গামার সঙ্গে লড়াইটা শেষ হবার নয়। গামা মস্তান কখনও মস্তানি ছাড়তে পারে? শিকার করার নিজ-অঞ্চল-চিহ্নিতকরণের লড়াই কখনও শেষ হতে পারে? … এই আধিপত্য এবং ক্ষমতার দ্বৈরথ আমৃত্যু চলবে।
এ-তল্লাটের সমগ্র ইঁদুর সমাজের উপর যখন তখন হত্যালীলা চালানোর সনদ কার আছে? গামা বেড়ালের। তাবৎ বেড়ালিনীদের জয় করবে কে? গামা বেড়াল। বেপাড়ার কোনো বহিরাগত হুলোকে ডুয়েলে হত্যা করবে কে? গামা গুন্ডা। এর মধ্যে মানুষের ভূমিকা কতটুকুই বা!
ঘরে ঘরে, আলসেতে আলসেতে, কৃষ্ণপক্ষে, শুক্লপক্ষে, অমাবস্যায় কিংবা পূর্ণিমায়, অলিতে গলিতে, পাঁচিলে পাঁচিলে নিঃশব্দে চরে বেড়ায় গামা। মাঝে মাঝে গভীর রাতে ওর আকস্মিক বলদর্পী হুঙ্কারে আঁতকে উঠতে হয়। পদ্মনাভ কিন্তু ঘুম ভেঙে দৌড়ে আসে। ইদানিং-এর সংগৃহীত ইষ্টকখন্ড, পুরনোবাড়ি-ভাঙ্া-টুকরো, রেল-লাইন থেকে কুড়িয়ে রাখা বড় বড় মুঠো আকৃতির ধারালো পাথর সটান ছুঁড়ে মারে গামার দিকে। সঙ্গে চলে হুমকি-খিস্তি। ছাদের আলসেতে যতন করে মাল্গুলো গুছিয়ে সাজিয়ে রেখেছে যাতে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে গামাকে আহত করা যায়। এমন আহত… যাতে মৃত্যু অবধারিত থাকে।
কখনও কখনও শয়তানটা অদৃশ্য থেকেও নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে থাকে। তখন চলে পদ্মের অনুমাননির্ভর এলোপাথারী ইঁটপাথর নিক্ষেপণ। আশেপাশের বাড়িতে, জানলায় ঠকাস-ঠক, ফটাস-খটাস করে লাগলেও সে দৃকপাত করে না। লক্ষ্যে স্থির না থাকলে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে না। গামা জেনে গেছে, এ-বাড়ির এই লোকটা তাকে খুন করতে চায়। তবুও সে অশরীরীর মতো এ-বাড়িতে পদসঞ্চার করে যায়। মানিপেনি-সুন্দরী তাঁর দখলের তালিকায় অবশ্যই আছে। বিনা যুদ্ধে গামা কখনও জমি ছাড়ে না। তবে খুঙ্খারাপির এই চরম বিপজ্জনক খেলার এসপার-ওসপার চ্যালেঞ্জ ভারি আকর্ষকও বটে।
*
–‘নবনীতা তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছো’।
–‘কোথায়? এই তো সঙ্গে আছি’।
–‘কথা ঘুরিও না। আমার সঙ্গে মিথ্যাচার করবে না’।
–‘সে কি! মিথ্যাচার কখন করলাম? যে যদি কেউ করে থাকে সে তো তুমি’।
–‘আমি?’
–‘হ্যাঁ। ডিভোর্স তোমার হয়ে গেছে। তবুও তুমি পথে আসছো না। আমি শুধুমাত্র ব্যবহারের বস্তু নাকি? আমি কি তোমায় বিয়ে করতে চাইনি?’
