ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • প্রকাশ্যে ঈর্ষার কথা বলি


    অভীক মজুমদার (September 9, 2022)
     

    কোন বইয়ের সঙ্গে জীবনের কোন মুহূর্তে কার দেখা হবে, সেটা বিশেষজ্ঞরা বলেন আপতিক; কেউ বলেন দৈব নির্ধারিত। অনেক সময় দেখা যায়, এমন এক-একটি বই বা লেখা পাঠকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নতুন কোনও আশ্চর্য আতশবাজি অন্দরে জ্বালিয়ে দেয়, যার আভা জীবৎকালে বিবর্ণ হয় না। দু-একটা ব্যক্তিগত কথা বলি। আমার মা-বাবা দুজনেই শিক্ষকতা করেছেন। ফলে ইশকুলের একটু উঁচু ক্লাসে উঠতেই, দুপুরে-বিকেলে অনুপস্থিতির সুযোগে, বাবার সমস্ত বইপত্রের ভাণ্ডার তছনছ করে পড়ার সুযোগ পেয়ে যাই। আমার বাবা, প্রয়াত আশীষ মজুমদার ছিলেন বাংলার জনপ্রিয় শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। সেই বইপত্রের মধ্যে, সম্ভবত ক্লাস এইট-এর শেষের দিকে, আমার হাতে আসে গাঢ় ছাই রঙের মলাটে, সাদা রঙে ছাপার হরফে লেখা একটি কাব্যগ্রন্থ— ‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি’। কবির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ১৯৭৯ থেকে ২০২২— এই বইটি বুকে আঁকড়ে আছি। কতবার যে পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই! বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে পাঠ (reading) পালটে গেছে, মনও হয়তো (হয়তো নয়, নিশ্চয়ই!), কিন্তু মুগ্ধতা কমেনি। প্রথম সেই সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৭২ সনে চৈত্র মাসে, অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে। তখন সুনীলের বয়স বছর তেত্রিশ! কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে চিন্তার এত প্রখরতা, অভিব্যক্তির এমন দাপট এবং কাব্য-আঙ্গিকে গভীর নৈপুণ্য, এক কথায়  বিস্ময়কর! প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’ (১৩৬৪)-এর বিধিবদ্ধ, আয়তাকার, মাপা কবিতাগুলির পাশে এ এক অভূতপূর্ব বিস্ফোরণ! খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমি এই কাব্যগ্রন্থের কবিকে ঈর্ষা করি। কী করে এই সিদ্ধি, দমকা হাওয়ার মতো তিনি করতলে ধরলেন, সে এক অতলান্ত রহস্য। অন্তত আমি আজও কোনও সদুত্তর পাইনি। পূর্বাপর বাংলা কবিতার একাগ্র পাঠক হতে চেয়েছি। বিশ্বকবিতারও। বহু সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়েছি। জাহাজ-কাপ্তেন নয়, সামান্য খালাসি কিংবা মাঝিমাল্লা হিসেবে। এই কাব্যগ্রন্থের মূল্যায়ন কিন্তু একই আছে।

    ২.
    ভূমিকা অতি-সংক্ষিপ্ত। কিন্তু বর্শাফলার মতো। দীর্ঘশ্বাস, আত্মক্রোধ আর নির্মেদ সংকল্পের শান দেওয়া মাঞ্জা। একটি কাব্যগ্রন্থের ভূমিকার প্রথম পঙ্‌ক্তি যে হতে পারে, ‘অনেক কবিতার কপি হারিয়ে গেছে।’— এটা অবিশ্বাস্য! দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে, ‘জানি, যে-কবিতা আমি লিখতে চাই, এখনো তার মর্ম স্পর্শ করতে পারিনি।… যে-কবিতা জীবনের, সে কবিতার জন্য জীবনকে যোগ্য করে নিতে হবে। এ জীবন সজ্ঞানে, আত্মত্যাগে নয়, সর্বগ্রাসে, সর্বভুক কবিতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যদি না পারে, তবে কবিতা লেখা ছেড়ে, সেই দিকভ্রান্ত জীবন তখন নিজেকে নিয়ে কী করবে জানি না।’

    জীবন আর কবিতা, দুই বহুমাত্রিকতার সংঘর্ষে আর সংবেদে; অনলদীপ্ত, অনির্বচনীয় কিমিয়াবিদ্যায় যে-ধাতুনিষ্কাশনের ইশারা এই বাক্যবন্ধগুলির আনাচেকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে, তার আঁচ পাঠকমনেও পৌঁছে যায়। তারপর, প্রবেশ। কবিতার পর কবিতায় বিদ্যুৎতরঙ্গ।

    দু-একটি বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকাতে অনুরোধ করব। গ্রন্থভুক্ত ৭১টি কবিতায় সমকালীন সমাজ-সংসার এবং যে-কোনও প্রতিষ্ঠানের প্রতি রুক্ষ বিরক্তি আছে, একক ব্যক্তিমানুষের নির্ভেজাল স্বাধীন প্রত্যাখ্যান আছে, প্রেম-নীরা-শরীর-যৌনতা বিষয়ে যুগপৎ আকর্ষণ আর ক্ষতবিক্ষত বিকর্ষণ আছে। এই আপোসহীন মেজাজটাই কাব্যগ্রন্থের অশ্বশক্তি। চমকপ্রদ দক্ষতায়, সংকেতে আর রহস্যে তাকে কবিতা করে তোলা হয়েছে। আপাদমস্তক নাগরিক এই কবি। বিদেশি সাহিত্য অনুষঙ্গেও তাঁর নানাবিধ পারদর্শিতা। তিনি পূর্ববর্তী বা সমকালীন কারোর মতো না। তখনকার ‘কৃত্তিবাস’-এর অন্যান্য ওস্তাদদের সম্পূর্ণ ভিন্নপথে এই কবি, ‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি’ জুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে গেছেন।

    ‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি’ (নতুন সংস্করণ; বিশ্ববাণী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯) কবিতাবইয়ের প্রচ্ছদ

    কাব্যশরীরে নানা রূপকল্প, সব ক-টি ছন্দকাঠামোয়, মুদ্রণের নানান নিরীক্ষায়, মুহুর্মুহু নাটকীয়তায়, জাদু-উন্মোচনে, গভীর সৎ অনুভবে সুনীল একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। সেই যুগ থেকেই সুনীলের কবিতা আত্মজৈবনিক, স্বীকারোক্তিমূলক। এখানেও আমি, সুনীল, নিখিলেশ— এইসব নানা রূপে উত্তমপুরুষ জটিল সব নকশা নিয়ে আবির্ভূত। কিন্তু, তাকে কবিতায় সাজিয়ে তোলার সাবলীল ক্ষমতা এবং বিশেষত সাহস, আবার বলি ঈর্ষণীয়। যেন মনে হয়, দৈব ভর করেছে।

    ৩.
    বাংলা কবিতার এক প্রধান সমস্যা, অন্তত আমার মনে হয়, যৌক্তিক পারম্পর্যের ফাঁদে পড়ে গদ্য-পরিণামের গহ্বরে আত্মসমর্পণ। মহাপ্রতিভাদের তর্জনী ওঠার আগেই সবিনয়ে কবুল করি, আমি নিজেও এর ব্যতিক্রম নই। সেই কাহিনিকেন্দ্রিক অর্থবাহী পারম্পর্যের মুখে ছাই দিয়ে বিস্ময়করভাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই ‘রহস্যময়’অভিযাত্রা।

    ১.
    ‘আমি তোমায় চিম্‌টি কাটি, মুখে দিই দুধের বাটি
    চোখ থেকে চোখ পড়ে যায়, কোমরে সুড়সুড়ি পায়
    তুমি খাও এঁটো থুতু, আমি তোমার রক্ত চাটি
    বিলিবিলি খাণ্ডাগুলু, বুম্‌ চাক ডবাং ডুলু
    হুড়মুড় তা ধিন্‌ না উসুখুসু সাকিনা খিনা
                                        মহারাজ, মনে পড়ে না?’

    (‘মহারাজ, আমি তোমার’)

    ২.
    ‘মোহমুদগরের মতো পাছা আর দুলিও না, তুমি হৃদয় ও শরীরের ভাষ্য
                                                    নও, বেশ্যা নও, তুমি শেষবার
    পৃথিবীর মুক্তি চেয়েছিলে, মুক্তি, হিমযুগ, কথা দিয়েছিলে তুমি
                                                         উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।’

    (‘হিমযুগ’)

    ৩.
    ‘কোনোদ্বিধানেই আমি অসম্ভব ভালবাসা এইমাত্রতোমারচিবুকে
    রেখে এলুম ১১টা ১০এ চোখঘুমেযদিঅতনা জড়াতো
    পৃথিবীর সবদরজাখুলেআমি
    অসম্ভব শব্দশুনে অসম্ভব ধবলমিনার…’

    (‘কয়েক মুহূর্তে’/ লাল করে দেওয়া শব্দগুলি ২ পয়েন্ট বড় ও Bold)

    ৪.
    ‘কুসুমের বুক থেকে ঝরে গেছে সব পবিত্রতা; এই লাইনটা নিয়ে মহা মুস্কিলে পড়েছি। লিখেই মনে পড়ে, না না, আমি বলতে চাই স্ত্রীলোকের শরীর থেকে সব রূপ উবে গেছে। কিন্তু এ কথাটা কিভাবে লিখবো বুঝতে না পেরে, কুসুমের বুক থেকে ঝরে গেছে ইত্যাদি। তখন মনে হয়— কেন, এভাবে ঘুরিয়ে লিখবো কেন, সোজাসুজি লিখবো, আমার কাকে ভয়?’

    (‘না লেখা কবিতা’)

    ৫.
    ‘যৌবন আসতে বড় দীর্ঘ সময় লাগে, প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি
    উরু ও জিভের সঙ্গে ঘোরতর দ্বন্দ্ব যেদিন শেষ হয়
    তার পরেই বিস্মরণ, আগে শাদা মেঘ; আমি মেঘের সঙ্গে
    কখনো কথা বলিনি।…’

    (‘অসমাপ্ত’)

    কী অপ্রতিদ্বন্দ্বী নিপুণ হাতে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন লম্বা পঙ্‌ক্তির মিশ্রকলাবৃত্ত—

    ‘প্রহরের ঘণ্টা বাজে, হে প্রহরী, রক্তের গমন ধ্বনি কখনো
                                                                      শুনেছো?
    যারা ঘুমে ঢলে আছে, তারা সব মৃত-রক্তে,
                                                    অন্ধকারে মগ্ন থেকে যাবে
    তিন বেদনার দীক্ষা নিঃস্ব বাদুড়ের মতো শূন্যপথে দিয়ে যাবে
                                                                     নির্লিপ্ত ত্রিকাল
    তোমার ললাট জ্বলবে নীল-শিখায়, দুই চক্ষে রহস্যের
                                                                  অন্তরাল পাবে।’

    (‘রাত্রির বর্ণনা’)

    অথবা দলবৃত্তে মুক্তদল-রুদ্ধদলের বৈচিত্রনির্মাণ—

    ‘আমার জানলা বন্ধ ছিল উঠেও ছিটকিনি খুলিনি
    জানলা ভেঙে ঢোকার বুদ্ধি ঈশ্বরেরও মনে এলো না?
    আমায় কেউ মনে রাখেনি, না ঈশ্বর না প্রতিমা… …’

