বলিউডে প্রথম পা রাখলেন, ছবি জুড়ে দুর্দান্ত উপস্থিতি, নায়িকা রানি মুখার্জি এবং তাঁর সঙ্গে টক্কর দিয়ে অভিনয় এবং হাউসফুল ও দর্শক আপ্লুত— এমন নিটোল একটা বৃত্ত তৈরি হল কী করে?
শুরুটা কী করে হয়েছিল বলতে পারি, কিন্তু বৃত্তটা খুব সচেতনভাবে তৈরি করা হয়নি, ওটা হয়ে গেছে। হ্যাঁ, আমার অফারটা পেয়ে ভাল লেগেছিল তো বটেই, তবে প্রথমে খুব বিস্মিত হয়েছিলাম এটা শুনে যে রানি মুখার্জি স্বয়ং এই রোলটার জন্য আমায় চেয়েছেন এবং উনি ইনসিস্ট করেছেন রোলটা যাতে আমি করি। এ সব আমায় একটি জুম কলে বলেছিলেন আমার ডিরেক্টর।
২০২১ সাল। আমি মেদিনীপুরে গিয়েছি ভোট দিতে। ওখানেই একদিন সন্ধেবেলায় মুম্বইয়ের একটি কাস্টিং এজেন্সি থেকে আমার কাছে ফোন আসে এবং তারা জানায় যে এই রোলটির জন্য আমায় কাস্ট করতে ইচ্ছুক। পরের দিন ডিরেক্টর সরাসরি কথা বলতে চান। এর পর আমার কাছে ফোন আসে অভিনেত্রী দামিনী বসুর। তিনি বলেন, ‘শোন, তোকে একটা এজেন্সি থেকে ফোন করেছিল তো? কোনও ধানাইপানাই করবি না, কাল ডিরেক্টরের সঙ্গে ভাল করে কথা বলে নিবি।’ রীতিমতো আদেশ পেলাম। তারপর দিন সকালে পরিচালক অসীমা চিব্বর আমায় জুম কল করেন। এবং সেই কলে সমস্ত আলোচনা হয়। আমি একটু সন্দিগ্ধ ছিলাম, যে ব্যাপারখানা কী! আমার অডিশন চাইছে না, একেবারে সরাসরি রোল অফার করছে! ভেবেছিলাম, ডাকছে, ঠিক আছে। একটু-আধটু অভিনয় করিয়ে হয়তো বাদ দিয়ে দেবে।
তারপর যখন শুনলাম রানি মুখার্জি বলেছেন যে রোলটা যেন আমি করি, তখন সত্যিই বিশ্বাস করতে একটু অসুবিধে তো হচ্ছিল। প্রথমে মনে হল, রানি মুখার্জির মতো একজন অভিনেত্রী আমার নাম জানেন, এবং আমায় একজন অভিনেতা হিসেবে চেনেন, আমার কাজ দেখেছেন এবং এই রোলটার জন্য আমায় বেছেছেন!!! এটা সত্যিই একটা বড় প্রাপ্তি।
জীবনে প্রথম হিন্দি ছবি করব, বিপরীতে নায়িকা রানি মুখার্জি, এটা সাধারণত কোনও অভিনেতাই ভাবে না বোধহয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এরকম একটা ব্যাপার সত্যি তো হয়েছেই। তারপর বিদেশে একটা লম্বা সময় শুটিং, তারপর নানা পর্ব পেরিয়ে রিলিজ এবং শুনছি লোকজন তো ভালই বলছে।
কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
খুবই ভাল। এই রোলটার জন্য একটা লম্বা সময় ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। অন্যান্য় ছবির জন্য যতটা প্রস্তুতি নিই, এক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশ কিছুটা বেশিই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। বিশেষত ভাষাগত প্রস্তুতি। আমি এই ছবিতে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি এবং কিছুটা নরওয়েজিয়ান ভাষাও বলেছি। ফলে প্রস্তুতি তো নিতেই হয়েছিল এবং পরিচালক প্রতি পদে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। আমার সঙ্গে অসীমার পুরো রিহার্সালটা হয় কিন্তু জুম-কলে। লকডাউন এবং পরবর্তীর বিধিনিষেধের সময়টায় যাতায়াতের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল, ফলে এই ভাবে আমরা পুরো প্রস্তুতিটা করি। কেবল পরে একদিন মুম্বই গিয়েছিলাম আমার ভিসার কাগজপত্রের জন্য, তখন একবার সামনাসামনি বসে অসীমার সঙ্গে একটা রিডিং সেশন হয়।
