এ-বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ঈশান ঘোষের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ‘ঝিল্লি’-কে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয়। ছবির বিষয় ছিল কলকাতার ধাপা অঞ্চল ও সেখানকার মানুষজনের জীবন। সেই ছবি নিয়েই পরিচালকের সঙ্গে কথা বললেন পৃথ্বী বসু।
প্রথম ছবি করতে এসে ধাপা অঞ্চলের মানুষজনকে নিয়ে ছবি করা এবং তার মধ্যে একটা সামাজিক টানাপড়েনকে তুলে ধরার ভাবনাটা কাজ করল কেন?
এর একটা ছোট ইতিহাস আছে। ২০১১ সালে আমি বাবার সঙ্গে ক্যামেরা অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করা শুরু করেছিলাম এবং এই কাজটা আমায় চার-পাঁচ বছর ধরে করতে হয়। ২০১৫-’১৬ সাল নাগাদ আমি নিজে কয়েকটা ডকুমেন্টারি শুট করি। সেই সময়ই ২০১৬ সালের শেষে আমি আর আমার দিদি একটা এনজিও-র জন্য ময়লাকুড়ুনিদের নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি শুট করার প্রস্তাব পাই। অনেক মাস ধরে আমরা তিলজলায় শুট করেছিলাম। তখন ওদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছি। শেষপর্যন্ত কোনও একটা আইনি সমস্যা থাকায় ডকুমেন্টারির কাজটা শেষ হয় না। মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়। আমার খুবই খারাপ লেগেছিল। ভেবেছিলাম, ওদের জীবনটা কোথাও অন্তত ধরা পড়বে! মানুষজন তো আর ওই জীবনটা জানে না! কিন্তু সেটা আর হল না।
তবে, সেই সময় থেকেই আমার মনে হতে থাকে, এই দুনিয়াটাকে আরও ভাল করে চিনতে হবে। জানতে হবে। কারণ আমি বড় হয়েছি অন্যভাবে। এই জগতটা সম্পর্কে কিছুই জানি না। নিজের সুরক্ষিত ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে শহরের যে এতগুলো স্তর রয়েছে, সেগুলো চেনা খুব জরুরি বলে মনে হত। তাদের গল্প যদি আমরা না খুঁজে বের করতে পারি, হয়তো সেগুলো আর কোনওদিন বলাই হবে না। তখনই অবশ্য আমাকে একজন বলছিল, সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন প্রতিনিধি হয়ে প্রান্তিক মানুষের গল্প নিয়ে সিনেমা বানানোর আদৌ দরকার ছিল কি না! আমি তখন বলেছিলাম যে, ধাপার একজন শ্রমিক সারাদিন খেটেখুটে নিজেদের জীবনযাত্রা নিয়ে একটা সিনেমা বানানোর সুযোগ পাবে, এটা আমি আশা বা বিশ্বাস করি না। ফলে তাদের গল্পটা কাউকে-না-কাউকে বলতেই হবে! একজন চিত্র-পরিচালকের এটা একটা অন্যতম দায়িত্ব বলেই আমার মনে হয়। এই ভাবনাটা থেকেই ‘ঝিল্লি’ করার কথা ভেবেছিলাম।
‘ঝিল্লি’ একটা অন্ধকার জায়গা থেকে শুরু হয়ে আবার একটা অন্ধকারেই মিশে গিয়ে যেন বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। মাঝখানে কিছু স্বপ্নকে আমরা ঘুরপাক খেতে দেখি, যদিও তা বাস্তবায়িত হয় না। অন্য কোনও আশার দিক দেখিয়ে ছবিটা শেষ করতে ইচ্ছে করেনি?
ধরো, এই মুহূর্তে যদি আমি একটা ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়াই এবং যে-কোনও একটা লোককে ফলো করা শুরু করি, তার জীবনটাকে ক্যামেরাবন্দি করা শুরু করি— সেটা যেরকম হবে, আমার সিনেমাটাও সেরকম। আমি ভেবেছিলাম, ক্যামেরাটা জাস্ট ওদেরকে ফলো করবে আর ওরা সারাদিন কী করে সেটাকে তুলে ধরবে। এই ছবিতে যেহেতু সেই অর্থে কোনও প্লট নেই, তাই আশাবাদের বিষয়টা নিয়ে সেভাবে ভাবিইনি। ওই অঞ্চলের মানুষজনের আবেগ-অনুভূতির জার্নিটা শুধু দেখাতে চেষ্টা করেছি। ওদের ধৈর্যশক্তি, ওদের কমিটমেন্ট, আনন্দ— এই সব কিছু। যতটা পারা সম্ভব হয়েছে আর কি! আর এটাও খুব সত্যি কথা, ওদের ব্যাকগ্রাউন্ডটাই এমন, নিজেদের ভেতরে যে স্বপ্নগুলো ওরা লালন করে, সেগুলো শোনার কেউ থাকে না। শেষে গিয়ে সেগুলো নষ্ট হতে বাধ্য হয়। ছবির শেষটাও অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যেমন ছবিতে পার্কটা তৈরি হয়ে গেছে, এটা দেখানো হয়েছে। ওটা সত্যিই হয়ে গেছিল। ২০১৯ সালের শেষে হাড়-কারখানাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শেষ দৃশ্যটা আমরা ওখানে গিয়ে শুট করি। বকুল যে ওখানে দৌড়য়— এটা এভাবে ভাবা যেতে পারে— হয়তো ওর মানসিক সুস্থতা হারিয়ে গেছে বলেই ও জীবনের একটা শান্তি খুঁজে পেয়েছে। সমাজের কাছ থেকে এই মানুষগুলো এতটাই ধাক্কা খেয়ে এসেছে ক্রমাগত, আমার মনে হয়েছিল, মানসিক ভারসাম্য হারানোর মধ্যে দিয়েই বকুলের শান্তি পাওয়ার জায়গাটা দেখানো যেতে পারে! এটা আমার মত বললাম।
ইংরেজিতে এই ছবির নাম Discards, বাংলায় ‘ঝিল্লি’— ‘ঝিল্লি’ শব্দের কি আলাদা কোনও অর্থ আছে?
হ্যাঁ। ধাপায় যে হাড়-কারখানাটা আছে, সেখানে প্রথমে সমস্ত পশুর কঙ্কালগুলো জড়ো করা হয়। তারপরে ওই কঙ্কালগুলো থেকে হাড়গুলোকে আলাদা করে ওখানকার লোকেরা মেশিনে ফেলে। সেইখানে বাকি কাজটা হয়। মানে, হাড়েরও যে-অংশগুলো কাজে লাগে না, সেগুলো আলাদা করে নিয়ে শেষে হাড়গুলো গুঁড়ো করে সেটা কাজে লাগানো হয়। মূলত ওষুধ তৈরির কাজে লাগে। আর বাকি যে-অংশটা ফেলে দেওয়া হল, অর্থাৎ ছাঁটটা, সেটাকেই ‘ঝিল্লি’ বলে।
এই ছবিতে যাঁরা অভিনয় করেছেন, সে-অর্থে তাঁরা কেউই পেশাদার অভিনেতা নন। প্রথম ছবি করতে এসে খ্যাতনামা কাউকে নেওয়ার কথা মনে হয়নি?
একেবারেই না। এই ছবির যে পরিবেশ আর চরিত্রদের আমি আমার ছবিতে ধরতে চেয়েছিলাম, আমার মনে হয়েছিল, এমন কয়েকজন বাস্তব চরিত্র খোঁজা দরকার যারা এটাকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে। যাদের জীবনের অভিজ্ঞতা ওখানকার মানুষজনের অভিজ্ঞতার খুব কাছাকাছি। যেরকম শম্ভুদা, উনি ৩০-৩৫ বছর ধরে নাটকের কাজ করেন, অনেক ফিল্মে ক্যামিওর কাজও করেছেন। বাগবাজারে একটা ছোট ঘরে থাকেন। সারাজীবন ধরে অনেক লড়াই করতে হয়েছে ওঁকে। আমি এইরকমই চরিত্র খুঁজছিলাম। বকুল যে করেছে, অরণ্য গুপ্ত, সে আমার বন্ধুর ছোট ভাই। ছোটবেলা থেকেই ওকে চিনি। ও ছবি আঁকে। ওর ছবি যদি তুমি দ্যাখো, সেখানে দেখবে একটা অন্ধকার জগতের প্রতি ওর আকর্ষণ রয়েছে। এমনিতেও মানুষ হিসেবেও ও খুব সরল। কোনও ঝামেলা নেই ওকে নিয়ে। আমার মনে হয়েছিল, ও যদি অভিনয় করে খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই করবে। মানে, ওইরকম প্রতিকূল জায়গায় কোনও সমস্যায় পড়তে হবে না। সমস্তটাই খেলাচ্ছলে করে দেবে। এছাড়া গণেশের চরিত্রে বিতান বিশ্বাস অভিনয় করেছে। ওর এটা দ্বিতীয় ছবি। যে চম্পার ভূমিকায় ছিল, সৌরভ, সে এমনিতে নাটক করে। মোট কথা, সবাই নতুন হলেও ওদের মধ্যে একটা প্যাশন রয়েছে অভিনয় করার, সেটাই হয়তো এই ছবিটাকে এতটা স্বতঃস্ফূর্ত করে তুলতে পেরেছে!
