ও
ও পারে না। সত্যিই যে পারে না, বুঝতে সময় লেগেছিল। চেপ্টে যাওয়া পটল টাইপ বেঁটে ফোন ওর। গায়ে দিশি শসার মতো আবছা বুটি-বুটি। টিপে দেখেছি। কিছু হয় না। আলো জ্বলে না, লেখা ফোটে না। ফোন এলে খ্যা-খ্যা করে বাজে। খুব জোরে। কী করে ব্যবহার করে কে জানে! করে কিন্তু। একবারও কাউকে ফোন করতে দেখিনি। কাউকে ফোন করার নেই? দরকার নেই? আমি দু-একজনের কথা শুনেছি যারা নিজেরা কিছু করে না। লোক থাকে ওদের। ‘বলে দাও আমি নেই।’ তারা কখনও বলে না, ‘দাও, আমি কথা বলব।’ ফোন ছাড়া তারা ভালোই থাকে। তবে ওর ফোন আসে। মেরেকেটে মাসে হয়তো একবার। এলে, খুব ব্যগ্র হয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর একটু দূরে চলে গিয়ে, খুব তাড়াতাড়ি কিছু বলে, শুনেটুনে, ফিরে আসে। তখনকার মুখ আর ফোন আসার আগের মুখের মধ্যে তফাত হয়। সারাক্ষণ ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে না। করার মতো কিছুই নেই। তবে আমি নিশ্চিত, সবসময় ওটার কাছেপিঠেই থাকে। বাইরে বেরোলে সঙ্গে নেয় না। অফ করে দিয়ে রেখে যায়। আমি কিছুতেই অন করতে পারিনি। একবার কায়দা করে জানতে চাওয়ায় বলল, ‘ব্যাটারিটা পুরনো হয়ে গেছে, খুব তাড়াতাড়ি চার্জ ফুরিয়ে যায়। খেয়াল রাখতে হয়, লাগবে কি না।’ এর মানে হল, ব্যবহার না করলেও জিন্দা রাখা জরুরি। প্লাগ পয়েন্টে লাগানো চার্জার থেকে ক্ষীণ বেণীর মতো একটা তার ঝুলতে থাকে। সবসময়। ওতে লাগিয়ে ফোনটাকে ঝুলিয়ে দেয়। বন্ধ ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো ব্যাপার। প্রায়ই দেখি, সেই দিকে তাকিয়ে আছে। আছে তো আছেই। একবার কার ফোন জিজ্ঞেস করায় আঁতকে উঠে অদ্ভুত মুখ করে তাকিয়েছিল। এই ব্যাপারটা ছাড়া আপত্তিকর কোনও কিছু নজরে আসেনি। বললাম বটে, তবে আপত্তির কোনও কারণ থাকতে পারে না। পঁচিশ বছর ঘর করছি। যে-মানুষ সময়মতো সব কিছু করে ফেলে, করে রাখে, যার কোনও দাবিদাওয়া নেই, শত্রু নেই, দোষ নেই, তার জন্য এটাই স্বাভাবিক।
আমার অসুবিধে হয় অন্য কারণে। কোথাও গেলাম, হয়তো কোনও বিয়ে বাড়িতে। ওই ফোন হাতে দেখলে কেউ-না-কেউ বলে বসবে, ‘এহেহে, এবারে একটা স্মার্ট ফোন নাও।’ ও বলবে, ‘কী করব নিয়ে?’ এর উত্তর হয় না। আমাকে ও কিন্তু একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিয়েছে। এখন অনেক লোকের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। ওতে ক্যামেরা, গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, আরও যা যা হয়, সবই আছে। এসব আমার কাজে লাগত না। একদিন খেয়াল করলাম, দিব্যি কাজে লাগাচ্ছি। ভাল লাগছে। কিছুদিনের মধ্যে অবশ্য কথা ফুরিয়ে গেল। লেখা থামানো যেত না। এটাও বুঝতে পারলাম, আজকাল প্রায় সবসময় আমার মেজাজ খিঁচড়ে থাকছে। আগে এমন হত না। এরপর যা শুরু হল, তা আরও খারাপ। ফোনটাকে আর সহ্য করতে পারছিলাম না। ফেলি কী করে? সারাদিন স্ক্রোল করে চলি। নতুন কিছু আসে না। কয়েকদিন ফেলে রেখে দিয়েছিলাম সাইলেন্ট করে। ভেবেছিলাম আপনি মরে যাবে। কোথায় কী! বের করা মাত্র দেখি চার্জ উপচে পড়ছে। অনেকেই জানতে চেয়েছে, ‘কী ব্যাপার, চুপ কেন?’ অবান্তর লিংক পাঠিয়েছে। আবার যে কে সেই! একে খুন করা অসম্ভব। ব্যাপারটা যে আসলে ভীষণ খারাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেটা বুঝেই কি ও স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে না? এদিকে, বাকি সব কিছু এত পারফেক্টলি চালায় যে হিংসে হয়! এবারে ওর ওপরে রাগ হতে লাগল। জমানো পয়সা দিয়ে ওকে একটা নতুন ফোন কিনে দিলাম। খুশি হল না। রেগেও গেল না। বাক্সে রেখে দিল। তার মানে ওই পটল দিয়েই চালিয়ে যাবে। ঠিক যেদিন আমি ভয়ংকর ঝগড়া করব বলে তৈরি, দেখি, নতুন ফোনে কথা বলছে। দেখামাত্র একটা খারাপ কাজ করলাম। অফিসে চলে যেতেই আগের ফোনটা নিয়ে অনেক কিছু খুঁজতে গেলাম। বন্ধ। আর চার্জ নিল না সে। চালু করতে পারলাম না। ওর যা কিছু আমি জানি না, তা নিশ্চয়ই আছে ওখানে। আমি নিশ্চিত যে ও নিজেই পুরনো ফোনটাকে মেরে ফেলেছে। যাক গে, এবারে আমার খেলাটা খেলতে পারব। অনেক কিছু শিখে গেছি। বুঝেছি। আরও জানা, বোঝা বাকি আছে। কে স্মার্ট, কে তা নয়, এবারে মালুম হবে।
যে-ব্যাপারটা নিয়ে আমার মনে সন্দেহ দানা বাঁধছিল, এবারে তার সমাধান সহজ হবে। প্রথমে সন্দেহের ব্যাপারটা বলি। এতদিন ও একজন বা কয়েকজনের সঙ্গে লুকিয়ে কথা বলত। এই ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ নেই। নিজের চেনা লোক সম্পর্কে মানুষ অকারণেই এক-দু’কথা বলে। ওকে বলতে শুনিনি। বন্ধুবান্ধব নেই। অফিসের কাজ অফিসে। আনস্মার্ট বলি কী করে? আজ অবধি এক নম্বর কাটতে পারিনি। কোনও দোষ খুঁজে পাইনি। এটা বিরক্তিকরও বটে। খবরের কাগজ পড়ে, শুধুমাত্র শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনের পাতা। একজন আসে অনেকদিন পরে-পরে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটু কথা বলে চলে যায়। কে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, ‘কেউ না।’ ফোনের কললিস্ট দেখতে পেলে আমার ফোনের ‘ট্রু কলার’ কাজে লাগিয়ে নাম জেনে ফেলতাম। একদিন, যেই না বাথরুমে গেছে, ফোন হাতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিলাম। লাভ হয়নি। ঝাপসা, মরা স্ক্রিন। সেদিন ওর নতুন ফোনটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করছিলাম, আপত্তি করেনি। করবে কেন? সব ব্যবস্থা আছে। কোনওটাই কাজে লাগায় না। অতএব কিছুই পেলাম না। কললিস্টেও কিছু নেই। অথচ ফোন এসেছে তো! তার মানে, ডিলিট করে দিয়েছে। অর্থাৎ, আমার সন্দেহ অমূলক নয়।
