বিলি গিলচার বেশ খানিক ফুরফুরে মেজাজে ব্রহ্ম ঠাকুরকে চটপট তাঁর সমস্যাটা বলে ফেলবার সুযোগ দিতেই— চট করেই বলছি!— বলে বিলির চোখের দিকে পূর্ণ চোখে তাকালেন ব্রহ্ম। তবে তিনি কথা বলতে শুরু করলেন একটু অন্য কায়দায়। গম্ভীর খাদের গলায় অদ্ভুত এক নাকি-সুরে সামান্য দুলে দুলে বললেন— ধরা যাক, আমার সমস্যাটা হল একটা চৌবাচ্চা। এই চৌবাচ্চাটি বিলি, চৌবাচ্চাটি হল আসলে এক পারমাণবিক গবেষণার চৌবাচ্চা। এবার ধরো, এতে তিনটি নল আছে, তিনটি নল দিয়েই এটাকে পূর্ণ করা যায়। যদি গ্রহান্তরের সঙ্গে যোগাযোগের কথা ভাবি, তবে খুলতে হবে এক নম্বর নল। চৌবাচ্চা পূর্ণ হতে মানে গবেষণা সফল হতে লেগে যাবে বছরের পর বছর। কিন্তু ফান্ডিং আসবে কোত্থেকে? তার জন্য খুলতে হবে আরেকটা নল, ধরো, অস্ত্র তৈরির নল। এবার দুটো নল একসঙ্গে খুলে রাখলে মহাকাশ গবেষণা পরিণত হবে অপেক্ষাকৃত গৌণ বিষয়ে— চৌবাচ্চা ভরুক না ভরুক, অল্প সময়েই চৌবাচ্চাওয়ালাদের পকেটগুলো ফুলেফেঁপে এক্কেবারে ঢোল হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তৃতীয় একটা নলও আছে চৌবাচ্চায়। ওটা হল সততার নল, শান্তির নল, নিরস্ত্রীকরণের নল। ওই নলটা খুললে আবার সাদা পায়রা উড়ে যায়, চাইকভস্কির কম্পোজ় করা ভায়োলিন কনচের্তোর মূর্চ্ছনা শোনা যায়। মন ভাল থাকে, গবেষণায় দিন বেশি লাগলেও মনের বয়স না বাড়ায় মানুষ চট করে বুড়ো হয় না। এবার ধরো পরিস্থিতির পাকে পড়ে তোমাকে প্রথম আর তৃতীয় নলটা খোলা রাখতে হল। হাতুড়ি দিয়ে দ্বিতীয় নলটি আমি নিজেই ভেঙে দিলাম। এবার অঙ্কটা দিচ্ছি। বল তো, এভাবে চৌবাচ্চাটির তিন-চতুর্থাংশ পূর্ণ হতে যে সময় লাগবে, তা চৌবাচ্চার ছয়ের পাঁচ ভাগ পূর্ণ হওয়ার সময়ের কত শতাংশ?
বিলি গিলচার ব্রহ্মের কথা শুনতে শুনতে বেশ খানিকটা পুতুলের মতোই হয়ে গেছেন এখন। তিনি একটা ঘড়ঘড়ে যান্ত্রিক গলায় বিড়বিড় করতে শুরু করেছেন— ছয়ের পাঁচ ভাগকে যদি দুইয়ের তিন দিয়ে গুণ করি, তৃতীয় নল খুললে যদি পিয়ানো, না না ভায়োলিন কনচের্তো শুনি— এটুকু বলতে বলতেই তাঁর চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে এল। ঠোঁট বেঁকে এল। থুতু পড়তে লাগল বেঁকে যাওয়া ঠোঁট থেকে। প্রায় পক্ষাঘাতের মতোই ব্যাপার। হাত থেকে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হল পিস্তলটির, সেটি ঝুলতে লাগল আঙুলের ডগা থেকে।
ব্রহ্ম ঠাকুরের দুই হাত জড়ো করে বাঁধা। তবু সেই অবস্থাতেই সঙ্গেসঙ্গেই তিনি কেড়ে নিলেন পিস্তলটা। সামনে তাকিয়ে গুন্ডাশ্রেণীর লোকটিকে বললেন— অতি সামান্য এক অঙ্ক-সম্মোহনের ট্রিক এটা, ভীষণ কার্যকরী হয় সব সময়ই। এখানে অস্ত্র বলতে লাগে শুধুই আমার চোখের সূক্ষ্ম দৃষ্টি আর নাকিসুরে বলা কিছু অং বং চং অঙ্ক! ছোটবেলায় অঙ্ক পরীক্ষায় তিন নলওয়ালা চৌবাচ্চার অঙ্ক এলেই আমাদের সবার মুখেরই ওই রকম ল্যাললেলে আতঙ্কিত অবস্থা হোত। আর অঙ্ক স্যরের চোখে থাকত কৌতুকমিশ্রিত হিংস্রতা। তার থেকেই এই সম্মোহনের কায়দাটা আমি বানিয়ে নিয়েছি। যাই হোক, দেখছই তো, তোমাদের কেতরে পড়া বসের বুকের দিকে তাগ করে রেখেছি তাঁরই সাধের অস্ত্রটা। বেগড়বাই করলে বলা যায় না, যদি ট্রিগার টিপে দিতে বাধ্য হই? সুতরাং বলাই যায় যে তোমাদের খেলা একরকম শেষ। ওহে ক্যাপ্টেন, এবার কপ্টারটার মুখ ঘুরিয়ে নাও বাবু! আমরা যে এক্ষুনি ফিরে যাব পোর্ট ব্লেয়ারে…
৩২।
ড. কিশিমোতো খুলে যাওয়া দেওয়ালের ভিতরের গহ্বরে মুখ বাড়িয়ে প্রাণপণে চেঁচিয়ে বললেন— মি. এরিক দত্ত? মি. এরিক দত্ত? আপনি কি ভেতরে আছেন? দয়া করে জবাব দিন!
ভেতর থেকে খানিকক্ষণের মধ্যেই জবাব এসে গেল। এরিক জানাচ্ছেন, তিনি ভেতরে আছেন।
এবার আশ্চর্য চেঁচিয়ে বলল— এরিকদা, আমি আশ্চর্য। আপনি কি একা আছেন? নাকি আর কেউ আছে আপনার সঙ্গে?
এরিক একাই ছিলেন। সে খবর পেয়ে আশ্চর্য বাকিদের বলল— একটা ভুল হয়ে গেছে। আমরা চারজন একসঙ্গে এখানেই আছি। চারজন একসঙ্গে থাকলে বিশেষ লাভ হবে না। দু’জন করে ভাগ হয়ে গেলে বরং সুবিধে হবে। কারণ কাজ এখন দুটো— এরিককে মুক্ত করা এবং বিলি গিলচারের মোকাবিলা করা। আমাদের মধ্যে কেউ কি আছেন যিনি বিলি গিলচার নামের লোকটিকে চেনেন?
ড. কিশিমোতো হাত তুললেন।
আশ্চর্য বলল— তা হলে এক কাজ করা যাক। আমাদের এর পরের কাজ— বিলিকে গ্রেপ্তার করা। মনে রাখতে হবে, বিলিকে ধরতে না পারলে আমরা ড: ব্রহ্ম ঠাকুরের সন্ধানই আর পাব না। কারণ আমার কাছে যে ইনফরমেশন আছে তা অনুযায়ী কেবল বিলিই জানেন ব্রহ্ম ঠাকুরের সন্ধান। ড. কিশিমোতো এবং মি. ওঙ্গে চৌধুরি, আপনারা চট করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে অশ্বত্থ গাছের অন্যদিকটায় লুকিয়ে পড়ুন। বিলি গিলচারকে কুয়োয় নামতে দেখলেই আমায় ফোন করবেন। আমি আমার ফোন ভাইব্রেশনে রাখছি। আপনাদের কল পেলেই আমি সতর্ক হয়ে যাব। বিলি গিলচার এই কুয়োয় নামবে তো বটেই, সেই সময়ে তার পেছনে আপনারাও নামতে শুরু করবেন। তার সামনে সে দেখতে পাবে আমাদের, আর পেছনে ঘুরলেই দেখবে আপনাদের। এভাবে আর পালাবে কোথায়? ধরা পড়তে বাধ্য হবে!
ওঙ্গে চৌধুরি চট করে আশ্চর্যের মোবাইল নম্বর সেভ করে নিলেন। তারপর কিশিমোতো জুনিয়রকে সঙ্গে নিয়ে উঠে গেলেন উপরে।
এদিকে অবস্থীসাহেব তাঁর রিভলভারটাকে আরও শক্ত করে খামচে ধরেছেন। বোঝাই যাচ্ছে এবারের অ্যাকশনে তিনি তা কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি নন। আশ্চর্য বুঝল কিছু বলেই কিছু লাভ হবে না। কুয়োয় নেমে আসা গিলচারের দিকে তাঁকে বন্দুক তাগ করতে না দিলে মুকুন্দ অবস্থী এবার দক্ষযজ্ঞই করে ফেলবেন।
দেওয়াল-দরজা হেলে গিয়ে ভেতরের সুড়ঙ্গের সঙ্গে সেতু তৈরি করে দিয়েছিল। আশ্চর্য সে পথে ভেতরে ঢুকে কারাগারের পাশের দেওয়ালের মধ্যে লাগানো বিরাট ছিটকিনিটা খুলে ফেলল। এটায় কোনও তালা লাগিয়ে যাননি বিলি, তাই তালা ভাঙতে হল না। এরিক দত্ত অবিচলিতভাবে বেরিয়ে এলেন। তিনি বহুবার বহু জায়গায় বন্দি থেকেছেন, এসবে তাঁর অভ্যেস আছে। আশ্চর্য কী করে তাঁকে মুক্ত করল— সেই অবান্তর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি গেলেনই না। পেশাদারের মতো জানতে চাইলেন পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক কী।
বিলি গিলচারকে মোকাবিলা করতে হবে এবং তাঁর থেকেই জানতে হবে ব্রহ্ম ঠাকুর এই মুহূর্তে ঠিক কোথায় আছেন— এটুকু কথা জেনে তিনি আশ্চর্যের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন কুয়োর একদম নীচে, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। তারপর চুপিচুপি তাঁর পকেট থেকে বের করলেন তাঁর রিভলভার। গোপনে অস্ত্রটা দেখিয়ে রাখলেন আশ্চর্যকে। তাঁদের থেকে পাঁচ ছ’ধাপ উপরে বন্দুক হাতে নিয়ে বিলি গিলচারের জন্য অপেক্ষা করছেন মি. মুকুন্দ অবস্থী। তাঁকে এরিকের এই রিভলভারটির অস্তিত্ব সম্পর্কে এক্ষুনি কিছু জানানো হল না।
এরিক এর মধ্যেই ন্যাড়া জেঠু মুকুন্দর বন্দুক-পাগলামো বিষয়টা টের পেয়েছিলেন। তিনি ফিসফিস করে আশ্চর্যকে বললেন— হয় হয়। ও রকম হয়। বন্দুক ব্যাপারটা কারুর কারুর কাছে উত্তেজক একটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়ায়। ডাক্তার, মানে ব্রহ্ম ঠাকুরেরও একটা বন্দুকের নেশা আছে। তবে বন্দুক তাগ করবার নেশা না, তাগ করা বন্দুকের সামনে দাঁড়ানোর নেশা। যখনই শত্রুপক্ষ ব্রহ্মের দিকে…
হঠাৎ হুড়মুড় করে কীসব আওয়াজ হওয়ায় এরিক দত্তর ফিসফিসানি মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গেল। হুড়মুড় শব্দের পরই একটা হইচই এল ওদের পাঁচধাপ উপরের সিঁড়ি থেকে, এবং সঙ্গেসঙ্গেই ঝুপ করে একটা শব্দ। শব্দটার সাথেই আশ্চর্য দেখল তার পায়ের কাছে উপর থেকে এসে পড়েছে একটা রিভলভার। রিভলভারটা না চেনবার কোনও কারণ নেই। ওটা হল শ্রীযুক্ত মুকুন্দ অবস্থীর সেই বিখ্যাত ক্ল্যাসিক ব্যারেটা স্ট্যামপীড।
৩৩।
ব্রহ্ম ঠাকুর দাবি করেছিলেন ‘তোমাদের খেলা শেষ!’, কিন্তু এতো সহজে খেলা মোটেই ঘুরল না। চালকের বাঁপাশে বসা ষন্ডা লোকটি আচমকা চিৎকার করে বলল— ইউ আর আ ক্রেজ়ি ফুল! লুক আউট— দেয়ার ইজ় নো বুলেট ইন দ্যাট গান! তবে আমি তোমার দিকে যেটা তাগ করে রেখেছি, সেটায় আছে। দেখবে নাকি ট্রাই করে?
ব্রহ্ম ঠাকুরের নিজেরই তো বুলেটহীন পিস্তল তাগ করবার বদ অভ্যেস আছে। মুহূর্তের ভগ্নাংশে তিনি খানিকটা হকচকিয়ে যেতেই নিমেষের মধ্যে লোকটি চাপড় মারল তাঁর হাতে। ব্রহ্মের হাতে ধরা পিস্তলটি কপ্টারের মেঝেতে পড়ে গেল।
ইতিমধ্যেই বিলি গিলচারের সম্মোহন কেটে গেছে। তিনি বললেন— আরেহ! আমার কী হয়েছিল? কী সর্বনাশ। এই লোকটা দেখছি প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই বেশি খতরনাক্! আমাকে এর মধ্যেই হিপনোটাইজ়ড করে ফেলেছিল? স্যাম, কালো কাপড়টা কোথায় রেখেছ? এর চোখ বেঁধে ফেলতে হবে। ইম্মিডিয়েট!
এই বলে তিনি স্যামের হাতের রিভলভারটা নিজের হাতে নিয়ে তাগ করে থাকলেন ব্রহ্মের দিকে। স্যাম পেছনে হাত বাড়িয়ে বেঁধে ফেলল ব্রহ্মের চোখ। ব্রহ্ম এবারে আর বাধা দিলেন না। এখন ওরা সতর্ক হয়ে গেছে। আর কিছুই করা যাবে না।
ব্রহ্মের চোখ বাঁধা হয়ে গেলে কপ্টারের মেঝে থেকে পিস্তলটা তুলে নিতে নিচু হলেন গিলচার। সঙ্গেসঙ্গে নিজের একটা হাঁটু উঁচিয়ে বিলির থুতনিতে মারলেন ব্রহ্ম। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলেন বিলি। ব্রহ্ম হেসে বললেন— জানি খেলাটা আর ঘুরবে না, তবুও একটা ছোট্ট প্রত্যাঘাত দিলাম। তোমরা মূর্খ। বোঝা উচিত ছিল, চোখ যত টাইট করে বাঁধা হয়, চোখ আর নাকের পাশের ফাঁক তত বাড়ে। ওখান দিয়ে তলাটা অনেকটাই দেখা যায়।
বিলি পিস্তলটা তুলে নিতে পেরেছেন এতক্ষণে। তিনি বললেন— অসীম বুদ্ধিসম্পন্ন হয়েও তুমি তো স্যামের ধোঁকাটা ধরতে পারনি। এ রকম অভিযানে কেউ কি খালি বন্দুক নিয়ে আসে? এটা কি তুমি সিনেমার শ্যুটিং পেয়েছ?
— বিলি, আমি তো খালি রিভলভার নিয়েই আসি। রিভলভারের উপর জানোই তো, আমি খুব একটা নির্ভরশীল নই! কখনই ছিলাম না।
— বাজে ঢপ দিও না টেগোর। আর তাছাড়া তুমি একটি মূর্তিমান গবেট হতেই পার, পাগল-ছাগল হতেই পার— শ্রদ্ধেয় আকুসি তোমার মতন একটি নাড়ুগোপাল নয়, যে আমায় একটা খেলনা গছাবে। অতএব, দুভাবেই প্রমাণিত হচ্ছে, তুমি একটি গোমূর্খ। এই যে ক্যাপ্টেন— আমরা কি এবার দ্বীপটার দিকে নামছি? শোনো টেগোর, আমরা ওই দ্বীপে ল্যান্ড কিন্তু করব না। ইট’স টু রিস্কি। বালুতটের একটু উপরে ভেসে থাকা অবস্থায় তোমাকে একটা নাইলনের সিঁড়ি দিতে পারি, তুমি তো তলাটা দেখতে পাচ্ছ, ধরেধরে আরামসে নেমে যাবে। নইলে যেটা করতে হবে, সেটা একটু খারাপ। ধাক্কা মেরে তোমায় বালিতে ফেলে দেব। অবশ্য দেখছই তো, একদম নরম বালি, বেশি লাগবে না তোমার। এবার বলো, অপশন ওয়ান না অপশন টু?
ব্রহ্ম ঠাকুর গম্ভীর স্বরে বললেন— বিলি, ওখানে নিজে নিজে নামা মানে তো আত্মহত্যা করা! আত্মহত্যা আমি করব না।
হেলিকপ্টারটা অনেকটা নীচে নেমেছিল। বিলি গিলচার কপ্টারের দরজাটা খুলবার নির্দেশ দিলেন। দরজা খুলবার সঙ্গে সঙ্গেই হাত বাঁধা চোখ বাঁধা ব্রহ্ম ঠাকুরকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন তিনি উপর থেকে। মুহূর্তের অসতর্কতায় ব্রহ্মের মাথা নেমে গেল নীচের দিকে। ফলে নীচের বালি নরম হলেও বেকায়দায় একটা নুড়িপাথরে ঠুকে গেল তাঁর মাথা। জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন ব্রহ্ম ঠাকুর।
(ক্রমশ)
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র