ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মুখঋত: পর্ব ২০


    ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় (July 15, 2022)
     

    দ্য শো মাস্ট গো অন

    ইতিহাসে পড়েছিলাম, শ্রমিকেরা, খেটে খাওয়া মানুষরা লড়াই করে, আন্দোলন করে তৈরি করেছিলেন কাজের সুস্থ পরিবেশ। অমানবিক পরিশ্রম ও অতিরিক্ত কয়েক ঘণ্টা কাজ করানোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে, তাঁরা কাজের সময়সূচি নিয়ে নীতিমালা তৈরি করেছিলেন। এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ বদলে দিয়েছিল ব্যক্তিমানুষের কাজ-পরিবার-নিজস্ব সময়ের ভাগগুলো। দিনে আট ঘণ্টার কাজ, তার জন্য পূর্বনির্ধারিত নির্দিষ্ট বেতন এবং অধিক কাজের/ ঘণ্টার ক্ষেত্রে বাড়তি পারিশ্রমিক।  

    তবে ক্রমেই আমরা এমন একটি ইঁদুর-দৌড়ের জন্য চক দিয়ে দাগ টেনেছি, সুস্থ কাজের পরিবেশ, সুচারু সঞ্চালনা ও নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কাজ শিশুদের পাঠ্যপুস্তকেই রয়ে গেল। হিস্ট্রি ক্লাসে ‘লেবার ল’ বা শ্রমিক আইন মুখস্থ করে ছয় নম্বরের বোর্ডের প্রশ্ন। ব্যাস, শেষ। 

    কাজ করতে কে না চায়! বেশি কাজ মানে বেশি উন্নতি, টাকা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, এসইউভি গাড়ি, ছেলে-মেয়ের ইংলিশ মিডিয়াম ইত্যাদি। ভারতবর্ষের মতো দেশে, বেকারত্বের উপকেন্দ্রে বসে, কেই বা চায় কাজ হারাতে? তাই ‘কাজ করে যাওয়া’-র চল শুরু হল। অমানবিক কাজ, যার কোনও নির্দিষ্ট সময়, ধরন, নিয়ম নেই। পরিবার-ব্যক্তি-মানুষ-অসুস্থতা-মৃত্যু-শোক-চুরি-ডাকাতি-খুন-আত্মহত্যা-প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদিকে প্রাধান্য না দেওয়ার একটা ‘কালচার’ তৈরি করে, সেটিকে ‘বেস্ট এমপ্লয়ি অফ দ্য মান্থ’ ভূষণে পুরস্কৃত করা হল! আর এই অসুস্থ বর্বর ব্যবস্থাপনাকে যুক্তিগত আশ্রয় প্রদান করতে একটি পুরনো ইংরিজি প্রবাদকে মিনিটে-মিনিটে আওড়াতে শুরু করলাম আমরা সবাই: ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’। 

    এই উক্তি কোনও এক মহৎ সময়ে কোনও এক মহান মানুষ বলেছিলেন। পরিষ্কার ভাষায় দাঁড়ায়, কঠিন পরিস্থিতি হলেও, মোকাবিলা করে আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে, থামলে হবে না। এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, চিরতরে ঘুমোনোর আগে বহু মাইল অতিক্রম করতে হবে। তাই মানুষের ধর্ম আবার ফিনিক্স পাখির মতো উঠে গিয়ে, ঝড় সামলে নিজের কাজে ফেরা। সেভাবেই সমাজ চলে, মানুষ বাঁচে, পৃথিবী সুন্দর হয়। তাই এই প্রবাদ।

    কিন্তু আমাদের চক্রাকার ট্রেনযাত্রায় এই প্রবাদের অর্থ পুরোপুরি বদলে গেল। আমরা শুধু ‘থামলে হবে না’ অংশটিকে তুলে এনে একদল কলুর বলদ তৈরি করলাম, যারা কেবলই ছুটে চলে, থামে না, কোথায় ছুটে যাচ্ছে তা-ও জানে না। একেই ইংরিজি প্রবাদ, তাতে আবার যদি একটু ‘অ্যাকসেন্ট’ দিয়ে বা কায়দা করে বলা যায় তাহলে জবাব নেই— সূত্রপাত হল এক অবান্তর কাজের নিয়মের। দিন বা রাত, সময়ের তোয়াক্কা না করেই, পরিস্থিতি না বুঝেই, যখন বলব তখনই চাই কাজ। 

