৯।
পোর্ট ব্লেয়ারের নৃতত্ত্ব যাদুঘরের কিউরেটর প্রোফেসর লতিকা মুরুগান সুব্রহ্মণ্যম, তাঁর হাতে ধরা দ্বিতীয় ছবিটা তুলে ধরে বলেছিলেন— এটা অনেক প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছে। মধু মাথুরের তোলা বিখ্যাত একটা ছবি। কিন্তু ছবিটায় মানুষের ভিড়ের পেছনে যেটা লুকিয়ে আছে, আপনারা কেউ তা দেখতে পাচ্ছেন কি?
কথাটা শুনেই বিলি গিলচার এবং এরিক দত্ত ছবিটার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। আর এই সুযোগেই নিজের হাতের কফিমাগটা জানলার ফোকরে বসিয়ে, ঘরের উলটোদিকের দরজাটা দিয়ে সিঁড়ির দিকটায় বেরিয়ে পড়লেন ব্রহ্ম ঠাকুর। খানিক আগে লতিকাদেবীর মুখে আন্দামানে লুকিয়ে থাকা পারমাণবিক প্রতিক্রিয়কের সম্ভাবনার কথা শোনামাত্রই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এখানে আর সময় নষ্ট করা চলবে না। আসলে তিনি তো ঠিক বিলি গিলচারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আন্দামানে আসেননি। তাঁর আসার একটা অন্য আসল কারণ আছে। লতিকার মুখে কিছু রহস্যময় অ্যাগ্রেসিভ সাউন্ডওয়েভের কথা শোনার পরেই তাঁর মনে হল, যে রহস্য-সন্ধানের জন্য তিনি আসলে এই দ্বীপপুঞ্জে এসেছেন, তার একটা হদিশ মিলল। ফলে ব্রহ্ম বুঝলেন, কিছুতেই আর দেরি করা চলবে না। হয়তো বেশ খানিকটা দেরি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে! অ্যাটমিক রিঅ্যাকটর আর অনিয়ন্ত্রিত ধ্বনিতরঙ্গের কথাটা শোনামাত্রই তাঁর মনে পড়ে গেছে একটা অতি পুরনো ছেঁড়া ডায়রির কথা, যে ডায়রিতে এইরকম একটা কিছুর উল্লেখ শুধু নয়, তার মোটামুটি অবস্থানেরও নির্দেশ ছিল। ব্রহ্ম ঠাকুর এক্ষুনি খোলাখুলিভাবে কথা বলতে চান তাঁর সঙ্গে, উত্তরাধিকারসূত্রে ডায়রিটা এখন যাঁর হাতে এসে পড়লে তিনি অন্তত অবাক হবেন না— বরং তাঁর মনের মধ্যে ইতিমধ্যেই কষে ফেলা বেশ কিছু যুক্তির হিসেব খাপে খাপে মিলে যাবে। ব্রহ্ম মনে করেন, এই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললেই একটা স্পষ্ট আন্দাজ পাওয়া যাবে— গোপনে কী ঘটে চলেছে এই অঞ্চলের কোনও এক অজানা দ্বীপে।
তিনতলার ক্যাফেটেরিয়াটা থেকে সিঁড়ি দিয়েই ধুপধাপ করে নেমে আসছিলেন ব্রহ্ম। দ্বিতীয় তলে পৌছে ল্যান্ডিং-এর পাশে একটা ম্যাগাজ়িন র্যাক তাঁর চোখে পড়ল। র্যাকটায় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক আমেরিকান ম্যাগাজ়িনের একদম সাম্প্রতিক সংখ্যাও রয়েছে। একটু চোখ বুলোতেই হঠাৎ একটা ম্যাগাজ়িনের মলাট দেখে চমকে উঠতে হল তাঁকে। কী আশ্চর্য! এই মলাটই যে প্রমাণ করে দিচ্ছে, তিনি সঠিক দিশাতেই ভেবেছেন। পাশাপাশি তাঁর মনে জেগে থাকা অন্য একটা প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছে এটা। তিনি এদিক-ওদিক তাকিয়ে র্যাক থেকে চট করে তুলে নিলেন ম্যাগাজ়িনটা। তারপর সেটি সাবধানে ঢুকিয়ে ফেললেন নিজের আলখাল্লার ভাঁজের ভেতরে।
*****
সন্ধে নেমে আসছে পোর্ট ব্লেয়ারে। সমুদ্রের ধারে একটা পুরনো ধরনের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন ড. কিশিমোতো। পরনে সাদা ফুলহাতা শার্ট আর নীল জিনস। কিশিমোতোর বয়স মধ্যচল্লিশ বা তার একটু বেশিই হবে, যদিও খাদ্য-সংযমে থাকেন বলে দেহের বয়স বাড়েনি, বড়জোর ৩৫-এর তরুণ বলেই মনে হয়। চোখে রিমলেস চশমা, নরম দাড়িগোঁফ লেগে রয়েছে তাঁর চিন্তিত মুখখানি জুড়ে। তাকিয়ে ছিলেন তিনি সমুদ্রের ওপারে একটা জঙ্গুলে দ্বীপের দিকে। দ্বীপটির নাম ‘রস আইল্যান্ড’। আন্দামানে যাঁরা বেড়াতে আসেন, তাদের অবশ্যদ্রষ্টব্য এই ছোট্ট দ্বীপটি। অবশ্য পর্যটকরা দ্বীপটিতে থাকেন না, খুব বেশি হলে এক-আধঘন্টার ট্যুর নিয়ে ফেরত আসেন। আসলে ওখানে থাকবার কোনও জায়গাই নেই, পুরোটাই জঙ্গল আর পাহাড়। সেই জঙ্গলের মধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইংরেজ সামরিক ব্যারাকের ধ্বংসাবশেষ। ১৯৪১ সালে বিরাট ভূমিকম্প হয়েছিল এখানে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জাপানি সৈন্যরা সেসময়েই এটা অধিকার করে নেয়। তবে দ্বীপটায় বসবাস কেন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেল তা নিয়ে অনেক তত্ত্বই আছে। একবার সমুদ্র উঠে এসে ডুবিয়ে দিয়েছিল দ্বীপটাকে, এটাও একটা কারণ।
দ্বীপটির দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভাবছিলেন কিশিমোতো। এবার উলটোদিকে ফিরলেন। তাঁর বোধহয় কিছু কাজের কথাই মনে পড়ল, তাই নিজের তাঁবুর দিকে এগোলেন তিনি। পুরনো বাড়িটার কম্পাউন্ডেই একটা তাঁবুতে কিশিমোতো রয়েছেন, যেহেতু তিনি কয়েকটা সংযোগ রক্ষাকারী যন্ত্রের দায়িত্বে আছেন, যেগুলো বাড়িটার পুরনো পুরু দেওয়াল ভেদ করে সিগন্যাল পায় না। অতএব একটা তাঁবুতেই কিশিমোতোর আস্তানা নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু তাঁবুটায় ঢুকবার আগেই গা-টা একটু ছমছম করে উঠল। মনে হল, ভেতরে কেউ রয়েছে। যে আছে, সে তাঁবুটার ভেতরে ঘোরাফেরা করছে, কী যেন করছে বা খুঁজছে বলেই মনে হল— অস্পষ্ট আওয়াজ শুনে। একটু দাঁড়িয়ে গেলেন কিশিমোতো, অল্প সময় নিলেন। তারপর এগোলেন। তাঁবুর জ়িপটা খুলে অবশ্য কাউকে সঙ্গেসঙ্গে দেখতে পেলেন না। তবে তাঁবুর মধ্যে এক পা রাখতেই ঘাড়ের বাঁদিকে একটা ধাতব শীতল স্পর্শ অনুভব করলেন। বুঝলেন একটা রিভলভারের নলের ডগা তাঁর ঘাড়ে ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আড়চোখে তাকিয়ে এবার দেখলেন, রিভলভারটা ধরে আছেন ধূসর-কালো আলখাল্লা পরিহিত তাঁর বয়স্ক সহকর্মী স্বয়ং।
রিভলভারটা তাঁর ঘাড়ে ঠেকিয়ে ব্রহ্ম ঠাকুর বলে উঠলেন— স্নেহের কিশিমোতো, তোমার গায়ে বন্দুক ঠেকাতে আমার কতটা খারাপ লাগছে তা হয়তো বলে বোঝাতে পারব না, কিন্তু আমার এই মুহূর্ত থেকেই এখানকার ঘোলাটে ব্যাপারস্যাপারের উপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ চাই। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে— তুমি একাধিক সত্য গোপন করে চলেছ। উত্তরাধিকারসূত্রে তোমার বাবা অর্থাৎ সিনিয়র কিশিমোতোর ছেঁড়া ডায়রিটার অ্যাকসেস পুরোমাত্রাতেই আছে তোমার, বিশেষ করে যখন তাঁর গবেষণা এবং আবিষ্কারের সমস্ত কাজেরই তুমি প্রধান সহকারী। এদিকে তোমাকে বগলদাবা করেই বিলি গিলচারের আন্দামানে আগমন। বিলির রুটম্যাপে আন্দামান ছিল না, ছিল ‘ইজু আরকিপোলাগো’। আমি ওই নামটা গতকাল রাতে উচ্চারণ করতেই বিলি যেমন ভাবে চমকালো, তাতে আমি এ ব্যাপারে একশো শতাংশ নিশ্চিত। আমেরিকার সিয়েটলে বিটিটু প্রকল্পের ল্যাব ধ্বংসের ঘটনাটা ঘটবার পর সে আমেরিকার পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে আন্তর্জাতিক তারিখরেখা পেরোয়। খুব সহজেই পৌঁছে যায় জাপানের তোকিয়োয়, তোমাদের গবেষণাগারে। বিলি সিয়েটলের ঘটনা ঘটবার কিছুদিন পরে যখন তৃতীয়বারের জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল, তখনই তার স্থানাঙ্ক নির্দেশ করছিল, সে তোকিয়োতে আছে। সেখান থেকে মানচিত্রের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সহজ উপায় হতে পারত এই দুটো শব্দ— ইজু আরকিপেলাগো, অর্থাৎ ইজু দ্বীপপুঞ্জ। আন্দামানও ‘আরকিপেলাগো’ অর্থাৎ দ্বীপপুঞ্জ, জাপানের ইজুও তা-ই। অতএব অজানা দ্বীপের খোঁজে এত দূরের ভূগোল ঠেঙিয়ে আন্দামান আসবার কোনও প্রয়োজনই তার ছিল না। তাও সে সিদ্ধান্ত বদল করে আন্দামানে এসেছে। এর একটা অন্য, বিশেষ কারণ আছে। এবং আমার বিশ্বাস তুমি ওর ডাকে সাড়া দিয়ে আসনি, তুমি এসেছ বিলির সঙ্গেই এই অভিযানের সঙ্গী হয়ে। অতএব দুইয়ে দুইয়ে যদি চার করতে পারি— এখানকার অ্যাটমিক রিঅ্যাকটর নিয়ে বিলির লুকনো ইন্টারেস্টে তোমার পার্টনার হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তুমি খালি এটা মনে রেখো, কিশিমোতো কিন্তু একজন নন, দু’জন। এবং সিনিয়র কিশিমোতো আমার বিশেষ বন্ধু। তোমার বাবার প্রাণ একদা আমিই বাঁচিয়েছিলাম, তাও আবার এ অঞ্চলেই! তার কিছুদিন পরেই তিনি আমার আমন্ত্রণে ‘কোয়াসিমোদো’ ছদ্মনামে আমাদের বিটিটু প্রকল্পে যোগ দেন। শোনো, বিলির ডাকে সাড়া দিয়ে এই আন্দামানে আমি আসলে আসিনি। এসেছি অন্য একটা কাজ নিয়ে। সেই ব্যাপারেই তোমায় জিজ্ঞেস করছি, স্বনামধন্য পরমাণু বিজ্ঞানী স্যর ক্যাভি আইজ়্যাক এখন ঠিক কোথায় আছেন? তোমরা কোনও এক নিকটবর্তী দ্বীপে নিশ্চয়ই তাঁকে আটকে রেখেছ! আমার সন্দেহ হয় সেই দ্বীপ এই পোর্ট ব্লেয়ারেরই লাগোয়া, হয় চ্যাথাম দ্বীপ, নয়তো রস আইল্যান্ড। ওহ না না, চ্যাথাম হবে না। চ্যাথামে তো ব্রিজ পেরিয়ে সহজেই যাওয়া যায়! তাহলে নিশ্চয়ই রস আইল্যান্ডই হবে। রসের কোথায় তোমরা লুকিয়ে রেখেছ স্যর ক্যাভিকে? বলো, এক্ষুনি বলো। আর দেরি করা চলবে না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে…
— প্লিজ় রিভলভারটা সরিয়ে নিন ড: ঠাকুর। বাবার প্রতি আপনার অবদান আমাদের পরিবারে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। ওঙ্গেদের দ্বীপে নেমে তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন, সে যাত্রা আপনি তাঁকে খুঁজে না বের করলে তাঁকে আর পাওয়াই যেত না, আমিও পিতৃহারা হতাম। তাই আমাকে দয়া করে শত্রু ভাববেন না…
কিশিমোতো দু’হাত উপরে তুলে ধরেছেন। এটুকু কথা বলতে বলতেই হালকাভাবে রিভলভারের নলের থেকে একটু দূরত্ব তৈরি করবার চেষ্টা করলেন তিনি। যেন একবার ঘুরে তাকাতে চাইছেন ব্রহ্মের দিকে। ব্রহ্ম অবশ্য সে সুযোগ দিলেন। তিনিও কিশিমোতোর চোখে একবার চোখ রাখতে চান। গতকাল রাতে কিশিমোতো ছোট্ট সাক্ষাতে চোখ সরিয়ে নিয়ে সন্দেহভাজন হয়েছিল। আদৌ এখন সত্যিকথা বলছে, না ষড়যন্ত্রীদের দলের সেও একজন অন্যতম অংশীদার, তা বুঝতে তার চোখের চাহনিটুকু সঠিকভাবে এবার পড়ে ফেলতে হবে ড: ব্রহ্ম ঠাকুরকে।
কিশিমোতো তাঁর দিকে ফিরে দাঁড়ালেও রিভলভারটা অবশ্য লক্ষ্যচ্যুত করলেন না ব্রহ্ম। সে সময় এখনও আসেনি। সতর্ক থাকা দরকার।
(ক্রমশ)
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র