–‘অবশ্যই। নিজের আর নিজের ছেলের জন্য চেয়েছো বটে’।
–‘ওঃ। আচ্ছা! এই সমস্যা? তাহলে শুনে রাখ, যে, তোমার কাছ থেকে এ-ব্যাপারে কোনো সহায়তা আমি আর চাইছি না। ঠিকাছে?’
–‘রাগলে তোমাকে আরো সার্প লাগে। আজকে তোমার হন্টেড হাউসে যাবোই যাবো। অনেক দিন যাওয়া হয় না’।
–‘আমি পোষা কুক্কুরী নই। হল! এবার ফিরব, দেরি হয়ে যাচ্ছে’।
–‘বর জুটে গেল নাকি? আমাকে ছেড়ে দিচ্ছো যে! কে সে? সেই নতুন গুড বয়টা? শোন শোন মনে রেখো, পদ্মনাভকে কেউ ছাড়তে পারে না। সে যদি ছেড়ে দেয়, তবেই ছাড়া পাওয়া যায়’।
–‘ভয় দেখাচ্ছ নাকি? জানো তো, আমি ওসব ভয়টয় পাই না’।
–‘তা তো বটেই। তুমি তো বীরাঙ্গনা’।
ভাবা যায় না। পদ্মের চোখে জল এসে যাচ্ছে নাকি? … নবনীতা ত্যাগ দিয়ে দিলো? কিন্তু এরকম তো কথা ছিল না। শালা! আজকে বারদুয়ারিতে যেতেই হবে। এত দূর বেড়েছো তুমি নবনীতা? আজকে শালা মাল খেয়ে মালামাল করতে হবে। শুধু বাড়ি ঢুকতে হবে সাবধানে। রুবেন্সের নারী দরজা খুলতে এলে তার ছোঁয়া বাচিয়ে ঢুকে পড়তে হবে। তাছাড়া ওরকম অতি মসৃণগাত্র নারীদের তার একেবারে না-পসন্দ। তাই ঐ বৌদি-মেয়েলোকটি বাদ। মদিগ্লিয়ানির রূপসী, বুগলিও বাদ হয়ে গেছে।
নবনীতা ততো সুন্দরী নয়। তাকে আঁকতে গেলে পিকাসোকে লাগবে। হো হো করে হাসি পেয়ে যায়। তখন ঠকাস করে টেবিলে গ্লাস নামিয়ে গাত্রোত্থান। কোনমতে নিজের স্টেশনে ফেরা। তারপর অনেকটা পথ। লাইন ক্রশ করে অন্য প্ল্যাটফর্মে ওঠার সময় পাথর কুড়োতে কুড়োতে যায়। টপাটপ ব্যাগে ভরে। কাছের শুকনো নালাটার দিকেও খেয়াল রাখে। আজ গামা শালাকে পেলেই খুন। থেঁতলে দিতে হবে একেবারে। এরপর মধ্যরাত্রের শুনশান বাজার এলাকা। ওখানে ঢুকতেই একটা একলা নেড়ি হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে — ‘কাঁ উঁ উঁ উঁ উঁ ভৌ ভৌ ভৌ’।
বহুবার বাচ্চা বিয়োনো ডিগডিগে শরীর। পেটের তলায় একসার অসমান বোঁটাসহ লটরপট্র করছে ঢিলে চামড়া। তাতেই এতো ওস্তাদি! তবে রে, পোথো কুক্কুরী, বড্ড বাড় বেড়েছে তোদের! দেখাচ্ছি মজা তোকে!
ফাঁকা মাংসের দোকানটায় কাঠের গুঁড়িটার উপরে ঝকঝকে চপারটা পড়ে আছে শুধু। এখনও আলো জ্বলছে। দোকানদার হয়তো কাছেপিঠে কোথাও গেছে। সটান চপারটা উঠে এলো পদ্মের হাতে। নেড়িটা কিছু একটা আন্দাজ করেছে। সংঘর্ষ আর আত্মসমর্পণের কুকুরকুন্ডলীময় জীবনে বেশ কয়েকবার মা হওয়া পোথো কুক্কুরী সে। তার আন্দাজ ভুল খুব কমই হয়ে থাকে। তাই সে পালানোর উপক্রম করে। কিন্তু পদ্ম চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আঘাত করে। তীব্র আর্তনাদে খানখান হয়ে যায় রাতের নৈঃশব্দ। পালাতে পালাতেও চপারের আঘাতে পেছনের ডান পায়ের আধখানা থাবা হারায় সে। নালার ঘাসে রক্ত মুছে কাঠের গুঁড়ির উপর চপার রেখে পদ্মও হাওয়া। আহা রে! মিস্ হয়ে গেল! সামান্য একটু ক্ষতি হল মোটে। সময়টায় খুনের মওকা ছিল। কিন্তু সেটা করা গেল না।
হয়তো এরকম পা-টলমল অবস্থায় খোলা জায়গায় নিকেশকর্ম কঠিনই ছিল। রাত গভীর। দোকানি অনুপস্থিত। নেড়ির আর্তনাদে কেউ জেগে উঠে দেখতে আসেনি। সবই ভালোয় ভালোয় মুহুর্তের মধ্যে মিটে গেছে।
…কেউ কি ভাবতে পারবে আঘাতকারী কে? সম্ভবত না। কারণ সাধারণত এতো রাতে পদ্ম এখান দিয়ে যায় না। অন্য কুকুরগুলোও আজ এখানে নেই। হয়তো কোনো বেপাড়ায় দল বেঁধে হল্লা মাচাতে গেছে… তারপর যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়েছে। এক-আধটা ঘুমন্ত লোককেও আজ দেখা গেল না। সবই ভালো। কিন্তু খারাপের থেকে খারাপ হল যে, তার নেশাটাই গেল কেটে। ফুঃ! এখনও দশ মিনিটের হন্টন বাকি, আজ কী যে হল! সব গোলমাল… সব উল্টোপাল্টা…। আক্রমণটাও সফল হল না।
*
অফিস অফিসের মতো চলছে। সেখানে মুক্ত বাতাস বয়। কিছুক্ষণ মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিলেই অক্সিজেনের অভাব ঘটতে থাকে। রোজ ছুটির সময় একসঙ্গে হাসাহাসি করতে করতে গুডবয় আর নবনীতা অফিসে থেকে বেরিয়ে যায়। মন জানতে চায়, ওরা কোথায় যাচ্ছে? মনই উত্তর দেয়, হন্টেড হাউসে নিশ্চিত। এইভাবে একটা বিপুল চাপ চলতে থাকে।
রঞ্জন একদিন হইহই করতে করতে এসে উপস্থিত পদ্মনাভের কাছে। ওর চোখেমুখে রীতিমতো উত্তেজনা, — ‘বস্, অফিসের কয়েকজন মিলে বকখালি যাওয়া হবে সামনের হপ্তায়। তোমাকেও যেতে হবে কিন্তু। কোনো “না” শুনবো না। নবনীতা যাচ্ছে ওর বাচ্চা নিয়ে।
‘আর নতুন ছেলেটা যাচ্ছে, নবনীতার টানে। হেব্বি মস্তি হবে’।
–‘নাঃ। আমি যাবো না। কিছুতেই না’।
–‘কেনো?’
–‘কেনো যাব? তোমরা তো যাচ্ছো ওদের শোয়ার ব্যবস্থা করতে। ওদের শোয়াশুয়িটা নিরাপদে এবং প্রকাশ্যে হোক, তাই না? ওদের সম্পর্কে একটা শিলমোহর পড়ুক এটাই তো তোমাদের বাসনা? তোমরা একদল বরাহ্নন্দন। বেরোও এখান থেকে’।
–‘আরে শোন না, তুমি না গেলে…’
মাথার উপর চেয়ার তুলে নেয় পদ্ম। চোখ ঘুরছে। লালাভরা মুখ।
–‘মেরে দেবো শালা। মজা দেখার মড়ক, তাই না? ঘটনা ঘটিয়ে চেটে খাবি? হায়নার মতো কলতান করবি? ায় তোর মাথাটাই আজ চেয়ার মেরে ফাটিয়ে দিই’।
… পালিয়ে বাঁচে রঞ্জন।
বকখালি যাওয়ার আগেই অফিসের কোনায় কোনায় রটে যায়, গুডবয়কে বিয়ে করতে চলেছে নবনীতা।
কেউ কেউ গুডবয়কে সাবধান করতে চায়,
–‘ওই চরানি মেয়েকে বিয়ে করলে মরবি তুই। জানিস, পদ্মের সঙ্গে ওর পুরো বিছানার সম্পর্ক ছিল? তার উপর এক-ছেলের মা। ছ্যাঃ! কী দেখলি তুই ওর মধ্যে? তোর থেকে তো বয়সেও অনেক বড়! বাড়িতে জানিয়েছিস?’
বকখালি থেকে ফিরেও তাই গুডবয়ের মুখ অন্ধকার,
–‘আমি এই চক্কর থেকে বেরোতে চাই, রঞ্জনদা। আমি আর পারছি না। মা-বাবার সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে। নার্ভ হারিয়ে ফেলেছি, দাদা। ওষুধ, ডাক্তার আর ড্রাগের ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি একেবারে’।
ছেলেটার চোখে জল। রঞ্জনের হাত জড়িয়ে ধরে সে,
–‘তোমরা একটু চেষ্টা করলে আমার ট্রান্সফারটা কি হতে পারে না? তুমি তো সবই বুঝতে পারছো, দাদা। আমার বিয়ে অব্দি ঠিক করে ফেলেছে বাবা-মা। প্লিজ হেল্প মি’।
–‘আরে ইয়াং ম্যান, চোখ মোছ। আমি অনেক আগে থেকে ইউনিয়নে পিক্চারটা জানিয়েছি। বলেছি, তোকে এখান থেকে যে-কোনো মূল্যে দূরের কোনো অফিসে সরিয়ে দিতে। হয়তো, শিগ্গিরিই হয়ে যাবে। এখনও এ-শর্মার যথেষ্ট হোল্ড আছে রে, ইউনিয়নে। তবে ওই খুনেটার থেকে সাবধান। নবনীতা ওকে এখন উস্কোচ্ছে কিন্তু। পদ্মের কথা বলছি, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস। আলোচনার জন্য কোথাও ডাকলে যাবি না কিন্তু’।
–‘না না, পাগল হলে?’
*
ছয় মাসের মধ্যে গুডবয় ভ্যানিশ। খুব গোপন যৌথ প্রচেষ্টায় ট্রান্সফার অন্য অফিসে। পরে পরেই বিবাহ-সংঘটন। হাতের কাছে পেলে ওকে পদ্ম কুপিয়ে দিতো হয়তো। ওর পুরাতন ক্রোধ এখন বাতাস পাচ্ছে নবনীতার কাছ থেকে।… গুডবয়ের পতন, নিকেশ, ধ্বংস হোক। একই লক্ষ্যে পদ্মও উন্মত্ত।
–‘চল নীতা, হন্টেড হাউসে যাই’।
–‘না, শরীরটা ভালো নেই’।
–‘নাকি স্মৃতির ঝাপ্পড়ে কলিজা খানখান?’
গঙ্গার ধারে বসে নবনীতার কব্জি ধরে মোচড় মারে পদ্ম।
–‘উঃ। লাগছে। ছাড়ো। আমি তোমার বুগলি নই। আগে সেয়ানাটাকে শাস্তি দাও। তবে না হন্টেড হাউসে যাওয়া! ও আমায় ডিচ্ করেছে, ছোটখাটো অপরাধ নয় এটা! বিয়ের আশ্বাস দিয়ে সহবাস! আমার বাবা-মার সামনে আমার মুখ পুড়বে বলে আইনে ওকে ফাঁসালাম না। কিন্তু তুমি কী ব্যবস্থা নিলে?’
–‘চেষ্টা তো করছি। কিন্তু হচ্ছে না। শুয়োরের বাচ্চাটা খুবই প্রোটেক্টেড। ওখানে ইউনিয়ন খুব স্ট্রং। ওদের নিরাপত্তাবলয়ে ব্যাটা রয়েছে’।
–‘কেন পারছো না জানো? আসলে তুমি তো একা…। গোঁয়ার…। নির্বোধ…। এসব করতে টিম লাগে। তুমি হচ্ছো একা একা ঝান্ডালড়ানে। ধ্যূস্। আর তুমিও তো আমাকে ডিচ্ করেছো। এখন চাইলেও আমি তোমাকে বিয়ে করছি না। তুমি শুধু কুকুর-বাড়ালই তাড়াতে পারো। হুঁঃ’।
–‘কী বললে!’ গাছতলার বেঞ্চের সঙ্গে ক্ষত-শুকনো এক হাতের থাবায় নবনীতাকে ঠেসে ধরল পদ্ম।
সঙ্গে সঙ্গে হুইসেল বাজল পিছনে। গার্ড।
–‘এই-ও-ও! বাড়াবাড়ি করলে চালান করে দেবো। যতোসব মাতালগুলো এখান এসে ভিড় করে। দেবো এক রুলের গুঁতো, বুঝবি ঠ্যালা। ম্যাডাম, এখান থেকে উঠুন। বাড়ি যান’।
হুইসেল বাজাতে বাজাতে চলে যায় গার্ড।
… আজ মদ খায়নি। তবু মাতালের মত এলোমেলো পা পড়ছে পদ্মের। নবনীতা একাই ট্যাক্সিতে উঠে চলে গেছে। বহুদূরে চলে যাচ্ছে নবনীতা,… পিকাসোর নারী, উইপিং ওম্যান। ওই মাস্তারপিসটার মতোই ভাঙাচোরা মুখের দেখাচ্ছিল ওকে, যাবার সময়। … ক্রন্দিতা বালা।
*
আজকাল রোজ রাতে ঘটছে গামা-বেড়ালের হানা। মাঝে মাঝেই ওর ‘আঁও আঁও’ তর্জন প্রমাণ করে, ব্যাটা জান লড়াচ্ছে কোনো অনিবার্য সংঘর্ষে। সেই সঙ্গে ওর মাত্রাছাড়া অবজ্ঞা, অগ্রাহ্য, দুঃসাহস, না-চেনার ভান পদ্মনাভকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। ছাদের আলসেতে প্রতি তিন ফুট দূরে দূরে ইঁট-পাটকেল-রেলের পাথরের সুচিন্তিত মিশ্র অস্ত্রসম্ভার। ধারাবাহিক যুদ্ধের পরিমজ্জা। অনেক অনেক ছোঁড়াছুড়ি হয়েছে। প্রতিবেশীদের ঘটেছে অনেক ক্ষতি। কিন্তু গামা মস্তানের কিস্যু হয়নি। আজ ব্যাটাকে ধরতেই হবে। … লড়াই…।
ঘরের একমাত্র জানলাটির মুখোমুখি মেঝেতে সতরঞ্চি পাতা হয়েছে। সেখানে পদ্ম শয়ান। জানলার একটা পাল্লা ছিটকিনি এঁটে বন্ধ। অন্য পাল্লাটার করায় বাঁধা দড়িটার মুক্তপ্রান্ত পদ্মের হাতে ধরা। খাটের বিছানায় রাখা আছে একটা প্লেটে মাছের ঝোল থেকে তোলা একটুকরো মাছ। আর পদ্মের গায়ের পাশে মেঝেতে রাখা আছে একটা টর্চ আর নতুন কেনা চপারটা। একবার ঢুকে দেখ বাছাধন! তোর হাঁড়ির হাল করে ছাড়বো। কোপাবো তোকে।
হালকা ঝিমুনির মধ্যেই কানে এলো, ‘খুট’। তাকিয়ে দেখে, জানলার তাক থেকে মাছের প্লেটের দিকে লাফাচ্ছে গামা বেড়াল। সঙ্গে সঙ্গে দড়িতে টান দিলো পদ্ম। ঠাস করে জানলা বন্ধ হল। …এবার টর্চ জ্বালা এবং চপার হাতে ঝাঁপাতে হবে। ওঃ! ভগবান! টর্চটা জ্বালতে এক্ষনিই হাত ফসকাতে হলো? টর্চটা গড়িয়ে গেল খানিকটা। সেটাকে সংগ্রহ করে চপারটা সঠিক ভাবে ধরে উঠতে সামান্য সময় লেগে গেল।
সেই ফাঁকে একলাফে জানলা ঠেলে পালালো শয়তানটা। যেতে যেতে ‘ফ্যাঁসসস’ করেছিল। যুদ্ধ ঘোষণা।
এটা ঠিক হিসেবের মধ্যে ছিল না। পদ্মও উঠে পড়ল এক লাফে। ঘরের কোণ থেকে তুলে নিল ঢিল-পাটকেল-রেল পাথরে ভরা ঝোলা ব্যাগটা। সেতাতে চপার ঢোকালো। ব্যাগটা খালি গায়ে ক্রশ করে নেওয়া। পরনে হাফপ্যান্ট। হাতে লাঠি। জাগুয়ারের মতো শক্তিশালী লাফে অনেকখানি পথ এক-একবারে ডিঙিয়ে গামার পিছু নিল এক ক্রোধান্ধ মানুষ। … গামা বিভ্রান্ত। এতখানি আত্মসমর্পিত একজন মানুষ তার কল্পনার অতীত। তবুও প্রতিযোগিতাময় এই দৌড় হয়তো অসম। বেড়ালের সঙ্গে কি মানুষ পারে? পারতেও পারে! পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে নক্ষত্রবেগে ছুটছে মানুষটা। একটা পাথর দুরন্তগতিতে ছুঁয়ে গেল গামার পিঠ। চমকে উঠল জানোয়ারটা। সোজা পথ চেহ্রে নেমে গেল পাশের নালায়। … আচ্ছারে সেয়ানা! নালায় নেমে তুই বাঁচতে পারবি? আর একটা পাথর আছড়ে পড়ল ছূটন্তটার পায়ের পাশে। ঝোপঝাড়ে আকীর্ণ নালা। কোথাও সামান্য জল। কোথাও খটখটে শুকনো, মশাদের আড়ত। কিন্তু বিদ্যুৎগতিতে গামাগুন্ডা নালার ঝোপে ঢুকে যায়। ওঃ! গড! দাঁড়ারে বজ্জাত! থেঁতলে মারব তোকে। রাস্তায় ব্যাগ ফেলে দিয়ে শুধু লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পদ্ম। ঝোপ পেটাতে থাকে নির্মমভাবে। মধ্যরাত্রের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘভাসা সচাঁদ আকাশ আলো-আঁধারির মায়া ছড়িয়েছে। সবই অস্পষ্ট। কোথায় যে মালটা সেঁধোলো, কে জানে!…
অকস্মাৎ গামার আত্মপ্রকাশ। তীব্রগতিতে টরপেডো হয়ে লাফিয়ে উঠে সে হেচড়ে দেয় পদ্মর মুখে। এবং পালায়।
–‘ওঃ! মাগো!’ দু-হাতে মুখ চেপে ধরে পদ্ম বসে পড়ে। সম্ভবতঃ, এক চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে।
এবার? তাহলে? অতঃপর?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র