মিটু ছবিছাবা
একটা সিনেমার নাম ‘ফ্রেশ’ (২০২২-এরই ছবি)। সেখানে একটা মেয়েকে তার প্রেমিক বাড়িতে নিয়ে গিয়ে, মদে ওষুধ মিশিয়ে অজ্ঞান করে দেয়। জ্ঞান ফিরতে মেয়ে দ্যাখে, তার হাত লোহার শিকলে বাঁধা। মেয়েটি বলে, তুমি কি আমাকে ধর্ষণ করবে? প্রেমিক বলে, আরে না না, আমি তোমার মাংস কেটে বিক্কিরি করব। বহু বড়লোক আছে, যারা তারিয়ে তারিয়ে নারীমাংস খায়। তবে, তোমায় এক্ষুনি খুন করব না, ওরা টাটকা মাংস চায় তো, তাই জিইয়ে রেখে যতটা পারা যায় আমরা কেটে কেটে নিই। মেয়েটি এক সময় বুঝতে পারে, তার পাশের দুটো কুঠুরিতেও মেয়ে বন্দি আছে। তাদের মাঝে মাঝে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, হাত বা পা কেটেকুটে ফেরত দেওয়া হয়। মেয়েটি একদিন বাথরুম যাওয়ার সময় ছেলেটিকে আক্রমণ করে, ছেলেটি তাকে মেরে অজ্ঞান করে দেয়, মেয়ে জেগে উঠে বোঝে একটা অপারেশনের টেবিলে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, কী করছ? প্রেমিক বলে, আমি তোমার নিতম্বটা নিয়ে নিচ্ছি। কিছুদিন পর মেয়েটি ছেলেটির সঙ্গে একরকম ভাল ব্যবহারই শুরু করে। একদিন জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, কেমন খেতে? ছেলেটি বলে, চলো, ডিনারে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। খাওয়ার টেবিলে ছেলেটি তার দিকে এগিয়ে দেয় রান্না করা মানুষের মাংসের প্লেট। মেয়েটি বলে, এটা কি আমি? ছেলেটি বলে, না না, অন্য মেয়ে। তারপর বিভিন্ন পদ (মাংসেরই) খাওয়া হয়, গল্পটল্প হয়। এর মধ্যে মেয়েটির বান্ধবী তাকে খুঁজতে খুঁজতে বহু গোয়েন্দাগিরির পরে হাজির হয় ছেলেটির বাড়িতে, সেখানে ছেলেটির বউ তাকে ঘায়েল করে এবং সে এখানেই অন্য কুঠুরিতে বন্দি হয়। তাকেও টেবিলে শুইয়ে কর্তন হয়। পরেরদিন আবার ডিনার, এবার প্রথমে লিভার দিয়ে ভোজ শুরু হয়। ছেলেটি কথায় কথায় বলে, এই যে নিজেকে দিয়ে দেওয়া, একেবারে আরেকজনের দেহে লীন হয়ে যাওয়া, তারই এক অংশ হয়ে যাওয়া, এর মধ্যে আশ্চর্য সমর্পণ আছে, মেয়েরা অনেকে বোঝে না। এরপর ছেলেটি মেয়েটিকে খেতে দেয় স্তনের মাংস, বলে, খেয়ে দ্যাখো, চেনাও লাগতে পারে। মেয়েটি হেসে বলে, স্তনটাই শেষপাতের জন্যে রেখেছিলে? তারপর কেঁদে ফ্যালে। ছেলেটি সান্ত্বনা দেয়, ধীরে ধীরে চুমু হয়। তারপর গান চালিয়ে নাচ, তারপর শয্যা-গমন। ছেলেটিকে শুইয়ে মেযেটি আদর শুরু করে। এবং ছেলেটির দু’পায়ের মাঝে মুখ দিয়ে, কামড়ে পুরুষাঙ্গ ছিঁড়ে নেয়। ছেলেটি কাতরায়, পরে তাড়া করে আসে, ততক্ষণে মেয়েটি মুক্ত করেছে তার পাশের কুঠুরির এক হাত ও এক পা হারানো মেয়েটিকে, এবং তার পাশের কুঠুরি থেকে বান্ধবীকে (তার একটি স্তন খোয়া গেছে), তারপর পালানোর চেষ্টা হয়। ছেলেটিও পিস্তল হাতে বেরিয়ে আসে। মেয়েটি ও বান্ধবী মিলে ছেলেটিকে খুন করে। এক সময় উপস্থিত হয় ছেলেটির বউ এবং এক সহকারী। বউটিকে খুন করে মেয়েটির বান্ধবী। বলে, এই তোমাদের জন্যেই এরা এত বাড় বেড়ে যায়। ছবি শেষ হয়।
খুব সহজেই বোঝা যায়, নারীকে ভোগের মাংস হিসেবে দেখার একটি আক্ষরিক অনুবাদ সম্পন্ন হয়েছে ছবিটায়। যারা শুধু ভোগ্যবস্তু হিসেবে দ্যাখে, তারা নারীকে শিকলে বন্দি করে রাখে, কখনও তা প্রেমের শিকলও হতে পারে। ’আমি তোমার নিতম্ব নিয়ে নিচ্ছি’, ‘এ আসলে নিজেকে দিয়ে দেওয়া’, এসব কথার মধ্যে দিয়ে, নারীর নিঃশর্ত সমর্পণের যে-চাহিদা পুরুষের আছে, তা-ই বোঝানো হয়। একটা সার্থক প্রেমেও কি আমরা এই কথাগুলো শুনতে পাই না, তোমার বুক আসলে কার? এইটা কার? ওইটা কার? উত্তরে নারী বলে, তোমার, তোমার। প্রেমিক বলে, এটা আজ থেকে আমি নিয়ে নিলাম। আমার সম্পত্তি। মেয়েটি বলে, নাও। পুরুষ আশা করে, মেয়েটি ক্রমান্বয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতে দিতে শেষবেশ ছেলেটিরই ইচ্ছেকে নিজের ইচ্ছে বলে মনে করবে, তার ভিতরেই করবে বাস, দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী দীর্ঘ বরষ মাস। এমনকী ছেলেটি আর কাউকে ভালবাসলে, দুঃখ আঁকড়ে মেয়েটি পড়ে থাকবে, পুরুষটি যেন যা চায় তা-ই পায়, কামনা করবে। পুরুষের এই আকাঙ্ক্ষার, নারীকে বিলোপ করে নারীকে ভোগ করার এই অশ্লীল দাবি নিয়েই ছবি। কিছু নারী পুরুষের এই আকাঙ্ক্ষাকে সঙ্গত মনে করে ও স্বেচ্ছা-দোসর হয়, ছেলেটির স্ত্রী তারই প্রতীক। তারও একটা পা হাঁটুর তলা থেকে নেই। হয়তো সে এই পা কারও লোভের পাতে বেড়ে দিয়ে ধন্য হয়েছে। প্রচুর হরর ফিল্মে এখন নারীবাদী কথা বলা হচ্ছে, অনেক সময় ছবিগুলির নির্মাণের মূল ভূমিকায় নারীরাই থাকছেন। এই ছবির পরিচালকও নারী (মিম কেভ), লেখকও নারী (লরিন কান)। তাই ছবিতে নারী যখন বুঝতে পারে পুরুষ তাকে মেরেধরে সমর্পণে বাধ্য করবে, তখন প্রেমের অভিনয় করে তাকে বশ করে এবং সুযোগ বুঝে তার অঙ্গচ্ছেদ করে, যে অঙ্গ থেকে পুরুষের যৌন চাহিদা উৎসারিত হয়। ওর মধ্যে দিয়ে পৌরুষের মূলটাকে ছিঁড়ে নেওয়ার কথাও বলা হয়। অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে, নারীর প্রেমও একই কথা বলে কি না। নারী কি যৌনতার সময় প্রেমিকের পুরুষাঙ্গ মুঠোয় নিয়ে উদ্বেল হয়ে বলে না, এটা আমার? সে কি পুরুষের শরীরটাকে জড়িয়ে বলে না, এটা আমার সম্পত্তি? সে কি চায় না, পুরুষটি তার মধ্যে একেবারে লীন হয়ে যাক, তার তাবৎ ইচ্ছেকে আদেশ মনে করুক? এসবই হয়, তবে, নারীর সমাজ-নির্দিষ্ট ভূমিকা বলে, সে পুরুষের দাসী হয়ে, খাদ্য হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করবে। তার ললাটে বাধ্যতা নিবেদন ও সাষ্টাঙ্গ প্রণতির বহুকালব্যাপী নিষ্ঠুর ফতোয়া সাঁটা আছে। তাই এই ছবি সেই আদেশ-উদযাপনকারী পুরুষতন্ত্রকে থেঁতো করার চেষ্টা করে, পেট্রিয়ার্কির সহকারী-নারীকেও থেঁতলায়। সেদিক থেকে ভালই ছবি, মন্দ নয়।
কিন্তু এর চেয়ে একটু ভাল ছবি হল ‘দ্য অ্যামিউলেট’, এর লেখক-পরিচালকও এক নারী (রোমোলা গারাই)। ছবিটি ২০২০ সালের। এক একলা জঙ্গল-প্রহরীর কাছে এসে এক নারী আশ্রয় চায়। বেশ কদিন তার কুটিরে থাকে। প্রহরীর এক সময় তার প্রতি আকর্ষণ জন্মায়, যখন নারী অন্যত্র চলে যেতে চায়, প্রহরী তাকে থামানোর চেষ্টা করে, পরে ধর্ষণ করে। এক সময় প্রহরী লন্ডনে চলে আসে। তার ধীর বিষণ্ণ ভঙ্গি, তার নিজের হাত বেঁধে ঘুমোনোর রুটিন আমাদের বোঝায়, সে অনুতপ্ত। তার শেলটারে আগুন লাগে ও সে গিয়ে পড়ে এক মঠ-এ, সেখানে এক সন্ন্যাসিনী তার সহায়, তিনি বন্দোবস্ত করে দেন একটা বাড়িতে থাকার। সেখানে থাকে এক তরুণী আর তার মা, মা’কে দেখা যায় না কিন্তু তাঁর চিৎকারে বোঝা যায় তিনি কর্কশ ও অত্যাচারী। মেয়ে তাঁর চিৎকার শুনেই দ্রুত চলে যায়। সেখানে প্রহরীর যাওয়া বারণ। মেয়েটি প্রহরীকে রোজই অপূর্ব মাংসের ঝোল খেতে দেয়, তার সঙ্গে একটু-আধটু ঘনিষ্ঠতাও হয়, একটু গানের তালে নাচ। বাজার যাওয়ার সময় একদিন প্রহরী তার সঙ্গ ধরে, বলে চলো আমরা দূরে কোথাও চলে যাই, মেয়ে ম্লান হাসে। প্রহরী বাড়িটি ঘুরে দ্যাখে, সর্বত্র ড্যাম্প ধরে আছে, চিড় ফাটল ফাঁক, বাড়িটা যেন প্রাগৌতিহাসিক, নোংরা, পতনোন্মুখ। একদিন দেওয়াল সারাতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে অশুভ চিহ্ন, আগেকার কালে কোনও বাড়িতে শয়তান থাকলে লোকে এই চিহ্ন দিয়ে দিত। একদিন বাথরুম সারাতে গিয়ে প্রহরী দ্যাখে কমোডে একটা ছোট বীভৎস বাদুড় (মৃত)। একদিন নিষেধ সত্ত্বেও সবচেয়ে উঁচুতলার দরজায় উঁকি মেরে দ্যাখে, মা এক স্থবির গলাপচা শরীরের প্রাণী, যার পেট ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে সেইসব বাদুড়, আর প্রাণীটা আর্তনাদ করে চলেছে। মেয়েটি প্রহরীকে বলে, এই বাদুড়গুলো দাঁত নিয়ে জন্মায়, তাদের পা দিয়ে দিয়ে মাড়িয়ে তখুনি নিকেশ করতে হয়, নইলেই কামড়ে দেবে। বোঝা যায়, মা আর কেউ নয়, এক মনস্টার, যার দেখভাল করায় এই মেয়েটি আবদ্ধ। প্রহরী মা’কে মেরে ফেলে নারীকে উদ্ধার করতে চায়। সন্ন্যাসিনীর কাছে গিয়ে এও বলে, আমি এক জঘন্য অপরাধ করেছিলাম, নিজেকে ক্ষমা করার চেষ্টায় আছি। হয়তো মেয়েটিকে ভাল রাখতে পারলে তার নিজেকে ক্ষমা করার পথ সুগম হবে। মা’কে সে মারতেও যায়, তখন