প্রথম যখন হাঙরের চোয়ালটা দেখতে পেলাম, খাঁচার অত কাছে, ষোলো ফুট বিপুল শরীর, শিকার ধরার সময় তার লেজের ঝাপটা, এক মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, খাঁচার দরজা এক্ষুনি খুলে যাবে অথবা আমাকে নিয়ে খাঁচা গভীর সমুদ্রের নীচে। প্রত্যেকবার যখন কেল্পের জঙ্গলে মধ্যে দিয়ে ‘গ্রেট হোয়াইট’ শার্কদের শিকারক্ষেত্রে নামি, মনে হয় ধার করা সময়ে বাঁচছি। হয়তো এবারই শেষ।
— জান্দিলে লোভু, ফ্রি ডাইভার, সাউথ আফ্রিকা।
আমি খেয়াল করে দেখেছি, আমরা সবাই আসলে সবসময় হিরো খুঁজে বেড়াই। তবে আমরা মানে সেই জনতা, যারা জীবনে কোনও ভিকট্রি-স্ট্যান্ডে দাঁড়াইনি, কেজি স্কুলে একটা বসে আঁকো প্রতিযোগিতাতে থার্ড প্রাইজও পাইনি, ট্র্যাকে দৌড়োইনি, ক্লাসে ফার্স্ট হইনি, নজরুলগীতি প্রতিযোগিতায় কোনও বিচারকের মনে হয়নি লেগে থাকলে অনেক দূর যাব— সেই সব মানুষদের কথা বলছি। এই আমরা সবাই কিন্তু গল্পে-খবরে-খেলা দেখতে-দেখতে আর অবশ্যই সিনেমাতে হিরো খুঁজে বেড়াই। ‘ফরেস্ট গাম্প’-এ ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ, অভিনয়, অন্য সব কিছু বাদ দিয়েও প্রত্যেক সময় যখন ফরেস্ট অসামান্য কাজগুলো অনায়াসে করে ফেলে, আমাদের ভেতরের অসফল মানুষটার মধ্যে আনন্দের বুদ্বুদ ফাটে। বাকি সময় খবর রাখি না, কিন্তু অলিম্পিক আমাদের কাছে স্বর্ণযুগ। সেই সময় অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার— সব দেখি। জেতার পর যদি প্রায় অচেনা, পিছিয়ে পড়া দেশ থেকে আসা প্রতিযোগীরা ভিক্টরি-স্ট্যান্ডে দাঁড়ায়, তাদের সাথে আমরাও কেঁদে ভাসিয়ে দিই। তারপর মেয়ে হলে তো কথাই নেই! সেরেনা উইলিয়ামসের প্রত্যেকটা জিত আমাদেরও, মীরাবাঈ চানু আর সাক্ষী মালিকের জিত যেন অনেকটা বেশি অক্সিজেন ঢুকিয়ে দেয় আমাদের ফুসফুসে। মনে হয়, এদের প্রত্যেকটা মাস্লে একটু হলেও যেন আমাদেরও শক্তি আছে। আমাদের অকিঞ্চিৎকর যাপনের রোজকার স্ট্রাগল, ব্যর্থতা সব যেন ওদের প্রত্যেকদিনকার প্রস্তুতিতে, প্রত্যেকটা জেতা-হারায়। আর শুধু স্পোর্টস কেন? ইসরোর মহিলা মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কপালে টিপ আর বিনুনিতে ফুল লাগানো ছবি যখন বিবিসির পাতায়— আমাদের পা তখন আকাশে। নিউজিল্যান্ডের প্রাইম মিনিস্টার জেসিন্ডা আরডার্নের নেতৃত্বে যখন একটি বন্দুকজনিত গণহত্যার পর তার সরকার অবিশ্বাস্য কম সময়ের মধ্যে গোটা দেশে স্বাভাবিক ভাবেই মারণাস্ত্র নিষিদ্ধ করে দেয়, পৃথিবীর অপরপ্রান্তে আমেরিকায় বসে আমার সমস্ত রাষ্ট্রপতিদের ওপর ধিক্কার আসে। মনে হয় জেসিন্ডা কেন পৃথিবীর অন্য গোলার্ধে?
