বেশ কয়েক বছর আগের কথা। পরিবেশ নিয়ে গবেষণার কাজে স্টকহোম-এ এসেছি। মে-জুন মাস, কিন্তু ভালই ঠান্ডা। উত্তর ইউরোপে গ্রীষ্মের শুরু আর কলকাতার শীত প্রায় একই রকম। হালকা থেকে ঘন নীল তুলির টানে আঁকা লেক মালারেন-এর জল যেখানে বাল্টিক সাগরের স্বপ্নে বিভোর, ঠিক সেখানেই আট শতকেরও বেশি পুরনো এই স্ক্যান্ডিনেভীয় রাজধানী।
আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ওই লেকের ওপরেই টুকটুকে লাল রঙের একটা হাউসবোটে। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে অফিস যেতে লাগে মিনিট কুড়ি। যাওয়ার সময়ে অসুবিধে হয় না, কিন্তু সন্ধ্যাবেলা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ঘুরপথে ফিরি। কারণ আর কিছুই নয়, ওই রাস্তার ওপরেই একটি ছোট পাব-এ ভিড় জমায় ‘পাঙ্ক’রা। তখন তাদের পাঙ্ক বলে চিনতাম না, কিন্তু ওই মোরগঝুঁটি, কালো জ্যাকেট, মাথা কামানো, লাল-নীল-বেগুনি কেশসজ্জার পুরুষ ও নারীদের দেখে আমি কেন যেন ওদের নিও-নাৎজি গুন্ডাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। তাই সোজা রাস্তা দিয়ে ফিরতে একটু ভয় করত, যদি ঘাড় মটকে দেয়!
‘পাঙ্ক’ শব্দের একটি অর্থ গুন্ডা বা বদমাইশ হলেও, অনেক পাঙ্ক-ই তা নন। পশ্চিমে, হিপিদের ছুটি হওয়ার সময়ে, যে পাঙ্ক ‘সাব-কালচার’ মানুষের মনোজগতে তাঁবু খাটিয়ে বসে পড়ে, সেটি প্রতিবাদী, স্বাধীনচেতা এমনকী অ্যানার্কিস্ট চিন্তাভাবনার চারণভূমি। সেখানে যেমন দেখা যায় ‘সেক্স পিস্তল’-এর মতো বহুল জনপ্রিয় পাঙ্ক-রকারদের, তেমনই পাঙ্ক ভাবধারায় পুষ্ট হয়ে গজিয়ে ওঠে ওয়েবজিন-ভিত্তিক আন্ডারগ্রাউন্ড সাহিত্য, ফ্যাশন, ছবি, এমনকী রাশিয়ার ক্ষমতাকেন্দ্রের চক্ষুশূল— আজকের ‘পুসি রায়ট’ ব্যান্ড।
এসবের মধ্যেই, আশির দশকের শুরুর দিকে, কমপিউটার এবং ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তার পিঠে খানিকটা ভর করে, এসে পড়েছিল নতুন এক ধরনের সৃষ্টিচিন্তা, যার নাম, মার্কিন ব্রুস বেঠকে-র একটি জনপ্রিয় ছোটগল্পের অনুসরণে রাখা হয়, ‘সাইবারপাঙ্ক’। এই সাইবারপাঙ্ক-এ যেমন থাকল পাঙ্কের বিদ্রোহী, প্রতিষ্ঠানবিরোধী, আন্ডারগ্রাউন্ড আর মার্জিনের চেতনা, তেমনই তার সঙ্গে জুড়ে গেল আন্তর্জাল, সাইবারস্পেস, কমপিউটার হ্যাকারদের কালচার।
সাইবারপাঙ্ক সাহিত্য আমাদের উপহার দিল হ্যাকারের চরিত্র, ক্রাইম আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে লেখা উইলিয়াম গিবসনের কাল্ট উপন্যাস ‘নিউরোমান্সার’, জাপানের সাইবারপাঙ্ক ঘরানার ‘তেৎসুও— দ্য আয়রন ম্যান’-এর মতো মাথা-চটকানো চলচ্চিত্র, বা ফিলিপ কে ডিক-এর গল্পনির্ভর সুপারহিট ছবি ‘ব্লেড রানার’। সাইবারপাঙ্ক শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, বৃহত্তর সৃষ্টিচেতনায় ছাপ ফেলতে শুরু করল।
এদিকে উষ্ণায়ন, ক্লাইমেট চেঞ্জ, এশিয়ার আর্থিক সঙ্কট, গন্ডায় গন্ডায় প্রজাতির বিলুপ্তি এবং আরও নানা রকম খারাপ খবর ভিড় করে এসে বেশ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, পুঁজিবাদী অর্থনীতির ইঞ্জিনে মরচে ধরতে শুরু করেছে। আনেওয়ালা পল ঠিক কী মূর্তি ধারণ করতে পারে, সেই নিয়ে অর্থবীতিবিদ থেকে পোস্টমর্ডান কুমির, সবাই অন্ধকার বা অল্প আলোয় শিকার ধরার খেলায় মেতে উঠলেন। সাহিত্যিক আর হলিউডের সিনেমা-নির্মাতাদের কল্পনায় এই নিরাশার সময়কে ভবিষ্যতে নিক্ষেপ করে লেখা হল ডিসটোপিয়ান বা পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক ঘরানার গল্প। করম্যাক ম্যাকার্থি-র উপন্যাস ‘দ্য রোড’ পুলিৎজার পায় ২০০৭-এ, তৈরি হয় বক্স অফিস কাঁপানো ‘ডে আফটার টুমরো’ বা ‘স্নোপিয়ার্সার’।
ভাল ছবি, ভাল গল্প। কিন্তু তারপর? অনিশ্চিত-অন্ধকার ভবিষ্যৎ কল্পনায় বারবার ডুব দিয়ে পাঠক কি ভয়ে সিঁটিয়ে যাবেন না? একের পর এক এই ধরনের সিনেমা, গল্প বা ভিডিও গেমের জগতে ঢুকে পড়লে, তাঁর মনে সুন্দর একটা পৃথিবীর স্বপ্নবাসনা কি চিরকালের জন্য ম্লান হবে? তাহলে তো বিপদ। বহু অ্যাক্টিভিস্ট এই ধরনের লেখাকে ‘ডিজাস্টার পর্ন’ও বলতে শুরু করলেন।
আবার এই প্রলয়-লালায়িত অন্ধকারের ফিকশনের পক্ষেও সওয়াল করলেন কেউ কেউ। তাঁদের বক্তব্য, পাঠক গল্পের ডিসটোপিয়ান অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিয়েও, মূল বক্তব্য বুঝতে ভুল করবেন না। পাঠক যথেষ্ট সচেতন। সত্যিই তো, গৌতম যদি বার্ধক্য, জ্বরা, মৃত্যুর দৃশ্যগুলি দেখে ঘরে সেঁধিয়ে ডিপ্রেশনে চলে যেতেন, তাহলে বুদ্ধের নিষ্কাম কর্মের এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গের দীক্ষা কারা মানুষের কাছে পৌঁছে দিত?
এই সব যুক্তি, তক্কো আর গপ্পে কেটে যায় এই শতকের প্রথম কুড়িটা বছর। ২০১৯-এ আমার সদ্য প্রকাশিত একটি উপন্যাস সম্পর্কিত বিষয়ে বক্তৃতা দিতে, যেতে হয়েছিল হংকং-এর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে আলাপ হল পরিবেশ নিয়ে গবেষণারত ক্রিস্টফ রুপ্রেখটের সঙ্গে। এই জার্মান ভদ্রলোক কাজ করছেন পোষণযোগ্যতা (Sustainability) নিয়ে। সম্প্রতি সাস্টেনেবেলিটি-র নতুন সংজ্ঞা উদ্ভাবন করে ক্রিস্টফ এবং তাঁর সহ-গবেষকরা বেশ আলোড়ন ফেলেছেন। তাঁর মুখে নতুন শব্দটি শুনলাম: ‘সোলারপাঙ্ক’ (Solarpunk)।
ডিসটোপিয়ান সাহিত্যের পাশাপাশি একটু একটু করে যে একটি বিপরীত ধারা বইতে শুরু করেছে তার খবর জানা ছিল। এই ধরনের লেখা, যেমন কিম স্ট্যানলি রবিনসনের ‘প্যাসিফিক এজ’-ও খানিক পড়া হয়েছে। সাইবারপাঙ্কের সঙ্গে পরিচয় বহুদিনের, ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের ‘স্টিমপাঙ্ক’ লেখা এক ধরনের পাঠককে মজিয়ে রাখে সেটাও শুনেছি। আর আমার উপন্যাসে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিষয় থাকায়, সমালোচকরা তাকে ‘বায়োপাঙ্ক’ ঘরানায় রেখেছেন শুনে খুশিই হয়েছিলাম। কিন্তু সোলারপাঙ্ক ব্যাপারটা কী?