বুঝতে পারে এই মা আসলে এক পুরুষ, যে তার স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে খুন করে নিজের মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। এ তারই বাড়ি। মনস্টারকে প্রহরী মেরে ফ্যালে। তারপর মেয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, যৌনতাও হয়। মেয়েটি বলে, তুমি শিশুর মতো ঘুমিয়েছ কাল। মানে নিশ্চয়ই সে নিজেকে ক্ষমা করে দিতে পেরেছে। তারপরে প্রহরীর শুরু হয় অসহ্য যন্ত্রণা ও কালো বমি, সে কুঁকড়ে যেতে যেতে বলে, কেন আমার এরকম হচ্ছে? সন্ন্যাসিনী এসে বলে, তুমি ভালই জানো, কেন হচ্ছে। তারপর সন্ন্যাসিনী ও মেয়েটি বসে আলোচনা করে, প্রহরী যখন মনস্টার হয়ে যাবে, কে অনন্তকাল তার দেখাশোনা করবে। প্রহরী বলে, আমি ওকেই চাই। মানে, বাড়ির মেয়েটিকে। তারপরে সে বাড়ির এক ঘরে এক বৃহৎ ঝিনুক দেখতে পায়, যার মধ্যে হামাগুড়ি মেরে সে দ্যাখে, বাড়ির মেয়েটি এক অদ্ভুত আদি দেবী, যার মূর্তি সে বহুদিন আগে মাটি খুঁড়ে পেয়েছিল তার দেশের জঙ্গলে। শেষে দেখা যায়, প্রহরী যাকে ধর্ষণ করেছিল, সে ভালই আছে, নিজের সন্তানের সঙ্গেই সে থাকে, তাকে ওই মূর্তিটি উপহার দেয় এই মেয়েটি, এবং গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। পিছনের সিটে বস্তাবন্দি হয়ে আছে প্রহরী-মনস্টার।
ছবিটিতে পুরুষের টানা টানা চোখ, নিত্য অনুশোচনা দেখে আমাদের মনে হয়, সে ক্ষমার যোগ্য, এ ছবি হয়তো ক্রমে হয়ে উঠবে তার কলুষ থেকে নির্মলতায় যাত্রারই কাহিনি। ছবিটির অনেকক্ষণ অবধি আমরা জানতেও পারি না, কীসের জন্য তার এই অন্তর্বেদনা। যখন বুঝি সে ধর্ষক, অবাক হই, কিন্তু মনে হয় এই মেয়েটিকে উদ্ধার করলে হয়তো পাপক্ষালন হবে। আফটার অল, মেয়েটা একটা মনস্টারের সঙ্গে থাকতে বাধ্য হয়, কত যুগ ধরে তাকে সেবা করে। শেষে যখন বোঝা যায়, অসহায় মেয়ে বলে যাকে ভাবা হচ্ছিল, সে-ই আসলে পুরোটা ঘটিয়েছে, সে-ই সেই আদিম দেবী, যে অপরাধী পুরুষদের চিরশাস্তি দেয়, তাই মেয়েটি আসলে দণ্ডিতা নয়, বরং দণ্ডদাত্রী, তখন প্রবল চমক জাগে। যে সন্ন্যাসিনীকে ভাবা হচ্ছিল দেবতার পূজারিনি, তিনি কল্যাণময় নয়, রুদ্রাণী দেবীর দূত, বুঝেও অবাক লাগে। সবচেয়ে বিস্ময়ের কাণ্ড, প্রহরী ক্ষমা পায় না। যে একবার ধর্ষণ করেছে, আশ্রিতাকে রক্ষা করার পরিবর্তে আঘাত করেছে, সে যতই ইনিয়েবিনিয়ে আত্মধিক্কারী ডাইরি লিখুক, ন্যাকা ন্যাকা প্রায়-ধর্মীয় আকুতিময় কথা বলুক, শত স্বীকারোক্তিতেও তার নিস্তার নেই। তাই, ঠিক যখন মনে হয় এক স্নিগ্ধ নারী এসে তার অন্য নারীর প্রতি অত্যাচারের ক্ষত একেবারে বুজিয়ে দিল, তখনই সিনেমায় তার প্রকৃত ও চরম শাস্তির লক্ষণ দেখা যায়, এবং আমরা সিনেমার (বা অন্যান্য শিল্পের) অনুতপ্তের প্রতি আচরণের চলতি গৎ থেকে এমন একটা সপাট মোচড় দেখে শিউরে যাই। ছবিটা বলে, এখন-ভাল দিযে তখন-খারাপের সমাধান হয় না। লক্ষণীয়, প্রহরী যখন বুঝতে পারে, তাকে মনস্টার হয়ে বাঁচতে হবে, সে হয়ে উঠবে বিকট মানবেতর প্রাণী, অসহ যন্ত্রণা যার দিনসঙ্গী, যার পেট ফাটিয়ে প্রায়ই বেরিয়ে আসবে লোমহীন শ্বেতবাদুড় (অর্থাৎ প্রসবযন্ত্রণা পাবে সে অযুত বার, যে প্রকাণ্ড ব্যথা শুধু মেয়েরা ভোগ করে এ পৃথিবীর নিষ্ঠুর বায়োলজি-সূত্রে), তখনও বলে, দোসর হিসেবে পৃথিবীর আর কাউকে চায় না, চায় এই মেয়েটিকেই। মানে, যে-মেয়েকে যে-দশা থেকে উদ্ধার করার জন্যে সে সারা সিনেমা ছটফট করল, সেই দশাতেই তাকে আর এক কল্প নিমজ্জিত করতে তার এতটুকু বাধবে না, কারণ এবার সে নিজেই মনস্টার, তাই তার গলাপচা অস্তিত্বটার সঙ্গে এই মেয়েটিকেই জুড়ে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা পাবে। বোঝা যায়, অ্যাদ্দিনের ক্ষমাভিক্ষা আসলে তার সত্তা অবধি পৌঁছয়নি, সে আত্মসংশোধনের প্রধান কথাটাই জানে না, অন্যের ভালকে প্রাধান্য দিতে শেখেনি, সে এখনও আত্মময়, অ-সংবেদী। এও বোঝার, অনেকদিন আগে, যখন সে মাটি খুঁড়ে এই দেবীকে পেয়েছিল, তখন আদৌ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। মানে, দেবী আগাগোড়া তার উপরে নজর রাখছিলেন, ঘটনারও আগে থেকে তাঁর চোখ লোকটির দয়াঘন ব্যবহারের প্রদর্শনী পেরিয়ে তার স্বভাবকে পড়ে নিয়েছিল।
আরেকটা ছবির কথা বলা যায়, তার আড়নটা কমেডির, নাম ‘প্রমিসিং ইয়ং উওম্যান’, ছবি ২০২০ সালেরই। এরও লেখক-পরিচালক নারী (এমারেল্ড ফেনেল)। নায়িকা ডাক্তারির উজ্জ্বল ছাত্রী ছিল, কিন্তু পড়া মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে সে এখন কফির দোকানে কাজ করে, মা-বাবার সঙ্গে থাকে। সপ্তাহে একদিন রাত্রে সে কোথাও গিয়ে খুব মাতাল এবং প্রায় বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার ভান করে, তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ছলে যে-পুরুষ কোথাও নিয়ে গিয়ে ভোগ করতে চায়, তাকে সে মোক্ষম মুহূর্তে হুট করে পূর্ণ জ্ঞানে থাকার পরিচয় দেয়। পুরুষ স্তম্ভিত হয়ে যায়। এ-ই মেয়েটির খেলা। ক্রমে জানা যায়, সাত বছর আগে মেয়েটির প্রিয়তম বান্ধবী নিনা যখন মাতাল ছিল, তখন তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে এক সহপাঠী, বারবার, এবং বন্ধুদের সামনে, তারা দেখছিল আর হাসছিল, পরদিন নিনার গোটা শরীর ভর্তি ছিল আঘাতের চিহ্নে (বলা যায় হাতের ছাপে)। নিনা নালিশ জানায়, কিন্তু পুরুষটির (এবং তাকে ঘিরে থাকা পুরুষদের) কোনও শাস্তি হয় না, উকিলও মেয়েটিকেই হ্যারাস করেন, নিনা এক সময় আত্মহত্যা করে। এ অবিচার ভুলতে না পেরেই নায়িকা পড়া ছেড়েছে। এর শোধ নেওয়াই এখন তার জীবন-প্রোজেক্ট। ওই সময়কার এক সহপাঠিনীকে সে ডাকে রেস্তরাঁয়, নিনার কথা তুলতে সে বলে, ধুর, ওটা ধর্ষণ নয়, আর যে-মেয়ে রাতদিন অনেকের সঙ্গে শুয়ে বেড়ায় সে যদি হঠাৎ ‘ধর্ষণ ধর্ষণ’ চেঁচায় তাহলে কে বিশ্বাস করবে? অত যদি আপত্তি তাহলে এত মদ খেও না যে একেবারে অচৈতন্য হয়ে পড়বে। অত নেশা করলে অনাকাঙ্ক্ষিত যৌনতা ঘটেই থাকে। নায়িকা সেই সহপাঠিনীকে অনেকটা মদ খাইয়ে বেসামাল করে দেয় এবং সে জেগে ওঠে হোটেলের একটা ঘরে, অন্য পুরুষের সঙ্গে। আবার ওই সময়ের কলেজের ডিন ছিলেন যে মহিলা, নায়িকা তার কিশোরী মেয়েকে গাড়িতে তুলে নেয় একটা বিখ্যাত ব্যান্ডের সঙ্গে আলাপের লোভ দেখিয়ে (নায়িকা বলে সে ওদের মেক-আপ করে)। ডিনকে গিয়ে নায়িকা যখন জিজ্ঞেস করে, সাত বছর আগে ছেলেগুলোর শাস্তি হয়নি কেন, তিনি বলেন, যথেষ্ট প্রমাণ ছিল না। একটা মেয়ের কথায় বিশ্বাস করে একটা ব্রাইট ছেলের কেরিয়ার তো নষ্ট করে দেওয়া যায় না। মেয়েটি মাতাল ছিল, সে হয়তো সবিছু ঠিকঠাক মনে করতে পারেনি। ছেলেটিকে তো বেনিফিট অফ ডাউট দিতেই হবে। নাযিকা বলে, আপনার মেয়েকে আমি এই কলেজেরই কয়েকটা ছেলের সঙ্গে রেখে এসেছি, সেই ডর্ম-রুমেই, আর ওখানে কয়েক বোতল ভদকাও আছে দেখে এলাম, তবে কিনা, ছেলেদের বেনিফিট অফ ডাউট তো দিতেই হবে, তারা নিশ্চয়ই আপনার মেয়েকে খুব যত্ন করবে। ডিন মেয়ের ফোনে কল করতে নায়িকারই পকেটে তা বেজে ওঠে, সে বার করে দেখায়। তখন ডিন বলেন, আমার ভুল হয়েছিল। সেই ঘরের নম্বর বলার জন্য যখন কাকুতি-মিনতি করেন, নায়িকা বলে, মেয়েটি রেস্তরাঁয় একটি বয়-ব্যান্ডের জন্য অপেক্ষা করছে, ভয় নেই। সহপাঠিনীকেও সে বলে, হোটেলের ঘরে কিছু ঘটেনি, সে শুধু বোঝাতে চেয়েছিল, মাতাল হলেই সম্মতি ছাড়া পুরুষসঙ্গ গ্রহণীয় হয়ে যায় না। যে উকিল নিনাকে হুমকি দিয়ে কেস প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিলেন, তার কাছে গিয়ে নায়িকা দ্যাখে, তিনি এখন ‘সাইকোটিক এপিসোড’-এর রুগি, ওকালতি ছেড়েছেন, দিনের পর দিন মেয়েদের বিরুদ্ধে এই কাজ করার পর এখন আর ঘুমোতে পারেন না, তিনি নায়িকার কাছে ক্ষমা চান। নায়িকার সঙ্গে ক্রমে এক ব্যাচমেটেরই প্রেম হয়, নিনার মাও নায়িকাকে বলেন, জীবনে এগিয়ে যা, একটা অন্যায়ের কথা ভেবে নিজেক নষ্ট করিস না। এই সময় কৃতজ্ঞ সহপাঠিনী নায়িকাকে একটা ক্লিপিং দেয়, নিনার ধর্ষণের ক্লিপিং, যেটা অনেকের ফোনে ঘুরত, যেখানে নায়িকা ধর্ষকের বহু সহপাঠীর সঙ্গে তার প্রেমিককেও দ্যাখে, সে দাঁড়িয়ে দেখছে এবং হেসে খুন হচ্ছে। মূল ধর্ষকটির বিয়ে সামনে, নায়িকা প্রেমিকের কাছে গিয়ে এই ক্লিপিং দেখিয়ে বলে, কোথায় তোমার বন্ধুর ব্যাচেলর পার্টি হচ্ছে বলো, নইলে এই ফুটেজ পাবলিক করে দেব। সে বলে। নায়িকার কাছে ক্ষমাও চায়, কিন্তু নায়িকা ক্ষমা করে না। ব্যাচেলর পার্টিতে স্ট্রিপার সেজে গিয়ে, তার বন্ধুদের মদে ওষুধ মিশিয়ে বেহুঁশ করে, ধর্ষকের মুখোমুখি হয়ে তার পেটে যখন নিনার নামটা খোদাই করে দেওয়ার বন্দোবস্ত করছে নায়িকা, লোকটি উঠে তাকে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফ্যালে। পরের সকালে এক বন্ধুর সাহায্যে নায়িকার দেহটা পুড়িয়ে ফ্যালে। নিখোঁজ নায়িকার খোঁজ করতে পুলিশ প্রেমিকের কাছে আসে, সে বলে সে আদৌ জানে না নায়িকা কোথায়, এও ইঙ্গিত দেয় যে তার মানসিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। বিয়ের দিনে প্রেমিকের ফোনে নায়িকার মেসেজ আসে (আগে থেকে শিডিউল করা মেসেজ), বোঝা যায়, উকিলকে সে ক্লিপিংটা পাঠিয়ে রেখেছিল, এবার সেটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রকাশ্যে, এবং পুলিশ এসে গ্রেফতার করে ধর্ষককে।
দুরন্ত কমেডির এবং নায়িকার ভূমিকায় ক্যারি মালিগানের অনবদ্য অভিনয়ে ভর করে সিনেমাটা আমাদের কাছে আসে একটি তরতাজা প্রতিবাদী ছবি হিসেবে। প্রায় টিক দেওয়ার মতো, পিতৃতন্ত্রের সবকটা অজুহাতকে ধরে ধরে কুপোকাত করে ছবির চিত্রনাট্য। লোফাররা নায়িকাকে টোন কাটলে সে স্থির তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। তারা কিছুক্ষণ পর চোখ নামিয়ে গালাগাল দিতে দিতে চলে যায়। ছবি জুড়ে ছেলেরা প্রায় সক্কলে বেকায়দায় পড়ে মিউমিউ মিনমিন বলে, তারা খুব ভাল লোক, শুধু এখন একটা ভুল করে ফেলছিল, একজন মাতাল মেয়ের যৌনাঙ্গে কয়েকটা আঙুল ঢুকিয়ে ফেলেছিল, তবে আদতে সে খুব, ভা, ল। কেউ ভিলেন-টাইপ নয়, ভীষণ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, কেরিয়ারে প্রবল সফল, খুব ভদ্র, প্রেমে কোমল, রুচিতে চমৎকার, এমন লোকও যে নারীবিদ্বেষী হয়ে উঠতে পারে, এবং তখন তার মনে সন্দেহটুকু উপস্থিত হয় না যে সে অন্যায় করছে, এটাকে একটু বাড়িয়েচাড়িয়ে (কমেডির লাইসেন্সই তাই) নায়িকার প্রতিশোধ-প্রোজেক্টের কাচের মধ্যে দিয়ে দেখিয়ে, ছবিটা বলে, ভাল পুরুষরা অনেক সময়েই খারাপ পুরুষ, এবং তাদের অন্যত্র ভালত্বের অজুহাতে এই মনোভাব অনালোচিত (বা অ-অভিযুক্ত) থাকতে পারে না। সমাজভর্তি লোকেরা (পুরুষ-নারী নির্বিশেষে) অপরাধবোধহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর খেয়ালই করছে না তারা কখন একটা মেয়েকে অন্যায় ভাবে অপমান করল, তার নিগ্রহকে সমর্থন করল— এই