত অনিশ্চয়তার মুখোমুখি আমাদের হতে হয় না। কিন্তু আমাদের উত্তরাধিকারীরা যে এতটা ভাগ্যবান হবে না তা এখনই বলে দেওয়া যায়। কেপ টাউন থেকে চেন্নাই, বেঙ্গালুরু থেকে বেজিং তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে।