মায়ের কাছে মাসির গল্প
তারপর আরও কিছু মাস কাটে। বাবুদা-কে কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। ফোন ধরে না। নাম্বার পাল্টে যায় মাঝে মাঝেই। একবার শোনা গেল বাবুদা স্পেনে চলে গেছে। সেখানে কোন ফ্লামেঙ্কো নাচিয়ের সঙ্গে কী একটা প্রোজেক্টে। বাবুদার ব্যাপার খুবই হাইফাই।
এক হেমন্ত সন্ধ্যায় ছাতিমের গন্ধে মাতাল হয়ে সৌমিত্র সিগারেট কিনতে একটা দোকানে ঢুকতে যাবে এমন সময় দেখে বাবুদা। সিরিয়াস মুখে বিপরীত ফুটপাতে হাঁটছে হনহন করে। গায়ে কালো পাঞ্জাবি। ‘ও বাবুদা! ও বাবুদা!’ রাস্তা ক্রস করতে গিয়ে প্রায় গাড়ি চাপা পড়ছিল সৌমিত্র।
বাবুদা : আরে সোমু তুই! এখনই জ্যাকেট চাপিয়েছিস গায়ে? শীত কোথায়?
সৌমিত্র : আমার গিটার?
বাবুদা : রাইট, তোর গিটার!
সৌমিত্র আশ্চর্য! এক চান্সেই মনে পড়ে গেল বাবুদার! বাবুদা হুট করে ঢুকে পড়ে রাস্তার একটা জামাকাপড়ের দোকানে।
বাবুদা (ফুল কনফিডেন্স) : ও দাদা, একটা কলম দেখি।
দোকানদার : কেন?
বাবুদা : এত প্রশ্ন করছ কেন? কলম দিতে পারছ না একটা?
দোকানদার ভয় পেয়ে যায়। একটা ডট পেন এগিয়ে দেয়।
বাবুদা : বেশ, এবার একটা কাগজ দেখি।
দোকানদার একটা কাগজও এগিয়ে দেয়। বাবুদা লিখতে গিয়ে বুঝতে পারে পেনে কালি নেই। দু’তিনবার বিফল ঘষাঘষি করে খুব রেগে যায়।
বাবুদা : ইডিয়ট! একটা কলম দিতে পারছ না? এটা কী?
দোকানদার ডবল ভয় পেয়ে আর একটি পেন এগিয়ে দেয়। বাবুদা লিখতে শুরু করে।
বাবুদা : সোমু এদিকে আয়। এই হল ঠিকানা।
সৌমিত্র : কীসের?
বাবুদা : তোর গিটারের।
সৌমিত্র : মানে?
বাবুদা : ওহো হাঁদা ছেলে! এটা আমার মায়ের বাড়ির ঠিকানা। কাল সকালে চলে যাস, গিয়ে বলবি আমি পাঠিয়েছি। কেসের মধ্যে যত্ন করে রাখা আছে তোর গিটার।
সৌমিত্র : তোমার মায়ের বাড়ি তো বর্ধমানে জানতাম। সিঁথির মোড়ে কবে এল?
বাবুদা : আহ্, ওটা দেশের বাড়ি। এখানে আমাদের নিজেদের ফ্ল্যাট।
সৌমিত্র : তুমি এখন ওখানে থাকো?
বাবুদা : আরে না সোনা। আমার উত্তরে থাকলে চলে? সব কাজ তো এদিকেই।
সৌমিত্র : তুমি কাল থাকবে সকালে?
বাবুদা : না রে, কাল সকালে আমি তো ঢাকা বেরিয়ে যাচ্ছি। সামনের উইকে ফিরব। তারপর তুই পল সাইমনের ওই গানটা শোনাবি তোর গিটারে! যা ফ্যান্টাস্টিক লাগে তোর গলায় ওটা! (আবার সেই হাসি)
সৌমিত্র ঠিকানা লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে ওটার একটা ছবি তুলে রাখে। মহামূল্যবান কাগজ। হারিয়ে গেলে মুশকিল। বাড়ি ফিরে কী মনে হয় একবার গুগল করে দেখে আদৌ ওরকম কোনও ঠিকানা আছে কি না। পেয়ে যায়, অসুবিধে হয় না।
পরদিন সকাল সকাল হাজির হয় সেই ঠিকানায়। চারতলা ফ্ল্যাট। লিফ্ট নেই। হেঁটে হেঁটে টপ ফ্লোরে গিয়ে বেল দেয়। দরজা খোলে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে এক ছোকরা।
ছোকরা : কাকে চাই?
সৌমিত্র : মাসিমা… ইয়ে মানে বাবুদার মা…
ছোকরা : বাবুদার মা?
সৌমিত্র : হ্যাঁ বাবুদা পাঠিয়েছে।
ভেতর থেকে এক পুরুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায় : কে রে?
সৌমিত্র : মাসিমা আছেন? আমি সৌমিত্র, বাবুদা পাঠিয়েছে।
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। তারপর এক মাঝবয়সি পুরুষ আসেন দরজার মুখে।
পুরুষ : কে মাসিমা?
সৌমিত্র : এই সরি, মানে এটা বাবুদার মায়ের বাড়ি নয়?
পুরুষ : কোন বাবু?
সৌমিত্র : আরে মিউজিক ডিরেক্টর বাবু।
পুরুষ : ওই শুয়োরের বাচ্চার আবার মা-বাপের ঠিক আছে না কি?
সৌমিত্র নীরব।
পুরুষ : কেন পাঠিয়েছে তোমাকে?
সৌমিত্র : না মানে আমার গিটারটা বোধহয় আপনার এখানে…
পুরুষ : বাবু শুয়োরের বাচ্চাকে বলবি আগে আমার দু’খানা কি-বোর্ড ফেরত দিয়ে যাবে, তারপর ওই গিটারের কথা মুখে আনবে।
এরপর সৌমিত্রর মুখের উপর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সৌমিত্রর বুঝতে একটু সময় লাগে কিন্তু এটা ভেবে ভাল লাগে যে, গিটারটা আছে! সে মনে আরেকটু সাহস সঞ্চয় করে আবার বেল দেয়।
পুরুষ : কী? কথা কানে যায়নি?
সৌমিত্র : না, মানে গিটারটা আসলে আমার তো, অনেকদিন দেখিনি। একবার যদি দেখতে পেতাম! না না, আমি নিচ্ছি না, জাস্ট দেখব।
পুরুষ : নিতাই, গিটারটা এই লোকটাকে দেখা তো!
সৌমিত্রর চোখের সামনে তাসের ঘর ভেঙে পড়ে। একটা ঝুলমাখা কালো সস্তা খাপের ভেতর থেকে একটা জীর্ণ, প্রাচীন, অসুস্থ গিটার বেরোয়।
সৌমিত্র : এটা কার গিটার?
পুরুষ : আমি কী করে বলব? রেখে গেছিল। আমাকে তো ব্লক করে দিয়েছে ফোনে। যেদিন হাতে পাব, শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ে ফেলে ক্যালাব।
হতাশা
এরপর আবার কিছু মাস কেটে যায়। বাবুদা পাঁকাল মাছের মতো বেঁচে থাকে। রেগুলার কাগজে ছবি বেরোয় কিন্তু সৌমিত্রর নাগালের বাইরে। একবার প্ল্যান হয়, সোশাল মিডিয়ায় লিখবে। লেখাও হয় কিন্তু সেখানে বাবুদা ওদের পাত্তাই দেয় না। গিটার ঝেড়ে দিয়েছে এই নিয়ে বাবুদার নামে কেউ স্টোরিও করতে চায় না কাগজে। কোথায় যে কলকাঠি বাঁধা আছে সৌমিত্র কিছু বুঝতে পারে না। পয়লা বৈশাখে শুভেচ্ছা জানিয়ে আচমকা এক মেসেজ আসে। রিপ্লাই না দিয়ে সোজা কল করে সৌমিত্র। বাবুদা ফোন ধরে না। আবার একটা মেসেজ আসে, ‘আগামীকাল সাকিব তোর কাছে তোর গিটার নিয়ে যাবে।’ পরদিন সত্যিই সাকিব একটা থার্ডক্লাস গিটার নিয়ে আসে, যেটা দেখে ওটা ওর মাথায় ভাঙতে ইচ্ছে করে সৌমিত্রর। পারে না। তবে ঠিক করে এবার বাড়ি গিয়েই ধরতে হবে ব্যাটাকে।
যে-অফার ফেরানো যায় না
সৌমিত্র : গিটার কোথায় বাবুদা?
রোহিত : আমি একটু বাড়িটা ঘুরে দেখি। তুই মালটাকে উঠতে দিস না।
বাবুদা : তোরা বড্ড ছেলেমানুষ।
রোহিত : চোপ! এখানেই বসে থাকো তুমি। একদম নড়বে না।
পাঁচ মিনিট বাদে ফিরে আসে রোহিত।
রোহিত : এখানে তো একটা খঞ্জনিও নেই মনে হয়। এটা কী জায়গা? এটা তোমার বাড়ি?
বাবুদা : আরে এটাকে তো স্টুডিও বানাব!
সৌমিত্র : এখানে?
বাবুদা : হ্যাঁ স্টেট অফ দ্য আর্ট!
সৌমিত্র : দ্যাখো, এই ক’বছরে আমি বুঝে গেছি ও-গিটার আমি আর পাব না!
বাবুদা : আরে এরকম কেন ভাবছিস? যেখানেই আছে, মানুষের কাজে নিশ্চয় লাগছে।
সৌমিত্র : এই প্লিজ বাজে না বকে আমার কথা শোনো। গিটারটার দাম ছিল।
বাবুদা : আলবাত! ভেরি এক্সপেন্সিভ।
সৌমিত্র : আমি তোমার থেকে গিটারটা আর চাই না। দামটা চাই। তুমি আমাকে দু’লক্ষ টাকা দেবে। কবে দেবে?
বাবুদা : আরে বোকা ছেলে। আগে বলবি তো!
রোহিত : এই কোথায় উঠছ?
বাবুদা : না উঠলে দেব কী করে?
সৌমিত্র : তোমার কাছে এখন টাকা আছে?
বাবুদা : উফ! ছটফট করিস না। বস শান্ত হয়ে।
এরপর বাবুদা গুটগুট করে পাশের ঘরে ঢুকে যায়। একটা কাঠের বাক্স হাতে ফিরে আসে।
বাবুদা : দেখ, এটার মধ্যে কোনটা পছন্দ হয়।
সৌমিত্র আর রোহিত তাকিয়ে দেখে টাকা নয়। দুটো অত্যন্ত দামি বিদেশি মাইক্রোফোন। দুটোই নয়ম্যান কোম্পানির।
বাবুদা : এই মডেলটা দেখেছিস কোনওদিন চোখে?
সৌমিত্র : এগুলো আসল?
বাবুদা : মডেল নাম্বার মিলিয়ে দেখে নে। দামও পেয়ে যাবি অনলাইন।
রোহিত চটপট মডেল নাম্বার মিলিয়ে দেখে এক-একটার দামই প্রায় তিন-চার লক্ষর কাছে।
সৌমিত্র : তুমি পেলে কোথায়?
বাবুদা : আরে আমার তো এসবের খুব সখ। সেবার জার্মানি থেকে আনলাম। আসলে সবসময় মাথায় রাখবি সোর্সটা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট। আজকাল তোরা সব বলিস না মিক্স-এ ঠিক করে দিবি। টেল মি, কী করে করবি? আরে বোকা, রেকর্ডিংটাই যদি ভুল করিস তাহলে আর সাউন্ড মিক্সে কী করে ঠিক করবি? তাই সবসময় মাইক্রোফোনটা টপ ক্লাস হওয়া দরকার। জাদুটা ওখানেই।
সৌমিত্র : তুমি কি সব জায়গায় মাইক ক্যারি করো না কি?
বাবুদা : আজকাল করছি। তবে এগুলো এই যে স্টুডিওটা বানাব, তার জন্যই নেওয়া। তোদেরই তো স্টুডিও। শোন, ব্যবসার জন্য তো খুলছি না এটা। শুধু সিলেক্টেড কিছু মানুষ নিয়ে কাজ করব। তোরা আসবি। যখন তোদের মনে হবে কাজ করবি। যখন মনে হবে আড্ডা দিবি। (আবার সেই হাসি)
রোহিত দেখেশুনে একটা মাইক হাতে দুলে নেয়, ‘এটা নিলাম।’
বাবুদা : ব্যাড চয়েস। তোদের ভোকাল্সের জন্য অন্যটা বেটার। ওটা আরও ফিল্মি সিল্কি ভয়েসের জন্য ভাল। মানে বোঝাতে পারলাম? মানে বম্বের আর্টিস্ট ধর…
তার আগেই রোহিত পাল্টে নিয়েছে : চল, উঠি।
ওস্তাদের মার
মাস দুই পরের কথা। সৌমিত্রদের অ্যালবাম রেকর্ড করার কথা। সল্টলেকের সাউন্ডহাউস স্টুডিওতে রেকর্ডিং। সৌমিত্র ওদের আগে থেকে জানিয়ে রেখেছে ওরা নিজেদের বিশেষ মূল্যবান বিদেশি ভোকাল মাইক নিয়ে আসবে। শুনে রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার বাপন খুব উত্তেজিত।
ওরা পৌঁছে দেখে ওদের স্বাগত জানাতে স্টুডিও মালিক কুলদীপ সিং নিজেই উপস্থিত। বড় ভাল মানুষ কুলদীপবাবু। গানবাজনা মন থেকে ভালোবাসেন। বিশাল ব্যবসা উত্তরবঙ্গে। কলকাতার স্টুডিও চলে লসে।
কুলদীপ সিং : আসেন আসেন। ওয়েলকাম। চা, কফি কিছু বলি?
সৌমিত্র : নমস্তে কুলদীপজি! চা বলবেন প্লিজ।
বাপন : আপনাকে বলছিলাম না কুলদীপজি, ওরা আজ নিজেদের মাইক নিয়ে এসেছে। ওই সেই মডেলটা!
কুলদীপ সিং : আরে কেয়া ব্যাড লাক! তুমরা তো জানো বোধহয়, লাস্ট ইয়ার আমি এই সেম মডেলের মাইক কিনেছিলাম এই স্টুডিয়োর জন্য। লেকিন চোরি হয়ে গেল।
সৌমিত্র : সে কী কথা! স্টুডিও থেকে মাইক চুরি হয় কী করে? সিসিটিভি নেই?
বাপন : তখন ছিল না। ওই চুরির কেসের পর থেকে লাগানো হয়েছে।
সৌমিত্র : যে-পিরিয়ডে চুরি যায় তখন কারা কারা এসেছিল জানা আছে?
বাপন : হ্যাঁ, তিন’চারজনকে তো বলেছিলাম।
কুলদীপ সিং : আরে ছোড়িয়ে! সব বড়া বড়া আদমিলোগ আছেন। পিলু সরকারের বেটা ছিল। ও ফিমেল সিঙ্গার, কী যেন নাম, সুচিত্রা দিদি ছিল।
বাপন : সুরিন্দরজি আমার তো সন্দেহ হয় ওই বাবুদার উপর। ওকে বলাতে এমন রিঅ্যাক্ট করল! আমরা শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও ভীষণ বাজে ব্যবহার করল ফোনে। বলে আর কোনওদিন আসবে না এই স্টুডিওতে। আসবে না তো আসবে না। আমাদের কি আর ক্লায়েন্ট নেই? একদম ফালতু লোক।
কুলদীপ সিং : আরে যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। রেকর্ডিং-এর আগে এসব কোথা বলে লাভ নাই। আপনার মাইকটা যদি একবার বের করেন। আপকা মাইক একবার দেখেই চলে যাব।
সৌমিত্র আর রোহিত দুজনেই লক্ষ করে যে ঘরের ২২ ডিগ্রিতেও ওরা দুজনেই প্রবল ঘামছে। সৌমিত্রর পেটের ভেতর একটা যন্ত্রণা শুরু হয়। একভাবে তাকিয়ে থাকে কার্পেট ঢাকা মেঝের দিকে। পাশে বসে থাকেন সাদা পাগড়ি, সাদা দাড়ি-গোঁফ সৌম্য সুদর্শন নিরীহ বৃদ্ধ সর্দারজি। সৌমিত্রর একবার ইচ্ছে করে ওঁর পা-দুটো বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। এক দীর্ঘ নীরবতার মধ্যে সবাই বসে থাকে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র