আমরা, কলকাতাবাসীরা খুব রোম্যান্টিক, অতীতচারী এমন যে রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ি চাপা পড়ার জোগাড়— এবং তাই আমাদের খোদাই করা অভিজ্ঞান। পুজোর ঠিক পর পরই আমরা রোম্যান্টিকতার মৌতাতে নিজেদের ভাল করে হার্ড-টোস্ট করে নস্ট্যালজিয়ার ধূঁয়াধার চায়ের ভাপ নিতে নিতে দশমীর বিষাদ পালন করি।
অবশ্য মনে করে দশমীর বিষাদ পালন করতে হয় না। কয়েক লাখ ওয়াটের আলোগুলো যখন রাস্তা থেকে এক লহমায় এক্জিট দেয়, সাতমহলা রাজবাড়ির প্যান্ডেলের সামনে দিকটা হৃৎগৌরবের আভাস দিতে অন্ধকারে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, আর পেছন দিক থেকে দ্রুত খুলে নেওয়া হতে থাকে বাঁশ আর কাপড়ের ভিত, দেওয়াল, ঐতিহ্য, আর রাস্তায় নত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে নিয়ন-বাতি যা কিনা পুজোর আগেও একই রকম ভাবে আলোকিত করত, কিন্তু পুজোর পর তার ম্রিয়মাণ ঔজ্জ্বল্য নিয়ে সে কোথায় মুখ লুকোবে বুঝে পায় না, তখন আপনা থেকেই বিষাদ খোলা মাঠে চালিয়ে খেলার বিরাট সুযোগ পায়। আর তাকে বিশেষ সাহায্য় করে মোড়ে মোড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলে ভরে থাকা হতচ্ছাড়া ছাতিম গাছগুলো। বিলকুল না-ইনসাফি। এত ঠেসেঠুসে দুঃখ দেওয়ার মানেই হয় না।
তবে মনে রাখবেন, আমরা কিন্তু দুঃখবিলাসী, উদাসীন এবং ভুলো— এবং এই তিনে বিশেষণে চেপে আমরা ফাঁকিবাজ, অলস এবং সর্বোপরি খানিকটা শয়তানও বটে। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ঔদাসীন্য ব্যাপারটা কিন্তু রোম্যান্টিক নয়, সুবিধেবাদী অবস্থান।
রেগে যাওয়ার আগে, গুটিকয়েক কথা যাচিয়ে নিই, দেখবেন, দোষারোপটা জলবৎ তরলং। এই যে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে আমরা ইউনেস্কো হেরিটেজের জয়পতাকা উড়িয়ে প্যান্ডেল, আলো, শিল্প, প্রতিমা, রাস্তা বন্ধ, কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে আরও কয়েক কোটি খাবারের স্টল, যথেচ্ছ খাওয়াদাওয়া, বিরিয়ানির হুল্লোড়, কোল্ড ড্রিংকের জোয়ার, পুলিশদের গালাগাল সব হল, মজা যাকে বলে চেটেপুটেনিংড়েচুষে অন্তস্থ করা হল, মন পুজোর আনন্দে, প্রাইজ পাওয়ার ঠাকুর দেখার প্রাইডে ডগমগ হয়ে গেল। কিন্তু তারপর? কী হল?
তারপর আমরা যেটা করলাম শহরটাকে জাস্ট ভুলে গেলাম। আমরা আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পুনরায় ফিরে গেলাম। পুজো প্যান্জেলের পাশের রাস্তায় পড়ে থাকা আবর্জনার স্তূপ থেকে যখন বদগন্ধে ম ম করতে থাকল চারদিক, তখন আমরা সরকারকে দোষ দিলাম। প্যান্ডেলগুলো তৎক্ষণাৎ কেন রাস্তা থেকে ভ্যানিশ হয়ে না গিয়ে আপনার-আমার গাড়ি চালানোর সুবিধে করে দিল না, এই ভেবে প্রশাসনকে তুমুল গালাগাল দিলাম। রাস্তায় কেন গর্ত রয়ে গেছে, সেই নিয়ে সদা চারঅক্ষর প্রস্তত করলাম ঠোঁটের আগায়। অথচ পুজোর প্যান্ডেল যখন রাস্তার গর্ত খুঁড়ে তৈরি হচ্ছিল, তখন আমরা বর্ষাকালে শরতের মেঘ আর অর্ধেক প্যান্ডেলের ছবি পাঞ্চ করে ফেসবুকে লাইক তুলছিলাম। এখন চারিদিক নোংরা হয়ে রয়েছে, পচা জল জমে মশা হচ্ছে— সে দায়িত্ব পৌরপিতার। আমরা কোনও উদ্যোগ নেব না। আমরা কেবল মজা লুটে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে যাব। বলার সময় গাল ভরে বলব যে আমাদের পুজো, সবার পুজো। কিন্তু পুজোর আধার যে কলকাতা, তার জন্য কিছু করব না। কোনও ভাবেই সচেতন হব না। পুজোর একমাস আগেও না। পুজোর একমাস পরেও না। সারা বছর তো নয়ই। বরং সারা বছর থিম বানানোর কাজে যাঁরা মাথা দেবেন, তাঁদের বাপ-বাপান্ত করব। অথচ, যে উদ্যোগে আমরা পুজোর আগে আমরা সিট অ্যান্ড জ্র কিংবা ফাংশন আয়োজন করি, সেই উদ্যোগের ছিটেফোঁটা নিয়ে যদি পুজোর পর শহরটাকে আবার পরিপাটি করে তোলার আয়োজন করতাম, ব্যাপারটা মন্দ হত না। নাটক শেষ হওয়ার পর কিন্তু যত্ন করে মেকআপ তুলতে হয়, নিজের আসল চেহারা দেখার জন্য। ওটাই কিন্তু আসল চেহারা। ওটা নিয়েই কিন্তু ৩৬৫ দিন লোকজনের সামনে দাঁড়াতে হয়, নিজের পরিচয় দিতে হয়। আলমগীর বা নটী বিনোদিনী সেজে কিন্তু সারা বছর চলবে না।
কলকাতাকে ব্যবহার করব এবং নির্দ্বিধায় পরিত্যাগ করব। যৌনকর্মীর শরীরের মতো, জলে ভাসিয়ে দেওয়া মৃতের নাভির মতো। যার দিকে কখনও পেছনে ফিরে তাকাবো না। কিন্তু নিজের প্রয়োজনে যথেচ্ছ ব্যবহার করব। পুজোর আয়োজনে কোথাও কিছু কম পড়লে সমালোচনায় বিদীর্ণ করব। কিন্তু শহরটাকে পরিষ্কার রাখার কোনো দায়িত্ব আমরা নেব না। এমনকী একটা প্লাস্টিকের কাপ বা আইসক্রিমের কাঠি ঠিক জায়গায় ফেলব না।
যারা পুজোর আনন্দে মত্ত ছিলেন এত দিন, কেউ এখন খেয়াল করে শহরটাকে দেখেছেন? নোংরা, রাস্তায় বাঁশের ছড়াছড়ি, গাছগুলো মুড়িয়ে পড়ে রয়েছে। একেবারে ছইছত্তকার অবস্থা। কল্লোলিনীর কি এটাই প্রাপ্য ছিল? কলকাতার কিস্য়ু হবে না— এ কথা বলা যত সহজ, কলকাতার জন্য কিছু করা তত কঠিন। পুজোর আগে-পরে সব করবে পুজো কমিটি। আর আনন্দ করবে, গালাগাল দেবে নাগরিক কমিটি।
কোনও কিছুকে ছিবড়ে করতে হলে, তার মধ্যে রস সঞ্চারণ করাটা আগে প্রয়োজন। আখমারাই যন্ত্রের মধ্যে কলকাতাকে অহরহ পিষে আর বিশেষ কিছু হবে না। ফলে হেরিটেজের দোহাই দিয়ে উদ্বাহু নেত্য করার সময় এই কথাগুলো একটু মনে রাখলে ভাল। কলকাতা আমাদের আধার, তাকে কেবল ব্যবহার করাটা আমাদের উদ্দেশ্য হতে পারে না। ইউনেস্কো, ওপরের চিকনচাকনটাই দেখল, কলকাতার ভেতরে যে খড়ের গোঁজা, সেটা দেখতে পেল না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র