যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন অসুর বলতে আমার কাছে একটা ছবি ছিল, একটা মূর্তি ছিল, যেটা প্রতিবছর দুর্গাপুজোর সময়ে দুর্গা ঠাকুরের সঙ্গে আসত। আমি ওই চোখ বের করে থাকা মহিষাসুরের মূর্তিটা দেখে খুব মজা পেতাম। ওই মূর্তিটা বরাবরই ভাল লাগত, খারাপ লাগেনি কখনও। প্রথমত মূর্তিটার জিম করা চেহারা, তার ওপর দারুণ সাজপোশাক করে আসত। তবে ছোটবেলায় যেরকম সবাই শোনে, আমিও ওরকম শুনেছিলাম যে, অসুর হচ্ছে খারাপ এবং সে একটা মোষের পেটের ভেতরে লুকিয়ে ছিল শুরুতে। মা দুর্গা পরে মোষটাকে খুঁজে বের করে কাটেন এবং সেখান থেকে অসুর বেরিয়ে এলে তার বুকে ঘ্যাচাং করে ত্রিশূল গেঁথে দেন। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার খুব অবাক লাগত, যখন দশমীর পরে দুর্গা ঠাকুরকে বরণ করা হত, মা দুর্গার মুখে সবাই মিষ্টি দিত, সেই সঙ্গে অন্য দেবতাদেরও দেওয়া হত, তখন অসুরের মুখেও মিষ্টি দিতে দেখতাম। এই দৃশ্য দেখে বিস্ময় বাড়ত, কারণ অসুর তো খারাপ! ওর মুখে আবার শুধু-শুধু মিষ্টি দেওয়া কেন! অনেক পরে বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি, যেখানে ভাল থাকে সেখানে খারাপও থাকে। সেই কারণেই হয়তো অসুরের মুখে ওই মিষ্টি দেওয়ার চল। খারাপটাকে মেনে নেওয়া। খারাপ না থাকলে অনেক সময়ই আমরা ভালটাকে বুঝতে পারি না। উপলব্ধি করতে পারি না।
এখন যদি ভাবি, অসুর আমার কাছে কী, তাহলে কী মনে হয়? অসুর মানে কি, যাকে আমি পরাস্ত করতে চাই? যাকে ভয় পাই? এরকম তো কতই আছে! অনেক ক্ষেত্রেই তা কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তিমানুষ নন। রাগ হয়তো অনেকের ওপরেই হয়, কিন্তু একে-তাকে মেরে ফেলতে চাই, এরকম ভাবনা অন্তত আমার মনে আসে না। তবে ইদানীংকালে যে-বিষয়টাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, সেটা হল মানুষের মধ্যেকার অসহিষ্ণু মনোভাব। কাকে পরাস্ত করতে চাই, যদি কেউ আমার কাছে জানতে চান, তাহলেও আমি এই বিষয়টার কথাই বলব। ‘ক্ষতিকর মনে হচ্ছে’, ‘সরে গেলে ভাল হয়’, ‘না থাকলে ভাল হয়’ এরকম যদি কোনও একটা বিষয়ের কথা বলতেই হয়, তাহলে তা ওই চারপাশের অসহিষ্ণুতা। এই ভয়ের ভাবনাটা কিন্তু কয়েক বছর আগেও মনের ভেতরে দানা বাঁধেনি। কিন্তু বর্তমানে ঘটে চলা নানান ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেখে এই ভাবনাকে সরিয়ে রাখতে পারি না। ধর্ম থেকে শিল্প— সব ক্ষেত্রে যেন মানুষের মনকে একটা নির্দিষ্ট পথেই চালিত করা হচ্ছে। অর্থাৎ, ঠিক-ভুল দেগে দেওয়া হচ্ছে। কে ঠিক করে দিচ্ছে? রাষ্ট্র। আরও ভয়ের যেটা, অনেক মানুষ আছেন এরকম, যাঁরা এই ‘রায়’কে মেনে নিচ্ছেন অবলীলায়! সমাজের মধ্যে কিছু নিয়মবিধি তো থাকবেই, কিন্তু সবার জীবনেই এমন অনেক বিষয় থাকে, যেটা রাষ্ট্র কেন অন্য কেউই ঠিক করে দিতে পারে না। ঠিক করে দেওয়ার অধিকার তাদের নেই। আমার বিপরীত যেটা, মতের উলটো যেটা, সেটার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার মানসিকতাই মানুষ হারিয়ে ফেলছে ক্রমশ। সমাজে সহ্যক্ষমতা একেবারে আর নেই বললেই চলে! নিজের মতো না হলেই, সে শত্রু হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। আর এই মানসিকতার কারণে সমাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে। এটা যদি কাটিয়ে উঠতে পারি আমরা, তাহলেই হয়তো অশুভশক্তির বিনাশ সম্ভব হবে!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র