তারপর তো শুরু হল শুটিং। আমরা ৪৬ দিন এস্টোনিয়ায় শুটিং করেছি। আমি এর আগে কখনও এতদিন বাইরে থাকিনি বা এত লম্বা আউটডোর শুট করিনি। সবচেয়ে বেশি বোধহয় ২০-২২ দিন শুট করেছি। এবং মুম্বইয়ের ক্রু, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ক্রু-এর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা আমার প্রথম।
শুরুর দিকে ভালই লাগত, নতুন দেশ, নতুন মানুষ, ইউরোপে শুট করছি— তার একটা উত্তেজনা ছিল। কিন্তু প্রাথমিক উত্তজেনাটা কেটে যাওয়ার পর একটা ফরেন ফেটিগ কাজ করে। আমরা যারা এরকম নিয়ত শব্দ আর দৃশ্য়ের কোলাজের মতো একটা জায়গায় থাকি, তাদের পক্ষে এ রকম নিস্তব্ধতা, জ্বলজ্বলে দিন, সূর্যের আলো— এই সব ব্যাপারস্যাপার ঠিক ধাতে সয় না। তবে হ্য়াঁ, রানি মুখার্জি তো বটেই, প্রত্যেক সহ-অভিনেতা নিজের নিজের কাজ এত ভাল করে করেছেন যে আমারও সেটে কোনও অসুবিধেই হয়নি।
বাংলা সিনেমা আর হিন্দি সিনেমা তৈরি করার মধ্যে পার্থক্যটা কী দেখলেন?
অর্থের। ওদের প্রাচুর্য আছে বলে ওরা অনেক বড় স্কেলে ভাবতে পারে, ছকতে পারে এবং প্রযোজনা করতে পারে। আমাদের এখানে প্রাচুর্য নেই, বরং সর্বত্র আমরা বাজেট কাট করার চেষ্টা করি। করোনার পর সেটা আরও বেড়েছে স্বাভাবিক কারণেই। এ ছাড়া কিন্তু আর কোনও তফাত নেই। আমরা একটা মনিটর ব্যবহার করতে পারি, ওরা ৭টা মনিটর ব্যবহার করতে পারে। এদের প্রচুর রিগ্স হয়। আরও অনেক কিছুই বড় স্কেলে করতে পারে, সেটা আমাদের ইচ্ছে থাকলেও সাধ্য়ে থাকে না। কিন্তু যদি প্রতিভার কথা বলতে হয়, তাহলে আমি মনে করি আমাদের বাংলায় প্রতিভার কিন্তু কোনও অভাব নেই। এস্টোনিয়ার যে ক্যামেরাম্যান এই ছবিতে কাজ করলেন, তাঁর চেয়ে সৌমিক হালদার কিংবা শীর্ষ রায় বা রম্য কোনও অংশে প্রতিভার দিক থেকে কম যান না। ওদের ওখানে ওয়ার্কশপ হয়, আমাদের এখানেও হয়। আমাদের যদি অর্থের প্রাচুর্য থাকত, তা হলে এখানকার ছবির মান নিয়েও কোনও প্রশ্ন উঠত না।
রানি মুখার্জির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের, প্রথম রিহার্সালের অভিজ্ঞতা কেমন?
রানি মুখার্জির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ইউরোপে। মানে এস্টোনিয়ায়। তার আগে যে অসীমার সঙ্গে কথাবার্তা, জুম-কলে রিহার্সাল, মুম্বইয়ের রিডিং সেশন, এ সবের সময় কোথাও রানি মুখার্জি ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা এস্টোনিয়ায় শুটিং শুরুর আগের দিন। এবং সেই দিনই আমাদের প্রথম রিহার্সাল। তবে হ্যাঁ, রানি প্রথম থেকেই আমার সঙ্গে খুব সাবলীল ব্যবহার করেছেন। একজন সহঅভিনেতা যেমন করেন, ঠিক তেমনই। সর্বভারতীয় স্টারের যে একটা এয়ার থাকে, সেটা কিন্তু একবারও দেখাননি বা ফলাও করেননি। এবং তারপর ছবি যেমন এগিয়েছে, আমরাও তেমন ভাবে অভিনয় করে গিয়েছি।
রানি মুখার্জির সঙ্গে অভিনয়, কোথাও একটা টেনশন কাজ করছিল?