২০২১ সালে, আমার এহেন হিরো-সন্ধানী চোখ ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও-র ওয়েবসাইট থেকে খুঁজে পায় এক কৃষ্ণা মৎস্যকন্যাকে— সাউথ আফ্র্রিকার তীরবর্তী সমুদ্রে। দীর্ঘ, সরু-সরু বিনুনিতে বাঁধা তার নীল চুল, তার পেশিবহুল, দীর্ঘ কিন্তু প্রায়-তরল শরীর সাঁতার কাটছে সমুদ্রের গভীরে— সেখানকার মাছেদের মতোই, অনায়াস ভঙ্গিমায়। জান্দিলে লোভু— সাউথ আফ্রিকার ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী সমুদ্রে একজন ডুবুরি, একজন ডাইভিং শিক্ষক। আক্ষরিক অর্থেই তাকে বলা হয় ‘ব্ল্যাক মারমেড’। তবে প্রচলিত অর্থে আমরা যে-ডুবুরিদের দেখি, তিনি তা নন, তিনি একজন ‘ফ্রি ডাইভার’; যাঁরা অক্সিজেন ট্যাঙ্ক নিয়ে জলে নামেন না, তাঁদের কাছে তাঁদের ফুসফুসগুলোই অক্সিজেন ট্যাঙ্ক। আর তার শক্তিতেই জান্দিলে সমুদ্রের গভীরে প্রায় তিরিশ মিটার পর্যন্ত নামেন। একশো ফুট গভীর সমুদ্রে, অক্সিজেন ছাড়া নামা, অক্সিজেন ট্যাঙ্কের কৃত্রিম বুদ্বুদের থেকে, তাঁর নিঃশব্দ ডুব তাঁকে অনেক বেশি করে সমুদ্রের নীচের পৃথিবীটাকে উপলব্ধি করায়। পাবলিক রেডিওতে শোনা লোভু-র ইন্টারভিউয়ের এইটুকুই আমার মতো সাঁতার না-জানা মানুষের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট; কিন্তু সেখানেই তো শেষ নয়, কেমন ছিল তাঁর ওই গভীরে পৌঁছোনোর পথ? খাড়া চড়াই বলা যেতে পারে। প্রথম কারণ, অবশ্যই তিনি মেয়ে। যখন তিনি কাজে যোগ দেন, সাউথ আফ্রিকার সডওয়ানা উপসাগর— যেখানে সমুদ্রের তলার সৌন্দর্য স্কুবা ডাইভিং বা স্নর্কেল করে দেখার জন্য বহু মানুষ বেড়াতে যান, সেখানে এমনিতেই কোনও মহিলা ডুবুরি ছিল না, তার ওপর কৃষ্ণাঙ্গ? বর্ণবিভেদ সাউথ আফ্রিকা থেকে নিষিদ্ধ হয়েছে নয়ের দশকে। বর্ণবিভেদে সম্পূর্ণ অভ্যস্ত জান্দিলে, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের জন্য নির্ধারিত গরিব শহর সোয়েটোতে বড় হয়েছেন; সেখানে সুইমিং পুলের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। নামার জন্য যা পয়সা লাগতম, সেটাও তাঁদের ছিল না। ওই একই আর্থিক কারণে বহু কালো আর বাদামি বাচ্চাদের সাঁতার শেখা সম্ভব হত না। তাছাড়া সমুদ্রতীরের যে-জায়গাগুলো কালোদের জন্য নির্দিষ্ট থাকত, সেখানে ছিল পাথুরে এবড়োখেবড়ো বিচ। ভাল সমুদ্রতট— যেখান থেকে সমুদ্রে আরামে স্নান করা যায়, সেখানে যেতে পারত শুধু সাদারা। তার ওপর তাঁর পরিবার রক্ষণশীল ছিল; বাড়ির মানুষজনের জলে ভয় ছিল। তাঁর ঠাকুমা এহেন গেছো স্বভাব মেয়েদের যা যা করা বারণ, সেই সব কিছুকে কখনো ভালো চোখে দেখতেন না। এসব সত্ত্বেও কিন্তু জোর করে সাঁতার শিখেছিলেন তিনি। জীবনে সম্পূর্ণ অন্য পেশাতে প্রতিষ্ঠিত হন একদিন, কখনও ভাবেননি তিনি ডুবুরি হবেন।
সময় এগোতে থাকে। বয়স তিরিশ পেরিয়ে যাবার পর, বালিতে বেড়াতে গিয়ে স্কুবা ডাইভিং করার সময়ে তিনি প্রথম সমুদ্রের নীচের জগৎ আবিষ্কার করেন এবং সম্পূর্ণ প্রেমে পড়ে যান; বোঝেন, ওই জগৎটাই তাঁর জায়গা। এতটাই সেই ভালবাসা যে, নিজের জায়গায় ফিরে এসে, পুরনো পেশা ছেড়ে তিরিশ পেরোনো জান্দিলে ট্রেনিং নিয়ে পালটে ফেলেন তাঁর কর্মক্ষেত্র আর একইসঙ্গে তৈরি করলেন প্রথম নজির। তিনি হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ‘ডিপ সি ডাইভার’। কালো মানুষরা সাঁতার জানে না, পারে না— এই গল্পটাই পালটে দিলেন তিনি, রাতারাতি তাঁর নাম হয়ে গেল ‘ব্ল্যাক মারমেড’। ওই একশো ফুট জলের গভীরে গিয়ে যখন প্রথম তিমিদের আওয়াজ শুনতে পান তিনি, সেই মুহূর্তটাই তো জয়ের মুহূর্ত, সাফল্যের মুহূর্ত; তাঁর শারীরিক আর মানসিক শক্তি, আর তার সাথে প্রচুর সামাজিক বাধা পেরিয়ে একটা চূড়ায় পৌঁছোনোর মুহূর্ত— ওইরকম মুহূর্তে আমি অনায়াসে কল্পনা করতে পারি তিনি জলের নীচ থেকে গোটা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে মৃদু-মৃদু হাসছেন আর হাত নাড়ছেন, আর আমার মতন অজস্র মানুষ তাতে রোমাঞ্চিত আনন্দাশ্রু মুছছে। কিন্তু বাস্তবে ঠিক তেমন হল না। এই পর্যন্ত এসে আমার হিরোর গল্পে একটা টুইস্ট এসে গেল। ওই জয়ের মুহূর্তটা বিশেষ টিকল না। কারণ মৎস্যকন্যা যখন তাঁর নিজের সাফল্য নামক তলোয়ারে বর্ণবাদ, পুরুষতন্ত্র, শারীরিক বাধা সব কিছুকে কচুকাটা করে ফেলে সমুদ্রের গভীরে তাঁর অভীষ্টে পৌঁছোলেন, তখন তিনি কী দেখলেন? দেখলেন জলের নীচে প্লাস্টিক, রংবেরঙের প্রবালে মৃত্যুর ফ্যাকাসে ছায়া। বিবেচনাহীন মানুষ আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সাগরের গভীরে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আর তার সাথে লুপ্ত হতে বসেছে সমুদ্রের তলার কিছু প্রাণী— যেমন, গ্রেট হোয়াইট শার্ক।
জান্দিলে হিরো। হিরোরা লড়াই করা ছাড়ে না। তিনি সমুদ্র-সংরক্ষণকারী দুই জীববিজ্ঞানী, যাঁরা বিশেষত হাঙরদের নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের সাথে মিলে তৈরি করলেন সম্পূর্ণ এক মহিলা টিম। সাউথ আফ্রিকার সমুদ্রের যে-অঞ্চলটাকে হাঙরদের মুক্ত বিচরণক্ষেত্র বলা হয়, সেখানে তাঁরা হাঙরদের ট্র্যাক করেন, এবং ওই ‘বেটিং রোপ’, যার মাধ্যমে ট্র্যাকিং-যন্ত্রটা লাগানো হয় যাতে তাদের স্থান পরিবর্তন, তাদের এত দ্রুত হারে লুপ্ত হবার কারণগুলো বোঝা যায়— সমুদ্রের গভীরে নিঃশব্দে পৌঁছে, সেটা লাগানোর দায়িত্ব আমাদের ‘কালো মৎস্যকন্যা’র। সেটা বিপজ্জনক হওয়া সত্ত্বেও, তিনি পৌঁছে যান সমুদ্র গভীরে, কেল্পের সবুজ জঙ্গলে। তাঁর দীর্ঘ নীল বিনুনিরা মিশে যায় কেল্পের জঙ্গলে, যেখানে ঘোরাফেরা করে ক্ষুধার্ত হাঙরেরা।
যখন এসব ভাবতে-ভাবতে, জীবনে জলের ধারে-কাছে না-যাওয়া আমার ক্ষুদ্র কল্পনাশক্তি আর এঁটে উঠতে পারে না, তিনি আমাকে আবার চমকে দেন। জান্দিলে থামেন না। পরিবেশ দূষণের এই লড়াইতে তিনি নিয়ে আসছেন আগামী প্রজন্মকে। তিনি গড়েছেন ‘ব্ল্যাক মারমেড ফাউন্ডেশন’। সেখানে বিশেষ ভাবে আসছে তার নিজের কমিউনিটির কালো বাচ্চারা, যাতে তারা ছোট বয়স থেকে সাঁতার শেখে। দীর্ঘ সময়ে পুষে রাখা সমুদ্রের ভয় কেটে যায় যাতে, তিনি তাদেরকে সমুদ্রকে ভালবাসতে শেখাচ্ছেন, পরিচিত করাচ্ছেন সমুদ্রের নীচের উদ্ভিদ, প্রাণীদের সাথে। বলছেন কীভাবে মানুষের দোষে ধীরে-ধীরে ধ্বংস হচ্ছে ওই পৃথিবী। নিয়ে যাচ্ছেন ওই পৃথিবীতে। তাঁর আশা এদের ওপরেই। ছোট থেকে এই বীজ বুনে দিলে কোনও-না-কোনও ভাবে ভালবেসে তারা যুক্ত থাকবে সমুদ্রের সাথে— তাঁর এই লড়াই বিফলে যাবে না। এই লড়াই চালিয়ে যাবে আগামী প্রজন্মও। আর আমরা কে না জানি, শিক্ষকদের থেকে বড় হিরো আর হয় না!