এই তো সেদিন। ছাপ্পান্ন? আরকানশাসের একটা স্টেজে কালো শার্ট পরা বছর তেইশের জনি ক্যাশ ছুড়ে দিলেন সেইসব কথা— ‘আই কিপ আ ক্লোজ ওয়াচ অন দিস হার্ট অফ মাইন/ আই কিপ মাই আইজ ওয়াইড ওপেন অল দ্য টাইম’ … একটু হাসলেন, প্রেমিকা ভিভিয়েন লিবের্টোর মুখ মনে পড়ল, জনি বললেন— ‘বিকজ ইউ আর মাইন, আই ওয়াক দ্য লাইন…’। আর এই কালো শার্ট, সেপিয়া টোনের কান্ট্রি মিউজিক একটা বোধের নাম হয়ে অল্প হেসে ঢুকে গেল আমাদের রক্তে। জন ডেনভার হামিং করলেন। সবেমাত্র পাশ্চাত্য ফোক-কান্ট্রির সিলেবাস ধরা তরুণীও গড়িয়ার ফ্ল্যাট থেকে ডিসেম্বরের ভেজা জানলার শার্সি ছুঁয়ে গলা মেলাল কলোরাডোর ছেলেটার সঙ্গে— ‘কোল্ড হিয়ার ইন দ্য সিটি, ইটস অলওয়েজ সিমস দ্যাট ওয়ে, অ্যান্ড আই হ্যাভ বিন থিঙ্কিং অ্যাবাউট ইউ অলমোস্ট এভরিডে…’
কান্ট্রির আসলে কোনও শুরু শেষ হয় না। কান্ট্রির দেশ হয় না। সংজ্ঞা হয় না। ওই যে বললাম, কান্ট্রি একটা বোধ হয়ে ঢুকে যায় অপরিচয় থেকে তীব্র এক বন্ধুত্বের দিকে। একটা সবুজ গাউন পরে ‘কোল মাইনার্স ডটার’ লোরেট্টা লিন গাইছেন, ‘দ্যাটস দ্য ওয়ান থিং দ্যাট ড্যাডি মেড সিওর অফ/ হি সোভেলড কোল টু মেক আ পুওর ম্যান’স ডলার…’ কেন্টাকি থেকে ইন্ডিয়ানা। আট ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর বদলানোর পর হঠাৎই ব্ল্যাক লাং ডিজিজে চলে যাওয়া নিজের বাবার কথা লোরেট্টার কণ্ঠে। যাপনের কথা, লড়াইয়ের কথা গানের ভেতর। কান্ট্রি শুধু কাউবয় টুপি আর একটা বুড়ো ঘোড়াকে নিয়ে লেইজার-পিরিয়ড না, কান্ট্রি এক বোধ, হৃদয়ের অন্তর্গত স্বপ্নের ভেতর, খেলা করে। তবে, ক্লান্ত করে না। তীব্র প্রেম, বিচ্ছেদ। ট্যামি ওয়েনেটের চোখের জল নেশার মতো আবহ তৈরি করে দিচ্ছে মিসিসিপি বা টেনেসির স্টেজে— ‘আওয়ার ডিভোর্স বিকামস ফাইনাল টুডে…’ ট্যামির চোখে-মুখে আরেক দিকপাল কান্ট্রি গায়ক জর্জ জোন্সের মুখ, ডিভোর্সের প্রতিটি অক্ষর বানান করতে করতে ঈষৎ দোলেন ট্যামি— ‘ডি আই ভি ও আর সি ই …’। ব্যক্তিগত সত্তায় ঢুকে পড়ে বিচ্ছেদ, মৃত সংসার ইত্যাদি। মনে করায় খোদ জিম রিভসের ব্যারিটোনে সেইসব কথাগুলো— ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট মাই হোম/ আই অ্যাম জাস্ট আ পাসিং থ্রু …’
