বাক্স-রহস্য
আমাদের ছোটবেলায়, যা নাকি অনেকটাই দূরে এখান থেকে, যাদের বাড়িতে টিভি ছিল, তাদের আমরা বড়লোক ভাবতাম। তার একটা কারণ অবশ্য এই যে, সে-সময়ে যাদের বাড়িতে টিভি ছিল, তাঁরা সত্যিই বড়লোক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই নিজেদের বাড়িতে থাকতেন, এবং সে-কালে নিজেদের বাড়ি থাকা মানেও বেশ একটা সম্পন্ন ব্যাপার। পাড়ায় যদিও কারও গাড়ি ছিল বলে এখন মনে করতে পারি না। গাড়িওয়ালা লোকজন আসলে ঠিক কতখানি বড়লোক, সে ভাবার মতো কল্পনাশক্তি আমাদের ছিল না। দৌড় ওই টিভি থাকা পর্যন্তই। আরও একটা ব্যাপার অবশ্য ছিল, নিজেদের টেলিফোন। এ-জিনিসও বেশি বাড়ির কপালে জুটত না তখন। হয়তো সান্যাল কাকুদের বাড়িতে টেলিফোন রয়েছে, আমরা জানি। ক্কচিৎ-কদাচিৎ কোথাও একটা ফোন করতে হলে পাড়ার আর পাঁচজন সে-বাড়িতেই হাজির হতেন। সেই ভারী, কালো রিসিভারের ফোনের ডায়াল তালা মারা। যখন-তখন কেউ যেন ডায়াল ঘোরাতে না পারে, সেই ভাবনায়। যে বা যাঁরা যেতেন, আমতা-আমতা করে একটা ফোন করার কথা বলতে পারতেন হয়তো। তালা খুলে দেবার পর ফোন সেরে নিয়ে বারান্দায় বসে এক কাপ চা-নিমকি-সহ একটু আড্ডা মেরে আবার নিজের বাড়ি। এভাবে একটা পাড়া চলত, একটা শহর চলত। এভাবে আমাদের পৃথিবী চলত তখন। যা আজ থেকে অনেকটাই দূরে।
সে যা হোক, ফিরে আসি টিভি’র কথায়। টিভি ব্যাপারটা তখন আমাদের কাছে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে হাজির হয়েছে। একটা কাঠের বাক্স, যার মুখে কাচের পর্দা লাগানো, আর সেই পর্দার ভেতরে মানুষজন চলছে, কথাবার্তা বলছে, এমনকী গোটা সিনেমা অবধি ফুটে উঠছে, এ-জিনিস আমাদের বোধগম্য হবার কথা নয় তখন। তাই বিস্ময় নিয়ে তার সামনে আক্ষরিক অর্থেই হাঁ করে বসে থাকা ছাড়া কোনও উপায় থাকত না। আমাদের বাড়িতে অবশ্য সেই হাঁ করার সুযোগ ছিল না, কেননা আমাদের বাড়িতে টিভিই ছিল না। আমাদের, সেই অর্থে, বাড়িই ছিল না নিজেদের। ভাড়া বাড়িতে থাকা। কিন্তু সেই সংসারের কোথাও মালিকানার মালিন্য ছিল না, এও সত্যি।
টিভি ছিল আমাদের উপরের তলায়। যাঁদের বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম, তাঁদের বসার ঘরে বেশ বড়সড় একখানা টেলিভিশন সেট ঢুকে এসেছিল ১৯৮৩ সালেই। কারণটা স্পষ্ট, ভারত ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে। সে-বছর বোধহয় সারা দেশ জুড়ে টেলিভিশন বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু সারা দেশের সব পাড়াতেই একটি কি দুটি ঘরে। বাকিরা জমায়েতের দলে। যেমন ছিলাম আমরা। মাঠে খেলার সময়ে যেমন তার চারপাশ ঘিরে জড়ো হতাম, তেমনই টিভি-তে খেলা দেখালেও কোনও-না-কোনও বাড়ির বসার ঘর উপচে পড়ত পাড়ার মানুষজনে। সে-দৃশ্যকে আজ এত বেশি বিরল মনে হয়, বলার নয়। এ-ওর ঘাড়ে পা দিয়ে, সে-তার কোলে চড়ে টিভি-তে খেলা দেখা চলছে। যে-বাড়িতে ঘটছে এটা, সে-বাড়ির মানুষের তো কোনও বিরক্তি নেই-ই, বরং একটা চাপা গর্ব আছে যে তার বাড়ি এখন পাড়ার সবচাইতে দামি বসার ঘরটার মালিক। কেননা সেখানে টিভি-তে খেলা দেখা যায়। দফায়-দফায় চা আসছে, উড়ে যাচ্ছে। ঘুগনির প্লেট হাতে-হাতে ঘুরে সাফ হয়ে যাচ্ছে। রাত এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত মরুভূমিতে রাতের তাঁবুর মতো জেগে আছে ওই এক বসার ঘর।
রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর টেলিভিশন বন্ধ করে সকলে যখন শুয়ে পড়ত, আমি একলা পায়ে উঠে চুপিচুপি এসে দাঁড়াতাম ওই স্তব্ধ টেলিভিশন সেটের সামনে। তার কাঠের টানাপর্দায় হাত রেখে নিজের বিস্ময় ঝালিয়ে নিতাম। আর সেও কি আড়ষ্টতা ভেঙে চুপিসাড়ে কথা বলে উঠত না আমার সঙ্গে? তার সাদাকালো ভাষায়?
সেরকমই বসার ঘর ছিল আমাদের দোতলায়। সেও একরকম আমাদেরই বাড়ি ছিল আর কি! নিজেদের একতলার ঘরের চেয়ে দোতলার বারান্দায় আমার বেশি বিকেল কেটেছে, আজও মনে পড়ে। ’৮৩-র খেলা তো হল, ১৯৮৫-তে এল বেনসন অ্যান্ড হেজেস চ্যাম্পিয়নশিপ। যেখানে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত সর্বোচ্চ ২৩৮ রান করবেন আর রবি শাস্ত্রী অডি গাড়ি জিতবেন। সে-খেলা দেখার জন্য দোতলার সেই বসার ঘরে গোটা পাড়া উপচে পড়ল। কারণ অবশ্য শুধু খেলা নয়, টিভি তো আর দু’চারজনের বাড়িতেও এসে গেছে তখন। বরং কারণ হল এই যে, পাড়ায় তখন সেটাই একমাত্র রঙিন টিভি। সেবারই কেনা হয়েছে। তার রং, জৌলুস, ঝলমলানির কাছে জীবনের সব প্রাচুর্য তখন ম্লান। তাই সেখানেই অর্ধেক স্টেডিয়াম হাজির। আট বছর বয়স তখন আমার। কিন্তু ভারত সেই ম্যাচ জেতার পর পাড়া জুড়ে যে আনন্দের ঢল, আর ওই বসার ঘরে টেলিভিশন থেকে উপচে পড়া রঙিন উল্লাস, সে আজও স্পষ্ট মনে আছে।
কিন্তু এই যে ধান ভানতে শীবের গীত গাইছি, তা এইটে বলার জন্যই যে, এর পর পর আমাদের বাড়িতেও একখানা টেলিভিশন সেট এল। সে এক মনে রাখার মতো কাণ্ড! এখনকার মতো বড় দোকানে গেলাম, পছন্দসই টিভি বাছলাম, টাকা দিলাম আর লোকজন বাড়িতে এসে ফিট করে দিয়ে গেলেন, তেমনটা তো নয়। টেলিভিশন কেনা হবে কি হবে না, এই পরিকল্পনাটাই চলল মাস ছয়েক। বাবা আর মা’র মধ্যে। কেননা টেলিভিশন তখন বিলাসিতাই। শেষমেশ দেখা গেল যে, দোকানপত্তরে যেসব ব্র্যান্ডেড টিভি সেট বিক্রি হচ্ছে, তা আমাদের ছোট সংসারের আওতার অনেকটাই বাইরে। কিন্তু কথায় বলে, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। আর এক্ষেত্রেও সেটাই হল।
মায়ের মামাতো ভাই, আমার চিত্তমামা তখন কাজ করতেন একটা নতুন টিভি কোম্পানি-তে, যার নাম ক্রোমেক্স। আজকের দিনে কারও এ-নাম শোনার কথা নয়, তখনও যে খুব বিখ্যাত ছিল এই কোম্পানি, এমনটাও নয়। কিন্তু স্থানীয়ভাবে তারা বেশ চলনসই একটা ব্যবসা করছিল তখন। আমাদের গড়িয়াতেই তাদের কারখানা আর অফিস ছিল। চিত্তমামা’র মুখে শুনলাম, তারা নাকি কিস্তিতে টেলিভিশন সেট কেনার সুযোগ করে দিচ্ছে এবং সেটাও বেশ সস্তায়। আজকের দুনিয়ায় যাকে ই এম আই বলে, সেই জিনিস তারা তখনই চালু করেছিল, নেহাতই মধ্যবিত্তদের স্বপ্নের কথা ভেবে। প্রস্তাব মন্দ নয়। এককালীন একটা সামান্য টাকায় ঘরে চলে আসবে আস্ত একটা টিভি সেট, তারপর মাসে-মাসে একটু করে শোধ দিলেই হবে।
শেষমেশ এই সহজ কিস্তির স্বপ্নেই রাজি হওয়া গেল। আগের রাতে তো আমার প্রায় ঘুম নেই, কাল বাড়িতে টিভি আসবে। এই যে জাগরণ, এই যে উত্তেজনা, এই যে অপেক্ষা, এর স্বাদ আজ আর কিছুতেই টের পাবার উপায় নেই। পরদিন জনাতিনেক ধরাধরি করে আমাদের বসার ঘরে এনে বসালেন সেই টিভি। মাটি থেকে বেশ খানিকটা ওপরে তার চৌকোনো কাঠের বাক্স, সেই বাক্সের চারপাশে চারখানা মজবুত পায়া লাগানো, যাতে ভর করে সে দাঁড়িয়ে থাকবে মেঝেয়। পর্দার দু’পাশ থেকে টান দিলেই দু’খানা কাঠের পাতলা পাল্লা বেরিয়ে এসে ঘোমটার মতো ঢেকে দেবে টেলিভিশনের মুখ, সেই পাল্লায় আবার চাবির ঘাটও আছে, চাইলে তাকে বন্ধ করে রাখা যায়।
টিভি বসল মেঝেয়, অ্যান্টেনা বসল ছাদে। সেইসঙ্গে টিভি’র মাথায় স্টেবিলাইজার নামক একটি বস্তু। এরপর টিভি চালিয়ে উপরে উঠে অ্যান্টেনা ঘোরাতেই ঝিরঝির পর্দায় ফুটে উঠল সাদাকালো ছবি। আমাদের রঙিন স্বপ্নের সহজ কিস্তিতে তখন তার বেশি রঙের জায়গা ছিল না। পর্দায় প্রথমবার ছবি ফুটে ওঠার যে-আনন্দ, সে আজও বর্ণনাতীত। তখন তো বাঁধাধরা সময়ে অনুষ্ঠান কেবল, সারাদিন সারারাত টেলিভিশন চালানোর কোনও পাট নেই। কিন্তু রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর টেলিভিশন বন্ধ করে সকলে যখন শুয়ে পড়ত, আমি একলা পায়ে উঠে চুপিচুপি এসে দাঁড়াতাম ওই স্তব্ধ টেলিভিশন সেটের সামনে। তার কাঠের টানাপর্দায় হাত রেখে নিজের বিস্ময় ঝালিয়ে নিতাম। আর সেও কি আড়ষ্টতা ভেঙে চুপিসাড়ে কথা বলে উঠত না আমার সঙ্গে? তার সাদাকালো ভাষায়? আজ এই জৌলুসের দুনিয়ায় সেই কিশোরকে তাই বুঝি বোবা বলে মনে হয়…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র