নতুন পরিচালক হিসেবে নতুনদের নিয়ে কাজ করা কতটা চ্যালেঞ্জিং? ভাল-খারাপ দুটো দিকই জানতে চাইছি।
খারাপ দিকটা একটাই, সেটা হচ্ছে ডিসিপ্লিনের অভাব (হাসি)। মানে ধরো, পেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীর যেরকম ডিসিপ্লিন থাকে, এই সময় ঘুম থেকে উঠে পড়তে হবে, এই সময়ে শুটিং-এ যেতে হবে— সেইটা কারোরই ছিল না। ফলে এইটা নিয়ে খুব ভুগতে হয়েছে। আমাদের তো কোনও প্রোডাকশন টিম ছিল না, পুরোটাই নিজেদের। ফলে সবাইকে একজায়গায় নিয়ে এসে ম্যানেজ করাটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। বিতান একমাত্র এদের মধ্যে ডিসিপ্লিনড। আমরা কী করতাম, একদম সকালে চলে যেতাম ধাপায় আর সারাদিন ধরে শুট করতাম। ফর্ম্যাল কোনও স্ক্রিপ্টও ছিল না। আমরা একটা সিচুয়েশন আর একটা সিকোয়েন্স ভেবে নিতাম শুরুতে। তারপর একটা শুধু কিউ দিয়ে দিলেই বাকিটা ওরা নিজেদের মতো করে যেত। আমি সেগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুট করে যেতাম। আর নতুনদের সঙ্গে কাজ করার সবচেয়ে ভাল দিকটা হল, আমরা গোটা কাজটাই করেছি একটা বন্ধুত্বের জায়গা থেকে। এই ছবিটা নিয়ে কারোরই কোনও প্রত্যাশা ছিল না আমাদের।
এই চরিত্রগুলোকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া?
অরণ্য গুপ্ত-র কথা তো বললামই, আমার বন্ধুর ভাই। শম্ভুদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি বাবার সূত্রে। শুটিং-এ চলে আসতেন। তাছাড়া ক্যামিওর কাজ তো করতেনই। ফলে যোগাযোগটা ছিল। বিতানকে আমি পাই আমার দিদির সূত্রে। দিদি নতুন অভিনেতা-পরিচালকদের নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ করত, যেখানে আমি বিতানকে প্রথম দেখি ২০১৩ সালে। সেখানে দেখেই আমার মনে হয়েছিল ওর মধ্যে একটা আলাদা কিছু আছে। এই ছবি করার সময় যেজন্য ওকে ডাকি। সৌরভকে অডিশনের মাধ্যমে পাই। আর গুড্ডু তো আমারই ভাই!
অন্য একটা জীবনযাত্রা সিনেমায় খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দেখাতে গেলে, ওই জীবনযাত্রাটা পরিচালকের নখদর্পণে থাকতে হয়। নাহলে মেকি লাগে। এখানে যেহেতু সেটা হয়নি, প্রস্ততিপর্বর শুরুর দিনগুলোর কথা জানতে ইচ্ছে করছে।
একজন পরিচালক যে-কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই আসতে পারেন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বোধহয় এটাই, সবরকম মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা। এটা একটা ফুল টাইম কমিটমেন্ট। সিনেমাটা তো শুধুমাত্র একটা বিখ্যাত হওয়ার মাধ্যম নয়। শুধু সেলিব্রিটি হওয়ার জন্য সিনেমা করার কোনও মানেই হয় না। সবসময়ের জন্য এর মধ্যে থাকতে হয়। আর আমি মনে করি, এটা মানুষের সঙ্গে না মিশলে হয় না। অনেক ডকুমেন্টারি শুট করতে গিয়ে আমার এই সুযোগটা হয়েছিল। ধরো, আমরা যখন ধাপায় যেতাম, আমাদের তো অন্যরকম একটা জীবনযাপন, কিন্তু ওখানকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে-বলে আমরা ওদের নিজেদের বন্ধুর মতো হয়ে যাই। প্রত্যেকের জীবন জেনেছিলাম। বাচ্চাগুলোর সঙ্গে খেলতাম রোজ বিকেলে। ফলে একটা বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়ে গেছিল। অদ্ভুত ভালবাসা পেয়েছি ওদের কাছ থেকে। যেরকম, কারখানায় যখন অরণ্যকে নিয়ে শুট করেছি, তখন কিন্তু শ্রমিকরা কাজই করছিল, দেখে মনে হবে আমি বলেছি বলে করছে। অরণ্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওদের সঙ্গে কাজ করত। এই না যে, আমি একটা কি দুটো শট নিয়ে ছেড়ে দিলাম। ফলে এতটা শারীরিক ভাবে যুক্ত হওয়ার ফলে ওরাও বুঝল যে, আরে, এরাও তো পরিশ্রম করছে আমাদের সঙ্গে! সেখান থেকে আপনাআপনিই একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়ে যায়। ধাপায় আমি যদি একটা প্রোডাকশন টিম নিয়ে যাই, তাহলে কি আর আমাদের মধ্যে দূরত্বটা ঘুচবে? ঘুচবে না। একটা অদ্ভুত আয়রনি তৈরি হবে তখন। ওদের মনে হতে বাধ্য যে, আমরা ওদের ব্যবহার করছি।
সিনেমার চরিত্রদের যে কার্যকলাপ, সেগুলো কি একদম বাস্তব থেকে নির্মিত না কি খানিকটা কল্পনা মিশে রয়েছে?
যখন ওরা কারখানায় কাজ করত, সেটা তো বাকিদের মতো করেই করত। ফলে সেটা একদমই বাস্তব। কিন্তু যখন ওরা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যা যা আচরণ করেছে, কিংবা অন্যান্য দৃশ্যগুলো— সেগুলো আমার মনমতো তৈরি করেছি। নাহলে ওরা কী করছে, শুধু এটুকুই যদি দেখিয়ে যেতাম, তাহলে তো একটা ডকুমেন্টারি হয়ে যেত, তাই না? সিনেমা করে তোলার জন্য কিছু-কিছু নাটকীয় উপাদান আমি ঢুকিয়েছি। একটা উদাহরণ দিই, এয়ারপোর্ট যেহেতু খুব কাছে, ফলে সারাক্ষণ প্লেন যেত মাথার উপর দিয়ে। আমরা কী করতাম, প্লেন গেলেই সেটা শুট করে নিতাম। তারপর এডিটিং-এ দেখলাম এর অনেক রকম মানে তৈরি হচ্ছে। অনেকে অনেক রকম ভাবে ব্যাখ্যা করছে। এইরকম আর কি!
‘ঝিল্লি’ শুট করতে কতদিন সময় লেগেছে?
সব মিলিয়ে শুট করেছি ৩০ থেকে ৩৫ দিন। কিন্তু অনেক দিন বাদে-বাদে। ২০১৭ সালের শুরুতে কিছুটা করেছিলাম, তারপর আবার বর্ষাকালে কিছুটা করি। আবার ২০১৮ সালের শুরুতে কিছুটা। তারপর ব্যস্ততার কারণে অনেকদিন শুট করা হয়নি। শেষ শুট করি, ২০১৯ সালের সালের অক্টোবর মাসে। আর ওইরকম কোনও প্ল্যান করেও অনেক সময় শুট করিনি আমরা। একদিন হয়তো সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, আমি অরণ্যকে ফোন করে বললাম, চল আজকে একটা দৃশ্য শুট করে আসি। এইভাবে মাঝে মাঝে শুট করতাম। এরকমও হয়েছে, এমন অনেক জায়গায় গিয়ে আমরা শুট করে এসেছি, যেখানে যাওয়াই বারণ। শুট করে ফিরে আসছি, হঠাৎ দেখি পুলিশ! এইরকম মজার সব ঘটনা ঘটত।
নতুন যাঁরা ছবি করতে আসছেন, আপনার কি মনে হয় না যে তাঁদের যদি আরেকটু স্বাধীনতা দেওয়া হত তাহলে তাঁরা আরেকটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারতেন?
অবশ্যই সেটা মনে হয়। কেননা, নিজেকে দিয়ে বলতে পারি, আমার ক্ষেত্রে এই পুরো সময়টাই ছিল শেখার। এখন আমার কাছে হয়তো ছবি বানানোটা একটু সহজ হয়ে গেছে, কিন্তু আমি যখন সিনেমা বানানো শুরু করি, তখন সাউন্ড, পোস্ট-প্রোডাকশন, এসব কিছুই জানতাম না। ফলে পুরোটা আমাকে একটু-একটু করে শিখতে হয়েছে। এখন ভাবলে মনে হয়, দু’বছর আগে হয়তো আমি ছবিটা শেষও করতে পারতাম না। আমার মনে হয়, সিনেমা বানাতে এসে প্রথম কাজটা এইসব বাধামুক্ত হয়ে করা উচিত। সেটা শর্টফিল্মও হতে পারে; যেখানে আমি আমার কাজটা নিজের মতো করে দেখাতে পারব। কারণ, প্রথমেই যদি আমি কাউকে বলতাম ফান্ডিং-এর কথা, কেউ শুনতই না। যদি-বা কেউ প্রযোজনা করতেনও, সেখানে আমাকে অনেক কিছু মেনে নিতে হত, যেটা আদৌ আমার ভাবনা না। বাংলা ছবির পরিচালকদের সমস্যা হচ্ছে, তাঁদের ধৈর্যটা কম। সবসময় তাঁদের মনে হয়, আমাদের নামটা সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকতে হবে। ফলে দু’তিন বছর ধরে খেটে যে একটা ভাল ছবি তৈরি করা, সেই জায়গাটা কোথাও চলে যাচ্ছে বলে আমার মনে হয়। যে-কারণে এক বছরের মধ্যে একজন পরিচালক এতগুলো কাজ করে ফেলছেন!
নতুন বাঙালি পরিচালক হিসেবে সাম্প্রতিক বাংলা ছবি নিয়ে কী মনে হয়?
কলকাতা যেহেতু একটা বড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, ফলে এর অনেক দায় আছে। ধরো, এই ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে অনেক লোকের সংসার চলে। ফলে এটা থাকবেই। এবং এর ফলে মূলধারার যেরকম ছবি হয়ে চলেছে, সেটাও হবেই। তবে আমার মনে হয়, এর পাশাপাশি যাঁরা একটু অন্যরকম ছবি করতে চান, তাঁদের আরও ভাল কাজ করা উচিত, যাতে এই মূল ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে একটা সমান্তরাল ধারারও রাস্তা খোলা থাকে। সেটা তিন-চার বছর পর পর একটা ভাল ছবি নয় কিন্তু, ধারাবাহিক ভাবে করে যেতে হবে। একমাত্র তাহলেই বাংলায় আরও অন্যরকম ছবির একটা ক্ষেত্র তৈরি হবে বলে আমার বিশ্বাস। এমনিতে ট্যালেন্টের তো কোনও অভাব নেই, কিন্তু তারা সেইভাবে সুযোগটা পাচ্ছে না!