কীভাবে কান্ট্রি এত কাছাকাছি হয়ে গেছিল আমাদের? ১৯২০-র হিলবিলি মিউজিক বা হঙ্কি-টঙ্ক থেকে পরে স্থায়ীভাবে কান্ট্রি হয়ে যাওয়ার রাস্তায় প্রথম হিট রেকর্ড হিসেবে ধরা হয় জন কার্সনের ‘লিটল ওল্ড লগ কেবিন ইন দ্য লেন’কে। যে-নৈকট্যের কথা বলছিলাম, সাগর পেরিয়ে আমাদের নাইন্টিজে বাংলা গানের ঝুঁটি ধরে ঘোরানো গৌতম-সুমনের কলকাতা এমনকী খোদ মফস্সল কীভাবে তাদের কলেজ-শুরুয়াতে কান্ট্রিকে কাছে টেনে নিল, তার জবরদস্ত উত্তর পেয়ে যাই হ্যাঙ্ক উইলিয়ামসের কথায়— ‘Folk music is sincere. There ain’t nothin’ phony about it. When a folk singer sings a sad song, he’s sad. He means it. The tunes are simple and easy to remember, and they’re sincere with them… I judge a song by its lyrics. A song ain’t nothin’ in the world but a story just wrote with music to it.’ মনে পড়ল তিরিশ ছোঁয়ার আগেই অস্বাভাবিকম ভাবে একদিন চলে গেছিলেন সেই হ্যাঙ্ক উইলিয়ামস। যাওয়ার আগের মাসে হ্যাঙ্কের শেষ কান্ট্রি টিউন— ‘নো ম্যাটার হাউ আই স্ট্রাগল অ্যান্ড স্ট্রাইভ/আই’ল নেভার গেট আউট অফ দিস ওয়ার্ল্ড অ্যালাইভ…’
আসলে সত্যিটা এটাই, ডেনভার-রিভস-জর্জ স্ট্রেটদের কোনওদিনই খুব দূরের বিজাতীয় কিছু মানুষ হিসেবে কখনওই মনে করিনি আমরা। আমাদের নিজস্ব বিবাহ-বিচ্ছেদ, বিট্রেয়াল বা প্রেম ভাঙার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ড্যান সিলসের গিটার— ‘অ্যাজ ফর মি অ্যান্ড লিটল কেসি, উই স্টিল মেক দ্য সার্কিট/ ইন আ ওয়ান হর্স ট্রেলার অ্যান্ড আ মোবাইল হোম…’। আমাদের ‘ধরা যাক আজ রোববার কোনও কাজ নেই’ লেগ্যাসির ভেতর বড় হন সাদা দাড়ির রোম্যান্টিক মুখের একজন ক্রিস ক্রিস্টোফারসন— ‘অন দ্য সানডে মর্নিং সাইডওয়াক/ উইশিং লর্ড, দ্যাট আই ওয়াজ স্টোনড/ বিকজ দেয়ার’স সামথিং ইন আ সানডে/ মেকস ইয়োর বডি ফিল অ্যালোন…’। নিরাপত্তাহীনতা আর ক্রুড রিয়েল লোনলিনেসে বড় হওয়া আমাদের নাইন্টিজ স্মৃতি চট করে রিয়েল এস্টেটে ঢুকে পড়ে হাঁসফাঁস করে, আমরা প্রেমকে বিশ্বাস করি না, একটা গ্লেন ক্যাম্পবেল হয়ে নীল সোফাসেটে ধাক্কা খায় আমাদের জ্বালাগুলো, অবিশ্বাসগুলো— ‘রাইডিং আউট অন আ হর্স ইন আ স্টার-স্প্যাংগ্লড রোডিও/ গেটিং কার্ডস অ্যান্ড লেটার্স ফ্রম পিপল আই ডোন্ট ইভেন নো…’। আমাদের না-হওয়া বাঞ্জি জাম্পিং, রোপ-ওয়াকিং, সুইসাইডাল বোধগুলো কখনও ‘ধূসর নীলাভ একতারা’, কখনও নীল মৃদু আলোর একটা ক্যাসিনোয় অকপট সত্যি কথা বলে দেয় ফ্রেঞ্চকাট স্মিত হাসির কেনি রজার্সের ব্যারিটোনে— ‘বিকজ এভরি হ্যান্ড’স আ উইনার/ অ্যান্ড এভরি হ্যান্ড’স আ লুজার/ অ্যান্ড দ্য বেস্ট দ্যাট ইউ ক্যান হোপ ফর/ ইজ টু ডাই ইন ইওর স্লিপ…’। তারপর যখন কনওয়ে টুইটি কিছুটা কথা ছুড়ে দেওয়ার স্টাইলে গেয়েছেন ‘হ্যালো ডার্লিং’, বলেছেন— ‘হোয়াটস দ্যাট ডার্লিং/ হাউ অ্যাম আই ডুইং…’ আর আমরা, বাকিটা ওঁর হয়ে ধরেছি পুরনো গ্রামাফোনে, ক্যাসেট প্লেয়ারে— ‘আই অ্যাম ডুইং অলরাইট এক্সেপ্ট আই কান্ট স্লিপ/ অ্যান্ড আই ক্রাই অল নাইট টিল ডন…’
বোহেমিয়ান, যেদিকে দু’চোখ কান্ট্রির ভেতর কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে একটা ভীষণ ভালমানুষি, ততটা স্মার্ট না এমন একটা আমি-তুমি-সে ছেলে, যে প্রেমিকা-চাকরি-ড্রিম সিকোয়েন্স খুইয়ে দিনগত পাপক্ষয়ের ভেতর একটা গানের প্ল্যাটফর্ম পেয়ে সেখানেই দিনরাত আস্তানা গেঁড়ে বসে আছে। আমাদের ম্যাজিক-ওয়ান্ড তখন ষাট পেরোনো মার্লে হ্যাগার্ডের গিটারে আশ্চর্য প্রদীপ জ্বালায়, আমরা আমাদের কথা খুঁজে পাই— ‘উই স্টিল ওয়েভ ওল্ড গ্লোরি ডাউন অ্যাট দ্য কোর্টহাউস/ অ্যান্ড হোয়াইট লাইটনিং’স স্টিল দ্য বিগেস্ট থ্রিল অফ অল…’। আমাদের বড্ড সাধারণ প্রেমের গল্পগুলো, পাশের বাড়ির জানলার মেয়েটির মুখ, ছেলেটির ঘাম আউটল’ কান্ট্রি মুভমেন্টের নায়ক ওয়েলন জেনিংসের কথায় সামনে এক আয়না ধরে— ‘আ গুড-হার্টেড ওম্যান লাভিং হার গুড-টাইমিং ম্যান…’। আমাদের যৌথ সত্তার কো-এড সাংগীতিক অ্যালবামের এক পিঠেই সুমনের ‘কেমন আছ হে কলকাতা’-র পর ঢুকিয়ে দিই উইলি নেলসনের ‘গুড মর্নিং আমেরিকা, হাউ আর ইউ’ বা জর্জ স্ট্রেটের অ্যামারিল্লোর টেক্সাসের নীল আকাশ— ‘হোয়েন দ্যাট সান ইজ হাই/ ইন দ্যাট টেক্সাস স্কাই/ আই’ল বি বাকিং অ্যাট দ্য কান্ট্রি ফেয়ার’। মাঝগঙ্গার স্টিমারের জেট, যমুনার কালো জল তখন তিরতিরে শেনানডোয়া নদী, আমাদের উইকেন্ডের ট্রিপ যেন রকি পাহাড়ের বরফ, জড়িয়ে ধরা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গাছ। এসব, সব কিছুই তখন আমাদের, আমাদের দেশের রাস্তা, আমাদের কান্ট্রি রোডস। ‘টু দ্য প্লেস, আই বিলং…’। একটা লাল টি-শার্ট পরা অলিভিয়া নিউটন জন কোমর দুলিয়ে আমাদের ভেতরের ততটা যৌনতা না ঢোকা লাভ-ইনফ্যাচুয়েশনের ব্যারিয়ারে লুকিয়ে থাকা আদুরে প্রেমটাকেই উস্কে দেন ভীষণ, আমরা গাই— ‘হোয়্যারেভার ইউ গো/ হোয়্যারেভার ইউ মে ওয়ান্ডার ইন ইওর লাইফ/ সিওরলি ইউ নো আই ওয়ানা বি দেয়ার…’। একটা সময় সেই ভালবাসা চলে যায়, কারও আবার আসে, কারও আসে না। আমরা একা হই না, কারণ ক্যাসেট প্লেয়ার আমাদের একলা মনে টিউনিং করা অ্যালান জ্যাকসন চিনিয়েছে, শিখিয়েছে— ‘ইউ ওয়্যার দ্য ফার্স্ট, সো ওয়াজ আই, উই মেড লাভ অ্যান্ড দেন ইউ ক্রায়েড/ রিমেমবার হোয়েন…’। বড় হয়ে, তীব্র সংসারী, তীব্র কেরিয়ারিস্টিক, তীব্র আপসকামী আফটারলাইফে আমাদের সেইসব মিষ্টি প্রেমের ঘর নিজস্ব ছাদ খুঁজে নিয়েছে জর্জ জোন্সের কণ্ঠে— ‘হি স্টপড লাভিং হার টুডে/ দে প্লেসড আ রেথ আপন হিজ ডোর/ অ্যান্ড সুন দে উইল ক্যারি হিম অ্যাওয়ে/ হি স্টপড লাভিং হার টুডে…’। আমরা প্যাথোজ চিনি, চিনি বিষাদ। থার্মোমিটার এগিয়ে দেওয়া, অগোছালো টি-শার্ট ব্যস্ত সময়ে ধরিয়ে দেওয়া ক্লান্ত, চোখে না পড়া মুখ তখন ‘কে মোরে ফিরাবে অনাদরে, কে মোরে ডাকিবে কাছে’র লেগ্যাসির মতো অদ্ভুত মায়া মেশানো গলায় ডন উইলিয়ামসের মতো করে ভাবায়— ‘ইউ আর মাই ব্রেড হোয়েন আই অ্যাম হাংগ্রি/ ইউ আর মাই শেল্টার ফ্রম ট্রাবলড উইন্ডস…’। আমাদের ইচ্ছে হয় ঘরের সব পর্দা যেন হাওয়ায় দোলে, দুজনের অফিস ফেরত একটা বিয়ার-চুমুক নাচের মতো আমাদের স্মৃতি-সত্তার প্রেম যেন দেখে ফেলে গোটা পাড়া, গোটা পৃথিবী। আমাদের মনে পড়ে গার্থ ব্রুকস— ‘আওয়ার লাইভস আর বেটার লেফট টু চান্স/ আই কুড হ্যাভ মিসড দ্য পেইন/ বাট আই’ড হ্যাভ হ্যাড টু মিস দ্য ডান্স…’
এইসব পেরিয়ে কোথা হইতে কী হইয়া গেল ধরনের একটা হাইফেন তৈরি হয়ে যায়। আমরা কাগজ ওলটাই। এক বছরের মধ্যে টুপটাপ করে মরে যান মার্লে হ্যাগার্ড, গ্লেন ক্যাম্পবেল, ডন উইলিয়ামস। আমাদের জানতে সময় লেগে যায় কখনও এক বছর, কখনও দুই, কখনও জানিই না সেইসব নায়কের এখন কে কে বেঁচে, আদৌ কতজন বেঁচে আছেন। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা একটা বোধ মাঝবয়েসি একঘেয়ে পিচ বা সাংসারিক দেওয়ালপোকার ভিড়ে আমাদের ততটা কোমর দোলাতে আর দেয় না। ওই, গার্থ ব্রুকসের ‘মিস দ্য ডান্স’-এর মতো আমরা সেই উদ্দাম নাচটাকে মিস করি বড্ড, টানা বৃষ্টির ভেতর হারানো রোদের মতো আমাদের সেইসব গানের লিরিক মনে করতে কষ্ট হয় খুব, একটা সময় পারি না আর। সোশ্যাল মিডিয়া, আন্তর্জালে বড্ড বহুমুখী, ওপর-ওপর ভাল লাগায় কোথাও একা হয়ে যায় কান্ট্রির মুখগুলো, গানগুলো, কথাগুলো। গ্লোবের উল্টোদিকে থাকা অজ়ি কান্ট্রি গায়ক জন উইলিয়ামসনের ‘ট্রু ব্লু’ আমাদের সেইসব বিস্মৃতিতে চোখের জল হয়ে ক্রুনিং করে— ‘ডোন্ট সে ইউ হ্যাভ গন/ সে ইউ হ্যাভ নকড অফ ফর আ স্মোক/ অ্যান্ড ইউ’ল বি ব্যাক লেটার অন…।
তারপর আমাদের সহজ উত্তর, নিষ্পাপ স্বীকারোক্তিগুলো লাল চোখে বুড়ো উইলি নেলসনের মতো স্টেজে ওঠে— ‘ইফ আই মেড ইউ ফিল সেকেন্ড বেস্ট/ গার্ল আই অ্যাম সরি আই ওয়াজ ব্লাইন্ড/ ইউ ওয়্যার অলওয়েজ অন মাই মাইন্ড/ ইউ ওয়্যার অলওয়েজ অন মাই মাইন্ড…’
কান্ট্রি হারায় না। কান্ট্রি হারাতে পারে না…
কভারের ছবি: ফোলসম কারাগারে গান গাইছেন জনি ক্যাশ
চিত্রগ্রাহক: জিম মার্শাল