ফেসবুক খুলে দিলাম। আমারই তৈরি পাসওয়ার্ড। আপত্তি করল না। আমার ফোন থেকে সব দেখতে পাব। দরকার পড়লে। কিছু লোক ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল। যে-লোক কারুর সঙ্গে মেশে না, তার সঙ্গে কে সম্পর্ক রাখতে চায়? এদের সবার প্রোফাইল লক করা আছে। অদ্ভুত সব প্রোফাইল পিকচার! কিছু জানা গেল না। হোয়াটস্যাপেও একই ব্যাপার। ধু-ধু করছে। ও স্রেফ কথা বলে। টেক্সট, ছবি, এসবে নেই। আমার ফোন থেকে ওর ফোনের অনেক কিছুই দেখা সম্ভব। কিন্তু কার সঙ্গে কী কথা বলছে তা জানা বা শোনা সম্ভব নয়। গুগল টাইমলাইনে কোথায় গেছে না গেছে চেক করলাম। আপিস, বাড়ি, বাজারের ত্রিকোণ। একবার প্যারিস হল। বিয়েবাড়ি। সে তো আমিও ছিলাম সঙ্গে। হাড়পিত্তি জ্বলে গেল দেখে, ও আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। ছিন্নভিন্ন করে দিলাম সেই আবেদন। আমরা কেউ কাউকে এই ব্যাপারে কিছুই বললাম না। চাঁদু, ভাবছ আমি তোমাকে চিনি না? তুমিও চেনো না আমাকে। বুঝবে এবারে, কিতনা প্যাডি-মে কিতনা রাইস।
এমন হয় না কোনওদিন। গতকাল থেকে একটাও কথা বলেনি। সাধারণত সকালে যায়। আজ একটু বেলায় গিয়ে, বাজার নামিয়ে দিয়ে ‘বেরোচ্ছি, তুমি খেয়ে নিও’ বলে ফের বেরিয়ে গেল। কখন ফিরবে সেটা না বলে। নতুন ব্যাপার, ফোনটা রেখে গেল না। ভালই হল, দরকার পড়লে কথা বলা যাবে। মুখ দেখে খুব দুশ্চিন্তায় আছে না খুশিতে, বুঝতে পারলাম না। অন্য দিন ঠিক সময়ে অফিসে চলে যায়। ফিরেও আসে। রবিবারে নানারকম বাড়ির কাজ করে। এই দিনে কোথাও একা যেতে দেখিনি আজ পর্যন্ত। সব মিলিয়ে বেশ অবাক হবার মতো ব্যাপার। আমি স্নান সেরে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। নিজের ফোন ব্যবহার করার চেয়ে এখানেই সুবিধে। বড় করে দেখা যায়। এখন আমি যে-সুবিধেটা নেব, সেটা এতদিন পাইনি। নেওয়া হয়নি। প্রথমে মনে হল অন্যায় করছি। তারপর নিজেকে বোঝালাম। ঢুকে পড়লাম গুগল ম্যাপে ওর টাইমলাইনে। একটা নতুন অ্যাপের সন্ধান পেয়ে ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম প্রথম দিনে। অনেক কাণ্ড করা যায় ওতে। এখন আরামসে ট্র্যাক করা যাবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই অবধি ও জানে না। ও শুধুমাত্র যাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের নামটা হাপিস করে দেয়। কিন্তু কেউ যে এভাবে ওর ওপর রিয়েল টাইম নজরদারি করতে পারে, পিছু নিতে পারে তা ভাবতেও পারবে না। এমন করছি কেন? বলা মুশকিল।
এই মুহূর্তে ও একটা নীল ডট। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে। ম্যাপে আমাদের বাড়ি থেকে ডট এক চুল নড়েনি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে না কি? না, ডটটা ছিটকে গেল। থামল শহিদ ক্ষুদিরাম মেট্রো স্টেশনের কাছে। ও মেট্রো ধরেছে। চলেছে উত্তর দিকে। সারফেস দিয়ে যাচ্ছে। শিকার দেখতে পেয়ে চিতা যেমন একটু এগোয়, অপেক্ষা করে, আবার ঝট করে এগিয়ে যায়, ব্যাপারটা সেরকম। আমার কন্ট্রোল টাওয়ারে আমি আয়েস করে। ও এই মুহূর্তে গিরিশ পার্কে। নামবে না কি? ডট ওখানেই স্থির। নেমেছে। এগোচ্ছে। বিবেকানন্দ রোড ধরেছে। খুব দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে চালতাবাগান। অটোতে নিশ্চয়ই। এইমাত্র মানিকতলা ক্রস করে গেল। সিগন্যাল খায়নি। কোন রুটের অটো কে জানে! কাঁকুড়গাছি। ডানদিকে ঘুরেছে। এরপর ফুলবাগান। কিছুক্ষণ এক জায়গায়। তারপর আবার, ও থামছে না। ঘুরেছে পুব দিকে। অবিশ্বাস্য গতিতে বাইপাস পেরিয়ে গেল। ওহ হো, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো! সেক্টর ফাইভের দিকে যাচ্ছে। উত্তেজনায় আমি স্ক্রিনের খুব কাছে এসে গিয়েছিলাম। দেখতে চাইছিলাম ওকে। করুণাময়ীতে একটু থেমে ও ঢুকে পড়ল সেন্ট্রাল পার্কে। বাব্বাহ্, ওইখানে অ্যাপো বুঝি? এই ভরদুপুরে? বইমেলা চলছে। আজ শেষ দিন।
কুইক ডিসিশন নিলাম। বইমেলা পৌঁছনোর এটাই ফাস্টেস্ট রুট। প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে-না-ঢুকতে মেট্রো পেয়ে গেলাম। টালিগঞ্জ পৌঁছনোর আগে দেখতে পেলাম ও বইমেলা প্রাঙ্গণে ঢুকেছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আন্ডারগ্রাউন্ডেও নেট জোরদার। টানেলে ঢুকে যাবার পর নিজের গতিপথ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ও কিন্তু নড়ছে না। থাকো তুমি ওইখানে। ক্যাঁক করে ধরব। অভিযোগ কী? না, অভিযোগ করব না। চমকে দেব। তবে ঘটনা অন্য হলে সারপ্রাইজের চেহারা বদলে যাবে। গিরিশ পার্কে অটো গিলে ফেলল আমাকে। একই রোড মুভি। চরিত্র অন্য। মানিকতলায় সিগন্যাল বদলে যাওয়া সত্ত্বেও অটো উত্তর-দক্ষিণের স্রোত ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল। সাংঘাতিক ট্র্যাফিক ভায়োলেশন। হোক। আমি লড়ছি আর একটা ভায়োলেশনের বিরুদ্ধে। কাঁকুড়গাছিতে আমাকে চালান করে দেওয়া হল আর একটা অটোতে, নো প্রব্লেম। আমার তাড়া আছে। ও এখনও একই জায়গায়। অপেক্ষা করছে নিশ্চয়ই কারুর জন্য। ফুলবাগান মেট্রোতে এই প্রথম নামলাম। স্পেস স্টেশনের মতো পরিবেশ। ঢুকে দেখি একদিকের প্ল্যাটফর্মে পর পর বন্ধ কাচের দরজা। ট্রেন এলে অটোম্যাটিকালি খুলবে দরজার সঙ্গে। অন্য প্ল্যাটফর্মে তো ট্রেন। দরজা খোলা। কোথায় যাচ্ছে ওটা? কাঁধে ঝোলা এক ভদ্রলোক, ‘আবার দেখছেন কী? ওইটা বইমেলা’ বলে আমাকে মেট্রোতে ঢুকিয়ে দিতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ঠিক এক ঘণ্টা আগে ও এখন দিয়ে গেছে। জানলার বাইরে সুভাষ সরোবর। সাইকেল রিকশা। স্টেডিয়াম। ঝকঝকে রুবিক বাড়ি। সিটি সেন্টার। মেট্রো বাঁক নিচ্ছে নিজেকে মুচড়ে। ঝলমল করছে প্রাক্ বসন্তের পূর্ব কলকাতা। করুণাময়ীতে আমাকে নামিয়ে মেট্রো চলে গেল সেক্টর ফাইভের দিকে। আমার টেনশন হচ্ছিল। আমার আর ওর মধ্যে দূরত্ব কমে আসছে। দেখছি, ঠায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ও। প্রথমে কাছে যাব না। ছ-নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম। আমার আর ওর ডট এখন একেবারে মিলে গেছে। কিন্তু কোথায় ও?
