জল্লাদের জমানা
আমেরিকার সবাই আবার প্রতিবাদে উত্তাল, কারণ আবার এক কৃষ্ণাঙ্গকে খুন করল পুলিশ, আবার ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গেল পুলিশের ভয়াবহ নৃশংসতা, তবে সবাই আরেকটু অবাক কারণ যে-পাঁচজন পুলিশ মিলে এই হত্যা করল তারা সকলেই কৃষ্ণাঙ্গ। মেমফিস-এ, টায়রি নিকোলস-কে থামানো হয়েছিল ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গ করার জন্য, যদিও তিনি কোন নিয়ম ভেঙেছিলেন তা এখনও স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না, তাঁকে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে টেজার দিয়ে শক দেওয়া হয়েছিল এবং মরিচের স্প্রে ছোড়া হয়েছিল তাঁর মুখে, তারপর তিনি ছুটে পালিয়ে যান এবং এরপর তাঁকে ধরে শুরু হয় বেধড়ক মার, তিন মিনিট ধরে চলে সেই পেটানি, কখনও মুখে লাথি মারা হয়, কখনও ঘুসি, ব্যাটন দিয়ে মারা হয় শরীরে, বারবার এমন সব আদেশ দেওয়া হয় যা মানা তাঁর পক্ষে অসম্ভব (যেমন হাত দুটো দুজন পুলিশ ধরে আছে, অথচ তাঁকে বলা হচ্ছে হাত দুটো এমন করে তুলে ধরো যাতে পুলিশ স্পষ্ট দেখতে পায়, তিনি মাটিতে পড়ে আছেন এবং তাঁকে আদেশ দেওয়া হচ্ছে মাটিতে শুয়ে পড়তে), অকথ্য গালাগাল করে হুমকি দেওয়া হয় (তোকে শেষ করে দেব, তোকে এমন শিক্ষা দেব যে…)। শেষে নিকোলসের দেহটাকে ঠেস দিয়ে রাখা হয় একটা পুলিশ-ভ্যানের গায়ে, প্যারামেডিকরা এলেও নিকোলসের শুশ্রূষা শুরু করতে তাঁদের লেগে যায় আরও ১৬ মিনিট, তারপর হাসপাতাল, যেখানে তিনদিন পর নিকোলসের মৃত্যু। পরে পুলিশের বডি-ক্যামেরার ফুটেজ এবং রাস্তার সিসিটিভি-র ফুটেজ থেকে বোঝা যায়, গোটা সময়টায় নিকোলস একবারও প্রত্যাঘাত করেননি, শুধু মা’কে বারবার চেঁচিয়ে ডেকেছেন, তাঁর বাড়ি ওখান থেকে একটু দূরেই।
‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশন’ সংস্থার পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে : ‘যদিও গণমাধ্যম অনেকটা সময় ধরে সবাইকে বুঝিয়েছে যে দায়ী পুলিশ অফিসাররা সবাই কৃষ্ণাঙ্গ, যেন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, একটা কথা আমরা স্পষ্ট করে বলি— সমস্ত পুলিশই পুঁজিবাদের স্বার্থ বজায় রাখতে কাজ করে, এবং রাষ্ট্রের মদতে হিংসা প্রয়োগ করে। যে-লোকই এমন একটা সিস্টেমে কাজ করে, যেখানে রাষ্ট্রের মদতে হিংসা চলছে, সে-ই আসলে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য জারি রাখার কাজে সহায়তা করছে।’ এর মধ্যে একটু রাজনৈতিক একবগ্গা ম্যানিফেস্টোর ভাষা পড়া যাচ্ছে, তবে এখানে বোধহয় বলার চেষ্টা হচ্ছে সব অনুগত কর্মচারীই কাজ করে চলেছে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থরক্ষার জন্য, আর আমেরিকায় ক্ষমতাসীন বলতে মূলত শ্বেতাঙ্গদেরই বুঝতে হবে। কিন্তু এতে সন্দেহ নেই যে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে থাকতে বা ক্ষমতা ভোগ করতে-করতে অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায় এবং মারতে খুব ভাল লাগে, এবং সেই ঔদ্ধত্য ও ধর্ষকাম সাদা-কালো নির্বিশেষে চারিয়ে যায়। সাদা পুলিশই প্রথম গাড়ি থেকে নিকোলসকে টেনে নামিয়েছিল, তবে মূল মারধরটা করেছে কালো পুলিশ। নিকোলসের পরিবার অভিযোগ করেছে, সাদা পুলিশটির বিরুদ্ধে কোনও খুনের মামলা রুজু করা হয়নি। কিন্তু তাতেও কালো নাগরিকের বিরুদ্ধে কালো পুলিশদের প্রকাণ্ড ক্রোধ ও ঘৃণার আখ্যান চাপা পড়ে না। একটা লোকের দুটো হাত দুটো লোক মুচড়ে ধরে আছে, আর আমি বলছি এক্ষুনি হাতদুটো তুলে আমাকে দেখা, আর সে তা না পারলে তার মুখে মরিচ-স্প্রে করে দিচ্ছি, একজন মাটিতে শুয়ে আছে আর আমি তাকে বলছি এক্ষুনি মাটিতে শুয়ে পড় আর সে যখন ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে তার মুখে আমি ফের মরিচ স্প্রে করে দিচ্ছি— এখানে কোনও আইন বা অনুশাসনের বালাই নেই, আছে স্রেফ অত্যাচার করার মজা, একটা অসহায় লোককে অনেকে মিলে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে খুন করার আমোদ। এখানে সাদা-কালো তফাত না করে, বলা ভাল, পুলিশ মেরেছে সাধারণ মানুষকে, ক্ষমতাবান মেরেছে ক্ষমতাহীনকে, ‘বেশ করেছি’ মেরেছে ‘ওরেবাবাগো’কে। কেউ বলেছে, বর্ণবৈষম্য এত সরল না কি, যে শুধু শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের ঘৃণা করে? কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি ঘৃণা বোনা নেই? যেমন পিতৃতন্ত্রের ধারণাগুলোকে অনেক মেয়েই তীব্র বহন করে চলে, তেমনই বর্ণবৈষম্যের নকশাগুলো বহু কৃষ্ণাঙ্গ আত্মস্থ করে নেয়। আরেক দল বলছে, এখানে মূল ব্যাপারটা আদৌ বর্ণ নয়, পুলিশের সংস্কৃতি। সেখানে শেখানো হয় (এবং এই মনোবৃত্তিকে বাহবা দেওয়া হয়) যে আগ্রাসন খুব ভাল, নিষ্ঠুর প্রহার হল বীরত্বের দ্যোতক, এবং মানুষকে শিক্ষা দিতে গেলে তা কানের গোড়ায় থাবড়া মেরেই দিতে হবে। বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গগুলো (এবং বাদামিগুলোও) হচ্ছে আইন ভাঙার জাসু, শৃঙ্খলা ও বাধ্যতা এদের রক্তেই নেই, একটু অবমানব গোছের, তাই এদের বিছুটি-জঙ্গলে পুঁতে না দিলে ব্যাটারা পথে আসবে না। অর্থাৎ, দ্বন্দ্বটা সাদা-কালোর নয়, কালো-নীলের, মার্কিন পুলিশের নীল উর্দি গায়ে দিলে কেউ আর কোনও বর্ণের থাকে না, একটা এমন সমসত্ত্ব দলের সদস্য হয়ে যায়, যারা মনে করে তাদের যে-কোনও অন্যায়ের অবাধ লাইসেন্স আছে। অনেকে বলছে, আরে এত তত্ত্বকথা কীসের, ব্যাপার স্রেফ এই : কয়েকটা বদ ঠ্যাঙাড়ে মস্তান— যাদের শিক্ষা বোধ পরিণতমনস্কতা নেই— তারা ধরে একটা লোককে পিটিয়েছে। সবসময় এরকম কোনও ঘটনাকে ব্যক্তির হিসেব থেকে সমষ্টির হিসেবে চেলে, চলতি সমালোচনা বা প্রতিবাদের খোপে ঠুসে দিতে হবে কেন এবং সে কুঠুরি থেকে গতে-বাঁধা বিলাপ ও নালিশ টেনে বের করতে হবে কেন?
করতে হয়, বা প্রায় স্বয়ংক্রিয় ভাবে এই ভাবনাগুলো মাথায় আসে ও টপাটপ আলোচনার টেবিলে ড্রপ খায়, কারণ কালোদের বিরুদ্ধে পুলিশি নিগ্রহ বহুকাল চলছে। এক মহিলা বলছেন তাঁর বাবাকে ২০১৪ সালে একজন পুলিশ গলা টিপে খুন করে, হুবহু এরকমই পরিস্থিতিতে, এবং সেই পুলিশের কোনও শাস্তিও হয়নি। এরকম উদাহরণ গাদা-গাদা, এ মার্কিন পুলিশের এক ‘ঐতিহ্য’ বলা যায়, শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ কেউ বাদ যায় না এই অকারণ কৃষ্ণাঙ্গ-হত্যার পাঁচালি থেকে, এবং শুধু পুলিশ কেন সাধারণ শ্বেতাঙ্গ মানসে কালো-বিরূপতা এমন প্রকাণ্ড প্রোথিত যে কৃষ্ণাঙ্গদের নিগ্রহ করা হয় বিমানবন্দরে পার্কে দোকানে প্রেক্ষাগৃহে, শুধু এই নির্দিষ্ট ঘটনায় কালোই কালোর হত্যাকারী বলে ব্যাপার সামান্য গুলিয়ে গেছে, কিন্তু তা বলে একে ইতিহাস থেকে ছিঁড়ে নিতান্ত আকস্মিক আপতিক আখাম্বা ভাবা শক্ত। আবার অনেকে বলছেন এই পুলিশদের বিরুদ্ধে যে অবিশ্বাস্য দ্রুতিতে ব্যবস্থা নেওয়া হল, তা থেকেও কালো-বিরোধী ইস্তাহার পড়ে নেওয়া যায়। ঘটনা ঘটেছে ৭ জানুয়ারি, ২০ জানুয়ারি পাঁচজন পুলিশকেই বরখাস্ত করা হয়েছে, ২৬ জানুয়ারি তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে হত্যা, অপহরণ, আক্রমণ এবং বেয়াদব আচরণের জন্য। ২৭ জানুয়ারি পুলিশের তরফে কিছু ভিডিও ফুটেজ রিলিজ করা হয়েছে, যাতে সবাই এই পাঁচজনের কাণ্ড দেখে শিউরে উঠেছে। কিছু সমালোচকের মতে, কালো পুলিশ বলেই এত তাড়াতাড়ি এদের ভিলেন প্রতিপন্ন করা হল, এত তাড়াতাড়ি গ্রেফতার করা হল, ভিডিও ফুটেজ রাখঢাক না করে প্রকাশ্যে এনে ফেলা হল, শ্বেতাঙ্গ পুলিশ হলে হত না, আজ অবধি হয়নি।
কিন্তু রং না দেখে রংবাজি দেখার দিকেও পাল্লা ভারী, ঘটনাটাকে পুলিশ বনাম সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখছেন বেশির ভাগ লোক। পুলিশ সম্পর্কে অ-পুলিশ মানুষের একটা ভীতি অস্বস্তি বিরাগ এমনিতেই কাজ করে। পুলিশ মাইকে প্রচারের সময় বলে তারা সমাজের নিতান্ত বন্ধু, কিন্তু কাজে মনে হয় তারা অত্যন্ত প্রভু এবং অধীনস্থদের প্রতি ভয়ানক বিরক্ত, আর তাদের হেনস্থা করতে পারলে নাহক পুলকিত। তাই পুলিশ হিংস্র ব্যবহার করলে বহু মানুষ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে সমঝদার মাথা নাড়ে ও তেড়ে ওঠে, ‘কেমন, বলেছিলাম না?’ অনেকে পরামর্শ দিচ্ছে, পুলিশ বাহিনীতে আরও কালো, আরও বাদামি, আরও হলুদ মানুষদের রাখো, প্রান্তিক বা সংখ্যালঘু মানুষের যোগদানে পুলিশ বাহিনী হয়ে উঠবে সেই গোষ্ঠীগুলির প্রতি সহিষ্ণু। কিন্তু কালো রক্ষক যদি কালো নিরীহকে এভাবে খুন করে, তবে এই তত্ত্ব তো ধুলো খাবে। এও ভেবে দেখতে হবে, যে-পুলিশরা ঘিরে ধরে লোকটাকে পেটাচ্ছিল, তারা আগাগোড়া জানত যে তাদের বডি-ক্যামেরায় পুরো ব্যাপারটা রেকর্ড হচ্ছে— তাদের তাবৎ খিস্তি হুমকি আস্ফালন এবং অবশ্যই ক্রিয়াকলাপ। তা সত্ত্বেও তারা এতটুকু ভয় পায়নি, নিজেদের আচরণে বা জিভে রাশ টানেনি, কারণ তারা জানতই যে কিস্যু হবে না। কেউ এই ক্যামেরার ফুটেজ দেখবে না, তাই তার ভিত্তিতে কোনও অভিযোগও হবে না। হয়তো লোকটা মরে না গেলে হতও না। ওরা বোঝেনি হাতের সুখ করতে গিয়ে, বা নিজেদের অতৃপ্তি কোথাও উগরে দিতে গিয়ে, ধাঁ করে ব্যাপারটা খুনে গড়িয়ে যাবে। তাহলে হয়তো বুট-পরা পায়ে মুখে লাথি মারতে গিয়ে গতিটা একটু কমাত, বা ব্যাটনের ঘা মারার সময়ে সংখ্যা কয়েকটা হ্রাস করত। কিন্তু ক্যামেরাকে কাঁচকলা দেখানোর স্পর্ধা অনায়াসে করতলগত যে-বাহিনীর, তার আচরণকে শুধু বর্ণবৈষম্য দিয়ে ব্যাখ্যা করলে, দৃষ্টিটা সরু হয়ে যাবে। যারা গণধোলাই দিতে ভালবাসে, যারা নিরস্ত্র লোকের ওপর অনেকে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে থেঁতলে দুমড়ে মুচড়ে রক্তাক্ত করে দিতে চায়, যারা প্রচুর গালাগাল মিশিয়ে সোল্লাসে বারবার তড়পায়, তোকে আজ শেষ করে দেব, এবং লোকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে যাওয়ার পর যারা গর্ব করে চিল্লায়, ওয়া কীরকম পেটালাম, ওঃ আমি যা ঘুসিগুলো মারছিলাম না, শালার একেবারে হয়ে গেছে— তাদের মূল বৈশিষ্ট্য হল, তারা মানুষকে মেরে আনন্দ পায়, অপমান করে খুশি হয়, তারা মদের মতোই হিংসার নেশায় ঢুকে গেছে, তারা উগ্রকর্মা বিদ্বিষ্ট এবং টর্চারপ্রেমী। তারা বুকে কষকষে গরগরে আক্রোশ পুষছে পালছে, আর ছোঁকছোঁক করে ঘুরছে কখন পরবর্তী উৎপীড়ন বাগাতে পারবে। তাদের সমস্যা শুধু বর্ণবিদ্বেষ নয, অমানবিকতা। এইরকম জল্লাদ দিয়ে যদি মার্কিন পুলিশ (বা, যে-কোনও পুলিশ) তৈরি হয়, তাহলে তারা ক্রমাগত অনাচার করবে এবং ‘রাষ্ট্রের অনুমোদন আছে’ এই বোধ তাদের আরও পরোয়াহীন ও খরখরে করে তুলবে। মানুষকে মারার অধিকার ভয়ানক অধিকার, প্রকাণ্ড দায়িত্ববোধ ছাড়া এই অধিকার বহন করা যায় না। কিন্তু দায়িত্ববোধ বা দায়বদ্ধতা শব্দগুলো গাল ভরে উচ্চারণ যত সোজা, আয়ত্ত করা তো তত সোজা নয়। তাই নিয়ম হল, মানুষ গুন্ডার হাতেও মরবে, পুলিশের হাতেও, কালো লোক মরলে চেনা তক্ক করবে, সাদা লোক মরলে একটু তুতলে যাবে।