তখন আমরা ময়মনসিংহে, আমার বয়স এগারো। মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ি। ১৯৪৭-এর চোদ্দ আগস্ট। ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ল, আজ থেকে এটা পাকিস্তান। এটা আর আমার দেশ নয়, আমার আপন একান্ত নিজের মাতৃভূমি নয়। কী করে কালকের দেশ আজ এক জাদুমন্ত্রবলে হয়ে গেল পরদেশ! আমাদের অনেকেরই দেশ স্বাধীন হওয়ার কোনও আনন্দ ছিল না; ছিল আকণ্ঠ রাগ, অতল হতাশা, তীব্র বিরোধিতা। দিল্লিতে বসে, লন্ডনে বসে কারা যে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়, সেইটে ভেবেই সেই বয়সে আমার অন্তর তিক্ততায় ভরে গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে আমাদের পরিবারটা দেশভাগের মতোই ভাগ হয়ে যায়। বাবা রেলের কর্মী, তাই অপশন দিয়ে চলে গেছেন আসামের আমিনগাঁওতে, সঙ্গে আমার মা আর ছোট দুই ভাইবোন। জ্যাঠামশাই, জেঠিমা আর আমার তিন জ্যাঠতুতো দাদাও কলকাতায় পাড়ি দিয়েছেন। আছি শুধু আমি, আমার দিদি, ঠাকুমা আর এক জ্যাঠতুতো দাদা। বাড়িটা লোকাভাবে খাঁ-খাঁ করছে।
একটু বেলা হতে-না-হতেই হঠাৎ আমাদের এক পাড়াতুতো দাদা, ফজলুদা এসে আমাকে বললেন, ‘ফ্ল্যাগ তোলোস নাই ক্যান? মাইনষে কওয়াকওয়ি করতাছে, হিন্দুবাড়ি বইল্যা ফ্ল্যাগ তোলে নাই!’
আমি ভয় পেয়ে বললাম, ‘না ফজলুদা, ফ্ল্যাগ তো বাড়িতে নাই, তুলুম ক্যামনে?’
ফজলুদা বললেন, ‘খাড়া, আমি ফ্ল্যাগ পাঠাইয়া দিতাছি।’
একটু পরে একজন একটা সবুজ রঙের চাঁদ-তারাওয়ালা ফ্ল্যাগ দিয়ে গেল। আমি সেটা একটা সরু বাঁশের ডগায় লাগিয়ে বারবাড়িতে পুবের ঘরের বারান্দায় বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে উড়িয়ে দিলাম।
কীসের স্বাধীনতা তা এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
একটু বেলার দিকে শহরের অবস্থা দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায়-রাস্তায় মানুষের ঢল। উদ্ভাসিত মুখের মানুষজন, অনেকে নতুন ঝাঁ-চকচকে লুঙ্গি পরে, নতুন বা পরিষ্কার জামা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে সমবেত ধ্বনি উঠছে, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ!’ চারদিকে এক উত্তাল উৎসব। যারা গাইঠ্ঠা বোমের কথা জানেন, তারা জানেন এর আওয়াজ মানুষের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। পুরু লোহার নলে বারুদ ঠেসে ভরা হয়, তারপর তার তীক্ষ্ণ অন্তর্ভাগটি মাটিতে গেঁথে সলতেয় আগুন দেওয়া। শব্দ যা হয়, তা পিলে চমকে দেওয়ার মতো। রাস্তার ধারে-ধারে এরকম রাশি-রাশি গাইঠ্ঠা বোম ফাটছে একের পর এক। সঙ্গে তুমুল হইহল্লা, বিপুল আনন্দধ্বনি। সেদিন যেন শহরটায় কোনও আইনকানুন ছিল না। এই উৎসব এমনই ছেঁয়াচে যে, কিছুক্ষণ আমিও বিহ্বল হয়ে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু ওই আনন্দযজ্ঞে আমার কোনও নিমন্ত্রণ আছে বলে মনে হচ্ছিল না। সেদিন আমার কোনও বন্ধুর সঙ্গে দেখাও হয়নি। পাড়ার যারা ছিল, তারাও যে কে কোথায় গিয়েছিল জানি না! এত একা লেগেছিল সেদিন!
সন্ধেবেলায় ফিরে মুখ গোঁজ করে বাড়িতে বসে রইলাম। বুকজোড়া এক দুরপনেয় অভিমান, রাগ, হতাশা। কে স্বাধীন হল আর কে হল না, তা বোধহয় আজও বুঝে উঠতে পারিনি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র