মৃণাল সেন: নতুনের সঙ্গে শেষ অবধি
কদিন আগে ১৪ মে মৃণাল সেনের ৯৯তম জন্মদিবস পালিত হল SRFTI প্রেক্ষাগৃহে । আগামী বছর ওঁর শতবর্ষ। সেদিন ওঁর ঘনিষ্ঠ অনেকেই অনেক কথা বললেন। শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাচ্ছিল কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা। আশির দশক। আমি তখন ম্যাক্সমুলার ভবনে নাটক করি। নৃত্যনাটক । অঞ্জন দত্ত তখন মৃণাল সেনের নায়ক। সে-ও ওখানেই নাটকের দল চালায়। নাম ওপেন থিয়েটার। সেই সময় ‘খারিজ’ মুক্তি পায় । আমরা যেহেতু একই ছাদের তলায় মহড়া দিতাম সবাই গিয়েছিলাম ছবি দেখতে। এরপর অঞ্জনের সঙ্গে করলাম নাটক। ব্রেশট-এর ‘থ্রি পেনি অপেরা’। অঞ্জন হয়েছে ম্যাক দ্য নাইফ। আমি দুটি চরিত্রে অভিনয় করি, জেনি ও লুসি। একটাতে আবার গান গাইতে হত, অঞ্জনের সঙ্গে নাচতে নাচতে। খুব টেনশনে থাকতাম। আর যেদিন শুনলাম মৃণাল সেন দেখতে আসবেন তার আগের দিন রাতে প্রায় ঘুমই বন্ধ। উনি এলেন। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম বসেছেন প্রথম সারির মাঝামাঝি। মঞ্চে ওঠার আগে ঠিক করে নিয়েছিলাম দর্শকদের দিকে তাকাব না। কিন্তু এমনই অমোঘ আকর্ষণ ওই ভদ্রলোকের যে বার বার ওঁর দিকেই চোখ চলে যায়। উনি কিন্তু একমনে নাটক দেখছেন। নাটকের শেষে পরিচিতির পালা। অঞ্জন আলাপ করিয়ে দিতে উনি বলেছিলেন, ‘জেনি চরিত্রে তোমাকে বেশি সাবলীল লেগেছে। আসলে তোমার চেহারা-পোশাক, বাচনভঙ্গির মধ্যে রয়েছে পাশ্চাত্যের ছাপ।’ এটা প্রশংসা হিসেবেই নিয়েছিলাম। এর পর ‘মারা সাদ’ নাটকেও উনি এসেছিলেন। আমার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো মৃণাল সেন আমাকে কোনো চরিত্রে সুযোগ দেবেন। হয়নি, তবে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগটা থেকে যায় এবং আমি যখন সাংবাদিকতার জগতে পদার্পণ করি, এই যোগাযোগই কাজে লাগে।
আমি বেশ কয়েকবার ওঁর সাক্ষাৎকার নিই, নানা বিষয়ে ওঁর মতামত নিই। এবং উনি বন্ধুর মতোই ব্যবহার করতেন। ওঁর বেলতলার বাড়িতে গেছি। চা খাইয়েছেন, গল্প করেছেন, অনায়াসে জিজ্ঞেস করেছেন সিগারেট খাই কিনা, না শুনে অবাক হয়েছেন, কারণ আমাকে দেখে মনে হয়েছে আমি সিগারেট খেতে পারি। এ ধারণা অনেকেরই হত। যাই হোক সিনেমা শুধু নয়, নানা ঘটনা নিয়ে, মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে, মহিলাদের পরিবর্তন, সাংবাদিকতায় মহিলাদের অবস্থান , ওঁর জীবনের অভিজ্ঞতা, শুটিংয়ের বাইরের ঘটনা, বিদেশ ভ্রমণের কাহিনি কথা বলতে উনি ভালবাসতেন । মাঝে মধ্যে গীতাদিকেও ডেকে নিতেন, যদিও উনি অফিশিয়াল ইন্টারভিউ নিলে চায়ের বন্দোবস্ত ছাড়া আসতেন না। ওঁদের বাড়িতে ছিল বইয়ের পাহাড়। অবিন্যস্ত ভাবে ছড়ানো ছিটানো বই, ডাঁই করে রাখা বই, কথা বলতে বলতে বই টেনে বার করে রেফারেন্স দিতেন….ওঁকে ইন্টারভিউ নিতে যাওয়া মানে বেশ কয়েক ঘণ্টার আনন্দ। মৃণালদার হাঁটা চলার মধ্যেও ছিল একটা গতিশীলতা। সিঁড়ি ওঠার সময় ৭০ বছর বয়সেও দুই ধাপ লাফিয়ে উঠতে পারতেন। এটা আমাকে তখন মুগ্ধ করেছিল, আর এখন পিছনে তাকিয়ে হিংসে হয়।
ওঁর শুটিংয়ে আমি খুব একটা যাইনি। তবে ৯০-এর দশকে ‘মহাপৃথিবী’ ছবির শুটিংয়ে একাধিকবার গেছি কারণ রীনাদি, অর্থাৎ অপর্ণা সেন ছিলেন ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্রে। আমি তখন পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, শুটিংয়ের ফাঁকে পাতার অলংকরণ, কোনো বিশেষ লেখা দেখাতে নিয়ে যেতাম। আর এটার জন্য যেতাম বিকেলে, কারণ মৃণালদার সঙ্গে আলাপচারিতার লোভ। উনি দুটো শটের বা সিনের মাঝে আসতেন রীনাদির সঙ্গে কথা বলতে। আর আমরা থাকলে আমাদেরও জড়িয়ে ফেলতেন আলোচনায়। আমাদের তেমন কিছু যোগ করার প্রয়োজন হত না,ওঁর কথা শুনতে শুনতে অন্য জগতে চলে যেতাম। আর রীনাদিও ততদিনে বেশ কয়েকটি ছবি তৈরি করে ফেলেছেন। মৃণালদা ও রীনাদির কথোপকথন চলত মেকিং নিয়েও। তখন তো আর মোবাইল ছিল না, এমনকি আমরা ডিক্টফোন বা রেকর্ডারও নিয়ে যেতাম না, তাই কংক্রিট কোনো প্রমাণ হাতে নেই যা আছে মনের ক্যামেরা ও রেকর্ডারে ধরা আছে। কখনও আবছা,কখনও বা উজ্জ্বল।
সেই বৃষ্টির সন্ধ্যা আজও মনে আছে। শুটিং হচ্ছিল, আমহার্স্ট স্ট্রিটের কাছে একটি বাড়িতে। বিকেলে যখন পৌঁছেছি তখন মেঘ করে এসেছে। পৌঁছে দেখি রীনাদির ঘরে সিন বোঝাচ্ছেন মৃণালদা । আমরাও বসে গেলাম। লাইট হচ্ছে রান্নাঘরে, ওখানেই সিন। আমাদের দেখে মৃণালদা কিছুটা বুঝিয়ে লাইট নিয়ে কথা বলতে বেরিয়ে গেলেন। ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আমরা তারই মধ্যে পাতা দেখিয়ে নিলাম রীনাদি কে। বৃষ্টির মধ্যেই ফিরে এলেন মৃণালদা, এত বৃষ্টির মধ্যে জানলার বাইরের লাইট বসানো যাচ্ছে না তাই অপেক্ষা করতে হবে।
বলেই বসে পড়লেন মাটিতে। পরনে দুধ সাদা চুড়িদার কুরতা। তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বিকেলের টিফিন এ সেদিন ছিল মুড়ি আর তেলেভাজা। আর কী চাই! শুরু হল গল্প। কেন ‘মহাপৃথিবী’ করছেন। কীভাবে কলকাতা পাল্টে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা বিদেশ চলে যাচ্ছে, ফিরছে না। সেই থেকে শুরু করে রীনাদির ছবি নিয়ে, মেয়েদের নিয়ে সিনেমা, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে মহিলা সমস্যা ও নারীর চোখ দিয়ে তাদের সমস্যা। আমরা কেউ কোনো কথা বলছি না, মৃণালদা ও রীনাদির কথোপকথনের নীরব সাক্ষী। কখন যে বৃষ্টি থেমে গেছে খেয়াল নেই। মৃণালদার এক সহকারী এসে বললেন শট রেডি, বৃষ্টিও থেমে গেছে। তবে বাইরে বেরোনো মুশকিল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি কলকাতা তখন ভেনিস। কথাটা বলতে মৃণালদা দাঁড়িয়ে গেলেন, শুরু হলো ভেনিস নিয়ে অভিজ্ঞতা। ‘এক দিন অচানক’ ছবি, যেটি ভেনিসে সদ্য পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়েছে, তাতে কেমন বৃষ্টির মধ্যে হারিয়ে যান ছবির মুখ্য চরিত্র। বৃষ্টি যেমন অনুপ্রেরণা যোগায়, তেমনই বিভীষিকার কারণ ও হতে পারে। এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়, কথা শেষ হয় না। এদিকে শট রেডি, অবশেষে আর না পেরে সহকারী প্রায় জোর করে নিয়ে যায় মৃণালদা ও রীনাদিকে শটে। আমি ও সাবর্ণী একটু এগিয়ে পিছিয়ে আসি। যেখানে শট হচ্ছে সেখানে জায়গা কম। লাইট ও কাজের লোক অনেক। আমরা এ ক্ষেত্রে অকাজের লোক,আর সবার কাছে সেই সময় অবাঞ্ছিত। মৃণালদা অবশ্য আমাদের শট দেখতে আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু আমরা অন্য সবার কথা ভেবে বেরিয়ে আসি। মৃণালদা ততক্ষণে শুটিংয়ে নিমগ্ন। দূর থেকে শুনলাম স্টার্ট সাউন্ড, ক্যামেরা….
বাইরে বেরিয়ে দেখি কলকাতার ভেনিসে আমাদের গাড়ি জলের তলায়। পত্রিকার পাতা ব্যাগে ঢুকিয়ে, মাথায় ব্যাগ তুলে, অন্য হাতে নতুন জুতো জোড়া ধরে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি জলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, আর মাথায় ঘুরছে মৃণালদার ভেনিস চর্চা ।
মৃণালদার সঙ্গে এর পর বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। ওঁর ৯০তম জন্মদিনে, ওঁর নতুন বাড়িতে, শরৎ বোস রোডের কাছে। এরই মধ্যে একবার ওঁকে বলেছিলাম আমি আপনার কাছ থেকে একটা পার্ট আশা করেছিলাম।। অবাক হয় উনি বলেছিলেন,’তাই? তুমি তো কখনও বলোনি সেকথা!’ সত্যিই তো বলিনি কখনো মুখ ফুটে। লজ্জায়। আর যখন সাহস সঞ্চয় করে বললাম ততদিনে উনি ছবি করা থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন, আমি বেশ কিছু ছবি করে ফেলেছি পরিচালক হিসেবে। আমরা একবার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গিয়ে ওঁকে ছবি করার কথা বলেছিলাম, ওঁর সহকারী হয়ে কাজ করব এটাও বলেছিলাম, কিন্তু উনি রাজি হননি। উনি তখন লিখে চলেছেন। ওঁর সঙ্গী ওঁর ডেস্ক টপ। ৮০/৯০এর পর ও যে নূতনকে এভাবে আলিঙ্গন করা যায় তার নিদর্শন মৃণালদা ।