    আপনি যদি কর্মী হন, তাহলে আপনার আর ব্যক্তিগত সময় বলে কিছু নেই। সবটাই আপনার কোম্পানি বা কারখানার। মালিকের বা বসের একটি আদেশেই হাজির করতে হবে ফলাফল। নইলেই কাঁচি! যদি কর্মক্ষেত্রে আরও উন্নতি করতে চান, তাহলে বিনাবাক্যে কাজ করে যান!

    করোনা-কালের উদাহরণ দেওয়া যায়। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ শুরু হল কাজ চলমান রাখতে, পৃথিবীর এই দুর্দিনে কিছুটা ঠেকনা দেওয়ার ব্যবস্থা। ‘শো মাস্ট গো অন!’ তাতে মালিকরা বুঝলেন, কর্মীরা সহজেই ল্যাপটপে মুখ গুঁজে কাজ করতে পারেন দিনের বেশির ভাগ সময়টা। বললেই ‘জুম’ মিটিং। ঝড়ে বাড়ি উড়ে গেলেও, ‘ভার্চুয়াল’ মিটিংয়ে থাকা চাই, সময়ের কাজ সময়ে ‘ডেলিভার’ করা চাই! তাই আপিসে যাও বা ছিল, এখন আর কোনও সময়সূচি, নিয়ম-মালা রইল না। বসের ফোন, একটা মেল, মেসেজে ছোট হুমকিতেই কাজের কৈফিয়ত দিতে হাজির থাকতে হবে কর্মীকে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে আরম্ভ করে আইটি ফার্মের কর্মচারী— কেউ রেহাই পাবেন না। বিশেষ করে দৈনিক বা সাপ্তাহিক সংবাদমাধ্যম বা পত্রিকার ক্ষেত্রে আপনার জীবনের সুতো ঝুলছে ‘পাতা ছাড়তে হবে’ বা ‘আপলোড করতে হবে’র ওপর। ‘শো মাস্ট গো অন!’ 

    ক্রেতাদের অভ্যেস হয়ে গেছে সব কিছু মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাওয়ার। চোখের পলকে পুঁইশাক হাজির, বোতাম টিপলেই এক লিটার সর্ষের তেল বাড়ির দরজায়! তাই অপর দিকে যিনি সেবাটি পৌঁছে দিচ্ছেন, তাঁকে আর মানুষ মনে হচ্ছে না! ক্রেতাকেও তাই বুঝতে হবে, আসলে গোটাটাই একটাই সিস্টেমের আওতায় পড়ে।

    এই চল আমরা নিজেরাই ডেকে এনেছি নিজের ওপর। আমার বস যখন আমাকে কাজের চাপ দিচ্ছেন সারাদিন, তখন আমি চাপ দিচ্ছি মোবাইলে থাকা ‘ইন্সট্যান্ট অপশন’-এ। ক্রেতাদের অভ্যেস হয়ে গেছে সব কিছু মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাওয়ার। চোখের পলকে পুঁইশাক হাজির, বোতাম টিপলেই এক লিটার সর্ষের তেল বাড়ির দরজায়! তাই অপর দিকে যিনি সেবাটি পৌঁছে দিচ্ছেন, তাঁকে আর মানুষ মনে হচ্ছে না! ক্রেতাকেও তাই বুঝতে হবে, আসলে গোটাটাই একটাই সিস্টেমের আওতায় পড়ে। আমরা সবাই শুধু ‘ডেডলাইন’-এ পৌঁছতে মরিয়া; অবশ্য ‘লাইন’-এ পৌঁছনোর আগেই ‘ডেড’ যদি না হই, তবেই। 

