প্রথম বিলেত: পর্ব ৪
আয়না দেখায় ‘কালো’ মুখ
বিলেতের বাড়িগুলো অধিকাংশ কাঠের, কাজেই তত মজবুত নয়। ভিতরটা পরিষ্কার, তিলমাত্র ধুলো অথবা দাগ নেই। রবীন্দ্রনাথ ভাবেন, দেশের পরিচ্ছন্নতা আর বিলেতের পরিচ্ছন্নতার অনেক তফাত। শিল্পজ্ঞান আর সৌন্দর্যজ্ঞান থেকে বিলেতের পরিচ্ছন্নতার জন্ম, আর দেশের পরিষ্কার ভাব যেন এক স্বতন্ত্র মনোবৃত্তি। রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, ‘প্রতি সামান্য বিষয়ে এদের ভালো দেখতে হওয়াটা প্রধান আবশ্যক। প্রতি পদে এরা সৌন্দর্যচর্চা করে।’ বহু বছর পর এই একই উপলব্ধি তাঁর প্রথমবার জাপানে গিয়ে আবার হবে।
বিলেতের ঘরগুলো মোটের উপর ছোট। রবীন্দ্রনাথের মনটা তাই খুঁতখুঁত করে। কিন্তু ছোট হলেও ঘরগুলো যথেষ্টই সাজানো। নীচু ছাদ, আগুন জ্বালালে গোটা ঘর সহজেই গরম হয়ে যায়। ঘরের ভিতর ছবি, চৌকি, টেবিল, কৌচ, ফুলদানি, পিয়ানো। প্রায় প্রতি ঘরেই তার উপর আবার আছে একটা করে আয়না। যেতে-আসতে নিজের মুখ না দেখে উপায় নেই তাতে! রবীন্দ্রনাথ যত মনে করেন বিলেতে গিয়ে সাহেব হয়েছেন, ততই আয়নাগুলো যেন তাঁর ‘কালো’ মুখের ছবি দেখিয়ে তাঁকে ভেংচায়। নিজের কালো মুখের কালো মূর্তি দেখে-দেখে আয়নাগুলোই ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে রবীন্দ্রনাথের।
শিক্ষার অভাব
ডাক্তার ‘ম’ এক আধবুড়ো চিকিৎসা ব্যবসায়ী। প্রকৃত ইংরেজ। বিলেতের বাইরে আর কিছু তাঁর মনে ধরে না। ভারতীয়দের হেয় করেন। কতগুলো মাসিক পত্রিকা পড়ে তিনি কিছু ভাসা-ভাসা জ্ঞান লাভ করে থাকেন। মুখে বলেন, শিখবেন আর শেখাবেন আনন্দের সঙ্গে; যদিও রবীন্দ্রনাথ বোঝেন, তাঁর শেখাবার সম্বল আদপে খুবই কম। রবীন্দ্রনাথদের মতো লোকেদের তিনি অশিক্ষিত বলেই জানেন। তার কারণ, তিনি ভাবতেই পারেন না একজন ভারতীয় কী করে শিক্ষিত হতে পারে। এমন ভাবার কারণও তিনি পেয়ে যান। বিলেতের বিবিরা হাত গরম রাখার জন্য যে গোলাকার পদার্থের ভিতর হাত গুঁজে রাখে, তাকে যে ‘muff’ বলে, রবীন্দ্রনাথ তা জানেন না দেখে আকাশ থেকে পড়লেন ডাক্তার ‘ম’। রবীন্দ্রনাথ ভাবলেন, তাঁর শিক্ষার অভাব এর চেয়ে বেশি আর কীই-বা হতে পারে!
গান শুনে উঠল হাসির ঢেউ
এক নিমন্ত্রণসভায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন এক মহিলার সঙ্গে আর এক রূপসী শ্রীমতী ‘হ’ কে। রবীন্দ্রনাথ আর আর দু’একজন যুবকের উপর ভার পড়ল তাঁদের আমোদে রাখবার। রবীন্দ্রনাথ কথায় অত পটু নন। রূপসীর রূপের ছটা আর কথামালা যে তাঁকে আবিষ্ট করেছে, আকার-ইঙ্গিতেও সে-কথা যেন তাঁকে আর বোঝাতে পারেন না তিনি। এর মধ্যে গৃহকর্তার অনুরোধে পিয়ানোবাদন শুরু করলেন দশ আঙুলে আংটি পরে আসা এক বৃদ্ধা ‘সংগীতশাস্ত্রজ্ঞতাভিমানিনী’। রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, যতই সাজুন, ‘তিনি বেশ জানবেন যে তাঁর রূপের বাজার সম্পূর্ণ দেউলে হয়ে গেছে।’ পিয়ানোয় তাঁর কেরামতি শেষ হলে, গৃহকর্ত্রী রবীন্দ্রনাথকে ধরলেন গান শোনাবার জন্য। গৃহকর্তা আর গৃহকর্ত্রী দুজনেই আগে রবীন্দ্রনাথের গান শুনেছিলেন। গানগুলো তাঁদের অত্যন্ত হাস্যকর লেগেছিল। তাঁরা দুজনে পরামর্শ করে যেন ঠিক করলেন, ‘আগামী নেমন্তন্নে এই কালো Indianটাকে চীৎকার করাতে হবে— তা হলে অভ্যাগত ব্যক্তিবর্গের পক্ষে সে ভারী একটা ‘treat’ হবে।’ রবীন্দ্রনাথ মনে-মনে এইসব জেনেও যেন ‘না’ বলার অবকাশ পেলেন না; বিশেষত যখন শ্রীমতী ‘হ’ মিষ্টি এক আদরের সুরে বললেন, ‘Yes, do give us a song Mr. T!’ রবীন্দ্রনাথ দু’একবার কেশে গান শুরুর উদ্যোগ নিলেন। তারপর গান ধরলেন। সে যেন কিছু কথা আর সুরের সমষ্টি গলার ভিতর থেকে কোনওরকমে বের করা। হেসে গড়িয়ে পড়লেন সবাই। সেই হাসির আবার কী বিচিত্র প্রকাশ! ‘কেউ কেউ হাসিকে কাশির রূপান্তরে পরিণত করলেন, কেউ কেউ হাত থেকে কী যেন পড়ে গেছে ভাণ করে ঘাড় নিচু করে হাসি লুকোতে চেষ্টা করছেন, একজন কোনো উপায় না দেখে তাঁর পার্শ্বস্থ সহচরীর পিঠের পেছনে মুখ লুকোলেন।’ সেই বৃদ্ধা সংগীতজ্ঞের মুখে লেগেছিল মৃদু ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের হাসি। তাই দেখে যেন রক্ত জল হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের। গান শেষ হলে রবীন্দ্রনাথের মুখ-কান লাল। ‘কেবল কালো রঙ বলে কেও দেখতে পায়নি।’ শ্রীমতী ‘হ’ তার মধ্যেই গানটার অনুবাদ শুনতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করে শোনালেন। গানটা ছিল ‘প্রেমের কথা আর বোলো না।’ অনুবাদ শুনে শ্রীমতী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের দেশে প্রেমের স্বাধীনতা আছে নাকি?’
নিজের রাজা
এক রোববারের সভার সদস্যরা একবার এক নৌকাবিহারের আয়োজন করেছেন। ‘ম’ মহাশয় সুন্দরী মেয়েদের লোভ দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথকে সেই যাত্রায় সামিল করলেন। রবীন্দ্রনাথ নৌকায় চড়ে দেখেন একজন মাত্র রূপসী ছাড়া সেখানে আর কোনও সুন্দরী নেই। তাঁর চারিদিকে আবার ঘন এক মানব-প্রাচীর দেখে রবীন্দ্রনাথ আঙুর ফল টক ভেবে সরে এলেন! পুরুষদের বাহারি পোশাক দেখে তাঁর ধারণা হল, তাঁদের সকলকেই হয়তো ডেকে আনা হয়েছে সুন্দরী মেয়েদের লোভ দেখিয়ে! যাই হোক, নৌকার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আলাপ হল এক ইংরেজের সঙ্গে। তিনি শেলির কবিতার অনুরাগী, রবীন্দ্রনাথের মতোই। চিন্তার মিল পেয়ে লোকটি বেজায় খুশি হয়ে সাহিত্য আলোচনার জন্য রবীন্দ্রনাথকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। এক সময় ভারতবর্ষের কথা উঠলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ভারতবর্ষ ‘কোন রাজার অধীনে?’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ব্রিটিশ গবর্মেন্টের।’ তাও তিনি বললেন, ‘তা আমি জানি, কিন্তু আমি বলছি কোন্ ভারতবর্ষীয় রাজার অব্যবহিত অধীনে?’ শেষে সব শুনে-টুনে বললেন, ‘আমার অজ্ঞতা মাপ করবেন।’
সবই সমান
বিলেতে একবার রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক পরিবারের সঙ্গে। সেই পরিবারের ‘বিলাসিনী’, বাড়িতে লোক দেখা করতে এলে সেজেগুজে তাঁদের আপ্যায়ন করতেন। সে এক অসামান্য প্রতিভা! বাক্য আর হাসি সকলকে সমানভাবে বিতরণ করবার প্রতিভা। রবীন্দ্রনাথ ভাল করে লক্ষ করে দেখলেন, সেই দুরূহ কাজটি কীভাবে এই বিলাসিনীরা সম্পন্ন করেন। দেখলেন, তাঁরা একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা কথা বলেন, শেষ করেই সকলের দিকে তাকিয়ে একবার হাসেন। কখনও-বা একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে শুরু করেন একটা কথা, বলতে-বলতে এক-একবার সকলের মুখে চেয়ে নেন। কখনও তাস খেলার ঢঙে এক-একটা কথার টুকরো ছড়িয়ে দেন আগন্তুকদের ভিতর। ‘এমন তাড়াতাড়ি ও এমন সহজে করেন যে তাঁদের হাতে যে অনেক কথার তাস গোছানো রয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়।’ যেমন একজনকে হয়তো বললেন, ‘Lovely morning, isn’t it?’ পরমুহূর্তেই আর একজনকে বললেন, ‘কাল রাত্তিরে সংগীতশালায় মাডাম নীল্সন গান করেছিলেন, ‘it was exquisite!’ যতজন মহিলা বসেছিলেন, তাঁরাও কেউ কম যান না। সকলেই একটা করে বিশেষণ যোগ করে দিলেন। কেউ বললেন, ‘oh charming’, একজন বললেন, ‘superb’, আবার আর কেউ বললেন, ‘something unearthly.’ আর একজন বাকি ছিলেন। তিনি বললেন, ‘isn’t it?’ কত কথা শুনে-শুনে দিন কেটে যায় রবীন্দ্রনাথের!
কভারের ছবি: ব্রাইটনে রবীন্দ্রনাথ
ছবি সৌজন্যে: লেখক