নামটার মধ্যেই রয়েছে এই সাহিত্য এবং জীবনচেতনার মূল মন্ত্র। সোলার, অর্থাৎ সৌরচালিত। এখানে ইলন মাস্ক-এর রকেটে চেপে মঙ্গলগ্রহে পালিয়ে বিত্তবানদের কলোনি বানাবার স্বার্থপর স্বপ্ন নেই, নেই সাইবারপাঙ্কের কম্পিউটার-কেন্দ্রিক আলো-আঁধারির জগৎ। সোলারপাঙ্কের গল্পের পৃথিবী বর্তমান বিজ্ঞাননির্ভর, এই সাহিত্যের পরতে পরতে সাধারণ কিন্তু বলিষ্ঠ স্বপ্ন দেখার প্রচেষ্টা। শুধু সাহিত্য নয়, সোলারপাঙ্ক এখন একটি ভাবধারা, একটি রাজনীতি, একটি জীবনদর্শন, একটি আন্দোলন, যা মনে করিয়ে দেয় গান্ধীর গ্রামস্বরাজ, শ্যুমাখারের ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’-এর চিন্তা। পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর অর্থনীতিতে বিশ্বাস না রেখে, এই সোলারপাঙ্ক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা জুড়ে সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখে।
ক্রিস্টফের উৎসাহে, সোলারপাঙ্ক গল্পের একটি সংকলন নিয়ে কাজ শুরু হল লকডাউনের কয়েক মাস আগে। ডি কে মোক, অ্যান্ড্রু ডানা হাডসনের মতো পরিচিত সোলারপাঙ্ক লেখক ছাড়াও, অনেকে গল্প পাঠালেন। সেসব গল্পে, বরফঢাকা অদূর ভবিষ্যতে ভ্লাদিভস্তক শহরে ঘুরে বেড়ানো সাইবেরিয়ার বাঘের ছবি তুলতে আসা কানাডিয়ান যুবক-যুবতীর ভুল বোঝাবুঝির মধ্যেই দেখতে পাই নতুন অনতিদূর ভবিষ্যৎ পৃথিবীর হাতছানি। জঙ্গল কাটা বহুদিন বন্ধ, বাঘও আর মানুষকে ভয় পায় না, ঘুরে বেড়ায় শহরপ্রান্তে, কিন্তু কতটা বদলেছে আমাদের উত্তরসূরি হোমো সেপিয়েন্স? দক্ষিণ ভারতের পরিচিত ফ্যান্টাসি গল্পকারের লেখায় ঠিক হ্যামেলিনের ‘পায়েড পাইপার’-এর মতো, ডলফিনরা মানবশিশুদের কানে গেয়ে যায় পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার গান। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের গল্পে লেসবিয়ান জুটির চিড়-ধরা সম্পর্ক জোড়া লাগিয়ে দেয় শহরের চোখধাঁধানো আলোয় পথ হারিয়ে ফেলা সমুদ্রকচ্ছপ।
ইউটোপিয়ান চিন্তাভাবনার সঙ্গে মিল থাকলেও, সোলারপাঙ্ক কল্পনা এবং পলিটিকস-এর বৈশিষ্ট্য: আমূল পরিবর্তন আর দুনিয়া বদলের খেলায় না মেতে, ছোট আকারে সমস্যার সমাধান এবং পরিবর্তনের প্রচেষ্টা। সোলারপাঙ্কের ‘গেরিলা গার্ডেনার’-রা বন্দুক তুলে নেয় না, তাদের অস্ত্র ‘বীজ বোমা’ বা ‘সিড বম্ব’। তারা পৃথিবীর নানা শহরের পরিত্যক্ত জায়গায় ফুল, ফল, সবজির বীজ ছড়িয়ে দিয়ে যায় রাতের অন্ধকারে। সেই সবজি স্থানীয় মানুষের কাজে লাগে, গাছে ফুল ধরলে নোংরা আবর্জনা, কংক্রিটের মধ্যে একটুকরো জায়গা সুন্দর হয়ে ওঠে। এইভাবেই সোলারপাঙ্ক চেতনা উদ্ভাবনকুশলতা, যৌথতা, সহমর্মিতার উপর ভর করে, পৃথিবীকে অল্প-অল্প করে সুন্দর করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। পুরোটা হয়তো সফল হওয়া যাবে না জেনেও, চেষ্টা চলতেই থাকে।