    শ্রমিক আইন তো মাথায় উঠেছে। নতুন আইন আবার চালু হবে কিছুদিনেই। তবে সেই আইন কতটা মানা হবে, সন্দেহ আছে। এই অমানবিক কাজের ধরনের জন্যই মানসিক অবসাদে ভুগছেন বহু কর্মী, কাজের বাইরের জীবন থেকে তাঁরা বিচ্যুত : পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়, ভালবাসার মানুষ, বৃহত্তর জগৎ— সব থেকেই। এই বীভৎস চেহারায় বহু সংস্থা আবার আশা রাখছেন, কর্মীদের কর্মক্ষমতা, কাজে নিপুণতা, মনঃসংযোগ ইত্যাদি বাড়বে। আমার ভয় করছে! ‘শো মাস্ট গো অন’? এইভাবে? কর্মী বেঁচেই যদি না থাকেন, কাজ করবে কে? 

    তার উত্তরও ওই প্রবাদের ভেতরেই খুঁজে নিয়েছি আমরা। যিনি পরলোকগমন করলেন, তাঁর জন্য অল্পবিস্তর চোখের জল ফেলেই আপনি কাজে ফিরে আসুন। শোক যেন আপনাকে বেশি না ছোঁয়, কাজে ফিরতে হবে যে! ‘শো মাস্ট গো অন!’

    তাই আমাদের আর কিছুই ছোঁয় না এখন। মৃত্যুতে শুধুই ‘পোস্ট’ দেওয়ার তাড়া, দুঃখ দেখিয়ে এগিয়ে যাওয়ার তাড়া। 

    পৃথিবী জুড়ে ‘সাফল্য’ শব্দটির অর্থ বদলে দিচ্ছেন বহু মানুষ। তাঁরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কালজয়ী হয়ে থাকবেন। আমাদের সেদিকে তাকানো উচিত। নিজেদের পরিসরে অমানবিক কাজের পরিবেশকে প্রশ্ন করা উচিত। ২৫ বছর বয়সের মধ্যেই সকল যুবক-যুবতীকে থিতু হতে হবে, এর কোনও মানে নেই, এটা সবাইকে বোঝাতে হবে। নইলে ডিপ্রেশন, আত্মহত্যা, রোজ ভেঙে পড়া, উদ্বেগের জন্য হওয়া অসুস্থতা আটকাতে পারব না কোনওদিন। ‘শো’ চলবে, কিন্তু মানুষকে মেরে ফেলে, তাকে যন্ত্রে পরিণত করে নয়। সুস্থ ভাবে ‘শো’ চালানো গেলে ভাল, নইলে কিছুদিন স্থগিত রেখে, পরে চালানো যাবে। প্রবাদে গা ভাসিও না। 

    এ-বছর অত্যন্ত জ্বরে ভুগছিলাম। সারা মুখে ঘা নিয়ে কথা বলতে পারছিলাম না, সারাদিন প্রায় ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে কাটছে। একজন পরিচিত সাংবাদিক বহুবার ফোন করেছেন দেখে মেসেজে জানালাম আমার শারীরিক অবস্থার কথা। তিনি আবার ফোন করায় ভাঙা গলায় কোনওমতে একই কথা জানালাম। তিনি উত্তরে বললেন, ‘আজকে সন্ধে সাতটায় একটা লাইভে থাকতে পারবি? একটা আলোচনা মতো হচ্ছে।’ আমি উত্তরে বললাম, মাথা তুলে বসতে পারছি না জ্বরের কারণে। তিনি বললেন, ‘কিছুক্ষণের জন্য আয়, কিছু হবে না।’

    শেষ অবধি করতে পারিনি সেই অনুষ্ঠান। তবে সেদিন এই কথাগুলো শুনে পরিচিত সাংবাদিকের অবস্থা বিবেচনা না করে পারলাম না। তাঁকেও তাঁর বস বলেছেন, যেন-তেন-প্রকারেণ কাউকে একটা আলোচনায় বসাতেই হবে। সেই বসকে তাঁর বস বলেছেন একই কথা। তাঁর বসকে এই কথা বলেছে চ্যানেলের টি-আর-পি। টি-আর-পি’কে এই কথা বলেছে দর্শক। ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’…

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook