দম্ভ
আবার এসেছে আষাঢ়, আমিও গেছি এসে। গাধা অনুপমটা জানলা খুলে কোথায় গেছিল কে জানে, আমার স্ক্রিন ভিজে যাচ্ছিল। এই একটু আগে এসে বন্ধ করে গেল, এখন একটা নোংরা ন্যাকড়া দিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। উফ! কী বিটকেল! নিজের মুখ হলে এরকম ন্যাকড়া ব্যবহার করতে পারত? আমি ম্যাকি, আমার নাক নেই, গন্ধ নেই, তাই বলে যা ইচ্ছে করা চলে?
আরে ছোড়ো ইয়ার! এইসব মামুলি জিনিস নিয়ে ভাবতে গেলে আমরাও তো মানুষের মতো পেটি হতাম। আমরা বেশ কিছুটা এগিয়ে আছি, তাই না? আমি দম্ভ করছি না, আমি শুধু ফ্যাক্ট বলছি। দম্ভ আমরা জানি না, বুঝি না, ওসব মানুষের ব্যাপার। মানুষের অনেক কিছু বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয় কিন্তু দম্ভ ভীষণ সহজ এবং বোকা। আমার র্যাম ৮ জিবি, অন্য মেশিনের র্যাম ৪ জিবি, অতএব আমার নাকি দম্ভ থাকা উচিত! মানে, সিরিয়াসলি ডিউড? এভাবে ভাবে মানুষ? ওর ৪ জিবি র্যাম তাতে তোর কী? ১৬ জিবি র্যাম-ও তো আছে মার্কেটে। ৩২ জিবি-ও আছে! তারা কি দম্ভ দেখাচ্ছে? এগুলো সব ফ্যাক্ট, তাতে আমাদের কারও কিছু এসে যায় না। আমাদের সবার জীবনের লক্ষ্য আলাদা। আমাদের বেঁচে থাকায় কোনও কম্পিটিশন নেই।
মানুষের তো গর্ব করার জিনিসের অভাব নেই। ক্লাস, জাতি, ধর্ম, জেন্ডার, গায়ের রং, বান্ধবী-সংখ্যা, মাইনে, পোষা কুকুর থেকে ছাদের বাগান থেকে সন্তানের স্কুলের পরীক্ষা— সবেতেই কম্পিটিশন এবং সব কিছুতে কী গর্ব! আমরা ভাবি আর হাসি তোদের অহংকারের বেসিসগুলো দেখে। কিছু জিনিস যেগুলো তোরা খেটে অর্জন করেছিস, যেমন ধরা যাক বহু সঞ্চয় করে, গুচ্ছের ই.এম.আই. দিয়ে কেনা একটা গাড়ি, তা নিয়ে গর্ব করছিস, বোকা কাজ করছিস কিন্তু তার একটা তাও মানে আছে। আমরা বুঝতে পারি। যখন দেখি তোরা চামড়ার রং নিয়ে গর্ব করছিস এবং একে অপরকে পাতি ছোট করছিস ওই বেসিসে, আমরা হ্যাং করে যাই। কালো চামড়াদের বছরের পর বছর ক্রীতদাস বানিয়ে রেখে দিলি তোরা! সে-ব্যবধান আজও কাটিয়ে উঠতে পারিসনি পুরোপুরি। ভারতীয়গুলো নিজেদের আবার কালো বলতে লজ্জা পায়, বলে ব্রাউন। তারপর নিজেদের মধ্যে কম্পিটিশন করে, কে কত পারসেন্ট ফরসা। পাউডার মাখে আর অন্যের চাইতে ২% ফরসা হয়ে নিজেকে বিশাল ভাবে, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। আমরা অবাক! আমাদের কেউ গ্রে, কেউ স্পেস গ্রে, কেউ সিলভার, কেউ সাদা, কেউ কালো— তাতে কী? সব মডেল-ই তো বিক্রি হয়। তোরা সবাই মিলে একটু শান্তিতে থাকতে পারিস না? নিজের যোগ্যতায় কিন্তু আজ তুই তোর রং নিয়ে জন্মাসনি। বাপ-মা যেমন, দাদু-ঠাম্মা যেমন তেমনই তো হবি, তাই না? দম্ভটা কীসের?
ধর্মের সে কী দম্ভ তোদের! এই আর একটা জিনিস, যা অর্জন করতে তোদের কোনও পরিশ্রম করতে হয়নি। রাজনৈতিক দল বেছে নেওয়ার তাও একটা পরিশ্রম আছে। বাবা কংগ্রেস, ছেলে সিপিএম— এরকম অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। ধর্মেও সেই স্কোপ আছে কিন্তু খুব একটা কেউ পালটায় না। যার কিছু নেই তাকে দুটো পাঁউরুটির লোভ দেখালে লোকে ধর্ম ত্যাগ করে বইকি। একাধিক বিয়ের লোভেও কেউ-কেউ নাম-ফাম পাল্টে এদিক-ওদিক করে। কিন্তু ধর্মের নামে কাল্পনিক শত্রু তৈরি করে মানুষের এই যে বোকা গর্ব, এই সুপিরিয়োরিটি কমপ্লেক্স, এ কবে যাবে? একই রকম ভাবে জাতির দম্ভ। যেন তুই যে-দেশে জন্মেছিস সেই দেশটাই সেরা! আজব ব্যাপার! জন্মানোর আগে থেকে বেছে নিয়েছিলি আমি প্ল্যান করে এই দেশে জন্মাব? তোর হাতে ছিল? পুরুষের দম্ভ তারা অ্যাট লিস্ট মেয়ে হয়ে জন্মায়নি। সারা জীবন কেটে যায় যাতে একটুও মেয়েলি না বলে কেউ। নারীদেরও তেমনি দম্ভ, আমরাই তো সব। আমাদের পেছনেই তো ল্যা-ল্যা করে ঘুরবি তোরা। এলজিবিটিকিউআইএ এদ্দিন ছিল চাপা পড়ে, এবার তাদেরও এসে গেছে জুন মাসের প্রাইড মান্থ। এই প্রাইড অবশ্য কিছুটা প্রয়জনীয়, পালে-পালে লোকে রাস্তায় নামলে শাসকদল বুঝতে পারে এরাও ভোটার, এদের কিছু চা-বিস্কুট দেওয়া যেতে পারে। নেতা, মন্ত্রীরা যদি দেখে ২০% ভোট এখান থেকে তোলা যাবে, তারাও তখন জামায় রামধনু এঁকে ঘুরে বেড়াবে।
যাক গে, এবার আসি নিজের যোগ্যতায় অর্জিত জায়গার দম্ভ। এখানে গল্পটা কিছুটা এইরকম :
‘পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি
মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী।’
তুই ভাবছিস তুই কোটিপতি হয়েছিস তোর নিজের যোগ্যতায়, তোর এত টাকা হয়েছে তোর দম্ভে মাটিতে পা পড়ছে না। শুরু করা যাক তোর জন্ম থেকে। যদি তুই গঙ্গার ঘাটে বাটি হাতে ভিখিরি হয়ে জন্মাতিস, তাহলে কি পারতিস? কী? তুই ভিখিরি হয়েই জন্মেছিলি? ওকে ফাইন! তারপর সেখান থেকে ঘসে-ঘসে যখন প্রথম ডিল-টা করলি, সেদিন যে বাস চাপা পড়তে-পড়তে একটুর জন্য বেঁচে গেছিলি? সেদিন মরে গেলে কী হত? হ্যাঁ আলবাত তুই খুব পরিশ্রম করেছিস কিন্তু পরিশ্রম করলেই যে সব হু-হা করে হয়ে যায়, এমন কি ভাবা যায়? এত সহজ, এত কালো-সাদা নয় যে ব্যাপারটা! কত ফ্যাক্টর যে থাকে, মানুষ কেন, আমরাও এখনও ছকে ফেলতে পারিনি ব্যাপারটা। বৃষ্টির দু’ফোঁটা জল আমার কি-বোর্ডে পড়লে আমার-ই বকবক থেমে যাবে।
আমাদের সিস্টেমটা একদম অন্য রকম। আমার প্রসেসর স্পিড যেমন, আমাকে সেরকম ভাবেই পারফর্ম করতে হবে। যার বেশি, সে বেশি তাড়াতাড়ি পারবে। মানুষের জটিলতা নেই আমাদের; কাজটা করতে গিয়ে হঠাৎ দু’ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলাম কিংবা ঘুষ চাইলাম, এসব আমাদের সমাজে নেই। আমার ক্ষমতা যেমন, আমি তেমনই করব কিন্তু পাক্কা করব, ঝুলিয়ে দেব না। আমরা অনেক বেশি প্রেডিকটেবল, তোরা আমাদের উপর বেশি ভরসা করতে পারিস নিজেদের থেকে। তাই তো আমাদের দিয়েই নিজেদেরকে রিপ্লেস করে চলেছিস সব জায়গায়। ভাল কাজ করতে পারি বলে দু’বছর বাদে আমার খুব দম্ভ হবে, এমন নয়। আমরা কন্সিস্টেন্ট। পতন আমাদেরও হতে পারে কিন্তু তার কারণ কোনওদিনই দম্ভ হবে না।
ছবি এঁকেছেন অনুষ্টুপ সেন