জীবনের এক টুকরো
অনেক ছবির মূল ঝোঁকটা থাকে স্বাভাবিক ব্যবহারের দিকে। মানে, কত নাটকীয় কাণ্ড হল সেটা বড় কথা নয়, মুখ্য উদ্দেশ্য: চরিত্রদের আচরণ কতটা স্বাভাবিক হল, দেখে মনে হচ্ছে কি না, আমরা একটা একদম সত্যিকারের জীবন দেখছি। অধিকাংশ ‘ইন্ডি ফিল্ম’, মানে ইন্ডিপেন্টেন্ট ফিল্ম, মানে কম খরচায় বন্ধুবান্ধব মিলে তুলে ফেলা ছবির যে স্রোত এখন পৃথিবী জুড়ে চলেছে, সাধারণত যে ছবিতে ক্যামেরার বা অন্দরসজ্জার বা পোশাক-আশাকের বিশেষ কায়দা থাকে না, মূলত সংলাপ ও অভিনয়ের ওপরেই ভর করে ছবিটা দাঁড়িয়ে থাকে, তারই একটা হল ‘অ্যাকচুয়াল পিপল’ (চিত্রনাট্যকার, পরিচালক এবং নায়িকা— কিট জওহর, ২০২২)। এখানে দেখানো হয় একটি মেয়ে, তার নাম রাইলি, আধা-মার্কিন আধা চিনা, সে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করছে। এ ধরনের ছবিতে সাধারণত কিচ্ছুই ঘটে না, স্রেফ কয়েকটা দিন ও রাত ফুটে ওঠে, এ ছবিতে কিন্তু রাইলির অনেকগুলো সমস্যা হয়, তবে সেগুলোকে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানোও হয়নি। রাইলি পড়াশোনা কিছুই করে না, ফলে গ্র্যাজুয়েশনে সে একটা বিষয়ে পাশ করতে পারে না, তবে তার মূল চিন্তা সে গ্র্যাজুয়েশনের অনুষ্ঠানটায় অংশ নিতে পারবে কি না, কারণ সেদিন তার মা-বাবা দেখতে আসবেন। তার শিক্ষিকা তাকে ডেকে বলেন, ক্লাসের গোড়ার দিকে তুমি তো খুব কথাটথা বলতে, বেশ প্রাণবন্ত ছিলে, এখন মনে হচ্ছে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছ, পরীক্ষাতেও তোমাকে পাশ করাতে পারব না, মনে হচ্ছে তোমার মনোযোগ নেই। এবং সত্যি, একটা পেপার তো সে আমাদের সামনেই জমা দিয়েছে কয়েক ঘণ্টা মাত্র লিখে। ভুলেই গেছিল, কবে লাস্ট ডেট। রাইলি অবশ্য বলে, কেন, আমি তো ভালই লিখেছি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সেটা বানিয়ে বলে, সেও জানে, তার পড়াশোনা হচ্ছে না। অনেকে তাকে জিজ্ঞেস করে, গ্র্যাজুয়েশনের পর কী করবে। কী ঠিক করেছে। রাইলি কিছুই ঠিক করেনি, তার জীবন কোত্থাও যাচ্ছে না, সে এমনি ঘুরেঘারে বেড়ায়, পার্টিতে যায়। একজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল প্রায় তিন বছর, সে ছেড়ে গেছে। সেই পুরুষটির এখনকার প্রেমিকা দৌড়য়-টৌড়য়, সামাজিক কাজকর্ম করে, এবং বেশ ভাল চাকরিও পেয়েছে। একবার তো রাইলির প্রাক্তন প্রেমিক তাকে রাস্তার ধারে একটা বেঞ্চিতে বসে থাকতে দেখে এইসব খবর দেয়, খারাপ ভাবে নয়, বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবেই, কিন্তু রাইলি ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছ’ মার্কা ক্রোধে ছেলেটিকে মারতে থাকে, তখনই আরেকটি মেয়ে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দৌড়ে এসে রাইলিকে জিজ্ঞেস করে ছেলেটি তাকে নিগ্রহ করছে কি না, পুলিশে খবর দিতে হবে কি না, রাইলিকে সে ট্যাক্সি ডেকে দেবে কি না। ছেলেটি কিছু বলতে গেলেই পথচলতি মেয়েটি তাকে বলে, আপনার সঙ্গে আমি কথা বলছি কি? তখন রাইলি হেসে গড়িয়ে পড়ে। তার ওপর রাইলি যে ফ্ল্যাটে থাকছিল একটি ছেলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে, সেটাও এ মাসেই ছেড়ে দিতে হবে। সেই ফ্ল্যাট-মেট’এর সঙ্গে একবার যৌনতা করার পর তাদের সম্পর্কের জটিলতা বেড়েছে। ছেলেটি একদিন বলে, তুমি প্লিজ বাড়িতে শুধু ভেতরের জামা পরে সারাক্ষণ থেকো না, আমার অসুবিধে হয়। মেয়েটি বলে, কেন। ছেলেটি বলে, ধরা যাক, কোনও মেয়েকে যদি আমি বাড়িতে আনি, সে যদি দ্যাখে তুমি এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছ, তাহলে অন্য কিছু ভাববে। রাইলি বলে, সোজা কথা, তুমি বোধহয় ভেবে ফেলেছিলে, একবার সেক্স করেছি বলেই আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি, সেটা হয়নি বলেই এসব ছুতো করছ। ছেলেটি তখুনি বলে, এ মাসের পর আর তুমি এই বাড়িতে থাকবে না। তোমরা হলে মিলেনিয়াল, তোমাদের এই অফুরন্ত এনার্জি, সারাক্ষণ পার্টি করা, আর এই ধারণা যে কোনও কিছুরই কোনও প্রভাব বা পরিণাম নেই— এগুলো আমার সহ্য হয় না। রাইলি একবার একজন ছেলেকে খুব পছন্দ করে ফ্যালে একটা পার্টিতে গিয়ে, তার সঙ্গে একবার বেশ ভাল যৌনতাও হয়, কিন্তু পরে সেই ছেলেটি তাকে বিরাট পাত্তা দেয় না। রাইলি তাকে যখন বলে, চলো কাল ডিনারে যাই, সে বলে, না, আমার কাজ আছে। কাজ সকালে সেরে নিও। না, সারাদিন ধরে কাজ আছে। আর না পেরে রাইলি বলে, আমার তোমাকে খুব পছন্দ, আমার ধারণা ছিল তোমারও আমাকে পছন্দ। ছেলেটি বলে, আমার তোমাকে ভাল লাগে, কিন্তু সেটা খুব সিরিয়াস কিছু না। ফলে রাইলির কিছুই ঠিকঠাক চলছে না। তার প্রেম, তার পড়াশোনা, তার থাকার বন্দোবস্ত। তবে কি সে নিউ ইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়া ফিরে যাবে? মা-বাবার কাছে? সে তো একটা বড় পরাজয় হবে। এমনকি থেরাপিস্টের সঙ্গে তার আটখানা সেশন শেষ হয়ে যাওয়ার পর যখন রাইলি তাঁকে বলে, আমি কি মাঝেমাঝে ফোন করতে পারি বা মেসেজ, তিনি বলেন, না, দুঃখিত, তা হয় না।
রাইলিও যে খুব ভাল লোক তা নয়। সে যেই ছেলেটির কাছে শোনে সে ভালবাসে না, অমনি ছেলেটির বন্ধুকে বলে, ও একটা যা-তা, মোটে ভাল ছেলে না। আর বিছানার পারফর্ম্যান্সও ভাল নয়। রাইলির ছোটবোন যখন পার্টিতে মদ খায়, রাইলি বারণ করে না। বোনটি অসুস্থ হযে পড়লে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয় এবং মা যখন রাইলিকে বলেন, তুমি বলো ও কালকে কী করছিল, তাহলে আমি তোমাকে বাড়তি কোর্সের (ফেল করেছে বলে তাকে এখন আরেকবার ওই বিষয়টা পড়তে হবে) টাকা দেব, সে তক্ষুনি বোনের নামে সত্যিটা ফাঁস করে দেয়। তারপর অবশ্য বোনও তাকে যাচ্ছেতাই বলে এবং বলে তুই এরকম লোক (অর্থাৎ নিজের বোনের নামে চুকলি করিস নিজের লাভের জন্যে) বলেই তোকে ডেভিড ছেড়ে গেছে। রাইলি তখন প্রচণ্ড রেগে যায়, বোনকে ঠেলে ফেলে দেয়, তারপর প্রকাণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং বলে যে তিন বছরের সম্পর্কের পর কী করে ছেড়ে গেল ও আমাকে? বলল, আমার ভালবাসা শেষ হয়ে গেছে! কেউ একবার ভালবাসলে কী করে তার ভালবাসা শেষ হয়ে যেতে পারে, আমি জানি না। এখন আমার নিজেকে কুৎসিত মনে হয়। মনে হয় আমি এত অনাকর্ষণীয় যে কেউ আমায় পছন্দ করবে না। মা-বাবা এবং বোন তখন তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়। রাইলি যেদিন ফেল করে সেদিন সে তার ফ্ল্যাট-মেট’এর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সোফায় কাছ ঘেঁষটে আসে এবং চুম্বন শুরু করে। পরে অবশ্য ছেলেটি তাকে সরিয়ে দেয়। বলে, এসব কোরো না, সামনের মাস থেকে কে ফ্ল্যাটে থাকবে তা ঠিক হয়ে গেছে। পরে অবশ্য একদিন, গ্র্যাজুয়েশনের পর যে পার্টি হচ্ছিল, সেখানে এসে ছেলেটি তাকে চুমু খেতে চায়, রাইলি এবার রাজি হয় না। সারা ছবি জুড়ে মাঝেমাঝেই বহু মোবাইলের ছবি দেখানো হয়, অনেক রাইলির বয়সি ছেলেমেয়ের, কেউ স্কেটিং করছে, কেউ সাজছে, কিন্তু মূলত রাইলির, সে হাবিজাবি যা পারছে করছে, হয়তো ওগুলো ইনস্টারিল, কিংবা ফেসবুকে দিয়েছে। মানে, সারাদিনটা রাইলি ও অনেক রাইলির মোটামুটি অবান্তর কাণ্ডকারখানাতেই কেটে যায়। রাইলির দো-আঁশলা সত্তাও তাকে মার্কিন সাদা চামড়ার সমাজে একটু একঘরে মতো করে রেখেছে। একটা দৃশ্যে তার সামনেই একজন ছেলে একটি মেয়েকে এই সব ‘ইমিগ্র্যান্ট’দের নামে খারাপ কথা বলে। মেয়েটি প্রতিবাদ করে, বলে, তারা এখানে এসে উদয়াস্ত খেটে, নিচু-ধরনের কাজ করে দিন-গুজরান করে, তারপর হয়তো একটা মোটামুটি সামাজিক জায়গা পায়। ছেলেটি বলতে শুরু করে, সাদা চামড়ার লোকরাও অনেকে গরিব আছে, তারাও নিচু ধরনের কাজ করে। মেয়েটি বলে, সাদা চামড়ারা তো ইতিমধ্যেই দরদ পায়, তারা তো ‘included’, তাদের কথা ভাবার জন্য তো নতুন করে ‘inclusive’ হওয়ার দরকার নেই। এই গোটা তর্কের মধ্যে অবশ্য রাইলি প্রায় মাতাল হয়ে বসে থাকে ও পরে শরীর খারাপ করছে বলে বাথরুম চলে যায়।
ছবিটার একটা বড় সম্পদ হল, এখানে কাউকে ভাল চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত করার কোনও দায় পরিচালকের নেই। নায়িকাকেও নয়। অন্য চরিত্ররাও কেউ ভিলেন নয়, আবার আলাদা করে নায়িকার প্রতি খুব সমব্যথীও নয়। এমনকি দো-আঁশলার যে ক্ষোভ, যে সঙ্গত বঞ্চনার নালিশ, তা উপস্থিত করলেও তা নিয়ে কোনও বিরাট আবেগের পসরা সাজিয়ে বসা হয় না। একটা জীবনের এদিক সেদিক পাশাপাশি তাসের প্যাকেটের মতো ফেলে রাখা হয়, কোনও ব্যাপারকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করে অনেকক্ষণ টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও নেই। চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক নিজেই মূল চরিত্রে অভিনয় করার জন্য খুব সুবিধেও হয়েছে, তিনি চমৎকার ফুটিয়েছেন চরিত্রটা। সমস্ত স্টাইল বা দেখানেপনা বর্জন করে (বেশ কিছু ফ্রেম আছে, ভাল করে দেখাও যাচ্ছে না অন্ধকারে, বা কথাবার্তা বলার সময় যারা কথা বলছে তাদের সকলকে একসঙ্গে একবারও দেখানো হচ্ছে না) নিতান্ত আটপৌরে ভাবে ছবিটা তোলা হয়েছে বলে ঘটনাগুলো আরও বাস্তব মনে হয়। নায়িকা দেখতে ভাল না, সেইজন্যেও চরিত্রটাকে একেবারে চেনা মনে হয়। সেদিক থেকে ছবির নাম সার্থক। অর্থাৎ, এখানে ছবির চরিত্র দেখতে পাবে না, সত্যিকারের কিছু লোকজন দেখতে পাবে। তাদের জীবন যেমন হয়, কিছুটা সাদামাটা, সামান্য টানাপড়েন-ওলা: তা-ই হবে, বিরাট কিছু হবে না। শেষে রাইলি গিয়ে একটা বন্ধুর বাড়িতে ওঠে, সেখানে থেকে নতুন ক্লাসটায় যোগ দেয়, প্রথম দিনেই একটা ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়। এরপর কী হবে, আদৌ কোনও ঘনঘটা-ওলা কিছু হবে কি না, কে জানে। জানাবার কোনও দায়ও পরিচালকের নেই। একটা আসল-মানুষের একটু জীবন-টুকরো নিয়ে ছবি, আমরা চলতে চলতে হট করে দেখে নিলাম।