এক-একটা দিন অম্লানের নিজেকে এমনি ভাবেই আয়নার সামনে দাঁড় করাতে ইচ্ছে করে। সম্পূর্ণ নগ্নভাবে। বন্ধুরা বলে ল্যাংটো; তারপরেই প্রতিটা লোম বোঝা যায়, প্রতিটা ঘামের বিন্দুতেই নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। গতকাল রাতে ঠিকভাবে শুয়ে থাকলেও, রিনাকে আয়না মনে হচ্ছিল। রিনাও এক্কেবারে নগ্ন ছিল, ওই যাকে বলে ‘ল্যাংটো’।
‘আরে শালা আকাশ ল্যাংটো, মেঘের পোশাক পরে ভয়ের সৃষ্টি করে! নদীও ল্যাংটো! তোরাই যত সব পোশাক, ফ্যাশনের পোঙা ধরে বসে থাকিস।’ কথাগুলো একবার অম্লানকে একটা নাগাবাবা জয়দেবের মেলাতে বলেছিল। অম্লান তখন সদ্য কাজ পেয়েছে, তাও আবার মাস্টারের কাজ; আর মাস্টার মানেই তুমি ঈশ্বর অথবা তার কাছাকাছি কেউ। তোমার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া থাকবে না, তোমাকে আস্তে কথা বলতে হবে, গোলাপ ফুলের মতো মলত্যাগ করতে হবে, দুধের মতো মুততে হবে, দামি সুগন্ধীর মতো পাদতে ও দুঃখিত বাতকর্ম করতে হবে। অনেকটা সেই ঈশ্বর বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো অবস্থা— কেমন যেন ভাবতেই অসুবিধা হয় ওঁরও ব্যক্তিগত অনুভূতি আছে, রয়েছে বর্তমান ব্যক্তিস্তরের মানসম্মান-প্রেম-ভালোবাসা। অম্লানের মনে পড়ে, তার স্কুলে পড়বার সময় তাদের স্কুলের এক মাস্টারমশাই ও দিদিমণিকে বাজারে একসাথে ঘুরতে দেখবার পরে চারদিকে একটা আলোড়ন হয়, এমনকী এলাকার লোক একজোট হয়ে হেডমাস্টার মশাইকেও ব্যাপারটা নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন। পরিস্থিতি এমন হয় যে, ওঁরা কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে করে নেন। অথচ স্কুলের ভিতর লুকিয়ে অথবা গর্তের ভিতর স্যার বা ম্যাডামদের ভিতর কত রকমের সম্পর্ক!
‘ওটাই তো সব কিছু ভিতরে ভিতরে। প্রকাশ্যে সব কিছু নিষিদ্ধ। শুনিসনি, প্রকাশ্যে নগ্নতা ঢাকলেই যৌনতা?’
শেষের কথাগুলো অম্লানের এক কলিগ স্কুলে বলে। তারপর থেকে অম্লান একটা জম্পেশ মুখোশ কিনে পরে নেয়। এটা পরে কীরকম যেন একটা শক্তি আসে। সকালে উঠে শরীরটা ল্যাংটো থাকলেও মুখে মুখোশ থাকবেই। মুখোশের ভিতর দিয়ে চা, মদ-গাঁজা-ভাং, এমনকী প্রকাশ্যে চুমুও খুশিমতো খাওয়া যায়। দুটো কাজ করতে হয়, মুখোশের ভিতর থেকে খাওয়া অথবা খেয়ে মুখোশটা পরে নেওয়া। মাথার ভিতর এই সব কিছু চিন্তা করতে-করতেই তো সকাল থেকে সন্ধে পেরিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে স্নান করে চুল ছাড়ানোর সময় আয়নার সামনে দাঁড়ালেই ভিতর থেকে কে যেন বলে ওঠে, ‘কী রে, কাল আবার মাল মারলি?’
এখন অবশ্য মদ খাওয়াটা কোনো ব্যাপার নয়। কিছুদিন আগেই এক সবজির দোকানদার বলে, ‘মদ না হলে চলবে কী করে? এখন তো হলেও মদ, মলেও মদ।’ স্কুলের কয়েকটা দিদিমণি নিয়ম করে প্রতি শনিবার মদের পার্টিতে বসে। সেখানে অবশ্য কোনও স্যারকে ডাকেন না। এমনকী যাদের বর আছে, তাদের বরদেরও না। দিব্যি আছে। রবিবার ছুটি, সোমবার মুখে সেই মুখোশ। ছাত্রছাত্রীদের আদর্শের পাঠ দিচ্ছেন, বাইরে কোনো ছাত্র বা ছাত্রীকে একসাথে গল্প করতে দেখলে শাসনের নামে কত কিছু বলছেন কিন্তু একবারের জন্য বলছেন না, ‘গোলাপ দিতে না পারলে কোনওদিনও রজনীগন্ধা দিতে পারবি না।’ আরে বাবা, ওরা তো এই সময় বেশ কিছু জেহাদি সন্ত্রাসবাদীদের মতো হাতে বন্দুক নিয়ে বা অস্ত্র নিয়ে ছবি দিচ্ছে না! এগুলো অবশ্য মুখে বলতে নেই, সেজন্যেই তো মুখোশ, নিজের সাথে দাবার গুটি চালা বা লুডোর দে ছক্কা লে পুট।
কথাগুলো ভেবে কী হবে, কেউ কি মিষ্টি খাওয়াবে, না কি কেউ বলবে, ‘আপনি দাদা ফাটিয়ে দিলেন, তাহলে এবারে আপনার পত্রিকায় একটা জায়গা দেবেন, আপনার নতুন প্রজেক্টে একটা ফ্ল্যাট, অথবা আপনার জন্য এক ফুসমন্তর!’? মাঝে মাঝে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ঠিক কাকে মারা ঠিক হবে? ওই যে লোকটা নেতা-নেতা কন্ডোম পরে, না কি যে কোথাও কন্ডোম পরিয়ে একটা বিতর্কের হিমালয়ে থাকতে পছন্দ করে? তারপর কেউ আঁতলামি মেরে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে, ‘আসলে, ধর্মটা আমার ঠিক আসে না। আমার বউ পূজা করে আমি শুধু দেখি।’
আচ্ছা ধর্মটা কি পায়খানা যে, আপনার পাবে আর আপনি আঁতলামি মারবেন? অবশ্য এখন আঁতলামি মারাটাও চপের মতোই একটা শিল্প। যেমন শিল্প ছাত্রীদের সাথে গোপন সঙ্গম অথবা প্রকাশ্যে পুরুষ-লিঙ্গ কেটে দেব বলে একটা পোস্ট দেওয়া। আপনার কি একটা বউ, কোনও অতিরিক্ত সম্পর্ক নেই? তাহলে আপনার আর এই জন্মে লেখক হওয়া হল না! আপনাকে দরজার এক পাশে দুটো হাত জোড় করে সব বড়-বড় লেখকদের দেখতে হবে। আপনার চোখের সামনে কিতকিত খেলে যাবে কয়েকটা নির্মম সত্য কথা, আপনি দেখবেন-ফুলবেন-ফুটবেন কিন্তু কথা বলা যাবে না।
‘অম্লানবাবু আপনি কিন্তু এখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। আপনার বাবা মিছিলে যেতেন, বাঁ-হাতে খেতেন, লিখতেন, আর আপনি বাঁ-হাতটা শুধু শৌচকাজে ব্যবহার করেন।’
‘আচ্ছা আপনার নামটা কী?’
‘আমিও তো অম্লান। দেখুন আপনার নাক-কান-হাত-পায়ে হাত দিয়ে দেখুন, পরিষ্কার আমার গন্ধ পাবেন। আচ্ছা আপনি কি ওদেশ থেকে ভয়ে পালিয়ে এসেছিলেন? আপনার মা-বাবা কই, এক কাপড়েই পালিয়ে এসেছিলেন? আর এসেই বিরোধিতা! এগুলো কি প্রচারের আলোয় আসার জন্যে, না কি এর পিছনে গভীর কোণো ষড়যন্ত্রের বীজ আছে?’
‘আচ্ছা অম্লানবাবু, স্বাধীনতা কাকে বলে?’
‘বার্নাড শ-এর লেখা ‘ফ্রিডম’ পড়েছেন? পড়ুন, বুঝবেন এটা একটা হেঁয়ালি। একটা দেশ ধর্মের ভিত্তিতে ভাঙা হলেও এখনও…’
‘জানো, আমার ঠাকুমা একবারের জন্যে হলেও তার ফেলে আসা দেশে যেতে চেয়েছিলেন। যেতে পারলেন, না, সম্ভব হল না। আমরা তো খুব উন্নত, তাই আমাদের এত ভাগ-এত বাধা!’
মাথা কাজ করছে না। অম্লান আসলে কে? আমি, না কি আপনারা সবাই? না কি কেউ না, ওই আয়নাটা কিছু জানে, বোঝে? আমি নাচলে নাচে, কাঁদলে কাঁদে। কিন্তু বাকি কিছু? অম্লান মানে আমি, মানে আপনারা, এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখনই রিনা এসে অম্লানকে দেখে বলে, ‘এ কী, তুমি এখনও মুখোশ পরোনি কেন? তোমার কোনো বুদ্ধি নেই? ল্যাংটো থাকলেও মুখোশ পরতে হবে, নাহলে এখানে কোনও দাম পাবে না।’
একটা মস্ত কিন্তু ফাঁকা মাঠ। দু’পাশে প্রচুর মানুষ, এমনকী ঈশ্বরও। সবার মুখে মুখোশ, আর পকেটে উল্টানো আয়না। অম্লানের ঘুম পাচ্ছে। শরীরে কাটাকুটি, উড়ে যাচ্ছে অম্লান সাথে আমিও। কিন্তু কোথায়? সেই যেখানে শূন্যতা ছুঁয়ে থাকে আরেক শূন্যতা, না কি অন্য কিছু? মিলিয়ে গেল অম্লান, আমিও। রিনা এখন শুধু আয়নার আরেক নাম। আমার শরীর থেকে একটা দেশের জন্ম হয় আমি তাও অল্পদিনের মধ্যে ধর্মীয় ভাবে সংখ্যাগুরু থেকে সংখ্যালঘু হয়ে দেশ ছাড়ি। এদেশে নিজেকে বুদ্ধিজীবী প্রমাণ করতে মরিয়ে হয়ে নিজের ধর্মের সব ব্যাপারে সমালোচনা করি। তারপর চেয়ারে বসতেই শরীরটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ পুরুষ শিক্ষক কমবয়সি ছাত্রী খোঁজে, আর মহিলা বলে ওঠে, ‘দেখা কোরো, নয় বাঁ-টাও কেটে দেব, হাতে ধরে নিয়ে যাবি।’ আমরা কেউ নিজের, কেউ-বা স্বামীরটা আগলে বসে থাকি। এই তো অম্লান ও আপনারা, এবং আমি অথবা আমি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র