সর্ষে শাকের সাতকাহন
শহরে ফাইনালি সেই দশদিন-ব্যাপী, নিউ ইয়ার টু ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলন শীত নেমেছে। মাঙ্কি-ক্যাপ, বাহারি গরম শাল, কদর্য দেখতে (এবং জঘন্য রঙের) লেদার জ্যাকেট, বাজখাঁই লেপ— সবই ঠিক এক হপ্তার জন্য বেরিয়ে পড়েছে। ঠিক ছুটি না থাকা সত্বেও, সবার মনটা খুশি-খুশি, ছুটি-ছুটি।
চিড়িয়াখানা মিউজিয়ামে উপচে পড়া ভিড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লোকাল সবজিওয়ালার ডালি সবুজে-সবুজ। ‘মরসুমী’ সবজির ধারণাটাই আজকাল বদলে গেছে; আপনি উদ্যোগী হলে নানা ধরনের সুপারমার্কেটে সারা বছরই ফুলকপি, মটরশুঁটি, পালংশাক আর তরমুজ পেয়ে যেতে পারেন; আপনার আনাজ-ওয়ালা উদ্যোগী হলে তো কথাই নেই। কিন্তু টাটকা সর্ষে শাকটা এখনও এই শীতের এক মাসই পাওয়া যায়।
পালং-কচু-বেথুয়া-নটে’র মধ্যে বেশ জেঁকে বসে থাকা ফ্রেশ সর্ষে শাক দেখেই মনটা ভালো হয়ে যায়, তার কারণ একমাত্র সর্ষে শাক দিয়েই আমি নানা ধরনের আমিষ রান্না করতে পারি, যার মধ্যে প্রধানত অল্প চর্বির শুয়োরের মাংস (লিন পর্ক) প্রধান। আগে প্রায় সারা বছর জুড়ে প্রায় চোখ বুজে যা খেয়ে বেড়াতাম, বয়স (এবং সুমতি) বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেটা এখন শীতকালের কয়েক সপ্তাহে এসে দাঁড়িয়েছে, এবং এটা আমি নিজের হাতের রান্নাটাই সবচেয়ে বেশি খেতে ভালোবাসি।
বাড়িতে সর্ষে শাক এলে অবশ্য আমিষ-নিরামিষ দু-ই রান্না হয়ে যায়। আগে নিরামিষ রান্নার কথা বলি। স্ট্যান্ড-অ্যালোন সর্ষে শাক একটু তেতো, তাই নিরামিষ রান্না, মানে শুধু শাকটার পদ বানাতে চাইলে, আমি একটু পালং মিশিয়ে নিই, যাতে তিতকুটে ভাবটা চলে যায়। পুরো শাকের তিন ভাগের এক ভাগ যদি পালং শাক হয়, খুব ভালো।
আমাদের বাড়িতে একদম বেসিক নিরামিষ পদটা হচ্ছে পাঁচফোড়ন দিয়ে সর্ষে শাক ভাজা, যেটার চেয়ে সহজ-সরল ব্যাপার আর হয় না। শাক ধুয়ে কুচো করে কেটে সেদ্ধ করে নিতে হয়, তবে গলিয়ে ফেলা সেদ্ধ নয়। তাওয়ায় সর্ষের তেল (অবশ্যই!) অল্প গরম করে নিয়ে পাঁচফোড়ন, একটু কুচানো রসুন, একটা শুকনো লঙ্কা হালকা ভেজে নিয়ে শাক তাতে ঢেলে দিয়ে অল্প কিছুক্ষণ রেখে তুলে ফেলে নিলেই হল— এক থালা গরম ভাতের সঙ্গে প্রথম পদেই যে কিস্তিমাত হবে, সেটা আমি লিখে দিতে পারি!
দ্বিতীয় রেসিপিটা আমার পিতামহীর, এবং পুর্ববঙ্গ রন্ধন-পটিয়সীরা হয়তো অনেকেই এটা জানেন। এটা আমি আমিষ-নিরামিষ দুই গতেই রেঁধে দেখেছি, বেশ লাগে! সেটা হল সর্ষে শাকের খিচুড়ি। খুবই সহজ পদ্ধতি— মুসুর ডালের খিচুড়ি বানাতে যা লাগে, এখানেও তাই। মুসুর ডাল, চাল, নুন, কাঁচালঙ্কা আর অল্প একটু গরম মশলা একটা প্রেশার কুকারে ঢেলে ভালো করে মিশিয়ে সেদ্ধ করতে হবে। ডাল আর চাল সেদ্ধ হয়ে এলে সর্ষে শাকের ডাঁটি আগে এবং পাতা পরে দিয়ে, আদা, রসুন আর অল্প একটু বাদামের গুঁড়ো দিয়ে একটা হুইসলের মতো সময় রান্না করে নিলেই কেল্লা ফতে; শাক সেদ্ধ হতে বেশি সময় লাগে না।
মজার ব্যাপার হল, বেশির ভাগ বাঙালি বাড়িতে ‘শাক’ বলতেই নিরামিষ পদের কথা ওঠে। আমি এই নিরামিষ পদটায় আগে থেকে ম্যারিনেট করে রাখা এবং অল্প ভাজা লিন পর্কের ডুমো ডুমো টুকরো ফেলে দিই; এক নিমেষে প্রায়-সাত্বিক খিচুড়ি হয়ে ওঠে ওয়ান-ডিশ শুয়োরের মাংসের ওয়ান্ডার!
এবার আসি আমিষ গতে, যেখানে সর্ষে শাকের পাহাড়ি পরিচয় ‘রাই’ বা ‘লাই’ শাক (lai xaak) হয়ে ওঠে স্টার অ্যাট্রাকশন। পর্ক খাওয়ার ক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে পছন্দের পদগুলো আমাদের দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি খাদ্যের সম্ভার থেকে আসে, যার বিশেষত্ব হল অল্প মশলার, হালকা, খুবই সুস্বাদু রান্না। এই ধরনের রান্নার সঙ্গে আমার পরিচয় মাত্র গত এক দশকের, প্রধানত আমার বিশেষ বন্ধু, ফসিল্স ব্যান্ডের গিটারবাদক অ্যালান আও-এর মাধ্যমে। সেই ২০০৮-’০৯ সাল থেকে আমরা একসঙ্গে বাজিয়ে এসেছি। ২০০৯ সালে আমার প্রথম নাগাল্যান্ড যাওয়া। প্রায় ২০ বছর আগে কোহিমা ছেড়ে কলকাতায় আসা কোহিমার ছেলে, আও নাগা অ্যালানের সঙ্গে ফিরে গিয়ে কোহিমা দেখা— এই সব কিছুর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে খাদ্যাভ্যাস; নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতির ভালো লাগা, সুদূর পাহাড়ে, সম্পূর্ণ আলাদা এক ভূ-অবস্থানেও সংস্কৃতির, মননের, জীবন-দর্শনে মিল খুঁজে পাওয়া। অ্যালানের সান্নিধ্যেই প্রথম ভূত জোলাকিয়া বা রাজা মির্চি দিয়ে রসানো শুয়োরের মাংস খেয়েছিলাম কোহিমায়, খেয়েছিলাম স্টাফ করা শুয়োরের অন্ত্র, বাঁশে স্টিম করা মাছ খেয়েছিলাম এক ধরনের, এবং খেয়েছিলাম আখুনি (axuni), বা ফার্মেন্টেড সয়াবিন দেওয়া নানা রকম পদ, যেটা অবশ্য শিলং-এই প্রথম হাতে-খড়ি। বিগত এক দশকে অ্যালানের বাড়িতে এই ধরনের রান্না যে আমি পাত পেড়ে কতবার খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। অবশেষে, নিজেই রান্না করতে নেমে পড়েছি, এবং তার প্রধান কারণ সর্ষে শাকের শুয়োরের মাংস রান্না করার ঝঞ্ঝাটহীন পদ্ধতি এবং সেই পদ্ধতিতে বানানো পদের তুলনাহীন স্বাদ!
সর্ষে শাকের শুয়োরের মাংস, বা ‘লাই শাক পর্ক’, আমার দেখা আমিষ রেসিপির মধ্যে অন্যতম সহজ রান্না। ডুমো করে কাটা্ মাংস অল্প সর্ষের তেলে ছাড়া পেঁয়াজ-রসুনে ভেজে তাতে প্রথমে ডাঁটা, এবং পরে পাতা দিয়ে পুরোপুরি ভাপে তৈরি হয় এই পদটা। জল দেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না, কেননা শাক থেকে এবং মাংস থেকে জল ছেড়ে তৈরি হয় এক অপূর্ব স্বাদের ঝোল, যার নুন-ঝালটা খেয়াল রাখলেই হল। আমি এই মাংসের ঝোলে অল্প একটু ভূত জোলোকিয়া আচার আর দু-একটা টাইমলি কাঁচালঙ্কা ছেড়ে দিয়ে দেখেছি, খাসা খোলে। এ-বাদে, শুধু রসুন দিয়ে, সম্পূর্ণ বিনা মশলায় তৈরি এই রান্নাটা দিয়ে এতটাই ভাত খেয়ে ফেলা যায় যে পরে ওভার-ইটিং ইত্যাদি ভেবে ভয়ানক অপরাধবোধ হতে পারে, কিন্তু গুলি মার!
স্বাদ যদি ছেড়েও দিই, গুণগত মানেও সর্ষে শাকের জুড়ি মেলা ভার। সর্ষে শাকে থাকে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভিনয়েড, লুটিন ও বিটা ক্যারোটিনের মতন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট; থাকে ভিটামিন এ, সি, ই, বি সিক্স এবং কে; ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, আর প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, যা ক্যানসারের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। ভাবা যায়? দশ টাকার এক তাড়া সবুজ পাতার কী মহিমা!
দেখছেন কী? শীত কিন্তু এলো আর গেল বলে, সর্ষে শাক যে ফুরিয়ে আসবে…