সোলারপাঙ্কে, পাঙ্কদের বিদ্রোহ ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভাবনার লেশ রয়ে গেছে বলে তাদের হয়তো ‘রবি-রংবাজ’ বলা যায়, কিন্তু এই ভাবধারার মানুষরা বলছে বিকেন্দ্রীকরণের কথা। ওপর থেকে কোনও মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ায় এরা বিশ্বাসী নয়— ‘no grand ideas’। ঘ্যাঁচ করে শত্রুর গলা কেটে, বা ভোগবাদের আফিমে মানুষকে ডুবিয়ে তাকে দিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করানো আর তার ব্যক্তিস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার পলিটিক্স এরা করবে না কিছুতেই।
বিশেষজ্ঞ কোনর ওয়েন্স-এর মতে, ব্যক্তিস্বাধীনতা আর সামাজিক সংহতির ভারসাম্য বজায় রাখতে তৈরি একটি সমাজের কল্পনাই দেখা যায় সোলারপাঙ্ক-এ। সমবায় ব্যবস্থা, কর্মীদের হাতে কোম্পানির মালিকানা, ছোট মাপে সৌর এবং বায়ু-শক্তির ব্যবহার, পরিবেশকে মানুষ এবং অন্য জীবজন্তুর জন্য উপযোগী করে তোলার প্রচেষ্টা— এ সবই সোলারপাঙ্ক সাহিত্য ও দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্গত। শিল্প ও সাহিত্য কল্পনায় এই সোলারপাঙ্ক ভবিষ্যতের চেহারা কেমন হতে পারে, তার ইঙ্গিত রয়েছে ইন্টারনেটের আনাচে-কানাচে।
ক্রিস্টফ বললেন, ওঁর কাছে সোলারপাঙ্ক সাহিত্যের দুটি দিক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এই লেখায় রয়েছে সৎ এবং নির্ভীক ভাবে সমাজ ও পরিবেশের সমস্যার মোকাবিলা করায় বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে নেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বা মহান কোনও সমাধানসূত্রের ওপর নির্ভরতা। দ্বিতীয়ত, হতাশায় না ডুবে, প্রলয় নিয়ে না ভেবে, এই ভবিষ্যৎ কল্পনা মনে করিয়ে দেয়, আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষরাই সহজ, সরল এবং সাধারণ মাপের সমাধানের ভিত্তিতেই, পৃথিবীকে আরও একটু সুন্দর করতে পারে। অতিমারীর অন্ধকারে, দাবানল, সাইক্লোন, ছোটবড় নানা রকম দুঃসংবাদ, স্বৈরাচারীদের চোখরাঙানি, বিপর্যয়ের গুঁতো খেতে খেতেও, সোলারপাঙ্করা দুনিয়া মেরামতের কাজ থেকে পিছিয়ে আসে না। সূর্যের শক্তি তাদের সহায় হোক।