জাস্ট দেখছি
আপনি মেয়ে দেখেন না?’ হ্যাঁ বলায় উত্তর এল, ‘আসছি, আছেন তো? সামনাসামনি কথা হবে।’ আপিস করেছি আমার এক বন্ধুর বাড়ির বৈঠকখানার পিছনের ঘরে। ওর বাড়ির ঠিকানা দেওয়া আছে। মেট্রো স্টেশনের কাছে, সবার সুবিধে হয়। ওদের বাড়ি এখন প্রায় খালি হয়ে গেছে। দিদি-বোনদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর প্রচুর জায়গা। ওরই বুদ্ধি। ‘দ্যাখ একটু রিস্কি কাজ তো বটেই। কিছু হয়ে গেলে পার্টি তোর বাড়িতে চড়াও হলে সামলাতে পারবি না। এ-পাড়ায় কেউ কিস্যু করতে পারবে না কিন্তু।’ আজকাল এমন পরোপকারী লোক পাওয়া যায় না। ওর স্বার্থ একটাই। লোক না থাকলে চেম্বারে এসে আমার সঙ্গে গল্প করবে, চা খাওয়াবে, এইসব। ব্যাচেলর। সারাজীবনই রিটায়ার্ড। মক্কেলের ফোন এসেছে বুঝতে পেরে উঠে পড়ল, ‘হয়ে গেলে বলিস।’ এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলেন ভদ্রলোক। আমার মতোই বয়েস হবে। ‘লিকার, দুধ, চিনি?’ জিজ্ঞেস করায় হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, ‘হলেই হল।’ আমি তিনবার বেল বাজালাম। এটাই সংকেত।
একটুও সময় নষ্ট না করে সোজাসুজি বললেন, ‘আমারটা একটু ডিফারেন্ট কেস, আপনি নাও নিতে পারেন। তবে আপনার ফিজ নিয়ে ভাববেন না।’ আমার কাজের পারিশ্রমিক ঠিক করতে সময় লেগেছিল কিছুটা। প্রত্যেক দেখার জন্য অ্যাডভান্স একটা টাকা। পাকা হলে বাকিটা। ভেস্তে গেলে নো রিফান্ড। বাড়ির দালালির মডেল। তফাত একটাই, কারবারটা জ্যান্ত মানুষ নিয়ে। বাড়ির জায়গায় নারী। ছেলেপক্ষের হয়ে আমি প্রতিনিধিত্ব করি প্রাথমিক ভাবে। দু’পক্ষ রাজি হয়ে গেলে আমার কাজ শেষ। নিজেরা দেখার আগে এই বাফারটা এখন অনেকের কাছে সুবিধেজনক। আমার ঘটকালিতে হওয়া দুটো বিয়ে দিব্বি টিকে আছে এখনও। তাই, এই কাজ করি এমন খবর বাজারে ছেড়ে দেওয়ায় ভালই ফল পাচ্ছি। আমার ব্যবহার, কথাবার্তা, চেহারার একটা ভ্যালু আছে। সেটা আমার বিজনেস ক্যাপিটাল। আমার নিজের বিয়ে অবশ্য আগেই চটকে গেছে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সমস্যাগুলো আমি কিছুটা বুঝি বইকি। কথা বলার সময় অনেক কিছু বুঝে নিতে পারি, যা জিজ্ঞেস করা শোভন নয়। কিছু কাজ ছেড়ে দিয়েছি এর আগে। যৌতুকের কথা বলতে বলা হয়েছিল আমাকে। পাগল না কি? আগে এই কাজটা করতেন পরিবারের সিনিয়র, কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন, অভিজ্ঞ লোকরা। এরাই ফিরে এসে কখনও বলতেন, ‘বিয়ে দেবে দাও, কিন্তু বলে দিলাম, টিকবে না বেশিদিন।’ অথবা, ‘পয়সা দিয়ে মেপো না, পরিবারটা ভালো।’ এখন ফ্যামিলি সিস্টেম একটু বদলে গেছে। বিয়ে ব্যাপারটাও যেন কেমন-কেমন। আজকাল নাকি প্রি-ওয়েডিং ছবি তোলা হয়! ঠিক তেমনই প্রি-সম্বন্ধ। সুখের কথা, বিয়ে করার কারণগুলো একটুও টসকায়নি। অন্য দেশে কী হয় না হয় জানি না; আমাদের এখানে বিয়ে-টিয়ে খুবই হয়। এর পরের ব্যাপার নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কোম্পানির দায়িত্ব সীমাবদ্ধ।
