ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ব্যালকনি অথবা পশমিনার গল্প


    প্রিতম মুখোপাধ্যায় (October 18, 2021)
     

    সিনেমা-টিভিতে অনেক রুস্তম দেখেছেন তো বৌদিমণি, আমরা কিন্তু ওরকম নয়। একদম পুচ করে নলিটা কেটে দেব। দাদাকে বলবেন অনেক প্রফেসারি মারিয়েছেন, এবার আমাদের অফিসে গিয়ে ভালছেলের মতো এইটটি ফাইভ থাউজেন্ড দিয়ে আসতে। কালকের মধ্যে টাকাটা ডিপোজিট না হলেই্‌… পুচ।’ একেবারে উদয়শঙ্করী মুদ্রায় গলা কাটার ভঙ্গিটা দেখিয়ে বাইকে উঠে বসল ছেলেটা। আপৎকালীন পরিস্থিতি সামলাতে পাশের বাইকে ছিল আরও দুটো নির্বাক গুন্ডা। ফাটা সাইলেন্সারের দুর্দান্ত শব্দ তুলে ঝড়ের গতিতে চলে গেল বাইকদুটো। বারান্দায় স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে থাকল বৃন্দা। পা-টা কাঁপছে। মনে হচ্ছিল পড়ে যাবে। রেলিং ধরে তাড়াতাড়ি সামলে নিল নিজেকে।

    অর্ণব ফিরল রাত ন’টার পর। কলেজ সেরে একটা সেমিনারে গিয়েছিল। বেশ ধীরে, শান্ত স্বরে হুমকির ঘটনাটা জানাল বৃন্দা। কালো হয়ে গেল অর্ণবের মুখ। একটা শীতল প্রবাহ খেলে গেল শিরদাঁড়ার মধ্যে। স্খলিতের মতো বসে পড়ল সোফায়।

    প্রথম দিন এসে সাততলার ওপর দক্ষিণখোলা বারান্দা আর আদিগন্ত বিস্তৃত দোলায়িত কাশবন দেখে হাততালি দিয়ে উঠেছিল বৃন্দা। তার মেয়েবেলাটা কেটেছে রেল কোয়ার্টারের ঘুপচিতে। সেখান থেকে কদমতলায় একান্নবর্তী শ্বশুরবাড়ি। বারান্দা দুরস্ত জানলা খোলারও উপায় ছিল না। সারাদিন লেদ মেশিনের আর্তনাদ, রাস্তার হুল্লোড় আর বাসের হর্ন। তার ওপর ছোট জা-র বড়-বড় বোলচাল। সবসময় সিঁটিয়ে থাকত সে। সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিটাকে দেখে বাচ্চা মেয়ের মতো নেচে উঠেছিল বৃন্দা। অন্যরা না থাকলে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরে চকাস করে একটা চুমুই খেয়ে ফেলত!

    হালকা গোলাপি রঙের টাইলস আর ঝকঝকে দুগ্ধফেননিভ মার্বেল-শোভিত বারান্দায় এসে পড়ে চাঁদের মায়াবী আলো— নতুন কেনা বেতের দোলনায় বসে থাকতে-থাকতে বৃন্দার মনে হয় যেন কোন স্বপ্নরাজ্যের মায়াপুরীতে চলে গেছে সে। এটা ছিল বৃন্দার অফিস থেকে ফিরে স্বর্গীয় এক বিলাসিতা। আর অর্ণবের বিলাসিতা ছিল চায়ের কাপ হাতে সকালের ব্যালকনি দখল করে থাকা। তার ফার্স্ট ক্লাস শুরু হত এগারোটায়। সকাল দশটা পর্যন্ত এইভাবেই জমিদারি চালে কাটিয়ে দিত সে। 

    নতুন ফ্ল্যাটের মসৃণ জমিদারি ভালই চলছিল একটা মাস। তাল কাটল প্রোমোটারের চ্যালা বুবাইয়ের ফোনে— একবার গোলাপদার অফিসে দেখা করার তলব। প্রথমদিন থেকেই গোলাপ ঘোষ লোকটাকে অপছন্দ অর্ণবের। সবসময় কেমন যেন একটা সবজান্তা তম্বি আর লম্বাচওড়া কথা। টাকার জোরে পার্টির বড়দা-বড়দি থেকে পুলিশ আর উকিলগুলোকে পুরো মুঠোয় ভরে নিয়েছে। গলায় সোনার তিন থাক চেন। ছ’মাসের পোয়াতির মতো ঢেউ-তোলা ভুঁড়ি আর টাইট জিন্‌স-স্নিকারে খচিত হিটলার সাহেব এসি অফিসে বসে পা নাচায়। নিমীলিত নেত্রে হাফ সেন্টেন্সে বাক্যবিনিময়। এমন একটা ভাব, যেন বেশি কথা খরচ করার যোগ্য মনে হচ্ছে না অন্যদের। আসলে ফ্ল্যাটের পজিশনটা পছন্দ হয়েছিল বলেই আসা। নাহলে এমন একটা বিছুটি লাগা লোকের ধারেকাছে যেত না অর্ণব। এদের দেখলেই কেমন গা গোলায়। বৃন্দা বলেছিল, ‘ও থাকুক না নিজের মতো। আমাদের তো কোনও গা ঘেঁষাঘেঁষির দরকার নেই। ফ্ল্যাটটা রেজিস্ট্রি হয়ে গেলেই তো সম্পর্ক শেষ।’

    পজেশনের মাসখানেক বাদে অর্ণব বুঝল সম্পর্কের ধ্বংসাবশেষটুকু এখনও রয়ে গেছে। শেষ হয়েও রেশ যায়নি। তলব পেয়ে জিজি, মানে গোলাপ ঘোষের ঠান্ডা অফিসে পা দিয়েই কাঁটার খোঁচা খেল অর্ণব। সামনে একটা কাগজ ফেলে দিয়ে বুবাই বলল, ‘দেখে নিন হিসেবটা। বৌদির কথায় ব্যালকনিতে যে স্পেশাল মার্বেল লাগানো হয়েছে ওর জন্যে এক্সট্রা লাগবে— এইটটি ফাইভ।’

    সারাদিন লেদ মেশিনের আর্তনাদ, রাস্তার হুল্লোড় আর বাসের হর্ন। তার ওপর ছোট জা-র বড়-বড় বোলচাল। সবসময় সিঁটিয়ে থাকত সে। সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিটাকে দেখে বাচ্চা মেয়ের মতো নেচে উঠেছিল বৃন্দা। অন্যরা না থাকলে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরে চকাস করে একটা চুমুই খেয়ে ফেলত!

    ‘এইটটি ফাইভ থাউজেন্ড!’ যেন সাততলার ব্যালকনি থেকে রাস্তায় থেবড়ে পড়ল অর্ণব। একটিও বাক্যব্যয় না করে স্রেফ মাথা দুলিয়ে আর মুচকি হেসে প্রত্যুত্তর দিল বুবাই। প্রোমোটার থুড়ি ডেভলপারের খাস ডানহাত এই বুবাই। শুরুতে এমন সমাদর যেন বুবাইয়ের সঙ্গে গতজন্ম থেকে চেনা। বৌদির গাছ করার শখ জেনে স্বেচ্ছাসেবক বুবাইয়ের কত রকম উপদেশ। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ, তখনই মনে হয়েছিল অর্ণবের। প্রথমদিককার হনিমুন-সেশন শেষ হবার পর থেকেই বুবাই আর তার প্রভুর রূপ পরিবর্তন হতে লাগল গিরগিটির মতো। এইটটি ফাইভ থাউজেন্ডের ধাক্কায় বিপর্যস্ত অর্ণব একটু বেসামাল হয়ে পড়েছিল ক’দিন। সাহস জুগিয়েছিল বৃন্দা। বলেছিল, ‘ছাড়ো তো। চাইলেই দিতে হবে নাকি! অমনি বলে দিল বৌদি চেয়েছিল। ব্যালকনিতে ফরেন টাইলস লাগানোর কথা তো হয়নি কোনওদিন। ওই হুলোবেড়ালটা নিজেই তো আগ বাড়িয়ে অনেক দরদ দেখিয়েছিল। সবেতেই খালি, ‘আমি করে দেব-আমি তো আছি’ এমন সব বাণী ছেড়েছেন। উনি যেন পরিত্রাতা যীশু।’

    একবার যখন টাকার কামড় বসিয়েছে, তখন মাংস তুলেই ছাড়বে। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এরা ছয়-কে নয় বানিয়ে ছাড়ে। যে-আশঙ্কা করছিল অর্ণব সেটাই মিলে গেল অক্ষরে-অক্ষরে। বুবাইয়ের একটা অহিংস ফোন এল কিছুদিন বাদে। পরিষ্কার বলে দিল অর্ণব, ‘ও টাকা আমরা দেব না। ব্যালকনির জন্যে এক্সট্রা টাকা দিতে হবে এমন কোনও কথা এগ্রিমেন্টে ছিল না।’ আবার কিছুদিন চুপ। তারপর কলেজ-ফেরতা অর্ণবকে শাসানি। ফোনে গালাগাল। বৃন্দার একরোখা ভাব আরও দৃঢ় হয়েছে। একদিন ওদের ফোন আসতেই কনজিউমার ফোরামের ভয় দেখাল বৃন্দা। পরের সকালেই বাইকবাহিনী এসে শুনিয়ে গেল গিলোটিনের আদেশ।

    সারারাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে গেল অর্ণব। তার সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে। নিতে পারছে না এতটা চাপ। বৃন্দা নীরবে লক্ষ করে গেল অর্ণবকে। সকালের চা-টা ব্যালকনিতে বসেই খেত দুজনে। বৃন্দা দেখল আধো-অন্ধকার লিভিংরুমে কুঁকড়ে বসে আছে অর্ণব। এক রাত্তিরেই যেন বয়েস অনেকটা বেড়ে গেছে তার। সামনে চায়ের কাপ রেখে বৃন্দা বসল অর্ণবের পাশে। হাতে হাত রেখে বলল, ‘ঠিকাছে তুমিও দেখো, আমিও চেষ্টা করছি। অফিস কো-অপারেটিভ থেকে কত পাব দেখি!’

    ২.
    অফিস কো-অপারেটিভের একটা মেম্বারশিপ ছিল কিন্তু সেখান থেকে লোন পাওয়া যে এত জলভাত, জানা ছিল না বৃন্দার। প্রায় দশ বছরের ঝানু মেম্বরশিপ অথচ কোনওদিনই হাত পাতেনি কো-অপারেটিভের দরজায়। সহকর্মী সুশান্তর তদবিরে লোনের পরিমাণ দাঁড়াল তেষট্টি হাজার। আর যেহেতু বৃন্দার দরকার কড়কড়ে টাকা, তাই একে-ওকে ধরে সুশান্ত ব্যবস্থা করে ফেলল ক্যাশ চেকের। শুধু রাস্তা পেরিয়ে স্টেট কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে চেকটা দিলেই হাতে চলে আসবে তেষট্টি হাজার। 

    ব্যাঙ্কের দিকে যেতে-যেতে বৃন্দা ঠিক করে ফেলল, অর্ণব যদি কিছু জোগাড় করতে পারে তো ভাল, নাহলে ওই টাকাটাই আনাজ নেওয়ার থলেতে করে অভিশপ্ত বারান্দা থেকে ঝুলিয়ে দেবে বদমাশগুলোর সামনে। দরজা খুলে সম্মান জানানোর মতো ভদ্রতাটুকু পাবারও যোগ্যতা ওদের নেই। ব্যালকনি থেকেই গলা চড়িয়ে বলে দেবে যে, বাকিটা পরে দিয়ে দেবে। না মানতে চাইলে হাতের বালা খুলে ছুঁড়ে দেবে ওদের দিকে। এমনই একটা প্রতিবাদের গুলতি না ছুঁড়লে যেন গাত্রদাহ কমছিল না বৃন্দার।

    ব্যাঙ্কের ক্যাশ-কাউন্টারেও সামান্য ভিড়। দেখা হয়ে গেল সহকর্মী শমিতাদির সঙ্গে। শমিতাদির একটা অ্যাকাউন্ট আছে সেখানে। হাজার দশেক টাকা তুলে একটা শাল কিনতে যাবে নিউ মার্কেটে। ক’দিন বাদেই বিয়ের গোল্ডেন জুবিলি। সারপ্রাইজ গিফ্‌ট দিয়ে বরকে চমকে দিতে চায় শমিতাদি। বৃন্দাকে পেয়ে যেন হালে পানি পেল শমিতাদি। একেবারে হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। দারুণ-দারুণ শাড়ি পরে বৃন্দা, দেখেছে শমিতাদি। জেনেছে বৃন্দার চয়েস বেশ ভাল। তাকে যেতেই হবে সঙ্গে।

    বৃন্দা দেখল আধো-অন্ধকার লিভিংরুমে কুঁকড়ে বসে আছে অর্ণব। এক রাত্তিরেই যেন বয়েস অনেকটা বেড়ে গেছে তার। সামনে চায়ের কাপ রেখে বৃন্দা বসল অর্ণবের পাশে। হাতে হাত রেখে বলল, ‘ঠিকাছে তুমিও দেখো, আমিও চেষ্টা করছি। অফিস কো-অপারেটিভ থেকে কত পাব দেখি!’

    টাকার ব্যবস্থা অনেকটা হয়ে গেছে। বৃন্দা এখন হাওয়ায় ভাসছে। অফিসের খাতায় ডিপারচার সই করেই এসেছে কাজেই আর ফিরে যাবারও তাড়া নেই। শুধু একটাই অস্বস্তি— এতগুলো টাকা নিয়ে রাস্তায়-বাজারে ঘোরাঘুরি করা ঠিক হবে না। আবার ওদিকটা তো পিকপকেটারদের স্বর্গরাজ্য! একটু ইতস্তত করছিল বৃন্দা কিন্তু শমিতাদির অসহায় ঝুলোঝুলিতে শেষপর্যন্ত রাজি হয়ে গেল।

    ৩.
    বাজেটের মধ্যেই একটা ভাল শাল পেয়ে গেল শমিতাদি। বৃন্দাকে খুব একটা সাহায্য করতে হয়নি। বরং তার চোখ চলে যাচ্ছিল পাশের ক্রেতার দিকে। লোকটার মুখের আদল অনেকটা অর্ণবের মতোই। তেমনই লম্বা আর ফর্সা। পালকের মতো হাল্কা ধবধবে শাল আলতো করে জড়িয়ে লোকটা হাঁটছিল দোকানের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। চুরি করে একটা অচেনা লোকের দিকে যতটুকু তাকানো যায় তার থেকেও একাগ্র ছিল বৃন্দার দৃষ্টি। লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিচ্ছিল বারবার। আর সেই সময় লোকটা গিয়ে দাঁড়াল দোকানের লম্বা আয়নার সামনে। সারসের দুটো সাদা ডানার মতো শালটা ঝুলছিল লোকটার বাহু থেকে। মনে হচ্ছিল যেন কোনও দেবদূত এখুনি উড়ে যাবে নীল আকাশের দিকে। মোহিত হয়ে সেদিকে তাকিয়েছিল বৃন্দা। আয়নার মধ্যে দিয়ে চোখে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি সরে গেল দোকানের অন্যদিকে।

    শাল কিনে দোকানের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা। সাদা রঙের একটা বড় গাড়ি এসে থামল সামনে। লোকটা উঠে পড়ল গাড়িতে। কাচের দরজা দিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে দৃশ্যটা দেখছিল বৃন্দা। কে যেন ‘স্ট্যাচু’ বলে নিশ্চল করে দিয়েছিল তাকে। সম্বিত ফিরে পেয়ে বৃন্দা বলল ‘উনি যে-শালটা নিলেন, ওরকম একটা দেখান তো।’ বৃন্দার কথায় যেন ভ্রুক্ষেপ নেই দোকানদারের। নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে সে। চারবার বলার পর বেশ বিরক্তির সঙ্গে উত্তর দিল, ‘অনেক দাম ওগুলোর।’

    ব্যাঙ্কের দিকে যেতে-যেতে বৃন্দা ঠিক করে ফেলল, অর্ণব যদি কিছু জোগাড় করতে পারে তো ভাল, নাহলে ওই টাকাটাই আনাজ নেওয়ার থলেতে করে অভিশপ্ত বারান্দা থেকে ঝুলিয়ে দেবে বদমাশগুলোর সামনে। দরজা খুলে সম্মান জানানোর মতো ভদ্রতাটুকু পাবারও যোগ্যতা ওদের নেই। ব্যালকনি থেকেই গলা চড়িয়ে বলে দেবে যে, বাকিটা পরে দিয়ে দেবে।

    ‘কত দাম?’ বৃন্দার গলায় জেদ।

    এবারও দোকানদার উত্তর দিতে সময় নিল। একবার আপাদমস্তক দেখে নিল, যেন বৃন্দা কোনও অবান্তর প্রশ্ন করেছে। মুখে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘ওগুলো রিয়াল পশমিনা। নাম শুনেছেন পশমিনার? দাম শুরু সিক্সটি থাউজেন্ড থেকে। এক লাখ-দেড় লাখ ভি হো শকতা। ও আপনি পারবেন না।’

    কথা শেষ করে বাঁকা হাসিটা আরও চওড়া হয়ে ছড়িয়ে পড়ল দোকানদারের মুখে। ‘পারবেন না’ মানে! কী বলতে চাইছেন দোকানদার ভদ্রলোক? অপমানে মাথাটা ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল বৃন্দার। গলা উঁচিয়ে বলে উঠল, ‘পারব কি পারব না আপনি কী করে বুঝলেন? পছন্দ হলে নিশ্চয়ই কিনব। দেখান পশমিনা, না দেখে আমি যাব না।’ 

    ৪.
    তখন সন্ধ্যা নেমেছে শহরে। আকাশে জেগে উঠেছে পূর্ণিমার গোল চাঁদ। সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার সময় বৃন্দা তাকাল সাততলার ব্যালকনির দিকে। হাল্কা নীল আলোয় ভরা ব্যালকনিতে অর্ণবের আবছা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ডুপলিকেট চাবি থাকে বৃন্দার কাছে। নিঃশব্দে দরজা খুলে মার্জার পদক্ষেপে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল বৃন্দা। পেছন থেকে আলতো জড়িয়ে দিল পশমিনা। চমকে উঠে দাঁড়াল অর্ণব। প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে। অর্ণবের ঠোঁটে হাত রেখে রহস্যময়ী বৃন্দা বলে উঠল, ‘না। কোনও কথা বলবে না। ওদিকে সরে বারান্দার ধারে গিয়ে দাঁড়াও। জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়ুক তোমার গায়ে। জড়িয়ে নাও শালটা। নতুন করে একটু দেখি তোমাকে।’

    কার্যকারণ কিছুই মাথায় ঢুকছিল না অর্ণবের। সরে ব্যালকনির প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল অর্ণব। বৃন্দা দেখছিল। দেখে যাচ্ছিল এক দৃষ্টিতে। কলেজের ক্লাসরুমে প্রথম যেদিন প্রফেসার এ.ডি. মানে অর্ণব দাশগুপ্তকে দেখেছিল, সেদিনের মতোই কেঁপে উঠল বৃন্দা। 

    অস্থির অর্ণব বলে উঠল, ‘অফিসের কো-অপারেটিভ থেকে যে-টাকাটা…’

    ‘ওই তো শালটা, এত ভাল লাগল… লোন যা পেয়েছিলাম প্রায় পুরোটাই…’

    ‘পুরোটাই!’ অর্ণবের গলায় আর্তনাদ। দমটা যেন আটকে গেছে গলার কাছে। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল অর্ণব, তাকে থামিয়ে দিয়ে বৃন্দা বলল, ‘ছেড়ে দাও ওদের কথা। যা হবার হবে। জংলি-অসভ্যগুলোকে পরিষ্কার বলে দেব, আর এক পয়সাও দেব না।’

    এগিয়ে এল বৃন্দা। আরও গভীর করে অর্ণবকে দেখতে দেখতে বলে উঠল, ‘যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা গ্রিক দেবতা… হাওয়ায় ভাসতে-ভাসতে আমরা উড়ে যাব অনেক দূর… চলে যাব অন্য এক মহাপৃথিবীতে…’

    অর্ণবের বুকে মাথা রাখল বৃন্দা। বাড়িয়ে দিল ঠোঁট। অর্ণবও নামিয়ে আনল তার মুখ। আর ঠিক সেই সময় শোনা গেল এক জোড়া বাইকের সাইলেন্সার-ফাটা কর্কশ শব্দ। হেডলাইটের তীব্র আলোয় খান খান হয়ে গেল জ্যোৎস্নাভরা রাত।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook