দলিতের খাবার কি হিন্দু থালায় ঠাঁই পায়?
এরোপ্লেনে আপনাদের কখনও ‘হিন্দু মিল’ দেওয়া হয়েছে? কী থাকে তাতে, উত্তর ভারতীয় বা দক্ষিণ ভারতীয় খাবার? দলিতের খাবার থাকে তাতে? আর দলিতের খাবার মানেই বা কী?
ভারতবর্ষে তফসিলি জাতি এবং তফসিলি জনজাতি হিসেবে তালিকাবদ্ধ কয়েকশো সম্প্রদায় একত্রে ‘দলিত’ নামে পরিচিত। উত্তর-পূর্ব ভারতীয় খাবার পাওয়া যায় এমন রেস্তোঁরায়, সেই সব অঞ্চলের জনজাতির বা ট্রাইবাল রান্নার স্বাদ খরিদ্দারেরা অল্প-বিস্তর পেতে পারেন বটে, তবে ‘নিচু জাতি’-র খাবার বা খাদ্যাভ্যাস বিষয়ে অধিকাংশ হিন্দুদের তেমন কোনও ধারণাই নেই।
দলিত-খাবারের উপর শাহু পাটোলে-র লেখা একটি বই সম্প্রতি আমার হাতে আসে। যে-মানুষদের ইচ্ছে করেই সমাজের এক প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, খাবারের ব্যাপারে তাঁদের সৃষ্টিশীলতা এবং উদ্ভাবনের ক্ষমতার বিষয়ে কথা বলে বইটি। মারাঠি ভাষায় লেখা এই বইয়ের নাম ‘অন্ন হে অপূর্ণব্রহ্ম’। বেশির ভাগ আশ্রমেই খাবারের (অন্ন) সঙ্গে ঈশ্বরের (ব্রহ্ম) যোগাযোগ স্থাপন করে যে বিখ্যাত শ্লোক গাওয়া হয়ে থাকে, এ শিরোনাম তারই কথা মনে করিয়ে দেয়। পাশাপাশি মনে করিয়ে দেয়, নিজেদের ‘শুদ্ধ’ বলে ভাবা মানুষেরা কীভাবে কিছু খাবারকে, এবং পাশাপাশি ঈশ্বরকেই, ‘অশুদ্ধ’ বলে বিশ্বাস করেন।
এই বইতে পাওয়া যায় দলিত সম্প্রদায়ের কিছু খাবারের কথা, অন্তত লেখকের নিজের সম্প্রদায়ের তো বটেই। পাটোলে লিখছেন কী ভাবে ময়লা কুড়োনোর মতো কিছু ‘অপবিত্র’ পেশায় লিপ্ত মানুষদের গ্রামের বাইরে থাকতে দেওয়া হত, এবং তাঁরা শুধু মরা জন্তু-জানোয়ারই খেতে পারতেন— রান্নার জন্যে আলাদা করে মারা জন্তু নয়, রোগে ভুগে বা বয়সের কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে এমন জন্তু। অনেক সময় পুজো-পার্বণের পরে নিয়ম করে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হত বাকিদের উচ্ছিষ্ট বা বাসি খাবার। সে খাবার প্রায়ই তাঁরা জারিয়ে রাখতেন, পরে খাওয়া হবে, এই উদ্দেশ্যে।
খাওয়া-দাওয়া নিয়ে এই সব সম্প্রদায়ের যে সব গান রয়েছে, তা মূল ধারার সাহিত্যে পাওয়া যায় না। সেসব গান প্রাণীদের আলজিভ, শ্বাসনালী, বা মেদচ্ছ্বদের (ওমেন্টাম) কথা বলে, যে সব শরীরের অংশ ‘উঁচু’ জাতের লোকেরা খায় না, ‘নোংরা’ মনে করে। জমাট রক্ত দিয়ে তৈরি খাবারের কথাও বলেন লেখক। দ্রষ্টব্য, ইউরোপীয় রান্নায় এবং বহু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খাবারে জমাট রক্তের পুডিং খুবই জনপ্রিয়। বলাই বাহুল্য, এইসব খাবারের মধ্যে গরু, শুয়োর, বা ইঁদুরের মাংসও রয়েছে, যেসব খাবার মূল সমাজের মানুষেরা খান না, এমনকী আমিষাশীরাও। হিন্দু শাস্ত্রে শুয়োর খাওয়ার বিষয়ে কোনও বারণ নেই বটে, রাজারা এককালে শিকার করে বুনো শুয়োরের মাংস খেতেন। তবে শুয়োরকে সচরাচর নোংরা হিসেবেই দেখা হয়, এবং বর্ণাশ্রমের মধ্যে যেসব সম্প্রদায় ‘প্রান্তবাসী’ বা ‘অশুদ্ধ’, তাঁদের খাবার হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকে।
কিছু নৃতত্ত্ববিদ এবং খাদ্য-ইতিহাসবিদের মতে, যে-সময়ে দলিতরা মরা এবং উচ্ছিষ্ট খাবার খাওয়া বন্ধ করে নিজেরাই পশু মেরে রান্না শুরু করলেন, সে-সময় থেকেই দলিত রন্ধনশিল্পের সূত্রপাত। বেশি জটিল বা উচ্চমানের রান্না করার সামর্থ্য না থাকায়, এ ধরনের খাবার সচরাচর খুবই সাদামাটা হয়। মাত্র কয়েকটি মশলা দিয়েই রান্না সারা হয়, খাবারে গন্ধও হয় খুব কড়া রকমের। এই রান্নার লক্ষ্য পেট ভরানো, স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হওয়া নয়।
এই একবিংশ শতাব্দীতেও খাবারের উত্তম-অধম বা শুদ্ধতা-অশুদ্ধতার বিচার করা হয় ধর্মীয় অনুশাসনেই। অতএব, পেয়াঁজ-রসুন বা মশলাপাতি ছাড়াই কেবল ঘি দিয়ে রান্না করা শাকসব্জিকে ব্রাহ্মণের উপযুক্ত ‘সাত্ত্বিক’ আহার বলে ধরা হয়। তারপরে আসে রাজার উপযোগী ‘রাজসিক’ খাবার— তেলতেলে, মশলায় পরিপূর্ণ, মাংসল। বাকি থেকে যায় ‘তামসিক’ খাবার— বাসি বা উচ্ছিষ্ট, ‘উঁচু’ জাতের বর্জনযোগ্য, কেবল ‘নিচু’ জাতিদের কাছে সহজলভ্য। শাস্ত্রমতে এঁটো খাবার বা উচ্ছিষ্ট (‘ঝুটা’), যা থুতু লেগে অপবিত্র হয়েছে, অতিথিদের দেওয়ার যোগ্য নয়। তা দেওয়া হয়ে থাকে ময়লা-কুড়নো বা জমাদারের কাজ করা দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের। এই জাতিগত শ্রেণিবিন্যাসকে অমান্য করতেই হয়তো শ্রীরামচন্দ্র আদিবাসী রমণী (দলিতও বলা যেতে পারে) শবরীর ‘ঝুটা বের’ বা উচ্ছিষ্ট আহার গ্রহণ করেছিলেন।