‘ঝিল্লি’ প্রযোজনা করেছেন শ্রীগৌতম ঘোষ। এটা অবশ্যই একটা বাড়তি পাওনা। আপনার ছবি করার পিছনে বাবা হিসেবে ওঁর ভূমিকার কথা যদি বলেন।
বাবা আমাদের ছোটবেলা থেকেই শেখাত যে, যে-কাজটাই করি না কেন, সেটা যেন খেটে শিখি। আর এটা কমবেশি সবাই জানে, গৌতম ঘোষ কাজের ক্ষেত্রে একেবারেই পক্ষপাতদুষ্ট নন। ফলে আমি যখন হঠাৎই ক্যামেরার কাজ শুরু করি ২০১১ সালে, সে-সময়ে তিন-চার বছর একদম বাবার সঙ্গে থেকে-থেকে কাজটা নিজেকে শিখতে হয়েছিল। এটা আমার উপকারই করেছে। আর এই ছবিটা যখন শুরু করি, তখন আসলে কেউই জানত না ছবিটার ব্যাপারে। কিছু একটা করছি শুধু এটুকু টের পেত। সকালে বেরিয়ে আমরা রাত করে গায়ে কাদা মেখে, দুর্গন্ধ নিয়ে ফিরতাম। সবাই আমাদের এখানে এসেই তারপর স্নান-টান করে যে-যার বাড়ি যেত। এভাবে কিছুদিন শুট করার পর, ফুটেজগুলো একদিন বাবাকে দেখাই। তখন বাবার ভাল লাগে। তবে কখনও কোনও পরামর্শ দেয়নি। শুধু উৎসাহ দিয়ে যেত। শেষে যখন এডিট হয়ে যায়, তখন বাবাকে পুরোটা দেখাই এবং বাবা ‘ঝিল্লি’র প্রযোজক হিসেবে থাকতে রাজি হয়। এমনিতে তো শুট করতে তেমন খরচ ছিল না, যা খরচ লেগেছিল সেটা পোস্ট-প্রোডাকশনে!
‘ঝিল্লি’ এখনও পর্যন্ত দুটো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে। কলকাতার সিনেমা হলে মুক্তির কোনও পরিকল্পনা আছে?
হ্যাঁ। কয়েকটা দৃশ্য বাদ দিয়ে, সেনসার হয়ে গেছে। আমরা প্ল্যান করছি জুলাইতে যদি হল-এ দেখানো যায়!
প্রথম ছবিতেই সেরা মনোনীত হওয়া একদিকে যেমন আনন্দের, অন্যদিকে সবার প্রত্যাশা বাড়ার কারণে একটা বাড়তি চাপও তৈরি হয়— এই জায়গাটা কেমন লাগছে?
আসলে আলাদা করে কিছুই মনে হচ্ছে না। একটা জায়গাই ভাল লাগছে শুধু, আমি নিজেকে যেরকম ভাবছিলাম যে, যা করছি অনর্থক করছি, সেটা আর মনে হচ্ছে না। পুরস্কার তো একটা প্রতীকমাত্র! তবে এটাও আনন্দের কথা, এরকম ছবি পুরস্কৃত হওয়া মানে স্বাধীন চিত্র-পরিচালকদের কাছে একটা জোরের জায়গা। তারা কোনওদিনই আর হয়তো ভাববেন না যে, নিজের মতন করে ছবি করে গেলে কিছুই হওয়ার নেই!
আপনার পরবর্তী ছবি নিয়ে কিছু ভাবছেন?
এখনও গবেষণার স্তরে রয়েছে সেটা। কিছুদিন বিরতি নিয়েছিলাম মাঝে। স্ক্রিপ্ট পুরোটা শেষ হলে তারপর শুট শুরু করব হয়তো। এক্ষেত্রে মনে হয় আর পাঁচ বছর লাগবে না!
‘ঝিল্লি’ দেখতে গিয়ে ধাপা অঞ্চলের একটা দিক দেখতে পেয়েছি আমরা। এখন ওদের কী অবস্থা? আপনার সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
শেষ গেছিলাম আমি গত বছরে। ২০১৯ সালে তো কারখানাটা বন্ধই হয়ে যায়! কারখানাটা বেসরকারি ছিল। এটা তৈরি হয়েছিল স্বাধীনতার সময়ে। ওখানকার শ্রমিকেরা একটা অদ্ভুত আড়ালে কাজ করত। এখন হয়তো ওদের দালালরা অন্য কোথাও কোনও কাজ দিয়েছে— সেটা আমি ঠিক জানি না। এমনিতে ওখানে একটা পার্ক তৈরি হয়েছে আর কারখানার জায়গায় বিগ বাজারের গোডাউন করেছে। জুলাইতে ধাপার পিছনে যে বস্তি রয়েছে সেখানে একটা স্ক্রিনিং করার ইচ্ছে আছে আমার। দেখা যাক!
ছবি সৌজন্যে: ঈশান ঘোষ