গতজন্মের বৃষ্টিধারা
মেঘ করে এলে কেন যে পড়াশোনায় মন বসত না, কে জানে। আজও বসে না অবশ্য, আর আজও তার কারণ জানি না। কিন্তু এখন আমি বলছি স্কুলসময়ের কথা। আমাদের স্কুল, যাদবপুর বিদ্যাপীঠ। অবশ্য স্কুল বললে তাকে ভুল বলা হয়, দিনের অধিকাংশ সময়ে তারই শরীরে লেপটে থাকতে থাকতে আমরা হয়ে উঠেছিলাম তার লতাপাতার মতন, আর সে ছিল আমাদের ছায়াবাড়ি। তা যা হোক, সেই ছায়াবাড়িতে জুন জুলাইয়ে আরও ছায়া যখন ঘনিয়ে আসত, কিছুতেই পড়ায় মন বসত না আমার। এ-কথার অবশ্য এমন মানে করবার দরকার নেই যে বছরের বাকি সময়গুলোয় পড়াশোনা করে উদ্ধার করে দিতাম, তা নয়। কিন্তু ওই মেঘের সারি এসে এমন ঢেকে ফেলত আকাশের জমজম আলো যে, বই অন্ধকার হয়ে আসত। মন তো দূর, চোখই বসতে চাইত না পড়ার বইয়ের পাতায়।
মাঝখানে বিরাট এক মাঠের জায়গা ছেড়ে রেখে তার তিনপাশ ঘিরে ছিল আমাদের চারতলা স্কুল। একপাশে সভাগৃহ, তাতে বচ্ছরকার সব অনুষ্ঠান বরাদ্দ। মাঠের মাঝখানে দাঁড়ালে মনে হত, তিন দিক থেকে ভারী লম্বা ও বয়স্ক, চিন্তাবান অভিভাবকেরা ঘিরে রেখেছেন আমাকে। ভয়ের কিছু নেই, বিপদের কিছু নেই, পথ ভুল হবারও কিছু নেই। যতদিন এদের মাঝখানে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি আমি। মাঠে সারাদিন দাঁড়াতে ইচ্ছে করলেও পারতাম না যদিও, স্কুলে যখন গেছি, ক্লাসে বসতেই হত।
আমাদের ক্লাসঘরগুলো ছিল ইয়া বড় বড়। তার বাইরের দিকের দেয়াল আলো করে দুখানা টানা লম্বা জানলা, আর এদিককার দেয়ালে পাহারাদার দুই দরজা। বেশিরভাগ ঘরের নকশাই ছিল এমনটা। একেবারে শুরু দেয়ালে এ-মাথা থেকে ও-মাথা টানা ব্ল্যাকবোর্ড, তার সামনে চেয়ার আর টেবিল, স্যার আর দিদিদের জন্য। তারপর দু’সারি তে আমাদের বসবার বেঞ্চ আর টেবিল। আমি সব সময় চেষ্টা করতাম আগেভাগে পৌঁছতে, যাতে জানলার ধারের কোনও একটা বেঞ্চে স্কুলব্যাগটাকে শুইয়ে দিয়ে সারাদিনের খুশি বায়না করে রাখতে পারি। আর সে-বেঞ্চ যদি ব্ল্যাকবোর্ড থেকে বহুদূরের হয়, তাহলে তো পোয়াবারো, বাইরে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে স্যার বা দিদিদের চোখে পড়তে সময় লেগে যাবে। এই ছিল আমার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। অবশ্য রোজ জানলার ধার পেতামই, এমন নয়, কিন্তু এও ঠিক যে, বেশিরভাগ দিন কীভাবে কে জানে, পেয়েও যেতাম।
জানলা। টানা লম্বা জানলা। তার বাইরে দিন বয়ে যাচ্ছে নিজের মতো করে। স্কুলেরই মধ্যেকার দিন, অথচ তার নিজের কোনও স্কুল নেই। তার সারাক্ষণ ছুটি, সারাক্ষণ কাজ। ওই, বয়ে যাওয়া। জানলার ধারের বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে একেক দিন আমার মনে হত, যেন এই বয়ে যাওয়া দেখার জন্যেই স্কুলে ভর্তি হয়েছি, রোজ পিঠে ব্যাগ নিয়ে পড়ি কি মড়ি করে এসে পৌঁছচ্ছি। আর সেই দিন, বছরের পর বছর একই রকম ভাবে রোদ-মেঘ-হাওয়া-জল পিঠে করে বয়ে যাচ্ছে জানলার বাইরে, তবু পুরনো হচ্ছে না কিছুতেই। কেবল আমি এক ক্লাস টপকে অন্য ক্লাসে উঠে যাচ্ছি, বইয়ের মলাটে রোল নম্বর বদলে যাচ্ছে।
এহেন জানলার পাশে বসে পড়ার বইয়ে মন দেওয়া এমনিতেই ছিল দুস্কর। বাইরে মাঠ, গাছ, কিছুটা আকাশও। বাইরে চড়ুইয়ের দল, শালিখের ঝাঁক। বাইরে ক্লাস নাইনের পিটি ক্লাস। বাইরে এই সমস্ত কিছু। তাই অগত্যা বাইরেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করত। মাঝেমধ্যে চক্ষুলজ্জার খাতিরে বইয়ের পাতা, খাতার মলাট এদিক ওদিক করতে হত ঠিকই, কিন্তু সে নেহাত ছলনা। তবে এই গোটা ব্যাপারটাই বদলে যেত বর্ষাকালে, যা বলবার জন্যে শুরু করেছিলাম এই লেখা। সকাল থেকেই মেঘ করে আসত যেসব দিন, সেসব দিনে স্কুলের চেহারাটাই পাল্টে যেত। বারান্দা আর করিডোরগুলোয় অল্প ঠান্ডা হাওয়া আর মেঘ-লাগা-সবুজের ক্লোরোফিল-আলো। স্কুলের দরজা দিয়ে ঢোকামাত্র একখানা বড় চত্বর ছিল, যেখানে বিশাল এক জলের ট্যাঙ্ক থাকত। আমরা সেখান থেকে জল খেতাম, হাতমুখও ধুতাম। তার উপরটা ছিল খোলা আকাশ। আর তার গায়ে গাছের ডালে বসে থাকা হরেকরকম পাখি আঁকা ছিল। সেই ট্যাঙ্কের মাথায় এসে পড়ত মেঘের আলো, আমরা স্কুলে ঢুকে হাতমুখ ধোওয়ার অছিলায় উপর দিকে তাকিয়ে বুঝে নেবার চেষ্টা করতাম, আর কত দেরি বৃষ্টির।
ক্লাসে বসার পর প্রথমেই যে আমার মন উড়িয়ে নিয়ে যেত, সে হল বর্ষার হাওয়া। তখনও বুঝতাম, এখনও বুঝি, বর্ষার হাওয়ার গায়ের গন্ধ বছরের অন্য হাওয়াদের থেকে অনেক বেশি কাছের, নেশার। তার গায়ে মিশে থাকে বহুপথের মাটি, দীর্ঘ সফরের ধুলো। তার গায়ে মিশে থাকে কত অজানা দেশের বৃষ্টিঝোরা… তবে না সে এই এতদূর আমাদের জানলায় এসে দাঁড়ায়? স্কুলের জানলাতেও দাঁড়াত সে। আর আমাকে ডাকত বাইরে। শুরুতে হয়তো জীব বিজ্ঞানের ক্লাস, আমি ব্রাউন পেপারে মলাট দেওয়া বইখানা খুলেছি সবে, চিত্ত স্যার ক্লাসে ঢুকলেন বলে, এমন সময়ে সেই ভেজা ভেজা হাওয়া এসে দিল সব উল্টে! তাকে দোষ দেওয়াও যায় না, সে তো এই কাজেই বেরিয়েছে পথে-পথে। সেই রাস্তায় আমাদের স্কুল পড়ে গেলে তার আর কী করা।
একে তো সেই হাওয়া, তার ওপর গোটা স্কুলটা কেমন যেন নিভে এসেছে। স্বাভাবিক দিনে তার যে-আঁচ, যে-তেজ, ঘরে-বারান্দায় তার যে গমগম করে ওঠা, সবটুকু কেমন নিভে এসেছে হঠাৎ। মেঘ লেগেছে তার গায়ে। আষাঢ়ে অসুখ করেছে তার। নিভে এসেছে তাই। যেন কোনও দস্যি বেড়াল সারাদিন পর জানলার কাছে চুপটি করে বসে আছে, যেন সমুদ্রে জাহাজ যাবে বলে আজ কেউ বাড়ি ছাড়েনি, যেন আভেনে কেটলি বসিয়ে চা নামাতে ভুলে গেছে সকলে… এমনই নিভে যাওয়া দিন হয়ে উঠত একেকটা সকাল। জীব বিজ্ঞান থেকে ভূগোল, বাংলা থেকে ইতিহাস, সব বইয়ের পাতা ঝাপসা হয়ে আসত একের পর এক। মেঘের দৌরাত্ম্যে অক্ষরগুলোও যেন বর্ষার দলে নাম লেখাত, কিছুতে ভালমতো পড়তে দেবে না। প্রথম পিরিয়ড শেষ, দ্বিতীয়টাও শেষের মুখে যখন, ক্লাস একেবারে ঘনান্ধকার। আমার মুখ যথারীতি জানলার বাইরে। স্কুলের মাঠটা যেন রুমালের মতো শুষে নিতে চাইছে বর্ষার এই মরা আলো, তাতে তার কী লাভ কে জানে। ব্ল্যাকবোর্ডের লেখাগুলোও ছাই ছাই, স্যার বললেন ক্লাসরুমের আলো জ্বেলে দিতে। সিলিং থাকা লম্বা ডাঁটিওলা কতগুলো বাল্ব জ্বলে উঠল পরপর। কিন্তু তাতে মনকেমন বাড়ল বই কমল না। ঘরখানা কেন যেন আরও নিভু নিভু হয়ে এল, মনখোলা গরিব মানুষের মুখের মতোই।
তখন আর প্রেইরি অঞ্চলের কৃষি কাজ মাথায় ঢুকছে না, গফুর আর মহেশের ভালবাসাও দূর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, ও হেনরি’র ছোট গল্পের মানে বুঝতে ইচ্ছে করছে না আর। কেবলই দেখছি, জানলার বাইরে ছাইরঙা মাঠে এবার ধুলোর ঘূর্ণি পাক খাচ্ছে, পাক খাচ্ছে, নিজের ঘূর্ণনে সে জড়িয়ে নিচ্ছে শুকনো পাতার অলস ঝাঁককেও। এই, এইবার নামবে… বলতে বলতে নেমেও গেল ঝুপ করে। বৃষ্টি। যেন গতজন্মের পার থেকে দেখা করতে আসা বন্ধু, যেন ঘুম থেকে ছাড়া পাওয়া দস্যি মেয়ে কোনও। টিমিটিমে আলোর ক্লাসরুমে স্যারের গলা, দিদির পড়ানো, সব ঝাপসা হয়ে ঢেকে গেল বাইরের ঝমঝম শব্দে। কয়েকটা কাচ ভাঙা আছে জানলার, তাই দিয়ে জলের ছাট ঢুকে এসে ব্যাগখাতাবই ভিজিয়ে একশা। গায়ে গায়ে ঠাসাঠাসি করে সরে আসা ছেলেমেয়েরা তখন বৃষ্টির সঙ্গে অসম যুদ্ধে নেমে পড়েছে। অথচ আমার চোখ সরছে না, মন সরছে না, ব্যাগখাতাবই সরছে না। গোটা স্কুলবাড়িটা যেন এক পরিত্যক্ত দ্বীপ তখন, যার কথা দুঁদে নাবিকরাও টের পায়নি কোনও দিন, যে কেবল ঘন বর্ষায় জেগে ওঠে সমুদ্রের বুকের ওপর, আবার মিলিয়ে যায় নীচে। আর আমার যেন কোনও অতীত ছিল না এই স্কুলবৃষ্টির আগে, যেন কোনও ভবিষ্যতও নেই কোথাও। কেবল এই টানা জানলার ধারে বসে ওপারের জলধারা দেখে যাবার নিয়তি নিয়ে বসে থাকা যেন আমার চিরকালের কাজ। আজও যখন বৃষ্টি নামে, আমি এক নামধামহীন বালককে দেখতে পাই। ফাঁকা ক্লাসঘরে, ডুবন্ত স্কুলের এক জানলায় চোখ রেখে যে বসে আছে। আর তাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে গতজন্মের বৃষ্টিধারা…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র