ম্যাট রিভসের ‘দ্য ব্যাটম্যান’ (২০২২) দেখার সময় এই প্রথম যেন আমার চোখের সামনে গথাম শহর জীবন্ত হয়ে উঠল। নিওনের পরিমিত ব্যবহারে, বৃষ্টিভেজা কংক্রিটের চিকচিকে আলোয়, ছায়াময়ী অলিগলিতে। গথামকে দেখে আমাদের চেনা কোনও শহরের সাথে তুলনা করা যায় না। বরং, মনে হয় একটা আধুনিক মিথোলজিকাল নগরী, যার কিছুটা অলীক, কিছুটা সত্য… যেখানে রাতের বেলা মেঘের কোলে একটা বাদুড়ের ছায়া দেখা যেতে পারে।
শুধু এস্থেটিক দিক থেকে নয়, এইরকম ব্যাটম্যানের গল্প সিনেমাতে আগে দেখা যায়নি। কমিক্সে ব্যাটম্যানের বেশির ভাগ গল্প গোয়েন্দাগিরির ধাঁচে লেখা, কিন্তু রূপোলি পর্দায় তাকে সেইভাবে আমরা তেমন পাইনি। তাই, ‘দ্য ব্যাটম্যান’ (২০২২) দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। ঠিক যেন কমিক্সের পাতা থেকে উঠে এসেছে এই রুকি ব্যাটম্যান। সে এখনও গথামকে পুরোপুরি চেনেনি, শহরটাকে নিজের আয়ত্তে আনতে পারেনি। গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে ভুল করেছে অনেক, আর তার জন্যে মাশুলও দিতে হয়েছে তাকে। এই ব্রুস ওয়েনের মধ্যে জ্বলছে ক্রোধের আগুন, আর সেই আগুনের ক্ষুধার্ত উদরে তার মনুষ্যত্ব ধীরে ধীরে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। সুপারহিরো সিনেমা নতুন করে ভালবাসতে শিখেছি ব্যাটম্যানের এইরকম মানবিক চরিত্রাঙ্কন দেখে। আর মনে পড়ে গেছে বহু বছর আগে পড়া একটা কমিক্সের কথা।
ব্যাটম্যান ইয়ার ওয়ান
‘দ্য ব্যাটম্যান’ (২০২২) দেখার পর যে-কাজটা আমি করেছিলাম, সেটা হল বাড়ি ফিরে বইয়ের গাদা থেকে টেনে-টেনে আমার কলেজ-জীবনে কেনা ‘ব্যাটম্যান ইয়ার ওয়ান’ (১৯৮৭) কমিক্সটা বার করে আনা। পেপারব্যাক বই। মলাটের একটা কোণ না জানি কীভাবে তুবড়ে গেছে। কিন্তু ভেতরের ম্যাট পাতার মাঝে জমে থাকা অন্ধকারে এখনও রোমাঞ্চ রয়েছে ষোলো আনা। ঠিক যেমন ছোটবেলায় রাতের দিকে ব্যাটম্যানের কার্টুন দেখে শিউরে উঠতাম, এখানেও তেমনটাই হল। এত বছর পরেও।
আসলে আধুনিক যুগের ব্যাটম্যানের কনসেপ্ট কীরকম হওয়া উচিত, সেটা ১৯৮৭ সালে চারটি ইস্যুতে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত ‘ইয়ার ওয়ান’ গল্পেই প্রথম ঠিক করা হয়। এর আগের বেশির ভাগ কমিক্সগুলোতে ব্যাটম্যানের চরিত্রে লঘুতা যেন একটু বেশি ছিল। রংচঙে বালখিল্যতার মাঝে ব্যাটম্যান শত্রু দমনের জন্য বেরুত। সাথে থাকত চ্যালা রবিন। জোকার, টু-ফেস বা রিডলার মুখোমুখি হলে সেগুলোয় ছিল একটা খেলা-খেলা ভাব, যেন আসল বিপদ কাকে বলে এরা কেউই ঠিক জানে না। লেখকরাও রিয়ালিজমের তেমন ধার ধারত না।
তারপর হঠাৎ, ফ্র্যাঙ্ক মিলারের জাদুতে, ১৯৮৬ সালের ‘ব্যাটম্যান: দ্য ডার্ক নাইট রিটার্নস’-এ ব্যাটম্যান হয়ে উঠল একজন অমানিশার কিংবদন্তি, গথামের সমস্ত অপরাধীর ভয়ের প্রতীকী। এই গ্রাফিক উপন্যাসে ব্যাটম্যানের গাম্ভীর্য ছিল আগের থেকে বেশি। গল্পে ভায়োলেন্সও ছিল মাত্রাছাড়া। তবে ‘ডার্ক নাইট’-এর গল্প ডিসি কমিক্সের প্রাথমিক ধারাবাহিকতার অংশ ছিল না, বরং সেখানে একটা বিকল্প অস্তিত্ব দেখানো হয়েছিল। গল্পের ব্রুস ওয়েন ছিল বৃদ্ধ— সুপারহিরো জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর, জীবনের সায়াহ্নে এসে সে আবার ফিরে এসেছিল গথামকে বাঁচাতে।
১৯৮৬-’৮৭ সালে ডিসি কমিক্স রিভ্যাম্পের সময় ঠিক যেন সেই ভাবেই ফ্র্যাঙ্ক মিলার আবার ফিরে এলেন ব্যাটম্যানকে বিস্মৃতির হাত থেকে বাঁচাতে। আর্টিস্ট ডেভিড মাৎজুকেলি আর কালারিস্ট রিচমন্ড লিউইসের সাহায্যে লিখে ফেললেন ‘ইয়ার ওয়ান’— গথাম শহরে ব্যাটম্যানের প্রথম আবির্ভাবের গল্প। যে-লেখক ব্যাটম্যানের শেষ জীবন দেখিয়েছে, সেই যে উত্থানের আখ্যান লিখতে পারবে, তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না। এরপর থেকে ব্যাটম্যানের সব গল্পে চলে এল প্রাপ্তবয়স্ক এলিমেন্ট। গথামের অর্থনৈতিক আর সামাজিক জটিলতা নিয়ে কাটাছেঁড়া চলতে থাকল। লঘুতাকে বাদ দিয়ে বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো কমিক্সের পাতায় আশ্রয় নিল। রাস্তার গুন্ডা, ক্রাইম লর্ড আর রংচঙে ভিলেনদের পাশাপাশি ঘুষখোর, পুলিশ আর রাজনৈতিক নেতারা নেপথ্যে চলে এল। আর ঠিক এই সময় থেকেই ব্যাটম্যানের গোয়েন্দাগিরিতে আনা হল রিয়ালিজম।
ব্যাটম্যানের প্রারম্ভ
আসলে ১৯৮৬ সালের দিকে ডিসি কমিক্সের নবীকরণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। বিক্রি তলানিতে ঠেকেছিল। তার সাথে, সমকালীন সমালোচকেরা নালিশ করছিল, ডিসি কমিক্সের হিরোরা নাকি বড্ড সেকেলে হয়ে গেছে। অতএব, সম্পাদকীয় পরিষদ ঠিক করলেন, সবার গল্পেই আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। নতুন যুগের সুচনা হল ওয়ান্ডার ওম্যান আর সুপারম্যানের নতুন গল্প লিখে। ক্লার্ক হয়ে গেল কানসাসের ফার্ম বয়। ডায়ানা জন্ম নিল কাদার তাল থেকে, ঐশ্বরিক আশীর্বাদের সহায়তায়। কিন্তু ব্রুসের গল্পে কী ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব? ডিসির সম্পাদকীয় পরিষদ মাথা চুলকাতে লাগলেন।
আসলে বব কেন এবং বিল ফিংগার দুজনে ব্যাটম্যানের এমন একটা প্রারম্ভ-গল্প লিখে গেছেন, সেটা যে-কোনও যুগে, যে-কোনও অনুষঙ্গে প্রাসঙ্গিক থেকে যায়। গথামের মতো অপরাধবেষ্টিত শহর পৃথিবীর প্রতিটা কোণায় দেখা যেত, দেখা যায়, দেখা যাবে। আর অপরাধীদের লুঠপাট-রাহাজানি তো সমাজের চিরকালীন অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘মাস্ক অফ জোরো’ দেখে রাতের বেলা বাড়ি ফিরছিলেন থমাস আর মার্থা ওয়েন, গথামের এক ধনী এবং প্রভাবশালী দম্পতি। সাথে ছিল তাদের আট বছর বয়সি ছেলে, ব্রুস। কেন জানি, থমাস ঠিক করলেন বাড়ি তাড়াতাড়ি যাবেন, তাই শর্টকাট ধরার জন্যে পার্ক রো-এর রাস্তা ধরলেন। অন্ধকার আর জঞ্জালে ভর্তি একটা গলি, লোকজন খুব একটা যাতায়াত করে না। শর্টকাটের সিদ্ধান্তই শেষে কাল হল, কোন এক ছিনতাইবাজের গুলি খেয়ে থমাস আর মার্থা বেঘোরে প্রাণ হারালেন। ছোট্ট ব্রুস তার মা-বাবার রক্তাক্ত দেহের পাশে বসে রইল অনেকক্ষণ। পুলিশ যে কখন এসে ওকে তুলে নিয়ে গেছিল, সেই বোধ ওর আর ছিল না।
এইরকম ভয়াবহ একটা অরিজিন গল্পকে পরিবর্তন করার কোনও মানে হয় না। রিভ্যাম্প করার সময় ফ্র্যাঙ্ক মিলার এই গল্প হুবহু এক রেখে দিলেন। ব্যাটম্যানের জন্ম হয়েছিল সেই অন্ধকার গলিতে, রক্তমাখা ব্রুস যেন বুঝেছিল, গথাম শহরে পচন ধরেছে, অরাজকতায় ভরে গেছে অলিগলি। প্রতি যুগে, প্রতি ব্যাটম্যানের জন্ম হতে থাকবে সেইরকম একটা গলিতে, যেখানে মা-বাবার সাথে শৈশবও মারা যায়।
ম্যাট রিভসের সিনেমাতেও এই অরিজিন রয়েছে। কিন্তু যেখানে অন্যান্য সিনেমায়, থমাস আর মার্থার মৃত্যুর সিন অনেক ঘটা করে দেখান হয়েছে, ‘দ্য ব্যাটম্যান’-এ (২০২২) সেই সবের বালাই নেই। সরাসরি সেই মৃত্যুর দৃশ্য না দেখিয়ে, একটা ছোট্ট ঘটনার মাধ্যমে পরিচালক দেখিয়েছেন, সেই রাতের ঘটনা ব্রুসকে চিরকালের মতো বদলে দিয়েছে।
সিনেমার শুরুতে দেখা যায় গথামের মেয়র বীভৎস ভাবে খুন হয়ে গেছেন। পুলিশের ডাক পেয়ে ক্রাইম-সিনে ব্যাটম্যান এসে দেখে মেঝেতে একটা রক্তাক্ত পায়ের ছাপ। সেই ছাপটা একটা বাচ্চার। জানা যায় মেয়রের ছোট্ট ছেলেটা তার বাবার মৃতদেহ সবার প্রথমে খুঁজে পায়। ব্যাটম্যান তাকিয়ে থাকে সেই পিতৃহীন ছেলেটার দিকে। তখন যেন সেই মিশকালো মুখোশের ভেতর থেকে আমরাও দেখতে পাই বাচ্চা ব্রুসকে। মনের গভীরে ব্রুস আবার সেই রাতের ঘটনাগুলোকে রিপ্লে করছে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ওর চোখদুটো যেন অল্প চিকচিক করে ওঠে, কারণ সে জানে শৈশবের মৃত্যু কতখানি কষ্টদায়ক।
কথকের ব্যবহার
সুপারহিরো কমিক্সে, কথকের ব্যবহার খুব একটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সিনেমায় ব্রুসকে ন্যারেটর হিসাবে দেখলাম এই প্রথম। এখানেও ‘ইয়ার ওয়ান’-এর প্রভাব নাকচ করা সম্ভব নয়। গ্রাফিক নভেলে অবিশ্যি শুধু ব্রুস ওয়েন / ব্যাটম্যান নয়, কথক হিসাবে রয়েছে জিম গর্ডনও। গথামের সেই পুলিশ কমিশনার যে ব্যাটম্যানকে নানাভাবে সহায়তা করে এসেছে, সেই গর্ডন কমিক্সে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এইক্ষেত্রে আমি বলব, সিনেমার থেকে কমিক্সের গভীরতা অনেক বেশি থেকে গেছে। ফ্র্যাঙ্ক মিলার বুঝেছিলেন গল্পের কথক হিসাবে শুধু ব্রুস ওয়েনকে রাখলে গল্পটা কেমন একতরফা হয়ে যাবে। অরাজকতার মূলে যাওয়া সম্ভব হবে না। কারণ ব্যাটম্যান এখনও নতুন, নিজের শহরকে সে সবে চিনতে শুরু করেছে। তাই জিম গর্ডনের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে গথাম শহরের পুলিশ বিভাগের দুর্নীতি; দেখান হয়েছে শহরের নৈতিকতার স্তম্ভে ঘুণ ধরেছে। তাই ‘ইয়ার ওয়ান’ সর্বদা ব্যাটম্যান কেন্দ্রিক হয়ে থাকেনি। এই গ্রাফিক উপন্যাসটি জিম গর্ডনের উত্থানের গল্পও বটে। গর্ডনের গুরুত্বটা বোঝানোর জন্যেই হয়তো কমিক্সের প্রথম প্যানেলের প্রথম সংলাপ ওকে দিয়ে বলানো হয়েছে।
‘Gotham City. Maybe it’s all I deserve now. Maybe it’s just my time in Hell.’
কেন জানি এই সংলাপটা পড়ে দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’-এর কথা মনে পড়ে। জিম গর্ডন নিউ ইয়র্ক থেকে এইবার নরকে প্রবেশ করছে।
‘দ্য ব্যাটম্যান’ (২০২২)-ও শুরু হয় একটা মনোলগের মাধ্যমে। ব্রুস বলছে:
‘Thursday, October 31st. The city streets are crowded for the holiday. Even with the rain. Hidden in the chaos is the element, waiting to strike like snakes. And I’m there too. Watching.’
এক্ষেত্রেও বোঝা যায়, গথাম শহর ঠিক কতখানি বিপজ্জনক, কতখানি বিশৃঙ্খল। গথামকে বর্ণনা দেওয়ার সময় ব্রুস সেটাকে শহর হিসাবে কম, হিংস্র জানোয়ার হিসাবে বেশি দেখেছে। গথাম শহর যেন অন্ধকারে ফুঁসছে, অপেক্ষা করছে ছোবল মারার জন্যে।
যেন বাইবেলের সময়ের সেই সদম আর গোমোররাহ (Sodom and Gomorrah) শহরদুটো গথাম নাম নিয়ে বর্তমান যুগের পৃথিবীতে একটা ছত্রাকের মত গজিয়ে উঠেছে। শুধু পার্থক্য এই যে, গর্ডনের সংলাপে ফুটে উঠেছে অসহায়তা। কিন্তু ব্রুসের কথা শুনে বোঝা যায় তার আত্মসংকল্প কতখানি দৃঢ়।
থিমের মিল
থিমের কথা এলে, বলতে হয়, ‘দ্য ব্যাটম্যান’ (২০২২) শুধু ‘ইয়ার ওয়ান’-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়নি। ম্যাট রিভস একাধিক গ্রাফিক উপন্যাস থেকে একটা ব্যাটম্যান/ডিটেকটিভ গল্পের নির্যাস টেনে নিয়ে সিনেমার পর্দায় এনে ফেলেছেন। ‘দ্য লং হ্যালোয়িন’, ‘ডার্ক ভিক্টরি’, ‘হাশ’, ‘ইগো’-এর মতো অসংখ্য উপন্যাসের নানা রকম এলিমেন্ট সিনেমায় চোখে পড়েছে, কিন্তু সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হলে তো আস্ত একখানা বই লেখা হয়ে যাবে। তার থেকে চলুন আমরা দেখি, ‘ইয়ার ওয়ান’ ঠিক কীভাবে ‘দ্য ব্যাটম্যান’ (২০২২) গল্পের উপর প্রভাব ফেলেছে।
‘ইয়ার ওয়ান’ উপন্যাস শুরু হয় ১২ বছর পর গথাম শহরে ব্রুস ওয়েনের পুনরাবির্ভাবের মাধ্যমে। তবে প্রথম দিন থেকেই সে বাদুড় সেজে রাস্তার গুন্ডা প্যাঁদাতে শুরু করেনি। বরং, ব্রুস প্ল্যান করে ভিখারির ছদ্মবেশ ধরে শহরের নানা অলিগলিতে ঘুরে বেরাবে। রেড-লাইট এরিয়া থেকে বন্দরের মতো অপরাধবেষ্টিত এলাকার মাঝে ঘুরে-ঘুরে সে শহরটাকে চেনার চেষ্টা করবে। ছদ্মবেশ অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু তারপরে অভিজ্ঞতার অভাবে সে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে যায়। মারপিট, পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্যে গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট ঘটানো ইত্যাদি নানা হলিউডি ঘটনার পর সে তার প্রাসাদসম বাড়িতে এসে পৌঁছয়। অত্যধিক রক্তক্ষরণের জন্যে ওর যাই-যাই অবস্থা। কেদারায় বসে ব্রুস নিজের ব্যর্থতার কথা ভাবছে, ঠিক তখনই জানালার কাচ ভেঙে একটা বাদুড় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে যায়। সেটার রাক্ষুসে চেহারার দিকে ব্রুস ঠিক করে, ‘I shall become a bat.’
কমিক্সের এই ঘটনাটা বললাম, কারণ ব্যাটম্যানের যে ব্লু-প্রিন্ট ১৯৮৭ সালে ফ্র্যাঙ্ক মিলার বানিয়েছিলেন, সেটা ২০২২ সালে ‘দ্য ব্যাটম্যান’-এ আমরা হুবহু দেখতে পাই। সিনেমায়, ব্রুস ব্যাটম্যান হিসাবে কাজ করা শুরু করেছে দু’বছর মতো হল, অর্থাৎ এটা যেন ‘ইয়ার ওয়ান’ কমিক্সেরই একটা সংযোজন। কমিক্সের ব্যাটম্যানকে অপরাধীরা সবে চিনতে শুরু করেছে, কিন্তু সিনেমায়, সে ইতিমধ্যেই সকলের মনে বেশ গভীর ছাপ ফেলতে শুরু করেছে… অপরাধীরা তাকে ভয় পেতে শুরু করেছে।
এখানেও সে ড্রিফটারের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। এখানেও নিজের ভুলের জন্য নানা প্রাণঘাতী সমস্যায় জড়াতে হয়েছে। এখানেও সে হাল ছাড়েনি, শেষ অবধি লড়ে গেছে।
কিন্তু অনেক রকম ন্যারেটিভ জটিলতার মাঝে, যে-থিমটা আমি এই দুটো গল্পেই দেখতে পেয়েছি তা হল, গথাম শহরের বিরুদ্ধে ব্যাটম্যানের সংগ্রাম। বিশেষ করে যারা শহরটাকে চালানোর দায়িত্বে আছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের নায়কের সংগ্রাম। দুটি আখ্যানেই পুলিশ কমিশনার থেকে শহরের মেয়র সকলেই দুর্নীতির পূজারি। ব্যাটম্যানের গল্পে রংচঙে ভিলেনের অভাব নেই ঠিক, কিন্তু গথাম শহরটাকে সবথেকে কলুষিত করছে এইরকম শার্ট-প্যান্ট পড়া তথাকথিত সভ্য রক্ষকেরা। দুই ক্ষেত্রেই ব্যাটম্যান এই সমস্যার কোনও সমাধান খুঁজে পায়নি। এখন প্রশ্ন হল, ব্যাটম্যানের জন্য এই দুর্নীতির সমস্যা বেড়েছে না কমেছে? ফ্র্যাঙ্ক মিলার আর ম্যাট রিভস— দুজনেই সরাসরি কোনও উত্তর দেননি।
এস্থেটিকের মিল
এস্থেটিকের কথা এলে, আর্টিস্ট ডেভিড মাৎজুকেলি আর কালারিস্ট রিচমন্ড লিউইসের, দুজনের কথায় বলতে হয়। ইঙ্কিং-এর সময় সরু নিবওয়ালা পেন ব্যবহার না করে, মাৎজুকেলি মূলত ব্রাশপেন ব্যবহার করেছেন। মোটা-মোটা রেখা আঁকার জন্য প্রতিটা প্যানেলে আলো ছায়ার বিপুল বৈপরীত্য বা কনট্রাস্ট দেখা যায়। গথামকে ছায়াময় দেখায়। সেই ছায়ার মাঝে চরিত্রগুলোকে কেমন অশরীরীদের মতো লাগে।
এই আলো-ছায়ার বৈপরীত্য, যা নোয়ার জঁরের অন্যতম বিশেষত্ব, সেটা ‘দ্য ব্যাটম্যান’ (২০২২) সিনেমায় প্রতিটা ফ্রেমে দেখা যায়। এই রকম ভিসুয়াল আইডেন্টিটির জন্যে সিনেমাটোগ্রাফার গ্রেগ ফ্রেজার মূলত দায়ী। তার ক্যামেরার কাজের জন্যে মৃদু অথবা কড়া আলোর মধ্যে থেকেও সিনেমার চরিত্রেরা অনেক সময় কালো অবয়বের মতো ঘোরাফেরা করতে থাকে।
আবার অন্যদিকে, কমিক্সে হাইলাইটের জন্যে রিচমণ্ড লিউইস প্রচুর লাল, গোলাপি, কমলা আর আকাশি রঙের ব্যবহার করেছেন। লাল, নীল আর গোলপি নিওন আলোয় গথামের রেড-লাইট এলাকা এক ধরনের উগ্র সৌন্দর্য প্রকাশ করে, যার মাদকতা অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
সিনেমায় এইরকম নিওনের ব্যবহার করা হয়েছে, যদিও অনেকটা পরিমিত ভাবে। গথামের মুখ অসংখ্য বিজ্ঞাপনের সাইনবোর্ডে ঢেকে গেছে। সেই সাইনবোর্ডের কড়া আলোয় বৃষ্টিভেজা রাস্তাগুলো শুয়ে থাকা সাপের মতো দেখায়।
তবে দুই ক্ষেত্রেই যে-রংটা সবথেকে বেশি ফুটে উঠেছে সেটা হল লাল রং। লাল-এর মাধ্যমে অনেক কিছু বোঝানো সম্ভব। ক্রোধ ও বিপদ, অথবা সাহস ও ত্যাগ।
কালারিস্ট রিচমন্ড ‘ইয়ার ওয়ান’-এ মূলত বিপদ বোঝানোর জন্যে লাল রঙের নানা শেড ব্যবহার করেছেন। বিপদের সময় সারা শরীরে অ্যাড্রেনালিন যেভাবে ছড়িয়ে যায়, ঠিক সেইভাবে কমিক্সের পাতা জুড়ে লালের নানা শেড দেখা যায়।
সেদিক থেকে সিনেমায় লাল রঙের গুরুত্ব একটু বেশি। প্রথমে, এই রঙের মাধ্যমে ব্যাটম্যানের মধ্যে জমে থাকা আক্রোশ বোঝানো হলেও, পরে এর অন্তর্নিহিত অর্থ পরিবর্তিত হয়ে যায়। গল্প এগোনোর সাথে-সাথে ব্রুস বুঝতে পারে, ব্যাটম্যান হয়ে শুধু ভয়ের উদ্রেক জাগালেই হবে না, বরং তাকে সাধারণ মানুষের মনে আশার আলো জাগিয়ে তুলতে হবে। সিনেমার ক্লাইম্যাক্সে সিনেমাটোগ্রাফার গ্রেগ ফ্রেজার একটা দারুণ ওভারহেড শট আমাদের উপহার দিয়েছেন। ধ্বংসাবশেষের মাঝে, হাতে লাল ফ্লেয়ার ধরে ব্যাটম্যান গথামবাসীদের পথ দেখিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে জল আর অন্ধকার। এখানে লাল রং হয়ে গেছে আশা আর সাহসিকতার প্রতীক।
শেষ কথা
সত্যি এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। নবীন ব্যাটম্যানের পথ চলা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৮৭ সালে, কমিক্সের পাতায়। সেই কমিক্সের নানা এলিমেন্ট যে প্রায় সাড়ে তিন দশক পর সিনেমার পর্দায় দেখতে পাব, সেটা বেশ আশ্চর্যের। বিশেষ করে এই যুগে, যখন বেশির ভাগ সিনেমার নিজস্ব আইডেন্টিটি বলে আর কিছু নেই।
আশা করি এইভাবেই ব্যাটম্যানের গুরুত্বপূর্ণ কমিক্সগুলো বেঁচে থাকবে, সিনেমার পর্দায় নতুন করে প্রাণ ফিরে পাবে। কারণ, বর্তমান সমাজে অপরাধ কখনও থেমে থাকবে না। কারণ, ‘Batman always comes back, bigger and better, shiny and new. Batman never dies. It never ends. It probably never will.’