দায়সারা গা-ছাড়া মনোভাবকে থাপ্পড় মারতে ছবিটার উৎপত্তি। নারী ও তার অধিকার নিয়ে হইহই করা লোকের প্রতি চারপাশের লোকের দৃষ্টি (সহপাঠিনী বলে, ছেলেরা চায় কলেজে ফেমিনিস্ট, পরে ‘ভাল মেয়ে’— এমন নারী। তাছাড়া ফেমিনিস্টরা নাকি পায়ুমৈথুন খুব উপভোগ করে), প্রশাসনের লোকের প্রচ্ছন্ন সমর্থন (ডিন বলেন, হপ্তায় দুটো করে এমন অভিযোগ আসে, প্রতিটায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়?), আইনব্যবস্থার প্রত্যক্ষ নারীবিদ্বেষ (উকিল বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে একটা পার্টিতে মাতলামির ছবি বার করতে পারলেই জুরি মেয়েটিকে ঘেন্না করতে শুরু করে। এখন কত সুবিধে হয়ে গেছে, আগে মেয়েটিকে চরত্রহীন প্রমাণ করতে তার জঞ্জালের ঝুড়ি ঘাঁটতে হত), মিডিয়ায় নারী নিয়ে নিষ্ঠুরতা ও রসিকতা (নায়িকার বাবা-মা নির্বিকার মুখে এমন একটা সাদা-কালো সিনেমা টিভিতে দেখেন)— সব মিলিয়ে গোটা বিশ্ব নারীর বিরুদ্ধে, অন্তত ছক-না-মানা নারীর বিরুদ্ধে, তার ন্যূনতম আত্মসম্মানের বিরুদ্ধে অস্ত্র উঁচিয়েই আছে। পরিচালিকা আগে ঠিক করেছিলেন, নায়িকার বডি পুড়ছে একটা মাঠের মধ্যে, এখানেই ছবি শেষ করবেন, প্রযোজকেরা হাঁ-হাঁ করে ওঠায়, শেষটা নতুন করে লেখেন। কিন্তু এই গ্রহ এই কাহিনির শেষ নতুন করে লিখবে কি?
মিটু আন্দোলন বহু শিল্পের জন্ম দিয়েছে, বহু সিনেমারও। এগুলোর অধিকাংশেরই অবশ্য একবগ্গা হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা, তা হচ্ছেও, কিন্তু বিভিন্ন ঘরানায় পুংতন্ত্রকে আচ্ছাসে নগ্ন করার প্রকল্পটা নারী-চলচ্চিত্রকারেরা যেভাবে নিয়েছেন, তাতে কিছু অন্য ধরনের ছবি হওয়ার চল ঘটেছে। পুরুষরা এ ধরনের ছবি অবশ্যই করতে পারেন, কিন্তু নারীরা প্রায় ক্ষমাহীন ভাবে কুঠার ধরেছেন, এবং তা প্রায়ই নিপুণ ব্যবহৃত। সেখানে অনেক চলতি ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে তাঁরা পিছপা নন, খরখরে অপ্রিয় হতে নারাজ নন, আবার দর্শক যাতে একে উপদেশ-কচকচি না ভাবেন, সেদিকে খেয়াল রেখে রসসৃষ্টি করতেও দক্ষ। কিছু খোঁচা খেয়ে ও কিছু শিক্ষিত হয়ে বাকি পৃথিবী কখনও হাততালি দিচ্ছে কখনও না, কখনও অস্কার দিচ্ছে (প্রমিসিং ইয়াং উওম্যান, সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য), কখনও বলছে বিশ্বের কোনও পুরুষই কি মাতাল মেয়েকে সযত্নে বাড়ি পৌঁছে দেয় না? ই কী স্টিরিওটাইপে ফেলা! নারীদের ক্ষেত্রেও যা হয়, তা-ই তো পুরুষদের ক্ষেত্রে করছেন মহাশয়া! (একই ছবি)। কিন্তু আলোচিত হচ্ছে, ঘুরপাক খাচ্ছে, লেখালিখিতে, ভাবনায়, এবং সবচেয়ে জরুরি: দর্শকের একলা ভাবার (ও সম্ভবত লজ্জিত হওয়ার) মুহূর্তটিতে। কম?