প্রথম হিন্দি ছবিতে কাজ, একটা টেনশন তো ছিলই। আমিও ন-বছর সিনেমায় অভিনয় করছি। বাংলায় আমার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। তার ওপর রানি মুখার্জি আমার কাজ দেখে আমায় সিলেক্ট করছেন। ফলে, নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ না থাকলেও, নিজের সেরাটা দেওয়ার একটা জেদ তো ছিলই। তবে, অভিনয় করার সময় আমি ভাবতাম না যে রানি মুখার্জির বিপরীতে অভিনয় করছি, আমি চাইতাম আমার সেরা অভিনয়টা করতে। এবং এই ছবিতে যাঁরাই কাজ করেছেন তাঁরাই কিন্তু প্রত্যেকে অত্যন্ত ডেডিকেশনের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং খুব ভাল অভিনয় করেছেন। আর আমরা প্রত্যেকেই অক্ষরে অক্ষরে চিত্রনাট্য মেনে চলেছি। চিত্রনাট্য যা পেয়েছি, পরিচালক যা বলেছেন, একদম সেইমতো কাজ করেছি।
এ বার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যার উত্তর নেশন জানতে চায় কি না জানি না, তবে বাংলা তো জানতেই চায়, তা হল— আপনি স্ক্রিনে রানি মুখার্জিকে অমন একটা সপাটে চড় মারলেন কী করে?
হ্যাঁ, এটা একটা প্রশ্ন বটে। যখন আমি প্রথম অসীমা অর্থাৎ সিনেমার পরিচালকের কাছ থেকে এই চ্য়াপ্টারটার কথা শুনেছিলাম, তখন থেকেই মনের মধ্যে একটা ধুকপুকুনি কাজ করছিল। আমি রানি মুখার্জিকে চড় মারছি!!! চিত্রনাট্যে চ্যাপ্টারটার নাম ছিল He Slaps, she slaps. ট্রেলারে অবশ্য সবাই দেখেছে যে আমিই রানিকে মারছি। এই চ্যাপ্টারটা আমি অসীমার সঙ্গে বার বার রিহার্সাল করেছি, অসীমা খুব সাহায্য করেছে।
তবে সত্য়ি কথা, বেশ টেনশনে ছিলাম। কিন্তু সিনটা যেদিন শুট হল, সেদিন সকাল থেকে রানি মুখার্জি এত ইয়ার্কি মারলেন আমার সঙ্গে যে ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে গেছিল। যখন রিহার্সাল চলছিল, তখন আমি যখন মক করে বা হালকা করে একটা থাপ্পড় মারছি, তখন রানি মুখার্জি বলছেন, ‘ওরে বাবা! অনির্বাণ আমার এত জোড়ে থাপ্পড় মারল যে আমার গাল লাল হয়ে গেল। এ বার আমি কী করে শুট করব?’ তো এই রকম মজা করতে করতে উনি আমায় অনেকটা সহজ করে দিয়েছিলেন। আরে বাবা! রানিও বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমি রানি মুখার্জিকে থাপ্পড় মারব, এটা আমার কাছেও একটা টেনশনের ব্যাপার। এবং সেই জন্যই উনি ওই পুরো ব্যাপারটাকে অত্যন্ত একটা মজার মোড়কে ঢেকে দিয়েছিলেন। ফলে, শট-টেকিং-এর সময় আমার মাথায় আর তখন রানি মুখার্জি ভারত বিখ্য়াত অভিনেত্রী এই ব্যাপারটা আর ছিল না। খুব স্মুদলি হয়ে গিয়েছিল। আর আর একটা খুব কমফর্টবল ব্য়াপার ছিল, এই গোটা শুটিঙের সময়টায় রানি আমার সঙ্গে কিন্তু বাংলায় কথা বলেছে। ৪৬ দিন বাংলায় কারও সঙ্গে কথা বলতে না পারলে কী রকম অবস্থা হত কে জানে!
মুক্তি পাওয়ার তো প্রায় একমাস হতে চলল, কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন? এরপর মুম্বইয়ে কাজের প্ল্যান করলেন না কি?
প্রতিক্রিয়া তো খুব ভালই পেয়ছি এখনও অবধি। প্রশংসাও শুনছি এদিক-ওদিক। বলিউডের প্রথম হিন্দি ছবিতে এতটা স্বীকৃতি ভালই লাগছে।
আর প্ল্যান? না, এখনও কিছু করিনি। ঢেউযের মতো অফার আছড়ে আছড়ে পড়ছে তেমনটাও নয়। আমার কোনও তাড়া নেই। ভাল কাজের অফার পেলে আবার নিশ্চয়ই করব।