    (‘অসুখের ছড়া’)

    একদম গদ্যধর্মী স্পন্দ থেকে রহস্য উন্মোচন—

    ‘সরমা অনুযোগ করেছিল, আমার ঘরে কোন ছবি নেই। আমি ওকে টেবিলের সম্পূর্ণ খালি সতেরোটা ড্রয়ার দেখিয়েছিলাম। ও দূরের জ্বলন্ত জিরাফ একেবারে লক্ষ্য করেনি। সেই পাপেই ওর মৃত্যু হলো।’

    (‘জ্বলন্ত জিরাফ’)

    অত্যাশ্চর্য সব পর্যবেক্ষণ, অপরিসীম সব আয়তন! আমার নানা কারণে মনে হয়, পরবর্তী বহু কবির কবিতায় এসব উচ্চারণ ক্রমাগত ছায়া ফেলেছে। অথচ, মাপ করবেন, সুনীলের কাহিনি-বীজ ধারক কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থ নিয়েই আলোচনা বেশি!

    ৪.
    এই কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা নিয়ে আমার অবশ্য একটু বিস্ময় এবং মনখারাপ আছে। সম্ভবত একটু তর্কও। আমার সঙ্গে শ্রদ্ধেয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ ছিল না। যোগ্যতার কারণেই। অযোগ্য আমি, সাকুল্যে বার চারেক তাঁর বাড়িতে একেবারেই আমন্ত্রণের দৌত্যে অল্পসময়ের জন্য গেছি। রোমাঞ্চকর, রোমহর্ষক অনেক গল্প শুনেছি তাঁর সান্নিধ্যের। কবি জয় গোস্বামী, প্রয়াত জয়দেব বসু, শ্রীজাত এবং গদ্যকার গৌতম সেনগুপ্তের কাছে। এই দূরত্বজনিত সংকোচে কোনওদিন তাঁর লেখালেখি সম্পর্কে কোনও উচ্ছ্বাস জানাতে পারিনি। তর্ক তো অনেক দূরের কথা!

    যাই হোক, কবিতাটির দিকে তাকানো যাক। কবিতার নাম ‘সাবধান’। প্রথম এবং দ্বিতীয় সংস্করণে ছাপা আছে—

    ‘আমি পুলিশের বোকামি দেখে প্রকাশ্যে হাসাহাসি করবো
    আমি নেহরুর উইল সম্পর্কে শুনবো ট্রামের লোকের ইয়ার্কি
    কম্যুনিস্টদের স্লোগানের শবযাত্রা দেখে আমার দয়াও হবে না;’

    ‘সাবধান’ কবিতার মূল রূপ
    সূত্র : ‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি’ (নতুন সংস্করণ; বিশ্ববাণী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯)

    হঠাৎ দেখেছিলাম, আমার প্রিয় আরেক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত ‘স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় কবিতা : বাংলা কবিতা-সংকলন’ (ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট/১৯৭৩)-এর মধ্যে একটি শব্দবন্ধ বাদ দিলেন। সেখানে ছাপা হল—

    ‘আমি নেহরুর উইল সম্পর্কে শুনবো ট্রামের লোকের ইয়ার্কি
    স্লোগানের শবযাত্রা দেখে আমার দয়াও হবে না;’

    সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সাবধান’ কবিতার পাঠভেদ
    সূত্র : সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় কবিতা : বাংলা কবিতা-সংকলন’ (দ্বিতীয় সংস্করণ; ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ২০১২)

    চমকে উঠি। তৎকালীন সুভাষ মুখোপাধ্যায় কেন ‘কম্যুনিস্টদের’ শব্দটি বাদ দেন, সে-কথাও সহজেই অনুমেয়। তিনি কবি এবং গদ্যরচয়িতা হিসেবে আমার শতকোটিবার প্রণম্য। তাঁকে ঘিরে আমার অবিচ্ছিন্ন উচ্ছ্বাস। কিন্তু, এটা উনি কী করলেন?

    গল্প অবশ্য এখানেই শেষ নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কবিতাসমগ্র ১’-এ দেখছি মুদ্রিত হয়েছে একটু পাঠভেদ-সহ, সুভাষেরই ‘সম্পাদিত’ রূপ। ‘কবিতাসমগ্র ১’-এর প্রথম সংস্করণ ১৯৯২ সালে। সেখানে ছাপা আছে—

    ‘আমি নেহরুর উইল সম্পর্কে শুনবো ট্রামের লোকের ইয়ার্কি
    চতুর্দিকে স্লোগানের শবযাত্রা দেখে আমার দয়াও হবে না;’

    পরবর্তীকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-কৃত ‘সাবধান’ কবিতার পাঠভেদ
    সূত্র : ‘কবিতাসমগ্র ১’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (প্রথম সংস্করণ; আনন্দ, জানুয়ারি ১৯৯২)

    প্রশ্ন অনেক। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অন্তর্লীন দলদাসত্ব নাহয় এই অন্যায় কাজের চালিকাশক্তি। এ-ধরনের অন্ধতা বামপন্থীদের সহজাত। আমি বোকার মতো ভেবেছিলাম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিশ্চয়ই বিষয়টি জানেন না। তেড়েফুঁড়ে প্রতিবাদ করতেন তাহলে। ওদিকে ভলগা-গঙ্গা দিয়ে (মিসিসিপি দিয়েও!) অনেক জল বয়ে গেছে। সুনীলের নিজের ‘রাজনৈতিক’ মতও পালটে গেছে ততদিনে। কিন্তু এক তরুণের সর্বস্বব্যাপী ডিস্‌গাস্ট যদি কবিতায় বদলে যায়, তাহলে তো কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থের নির্যাসই পালটে যাবে! চশমাহীন তরুণ কি চশমা-বিরোধিতা চল্লিশ পেরিয়ে তুলে নেবে? সুভাষ মুখোপাধ্যায় কি প্রথম যুগের কবিতার শব্দ-শব্দবন্ধ উত্তরপর্বে ছেঁটে দিয়েছেন? দেওয়া সংগত হত? প্রশ্নটি কবি আর কবিতার বহুস্তরিক সম্পর্ক বিষয়ে গভীর বিবেচনার দাবি রাখে। কাব্যগ্রন্থে প্রকাশের পর কবিতা হিমায়িত হয়ে যায়। কবির তৎকালীন মনোভঙ্গিও। কবি মতাদর্শগত ভাবে রূপান্তরিত হতে পারেন। কবিতা পারে কি? শিবির যদি কবি বদলান, সংস্করণের পর সংস্করণে কি কবিতা বদলে যাবে? কোনটিকে মান্য ধরা হবে? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কি এক অর্থে কবিতাটিকে খুন করলেন না? উপায় নেই, এসব তর্ক কার কাছে গিয়ে তুলব?

    ৫.
    তবে শেষপর্যন্ত এসব তুচ্ছ কথা। বিতর্কটি এতদিন পর তুললাম, কবি আর কবিতার স্বার্থেই। ৭ সেপ্টেম্বর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। কিন্তু, এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা— ‘স্বপ্ন, একুশে ভাদ্র’। সেই স্কুলবয়স থেকে আমি মানি, কবিতার উচ্চারণ সত্যতম, সর্বোচ্চ। তাঁর জন্মদিন ‘একুশে ভাদ্র’ ধরাই সমুচিত। ওই কবিতার তাৎপর্যও খানিকটা স্পষ্ট হয়। নতজানু এই কবিতা-প্রয়াসী বিমুগ্ধ প্রণামের সঙ্গে অনেকটা ঈর্ষাও এই কাব্যগ্রন্থের সূত্রে আপনাকে নিবেদন করছে। বিতর্ক নাহয় মুলতুবি রইল!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook