পুজোসংখ্যার নেশা
পুজোর আগে-আগে আনন্দ বলতে ছিল কেবল পুজোসংখ্যা। নতুন জামা বা জুতোর জন্যে অপেক্ষা যেমন থাকত, তার চেয়ে ঢের বেশি গুণ অপেক্ষা থাকত হাতে পুজোসংখ্যা পাবার। সেই অপেক্ষার রং আর গন্ধ যে কেমন, আজ এই বয়সে এসে লিখে বোঝানো কঠিন। তাই সে-চেষ্টা আর করছি না। হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ, পাড়ায়-পাড়ায় প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হচ্ছে, এদিকে-ওদিকে টুকটাক ছাতিম ফুলের নেশা ধরানো গন্ধ ভেসে উঠছে, আকাশ ঝকঝক করছে তার নীল রং নিয়ে, এরই মধ্যে পুজোসংখ্যা এসে পড়বে। এখন এসে পড়লেই তো হল না, মধ্যবিত্ত সংসারে খুশির জন্যেও অনেক হিসেবপত্তর কষতে হয়। আমাদের ছিল তেমনই সংসার। আমাদের পাড়াটাই ছিল তেমন। আর সেই কারণেই হয়তো, এ-বাড়ি ও-বাড়ি ভারি মিলমিশ ছিল। আমরা একঝাঁক সমবয়সি ছেলেমেয়ে খুব বন্ধু ছিলাম। একসঙ্গে বড় হচ্ছিলাম পড়াশোনা আর খেলাধুলোর মধ্য দিয়ে। আমরা আগেভাগেই ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিতাম, কারা কোন পুজোসংখ্যা কিনতে বলব বাবা-মায়েদের। এ যদি ‘আনন্দমেলা’ নিই তো ও ‘শুকতারা’, আর তাহলে সে নেবে ‘কিশোর ভারতী’। তারপর এ-হাত ও-হাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়া হবে। বাকি যা যা বেরোয়, সব পাড়ার লাইব্রেরিতে বাঁধিয়ে রাখা থাকে, সে আমরা পরেও পেয়ে যাব।
এই কড়ারে যখন মৌখিক চুক্তিতে আমরা আবদ্ধ, সবার বাড়ি মৃদু বায়না চলতে থাকে, পুজোসংখ্যার। আমার কথাটাই বলি এখানে। বাবা ছিলেন ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সাংবাদিক, একটু অপেক্ষা করে গেলে যে-কোনও পুজোসংখ্যা সামান্য ছাড়ে কিনতে পারতেন। আমি জানতাম, সেই ছাড়ও আমাদের পরিবারে অনেকখানি, আর তার জন্যে কিছুটা অপেক্ষা আমাকে করতেই হবে। হয়তো বাকিদের পড়ার টেবিলে উপহারের গন্ধ নিয়ে ঝকঝকে নতুন পুজোসংখ্যা শোভা পাবে ততক্ষণে, আমাকে তার ছোঁয়া পেতে আরও কিছু রাত জেগে কাটাতে হবে। আজ বুঝি, সেই অতিরিক্ত কয়েকখানা রাতের দাম কতখানি।
রাত জাগা অবশ্য সেখানেই শেষ হত না, কেবল অপেক্ষার ধরনটা পাল্টে যেত। কোনও-না-কোনও একদিন বাবার বাড়িফেরা কাঁধঝোলা থেকে নতুন চকচকে পাতার গন্ধ বেরোত, আর আমি টের পেতাম, আমার পুজোর স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, পছন্দের পুজোসংখ্যা এবার হাতের মুঠোয়। হয়তো সেই ছোটবেলাতেই এ-কথা টের পেতাম যে, ভালবাসার জিনিসকে কাছে পেয়ে তাকে আস্তে-আস্তে নিজের খুব কাছে আনতে হয়। আদরের যেমন অনেকগুলো ধাপ আছে, তা পেরিয়ে তবেই চূড়ান্ত মুহূর্তের কাছে পৌঁছনো, তেমনই এই অপেক্ষার ফসল হাতে পাবার পর, তাকে ভালবেসে নিজের মধ্যে নিয়ে নেওয়ারও অনেকগুলো ধাপ ছিল আমার। আজ ভাবি, এ-বয়সে এমনভাবে কিছুকে ভালবাসতে পারি কি আর? মনে হয় না।
হাতে পাওয়ামাত্র রাতের পর রাত জেগে, দুপুরের পর দুপুর পেরিয়ে তাকে গোগ্রাসে পড়ে ফেলাই যেত, কিন্তু আমি তেমনটা করতাম না কখনওই। রাতে তাকে হাতে পেয়ে এমনকী তার পাতাও ওল্টাতাম না একবার। ওই প্রথম পাওয়ার উপহার ছিল প্রচ্ছদ, আমার কাছে। মোটা, চকচকে কাগজের ওপর ছাপা নিপুণ তুলিতে আঁকা প্রচ্ছদটুকুই ছিল আমার আবাহন, পুজোসংখ্যার। কী যে অসামান্য সব প্রচ্ছদ তখন হত, এখনও চোখ বন্ধ করলে নিখুঁত দেখতে পাই তাদের। কেবল প্রচ্ছদই নয়, প্রতিটি উপন্যাসের সঙ্গে যে-সমস্ত শিল্পীরা ছবি আঁকতেন, তাঁরা তাঁদের সেরাটুকু উজাড় করে দিতেন, সেসব অলংকরণ হতো সংগ্রহে রাখার মতো।
মলাট দেখে নিয়ে, তাকে ভারই যত্নে ঢুকিয়ে রাখতাম আমার পড়ার টেবিলের দেরাজে। একটা বিষয় আমার বরাবরই ছিল, বইয়ের যেন কোনও অযত্ন না হয়। মলাট ভাঁজ করা বা পাতা মুড়ে পড়া, এসব ছিল আমার ঘোর অপছন্দ, আজও তাই আছে। সেই কারণেই, নতুন বইকে যতদিন পারা যায় নতুনের মতো রাখারই চেষ্টা করতাম আমি। ততদিনে কোন পুজোসংখ্যায় কোন লেখকরা কী কী লেখেন তা জেনে গেছি, কোন বইয়ে কোন-কোন শিল্পীর আঁকা মিলবে, আন্দাজ হয়ে গেছে তারও। এই যে রাতের বেলা নতুন বইটা ঢুকিয়ে রাখলাম দেরাজে, শুরু হল আমার জল্পনা। এবার কি অমুক লেখকের উপন্যাসে তমুক শিল্পী ছবি এঁকেছেন? এরকম একখানা অলীক খেলা আমি নিজেরই সঙ্গে খেলতাম। হাতের সামনেই আছে বই, কিন্তু তারিয়ে-তারিয়ে সেই অপেক্ষাকে আরও দীর্ঘায়িত করার যে নেশা একরকম, তা আমাকে পেয়ে বসত।
আমাদের ছিল একতলার দুটো ঘর, ভাড়া বাড়ি। তার ছিল কালো বর্ডার দেওয়া টুকটুকে লাল মেঝে, আজকের দিনে যা প্রায় বিরলই বলা যায়। শোবার ঘরে, মনে আছে, মাটিতেই বালিশ পেতে শুতাম আমি। রাতে ঘরে জ্বলত নীলচে এক আলো, তাতে আবছা দেখা যেত সব কিছু। শুয়ে তো পড়তাম, কিন্তু ঘুম আসত না। ওই অপেক্ষার নেশার একটা করে পাতা আমি এক-এক রাতে ওল্টাতে থাকতাম। কীরকম? না, পুজোসংখ্যা হাতে পাবার পরের যে-রাত, রাত মানে বেশ নিশুতিই, বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে, সেই রাতে আমি আবিষ্কার করতাম প্রথম উপন্যাসের প্রথম পাতাটিকে।
প্রথমে নিঃশব্দে দেরাজের ডালা খুলে পুজোসংখ্যা বার করে আনতাম। তাকে দু’হাতের পাতায় নবজাতক তুলে নেওয়ার মতো করে আলতো আদরে ধরে অনেকক্ষণ ধরে নতুন, চকচকে পাতার গন্ধ নিতাম। ওই নীলচে আলোর, লাল মেঝের ছোট্ট ঘরে সেই গন্ধই ছিল আমার সেরা পুজোর আগমনী। তারপর, পাতা উল্টে সূচিপত্র পার করে পৌঁছতাম প্রথম উপন্যাসের কাছে। তখন দিকপাল সাহিত্যিকরা ছোটদের জন্যে লিখছেন। কারও-কারও আছে বাঁধা চরিত্রের নতুন সব অ্যাডভেঞ্চার, কারও বা ফি-বছর একেবারে আনকোরা ধরন। কিন্তু কেউ কারও চেয়ে কম যান না লেখায়। আর শিল্পীরাও তেমনই। প্রতিটি উপন্যাসে অলংকরণের ধরন আলাদা, কিন্তু কোনটা ফেলে কোনটা দেখি, বলা কঠিন।
এইভাবে টানা রাত সাতেক জেগে আমার চলত আবিষ্কারের খেলা। কোন লেখক কী লিখেছেন আর কোন শিল্পী কী এঁকেছেন। যেন নিজেই বেরিয়ে পড়েছি নতুন সব দেশের খোঁজ করতে, এমনই এক নেশা ছিল তখন। এই করতে-করতে মহালয়া যেই পেরিয়ে গেল, দেরাজ থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসত আমার প্রিয় পুজোসংখ্যা। ততক্ষণে ঠিক করে নিয়েছি কোন লেখার পর কোন লেখা পড়ব, ফলে মনে-মনে একরকমের প্রস্তুতি হয়েই আছে। সেইমতো শুরু করতাম পড়া। কিন্তু, মনে আছে আজও, একটানা পড়ে উঠতে পারতাম না। অসামান্য সেসব উপন্যাসের একখানা শেষ করে কিছুদিন বসে থাকতে হত, তার ঘোরকে নিজের মধ্যে নিয়ে নেওয়ার জন্যে। শেষমেশ এমন হত, হয়তো ঠাকুর ভাসান হয়ে গেছে, বাতাসে হিমের টোকাও শোনা যাচ্ছে, কিন্তু আমার পুজোসংখ্যা শেষ হয়নি তখনও।
সেই নেশা থেকে অনেকখানি দূরে চলে এসেছি আজ, সেই বাড়ি থেকেও। সেখানে এখনও কালো বর্ডারের সেই লাল মেঝে আছে কি না জানি না, সে-ঘরে কে বা কারা থাকেন আজ, তারও খবর নেই। তবে আসার সময়ে সেই দেরাজওলা পড়ার টেবিলখানা নিয়ে এসেছি। সে আজও আমার লেখার ঘরের রোজকার সঙ্গী। কেবল পুজো এগিয়ে এলে, আমার মতো মনখারাপ হয়ে যায় তারও। কেননা আমারই মতো, সেও জানে, পুজোসংখ্যা কিনে, ঝোলা কাঁধে করে ক্লান্ত আমার বাবা আর কোনওদিন বাড়ি ফিরবেন না। ফিরে আসবে না আমাদের সেই পুজোও…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র