বইমেলা দূরে চলে যাওয়ার পর আর আসা হয়নি। মিলন মেলা প্রাঙ্গণে পৌঁছনোটা হয় সময়, নয়তো খরচ সাপেক্ষ ছিল। এটা আরও দূরে। অথচ কবে যেন চুপিসাড়ে মেট্রো হয়ে গেছে। খেয়াল ছিল না। যত সব আজেবাজে ঝগড়ার খবর নিয়ে মাথা দিতাম এতদিন। ময়দানের মেলার সঙ্গে এর মিল নেই। বেশ ঝকঝকে-তকতকে। দে’জ আছে। রূপা আছে। আছে আনন্দ। আরও নতুন কত কী! লিটল ম্যাগাজিনের মণ্ডপটা দেখতে পেলাম। লেখক-কবিরা এখন অনেক সফিস্টিকেটেড। দাড়ি আর ঝোলা ব্যাগ ছাড়েনি কেউ। মমার্ত কই? ইনস্ট্যান্ট পোর্ট্রেট, চালের ওপর নাম, এরা এখন দেওয়ালের ছবি। খাওয়া-দাওয়ার দেদার ব্যবস্থা। অন্যমনস্ক অবস্থায় অনেক দূর চলে এসেছিলাম। ফোন দেখলাম। ও কিন্তু সেই একই জায়গায়। ঠিক ধরব। তার আগে একটু বই দেখে নিই। ‘বাংলায় ভ্রমণ’, সেকালে রেলে চেপে অবিভক্ত বাংলার যেখানে যেখানে পৌঁছনো যেত, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। কাদের বই ভুলে গেছি। ছিল আমার। পাওয়া যায় এখনও? রাশিয়ার যা অবস্থা, ওদের মিষ্টি-মিষ্টি বাংলা রূপকথাগুলো খুঁজে লাভ নেই। ধর্ম সংস্থাদের তেমন দেখছি না। ফ্রি-তে দেওয়া হচ্ছে। একটা বাচ্ছা নীল মলাট বাইবেল পড়ছে। মেলায় দুজন বরাবরই সুপারহিট। রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ। ফিলোজফি নয়, ওঁদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে অজস্র বই।
এত বিষয় অজানা ছিল? যাঁরা লিখেছেন তাঁরা এত কিছু জানলেন কোথা থেকে? শুধুমাত্র রান্নার বইয়ের দোকান দেখতে পেয়ে ঢুকতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। ভীষণ ভিড়। বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম, ‘জ্যাম-জেলি-চাটনি-আচার যাচ্ছে’। ‘কোফতা-কালিয়া-কোর্মা-পোলাও প্যাক হবে’। কী যেন একটা স্টল, বই-টই নেই। মাইক বাজিয়ে কুইজ ধরছে একটা ডেপো ছেলে। যে-ভাষায় পটর-পটর করছে, তা একেবারেই বাংলা নয়। খুব ভিড় সেখানে। আচ্ছা, ওকে না খুঁজে বই দেখলে কেমন হয়? পরে, বাড়ি ফিরে দাঙ্গা সারা যেতে পারে। একটা ইংরিজি বইয়ের প্যাভিলিয়নে ঢুকলাম। ভিড় কম। প্রচুর ছবি দেওয়া বিদেশি বই। কফি টেবিল বুক। রঘু রাইয়ের ‘কলকাতা’। নামিয়ে দেখতে দেয় এরা।
এবারে দেখলাম ‘বারাণসী’। বইমেলার মতো ওঁর ছবিও বদলে গেছে অনেকটা। দুটো বই নিয়ে বরাবরই আমার আগ্রহ ছিল, কেনা হয়নি। বাড়িতে নিয়ে আসা ঝামেলার ব্যাপার। এবারেও দেখলাম সে-দুটো পাওয়া যাচ্ছে। একটা শুধুমাত্র বাংলা অপশব্দ, গালিগালাজের অন্তর্নিহিত মানে, ইতিহাস। অন্যটা হল, ‘সুখের ঠিকানা’। সম্পর্কের ওঠানামা যাতে গায়ে না লাগে, তার ফিল্ড গাইড। প্রব্লেম সলভার। আমাকে বাঁচাল লীলা মজুমদারের ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’। অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ বদলে গেছে। কী লাভ হয় এমন করে তা বোঝা মুশকিল। বিশ্বভারতী ছাড়া আর অন্য সবার রবীন্দ্র রচনাবলিতে রবীন্দ্রনাথের ছবি দেওয়া আছে। পাশেই শরৎ। রচনাবলির প্রচ্ছদে গোঁফ-দাড়ি বিনা রবীন্দ্রনাথ। ক্ষতি নেই। ‘আবোল তাবোল’-এর সব ছবি নতুন লোককে দিয়ে আঁকানো হয়েছে। এটা আমার মতে অমার্জনীয় অপরাধ। মেজাজটা আবার খারাপ হল। বইমেলার এক প্রান্তে চলে এসেছিলাম। চেনা কারুর সঙ্গে দেখা হয়নি। হলে কী বলব ভেবে পেলাম না। এক জায়গায় স্টলের গেট বন্ধ। ভেতরে সেলিব্রিটিদের পুরে দিয়ে কিছু-না-কিছু বলানো হচ্ছে। বাইরে একটা বড় টিভিতে সেটা দেখছে সবাই ভিড় করে। আমিও দাঁড়ালাম। সঞ্চালকটা মহা পাকা। একাই বকে যাচ্ছে। আচ্ছা, শীর্ষেন্দু কি এখনও আসেন? শরীরটা ভাল নয় শুনেছিলাম। বই কিনুক বা না কিনুক, সবাই সেলফি তুলছে খুব। যেসব স্টলের দেওয়ালে সত্যজিৎ, সৌরভ বা নানারকম ভূতের বড়-বড় ছবি রয়েছে, তার সামনে। অনেকেই রাগারাগি করছে। ছবি পোস্ট করা যাচ্ছে না। নেট নেই। এখানে নাকি জ্যামার লাগানো আছে! অনেক কথা কানে আসছে। অনলাইন পেমেন্ট করতে অসুবিধে হচ্ছে। ‘নিকুচি করেছে সাহিত্যের। রাখুন আপনাদের বই নিজের কাছে’ বলে সবটা কাউন্টারের ওপর ঢেলে দিয়ে চলে গেলেন এক ভদ্রমহিলা। এবারে আমি ফোন করলাম। লাগল না। সুইচ্ড অফ, তাও বলল না। সেইজন্যই কি ওকে এমন স্থবির দেখাচ্ছে? আন্তর্জালের সঙ্গে ওর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগের মুহূর্তের ছবিই কি দেখছি এতক্ষণ ধরে? ও কি এখনও বইমেলাতে আছে? না কি বেরিয়ে গেছে? বুঝতে হলে আমাকেও নেট ধরতে হবে। ন’নম্বর গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে বুঝলাম করুণাময়ী বাস স্ট্যান্ডের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। এই বিকেলে দিব্যি মাছভাত খাচ্ছে অনেকে। আমি চা নিলাম। লুজ কিনে একটা সিগারেট ধরালাম। কতদিন পর! ও খায় না। তাই আমিও খেতাম না। ফোন চেক করলাম। টাওয়ার পেয়ে গেছি। ও যদি বইমেলার মধ্যেই থাকে তাহলে লাভ হবে না। কিন্তু নড়ছে মনে হচ্ছে, পাঁচ নম্বর গেট দিয়ে বেরোচ্ছে, যেদিকে রাস্তার ওপর দিয়ে মেট্রো যায়।
মেলা থেকে বেরিয়ে পড়েছে ও। আমি এক্ষুনি দৌড়ে গিয়ে ধরতে পারতাম। কিন্তু করলাম না। নিজের জায়গাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। ও মেট্রোতে উঠে পড়েছে। এবারে যাচ্ছে উল্টো পথে, সেক্টর ফাইভের দিকে। বিকেলের আলো মেখে চলে যাওয়া ওর ট্রেনটাকে আমি দেখতেও পাচ্ছি। অনেকদিন পরে সিগারেট খাওয়ায় আমার মুখের মধ্যে নতুন অনুভূতি হচ্ছে। কফি নিলাম। ক্যাফিন আর নিকোটিনের যুগ্ম স্রোত রক্তে ছড়িয়ে পড়ল। আধপোড়া সিগারেট মাটিতে পিষে, কফির গ্লাস মুচড়ে ফেলে দিয়ে আবার ঢুকলাম বইমেলায়। সেই বইটা কিনব। খুঁজতে হবে। কোন স্টলে দেখেছিলাম মনে নেই। ওর যেখানে ইচ্ছে যাক। একটু ঘুরে আসুক। এক ঘরেই তো ফিরতে হবে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র