‘আমার একেবারেই শাদি-শুদার ইচ্ছে নেই। হাউএভার আমি যে উদ্যোগ নিচ্ছি এটা দেখানো দরকার’, শুনে বললাম, ‘আমি মেয়ের বাড়িতে গিয়ে কী বলব তাহলে? শুনুন, বিয়েটা যেন না হয়?’ ‘আহা, তা কেন? আপনি দেখে আসবেন। এদিকে আমি বলব যে আমার লোক তো গিয়েছিল। তারপর আপনি জানাবেন মেয়ের পছন্দ হয়নি। হতেই পারে। একটা কথা, ছেলের লোক মেয়ে দেখে গেল, অথচ মেয়ের পছন্দের কোনও দাম রইল না, এটা জেনে বুঝেই তো রাজি হচ্ছে লোকজন। এই যে একটা ওয়ান ওয়ে ভয়্যারিস্টিক অ্যাপ্রোচ, খুবই খারাপ, বিয়ে ব্যাপারটাই… যাই হোক, আমি তো করছি না। আমি অনেস্টলি একটা সিস্টেমকে হায়ার করছি টু গেট রিড অফ অ্যানাদার ট্রাবল। বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি ছেলেও দেখেন?’ সব কাজেরই প্রফেশনাল হ্যাজার্ড থাকে। চা খেতে-খেতে আমিও আমার স্টোরিবোর্ড, স্ক্রিপ্ট তৈরি করে যাচ্ছিলাম। রসিকতা করে বললাম, ‘হোপ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, এই একই সিস্টেমে ওনারা যদি আমাকে ডাকতেন আপনাকে দেখে আসার জন্য, রাজি হতেন?’ ‘না, নেভার। অনেস্টলি, রাজি হওয়া উচিত যদিও।’ ভদ্রলোকের এইটুকু সততা আমার ভাল লাগল। ‘আপনি বিয়ে কাটাতে চাইছেন, ফাইন, বিয়ে ছাড়া অন্যরকম যৌথ জীবনেও তো আগ্রহী হতে পারেন।’ ‘আপনি কি আমাকে কাউন্সেলিং করছেন?’ বলেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘না মশাই, আমার এই ঠিক আছে, আর নয়।’ ‘আর’ কথাটা ঠং করে কানে লাগল। ‘ঠিক আছে, ডান, লেটস প্রসিড।’
আমার একটা ডাটাবেস তৈরি হয়ে গেছে। বিবাহে উৎসাহী ছেলে ও মেয়ের পরিবারের। পাত্র বা পাত্রী নয়, বাড়ির লোকের ভূমিকা এখানে বেশি। দু’পক্ষ প্রথমে পরস্পরের সম্পর্কে জানছে নির্ভরযোগ্য, ভদ্র শিখণ্ডীর মাধ্যমে। যা দুটো মানুষকে একসঙ্গে জীবন কাটাতে উৎসাহিত করবে, তার বাইরের ব্যাপারটা আগে সেরে ফেলতে চাইছে। সেটা অ্যাপ্রুভড হলে নিজেরা এগোবে। মন্দ কী? আমার লেটেস্ট ক্লায়েন্ট তাঁর পছন্দের স্পেসিফিকেশন জানাননি। বিয়েই তো হচ্ছে না। তাই আমাকে ভাবতে হয়েছে এই পরিস্থিতির উপযুক্ত বাড়ি। বাজে বাড়ি, বাজে মেয়ে, যেখানে কিছুতেই বিয়ে দেওয়া যায় না, কীভাবে ঠিক করব? এই বিচারের দায়িত্ব আমার নয়। শুধু ইনফরমেশন দেওয়া-নেওয়ার এক্তিয়ার আমার। আমি নিজের এথিক্সের জায়গায় ঠিক আছি। একবার তো আমাকে পরিষ্কার বলা হয়েছিল, ছেলে প্রকৃতিস্থ নয়, বলার দরকার নেই, কারণ বিয়ে হলে ঠিক হয়ে যাবে। আমি রিফিউজ করেছিলাম। টাকা রোজকারের জন্য এত নীচে নামা যায় না কি? ডাটাবেস দেখতে-দেখতে মনে হল, দেখছি কেন? এই অবস্থায় আমার বন্ধু ঢুকল। শুনল। বলল, ‘দেখা করে নে। তারপর মক্কেলের কথা অনুযায়ী কাটিয়ে দে। নতুন মক্কেল এলে তাকে প্লেস কর। একটা না একটা তো লেগেই যাবে। টাকা তো দিচ্ছে ছেলে। মেয়ের বাড়ি তো নয় যে তুই তাদের চিট করছিস বলে অনুশোচনা হবে।’ আরও বলল, ‘একটা খটকা লাগছে, আদ্দামড়া লোক, এই যে একটা ফলস পরিস্থিতি তৈরি করছে, কেন? কে এত চাপ দিচ্ছে যে সে দেখাতে চায়, এই দেখো বাপু, আমি কিন্তু বিয়ে করতেই চেয়েছিলাম!’ চুপ করে রইলাম।
যাওয়ার দিন মক্কেল নিজেই এসে হাজির। বললেন, ‘কেন পরে বলব, আমি যাব আপনার সঙ্গে। এমনি। কথা আপনিই বলবেন।’ আপত্তি করা উচিত কি না বুঝলাম না। বললাম, ‘কি আর হবে, আপনিই যে অপাত্র সেটা বলব না, চলুন।’ মেয়ের বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে আমার একটু নার্ভাস লাগছিল। আগে এমন হয়নি। ওনারা অপেক্ষা করছিলেন। বসতেই চা এল। এনারা লাল চা খান, চিনি ছাড়া। আমার সঙ্গে যিনি আছেন, তাঁর ব্যাপারে কিছু আপত্তি আছে বলে মনে হল না। কেমন ছেলে চাইছেন আগেও জিজ্ঞেস করেছিলাম। একজন মহিলা, মেয়ের মা নিশ্চয়ই, খুব ক্লান্ত গলা, বললেন, ‘আমাদের মেয়ে সাধারণ। কী আর বলব বলুন! ভগবানের কৃপায়, আপনাদের আশীর্বাদে বিয়েটা হয়ে গেলে…’, একটু থেমে, ‘তারপর শান্তিতে ওদের কেটে গেলেই চলবে।’ ভদ্রলোক, যিনি মেয়ের বাবা হতে পারেন, ঘাড় নীচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলেন। ওনার বলার মতো কিছু ছিল না তেমন। ছেলে সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। কিছু একটা বলতে হয়। বলতে লাগলাম, ‘গভর্নমেন্টের বদলির চাকরি, তবে ভাতারে নিজেদের বাড়ি, বেলমুড়িতে কিছু জমি আছে, বাবা-মা নেই…’ পাশে বসে আমার মক্কেল মাথা নেড়ে সমর্থন করছিলেন। ঘরদোরের অবস্থা সাধারণ। তবে সুতোয় সেলাই করা ফ্রেমে বাঁধানো সেই লেখাটা আছে, ‘সুখ যদি কোথাও থাকে, তা এইখানে, এইখানে, এইখানে।’ এরপর মেয়েকে ডাকা হল। ভদ্রলোক ঘুসঘুস করে কাউকে কিছু একটা বারণ করলেন। মাথা নীচু করেই রইলেন। মনে হল পাশের ঘরে আরও কেউ রয়েছে। মেয়ে এসে বসল। বলল, ‘আমার কিছু বলার নেই, আপনার ছেলে রাজি থাকলে বিয়ে হবে।’ বলে একটা খাম এগিয়ে দিল, নিশ্চয়ই ছবি আছে। চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম আমার মক্কেল মেয়েটিকে জরিপ করছিল। মেয়েটি সেটা বুঝতে পারছে বলেই আমার ধারণা। আমার কাজ হল সব কিছু দেখেশুনে বুঝে নেওয়া। এক্ষেত্রে তার দরকার নেই। তবে, অভ্যাসমতো আমিও দেখছিলাম। কিছু অবান্তর কথা হল। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘তাহলে কী বলবেন?’
ভেতরের ঘরে আরও দু-একজনের কথাবার্তা উপচে আসছিল টানা পর্দার ফাঁক দিয়ে। একটা কথা শুনলাম, ‘একদম না।’ পরমুহূর্তে বেরিয়ে এল আর একটি মেয়ে। একটু কম বয়স। একইরকম মুখের আদল। তার দিদি ছাড়া আর দুজন অস্বস্তিতে পড়েছেন। সে আমাকে বলল, ‘আপনি মেয়ে যখন দেখেন, ছেলেও দেখেন নিশ্চয়ই, দিদির হয়ে গেলে আমারটাও দেখুন।’ দিদি বলল, ‘ওকে পছন্দ হলে ওর কথাই বলুন না। একই তো ব্যাপার!’ পরিস্থিতি বেয়াড়া টার্ন নিচ্ছে দেখে আমি পেশাদার হাসিমুখে, যেন অভিভাবক, বললাম, ‘ওয়ান অ্যাট আ টাইম প্লিজ।’ এগুলো চোরা টেনশনের সময়। ডেলিকেটলি হ্যান্ডল করতে হয়। দুজনেই হাসল। বিয়ের পরে টেস্টের ফলাফল নিয়ে এরা চিন্তিত নয় বলে মনে হল। আমার নার্ভাসনেসটা আবার ফিরে এসেছে। ছোটটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী পড়ো তুমি?’ সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর, ‘লাটে তুলে দিয়েছি, ব্যবসা করি।’ ‘কীসের ব্যবসা?’ কথাটা কিন্তু বলেছে আমার মক্কেল। ইনস্ট্যান্ট উত্তর, ‘বলব কেন? যাই করি না কেন, আমার সঙ্গে যার বিয়ে হবে সে অপদার্থ হলেও ক্ষতি নেই, আমি খাওয়াতে পারব।’ ছোট মেয়েকে কেন বের করা হচ্ছিল না আন্দাজ পেলাম। ‘দিদি ভাল, একটু টিউশনি করে। বিয়ে হয়ে গেলে কাটিয়ে দেবে। কী রে, ঠিক বললাম? তারপর বছর ঘুরতেই ছ্যানা, সকাল-বিকেল প্যাঁদাবে।’ আমার মক্কেল এখন ছোটটিকে দেখছে চোখ গোল করে। চেয়ার থেকে তার শরীরটা অনেকখানি এগিয়ে গেছে। এবারে রাশ টানা দরকার। এনাফ। তাছাড়া ওনার কথা বলার দরকার নেই। ভীতু। ভেড়ুয়া। বিয়ের ঝক্কি নিতে ভয় পায়। আত্মবিশ্বাসের অভাব। অসভ্য। যেই না ছোটটা এসেছে, কথার তুবড়ি ফুটেছে, অমনি বাবুর পুটুং জেগেছে। দিদি এসবে বিচলিত নয়। বাবা-মা অসহায়ভাবে অপেক্ষা করছেন এসব থামার। ভেতরের ঘরের দরজায় যে-মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, বেশ কঠিন মুখ, তিনি কে জানি না। মনে হল, ফোক্কড় ছোটটিকে সুযোগ পেলেই ঘাড় ধরে তুলে নিয়ে ঘরে পুরে দেবেন।
তেমন পরিস্থিতির সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল না। মক্কেল ছোটটির সঙ্গে কথা বলেই চলেছেন, সেও চালিয়ে খেলছে। চোখের দৃষ্টি দেখে সে বুঝে নিয়েছে, এ-লোক যেই হোক না কেন, আসলে কী চায়। দিদিও সেটা দেখেছে। প্রায় অদৃশ্য একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ছে তার মুখে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। আমরা দুজনেই বুঝলাম যে আমরা ভেতরে-ভেতরে হাসছি। কথা বলছি। অন্য দুজন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। কত অল্প সময়ে মানুষ এত ভোকাল হয়ে উঠতে পারে। ‘মুনিয়া চলে আয়’, দরজা থেকে কথাটা এল একবার। নাটকের প্রথম বেলের মতো তীব্রতায়। কী করে আসবে, মক্কেল বলে বসেছেন, ‘সংসারের চাপ কাকে বলে বোঝেন?’ ব্যাস। ‘আপনারা বোঝেন? তাহলে এর সঙ্গে একে-তাকে গুঁজে দিয়ে নিজের মাল বুঝে নিয়ে কেটে পড়েন কেন? বাজারে রূপচাঁদা মাছ বেচলেও তো পারেন!’ আমার পেশার ওপর সরাসরি আক্রমণ হচ্ছে ইডিয়টটার জন্য। আমি উঠে দাঁড়িয়ে রেফারির ভঙ্গিতে বললাম, ‘সাইলেন্স।‘ অমনি সবাই চুপ করে গেল। ততক্ষণে আমি মনে-মনে বড় বোনের নাম দিয়ে ফেলেছি চুনিয়া। এই যে, এত ঝঞ্ঝাটের মধ্যে মা মেরীর মতো শান্তভাবে বসে আছে, এমন মেয়ে যার কপালে জুটবে সে তো বর্তে যাবে। সো মাচ কাম উইদিন ক্যাওস। মুনিয়া অন্য মেটিরিয়াল। আমার অভিজ্ঞতা বলে এদের মতো মেয়েদের জন্য গোবেচারা পাত্রই ঠিক আছে। এই যে লোকে বলে, একরকম মানসিকতা হলে ভাল, সেটা একদম ভুল। আমার ব্যাপারটা যদিও এক্সেপশন। আমার প্রাক্তন স্ত্রী অপদার্থ বলেই আমাকে বিয়ে করেছিল। তারপর যে-ভুলটা করেছিল, সেটা হল, আমাকে মানুষ করার চেষ্টা। পারেনি। রেগেমেগে চলেই গেল। আর এমনই নিয়তি, আমি অন্যের হয়ে মেয়ে মাপছি। মেয়ের বাড়ি মাপছি। গুষ্টি মাপছি। এই মুহূর্তে সেই কেস অত্যন্ত জটিল।
সামলে দিল কিন্তু চুনিয়া। সমস্ত পরিস্থিতিটা সাম-আপ করে, শান্তভাবে বলল, ‘তাহলে এই বলবেন, কেমন?’ সে তো জানে না যে বলার কিছু নেই! যার জানার কথা তিনি লাইভ দেখেছেন। শুনেছেন। এই মুহূর্তে বেশ ঘামছেন। এমন বৌয়ের সঙ্গে অমন শালি ফাউ পেলে কী হত, সেটাই হয়তো মনের মধ্যে প্রসেস করছেন। একবার অপরাধীর মতো দিদির দিকে তাকালেন তিনি। তার ঠান্ডা, সব বুঝে ফেলেছি চোখ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তোকে কে বলেছিল মাঠে নামতে? সকালের ভারী পিচে জাঁদরেল বোনের পেস বোলিং সামলাতে পারলি না! আহত ও অবসৃত অবস্থায় প্যাভিলিয়নে ফিরে যা না। ‘তাহলে আজ আমরা উঠি? ওনাদের জানাই, তারপর জানাচ্ছি।’ বলে উঠে দাঁড়ালাম। মা আগের মতো একই জায়গায়। বাবা আরও ঝুঁকে পড়েছেন। দরজায় কেউ নেই। দুই বোন পাশাপাশি বসে চোখে-চোখে গল্প করছে নিশ্চিন্তমনে। কিছুই ঘটেনি তেমন। একটা মিথ্যে গল্প পকেটে ভরে আমরা দুজন নাটক দেখতে এসেছিলাম। স্টেজ আমাদের গিলে ফেলেছে। অন্য চরিত্রদের তুখোড় ডায়ালগের অভাব নেই। আমাদের না আছে প্রম্পটার, না আছে পকেটে চিরকুট কাগজ। আমরা দুজনেই এতক্ষণ কাজের নাম করে আসলে যা করছিলাম সেটা ধরা পড়ে গেছে, আমি নিশ্চিত। আমি কি মেয়েদের মুখ দেখে কিছু বুঝি না না কি? সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে আবার নার্ভাস লাগছিল। আমি যেমন আমার মক্কেলকে চিনে ফেলেছি, সেও কি আমাকে বুঝে গেছে? গেলেই বা কি? আমি যার দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলাম, তাকে নিয়ে এর তো মাথাব্যথা ছিল না। কাউকে নিয়েই থাকার কথা নয়। অথচ, যাক গে। আমরা যখন ল্যান্ডিং-এ পৌঁছে গেছি, ভুলেও মুখ ঘোরাচ্ছি না, ছাড়া পাওয়া চোরের মতো পাতাল খুঁজছি, তখন ওপর থেকে দুটি কথা পড়ল টুপ্ টুপ্ করে। একই নোটে, অথচ আলাদা স্কেলে, পিয়ানোর সাদা ও কালো কি-র মতো। ‘আবার আসবেন কিন্তু।’ ‘আপনিও।’ কোনটা কাকে বলা হল সেটা আমি আমার মতো বুঝলাম। বা বুঝতে চাইলাম। আমার রাগটা যায়নি। বাইরে বেরোই, তারপর যা বলার বলব।
বেরিয়ে কেউ কোনও কথা না বলে হনহন করে অনেকটা চলে এসে প্রায় একইসঙ্গে দুজনে থামলাম। আমরা পালাচ্ছিলাম। হাঁটার ফলে, চড়চড়ে রোদ্দুরে, অটো-ফটোর চিল-চিৎকারে আমি যা বলার জন্য রেডি ছিলাম তা আর বলা হল না। খুব খিদে পেয়েছিল। বাজার এরিয়া। কাঁড়ি-কাঁড়ি দোকান। খাবার মতো কিছু নেই। সর্বত্র গ্যাসবেলুনের মতো হাওয়া ভরা ভোঁদাইমার্কা চিপসের প্যাকেট ঝুলছে। দেখলেই আমার রাগ হয়। মনে হয় দৌড়ে এসে পিন দিয়ে পটপট করে ফুটো করে দিয়ে পালিয়ে যাই। যতগুলো সম্ভব। আমার সেই বন্ধু দার্শনিক মানুষ। বলেছিল, ‘মানুষ পয়সা দিয়ে নিজের ইগো কিনে খায়।’ আরও অনেক ব্যাপারেই আমার রাগ আছে। প্রফেশনাল জায়গায় সেসব একেবারেই প্রকাশ পায় না। ওই কারণে আমার ক্লায়েন্টকেও আমার কিছু বলা সাজে না। কী আর করেছে এমন? মুখে বলেছে বিয়ে করবে না। বলেছে। এদিকে স্পটে বিবাহে প্রস্তুত, ওপেন অফার দেওয়া মেয়ে দেখে নির্ঘাত মাথা ঘুরে গিয়েছিল। অল্প সময়ের জন্য হলেও মনটা ভিজে উঠেছিল। হতেই পারে। মত বদলে যেতেও পারত। এই অবধি ভেবে, একটু আনন্দ হল। কারণ বদলায়নি। বিয়েটা হল না যার সঙ্গে, পাকেচক্রে তাকে আবার আমার বেশ লেগেছিল। এই কিছুক্ষণ আগে। আমিও মানুষ। আমরা কেউ ক্রিমিনাল নই। কী যে হয়! ওসব এখন ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে।
রাস্তায় ঝুড়ি নিয়ে লোক বসে আছে, দেখে, ‘কলা কলা’ বলে দৌড়লাম। গবগব করে দুজনে খেয়ে ফেললাম দুটো করে। একটা চায়ের দোকান পেয়ে বসলাম। নানখাটাই বিস্কুট চায়ে ডুবোতে গিয়ে টাইটানিক হয়ে গেল। বোকা-বোকা হাসলেন উনি। দুজনে একসঙ্গে সিগারেট বের করলাম, অফার করলাম পরস্পরকে। একই ব্র্যান্ড। আমি নিলাম ওনার কাছ থেকে। উনি নিলেন আমারটা। ওনার ছোট। আমার কিং সাইজ।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র