মহাকালীর বাসার জমজমাট আড্ডা ছেড়ে রাত দেড়টা নাগাদ বেরিয়ে পড়া গেল। গন্তব্য: মাওয়া ঘাট। যাওয়ার পথে নিশম শর্টকাটের অজুহাতে পুরানো ঢাকার মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালানোর মতো নির্দেশ দিলে আমাদের অভিভাবিকা সুস্মিতা টুক করে গাড়ির বাঁ-দিকের সিটে বসে পড়ল। খানিক বাদে বুঝলাম, কী নির্মম অত্যাচার সেটা! মাঝরাতে সেই জমজমাট পুরানো ঢাকার স্টার, বিসমিল্লা, আর বাকি দোকানগুলো থেকে কাচ্চি বিরিয়ানি আর খিরি কাবাবের সুঘ্রাণ এসে নিশমের হাত ধরে টানাটানি করছে, কিন্তু নিশম তার মাতৃসমা বউদিকে টপকে রাস্তায় পা রাখতে পারছে না; আর সে নামতে না পারলে ‘অতিথ হইয়া’ আমি কী করে নামি গাড়ি থেকে! যাই হোক, দোকানগুলোকে মনে-মনে ‘টাটা বাই বাই, আবার যেন দেখা পাই’ বলতে-বলতে সোজা বুড়িগঙ্গার ওপরের সেতুতে, আর সেখান থেকে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে।
মাওয়া যাওয়ার জন্যে এইরকম একটা বেয়াড়া সময় বেছে নেওয়ার কারণ ঢাকার ট্র্যাফিক। মেট্রোরেল আর উড়ালপুলের কর্মকাণ্ডতে ঢাকার মানুষ এমনিতেই নাকাল, তার ওপর সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন বৃহস্পতিবার বিকেলে শহরের সবাই যখন বাড়ি ফেরার জন্যে পথে নেমে পড়ে, গোটা শহর তখন বিকল হয়ে যায়। বাহন থাকলে ঢাকার মানুষ তাই সপ্তাহান্তে পুরানো ঢাকায় কাবাব অথবা মাওয়ায় মাছ খাওয়ার কথা ভাবলে হারুন-অল-রসিদকে গুরু মেনে পথে পা বাড়ায়। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রায় শেষের পথে, পদ্মা সেতুর সাথে ঢাকা সংযোগকারী রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। আন্তর্জাতিক মানের সেই সড়ক ধরে সাঁই-সাঁই করে গাড়ি দৌড়ল, থামল একেবারে মাওয়া ফেরিঘাটে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে শক্তিগড়ে যেমন লাইন দিয়ে ল্যাংচার দোকান, বাইরে গাড়ির সারি, সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে গতি কমাতে দেখলেই একমুখ হাসি নিয়ে প্রত্যেক দোকানের প্রতিনিধি মরিয়া হয়ে ওঠে, একই জিনিস দেখতে পেলাম মধ্যরাতের মাওয়াতে। তফাত শুধু পসরায়। এখানে পদ্মা থেকে ধরা ইলিশ এবং অন্যান্য মাছ বরফের বিছানায় বিশ্রাম নিচ্ছে। বাক্স থেকে মাছ বার করে পছন্দ করো, কীভাবে খেতে চাও— ভেজে না ঝোলে, সর্ষেবাটা, কালিয়া না সাধারণ তেল-ঝোল, কীরকমের ঝোল চাই সেটা বলে দিতে হবে— মুহূর্তে মাছ কেটে রান্নায় চড়িয়ে দেওয়া হবে চোখের সামনে। আধঘণ্টা বাদে ধোঁয়া-ওঠা গরম ভাতের সাথে সেই মাছ পরিবেশন করা হবে। ‘ঘরোয়া’ থেকে ‘নিরালা’— গোটা বিশেক রেস্তোরাঁ সেই মধ্যরাতেও গমগমিয়ে চলছে আর একই ভাবে খাবার পরিবেশন করছে। সুস্মিতা সবাইকে কাটিয়ে একটি নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁয় ঢুকল। কারণ জিজ্ঞেস করতে বুঝলাম ‘কম্ফর্ট ফ্যাক্টর’— আর কিছুই নয়। দীর্ঘদিন ধরে এখানে এসে এক আত্মীয়তা তৈরি হয়েছে। পুরনো দোকান এখন পদ্মার গর্ভে— কিছুটা সরে এসে আবার নতুন করে দোকান উঠেছে। এই সরে আসার পেছনে দীর্ঘশ্বাস নেই, লড়াই আছে— যা নিয়ে পদ্মাপাড়ের মানুষজন আজও বাঁচে। যে কিশোর ফজলুল পুরনো পদ্মাপাড়ের রেস্তোরাঁ থেকে বাসন নিয়ে নদীতে ধুতে যেত, সে এখন নতুন দোকানের অন্যতম কর্ণধার। ফজলুল হঠাৎ করে তার আপাকে পেয়ে বেজায় খুশি হয়ে হাঁকডাক শুরু করে দিল। সুস্মিতার প্রতাপের ছটায় আমাকে রীতিমতো ধাঁধিয়ে যেতে দেখে সুস্মিতা আমায় বোঝাল, এখানে প্রায় সব দোকানেরই কিছু অনুগত কাস্টমার আছে, একেবারে নতুন মানুষ ছাড়া সবাই এখানে পুরনো জায়গায় ফেরত যেতে চায়, যদি গত বারের খাবার ভাল লেগে থাকে; ইলিশের সাম্রাজ্যে বসে খাবার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ধৃষ্টতা সচরাচর কেউ দেখায় না।
পরম গুরু সৈয়দ মুজতবা আলী বলে গিয়েছেন, ‘বেহেশ্তের বর্ণনাতে ইলিশ নেই বলে পাঁচ-বখত্ নমাজ পড়ে সেখানে যাবার বাসনা আমার নেই।’ গীতা বলেছে, ‘মহাজন যেন গতঃ পন্থাঃ’— আচার্যদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে। তাই রেস্তোরাঁর ভূগোল-ইতিহাস ছেড়ে যার সম্মানে এই মধ্যরাতের রঁদেভু, সেই ইলিশে মনোনিবেশ করলাম। বরফের বাক্সতে সারি-সারি বিভিন্ন মাপের ইলিশ শুয়ে। সেখান থেকে পছন্দসই ইলিশ বেছে নিয়ে ওজন করে নেওয়াটাই দস্তুর এখানে। সঙ্গে-সঙ্গে একজন বঁটি নিয়ে কাটতে বসে যাবে। ইলিশ কাটা হয়ে যেতে ফজলুল জিজ্ঞাসা করল, ‘কী খাবেন?’ এটা কোন ধরনের মশকরা জিজ্ঞাসা করার আগেই সুস্মিতা বুঝে গিয়েছে আমার মনের অবস্থা। ও ফরমাশ করল ইলিশ ভাজা আর ইলিশের তেল-ঝোল। আমাকে বুঝিয়ে বলল, এখানে বিভিন্ন ভাবে রান্না করে দেওয়া হয়— সর্ষে ইলিশ থেকে শুরু করে ভাপা ইলিশ অবধি সবই পাওয়া যায়। তেল-ঝোল বরিশালের মানুষের হাতে ভাল খোলে— এই পদ্মাপাড়ের মাওয়ায় কেমন করবে সন্দেহপ্রকাশ করতে সুস্মিতা বলল, ‘খেয়েই দ্যাখো না!’ ফজলুলকে হেঁকে মনে করিয়ে দিল, ইলিশ ল্যাজার ভর্তা যেন মিস না হয়। বাংলাদেশে আসা ইস্তক দেখছি, সব কিছুর ভর্তা হয় এখানে— আলু, টোম্যাটো, শিম, বেগুন, আলু-শাক— এমন কোনও জিনিস নেই যার ভর্তা বানায় না; তাই বলে ইলিশের ল্যাজার! ফজলুল হেসে বলল, ‘বানানোর সময় আপনাকে ডেকে নেবো।’
এই দোকানে শুধু ইলিশ নয়, হরেক কিসিমের মাছ পাওয়া যায়। সুস্মিতা পাঙ্গাস মাছ কিনে রাঁধতে চলল। হ্যাঁ, নিজে হাতে রাঁধতে। বিশ্বাস করিনি বলে গুটি-গুটি পায়ে ওকে অনুসরণ করে পৌঁছলাম রেস্তোরাঁর পেছনে এক চালাঘরে, যেখানে কাঠের জ্বালে মাটির উনুন জ্বলছে। শুনলাম নিয়মিত আর বিশেষ খদ্দেরদের জন্যে এই ব্যবস্থা। ইলিশ রান্নার জন্যে বসে না থেকে নিজে যদি কিছু বানিয়ে নিতে চায়, সেইজন্যে এই উনুন। সুস্মিতা ব্যস্ত হয়ে পড়ল পাঙ্গাস রান্নায় আর আমি হয়ে গেলাম ওর জোগাড়ে। রান্না যখন মাঝপথে, ল্যাজার ভর্তা বানানোর তরিকা দেখার ডাক পড়ল। মাছ ভাজা হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে-ভাজা ল্যাজাটা আড়াআড়ি কেটে ফেলল— মাঝের বড় কাঁটাটা ফেলে দিল। তারপর ল্যাজাটাকে টুকরো-টুকরো করে হামানদিস্তেতে ফেলে পিষতে লাগল আর সমানে ছোট-ছোট কাঁটাগুলো ফেলে দিতে লাগল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশে শিল-নোড়ার চেয়ে হামানদিস্তে অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়। খানিক বাদে কুচো পেঁয়াজ, শুকনো লঙ্কা, অল্প ভাজা জিরে, জলপাই আচারের তেল আর সর্ষের তেল ফেলে দিল হামানদিস্তেতে আর সমানে পিষতে লাগল। খানিক বাদে যেটা বের হল, সেটা দেখে মস্ত জ্ঞানীও ইলিশ-ল্যাজা বলতে কয়েক বার ভাববে।
খাবার রেডি। ধোঁয়া-ওঠা ভাত, ইলিশের তেল, ইলিশের ল্যাজার ভর্তা, ভাজা ইলিশ, জিরে-কাঁচা লঙ্কা আর অল্প সর্ষের তেল ভাসিয়ে তেল-ঝোল আর সুস্মিতার রান্না করা পাঙ্গাস মাছ। রাতের তৃতীয় আর চতুর্থ প্রহরের সন্ধিক্ষণে কেউ ওইরকম গোগ্রাসে খেতে পারে, সেদিন আমি নিজেকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। প্রত্যেকটা পদই রান্নার প্রতিযোগিতায় মেডেল পাওয়ার মতো, তবে আমি নিশ্চিত, ইলিশ-ল্যাজার ভর্তার মতো সুস্বাদু ভর্তা আমি আগে কোনওদিন খাইনি! নিশম ডাক্তার হয়েও খাদ্যরসিক। ওরও প্রথম ইলিশ-ল্যাজার ভর্তার অভিজ্ঞতা। কেমন লাগলো জিজ্ঞাসা করলাম। চোখ বন্ধ করে এক আধ্যাত্মিক হাসি মুখে ছড়িয়ে নিশম বলল, ‘বড় মোলায়েম!’
খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে রাত প্রায় কাবার। জয় রোজা রাখে, তাই এটাই ওর সেহেরি’র খাবার হয়ে গেল। এরপর ও আবার খাবে কাল সূর্যাস্তের পর। নিশম আর সুস্মিতা এমন এক পেশায় রয়েছে আর এত ছুটে বেড়াতে হয় দেশের প্রতি কোণে, ওরা রোজা রাখার ঝুঁকি নেয় না। এত খেয়ে ফেলেছি, মনে হল একটু অপেক্ষা করে যাওয়া ভাল। গায়ে পদ্মার হাওয়া মেখে চোখটা জুড়িয়ে এসেছে, দোকান এই সময় প্রায় ফাঁকাই থাকে— ভোরের আলো ফোটার জন্যে যখন অপেক্ষা করছি, ফজলুল মিঁয়া হঠাৎ বলল, ‘আপনারা এত দূরে এসেছেন, মাছের নিলাম দেখবেন না!’ লাফিয়ে উঠলাম। শুনলাম এই রেস্তোরাঁ থেকে এক মাইল দূরে পুরনো ঘাটের কাছে মাছের পাইকারি হাট বসে আর নিলাম হয়। সকাল ছ’টার মধ্যে হাট শেষ— তাই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়লাম সেদিকে। বড় রাস্তা থেকে একটা গলি ঢুকে গেছে, সেই গলি দিয়ে মিনিটে-মিনিটে ব্যাটারিচালিত মাছবোঝাই ভ্যান বেরোচ্ছে; সেগুলো যে গতিতে যাচ্ছে, ধাক্কা লাগলে নিদেন একটা হাড় ভাঙবে, তাই আলগোছে দেওয়াল ঘেঁষে-ঘেঁষে যখন হাটে পৌঁছলাম, তখন অর্ধেক মাছ বিক্রি হয়ে গেছে। কোন মাছ নেই সেখানে? ঝাঁকে-ঝাঁকে বিভিন্ন মাপের ইলিশ! আটশো-ন’শো গ্রামের ইলিশ তিনশো টাকায় বিক্রি হতে দেখে চোখ কচলে নিলাম স্বপ্ন দেখছি ভেবে। তার সাথে পাবদা, গুলশা, বিভিন্ন জাতের চিংড়ি, আড়, পাঙ্গাস, শোল, মহাশোল, বান থেকে শুরু করে কাতলা, মৃগেল, পাঁচমিশেলি সমস্ত মাছের বিক্রি চলছে সমান তালে। গলিতে লরি অথবা ম্যাটাডোর ঢোকার জায়গা নেই— তারা দাঁড়িয়ে আছে বড় রাস্তায়। এই সাইকেল ভ্যানগুলো সমান তালে মাছ নিয়ে গিয়ে লরি বোঝাই করছে আর লরিগুলো একের পর এক ঢাকার দিকে রওনা দিয়ে দিচ্ছে।
অত সকালেই কিছু দোকান খুলে গেছে। সেখানে পরোটা আর জলখাবার বানানো হচ্ছে, মাছের ব্যাপারীরা আর সাইকেল ভ্যানচালকেরা ব্যবসা শেষ করে নাস্তা করে বাড়ি যাবে। আকাশে আলো ফুটে গেছে বেশ খানিকক্ষণ– সূর্য মাথায় চড়তে এখনও দেরি। আমাদেরও বেরিয়ে পড়তে হবে মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমের রেকাবীবাজারে মাঠা খেতে। সেটা নাকি শুক্রবার সকাল সাতটা অবধিই পাওয়া যায়!
গ্রামের পথ দিয়ে ঝড়ের বেগে গাড়ি চলল। রমজান মাস শুরু হয়ে গিয়েছে তাই রক্ষে, গ্রামবাসীরা সেহ্রির খাবার খেয়ে ছুটির দিনে দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে। রাস্তায় সেরকম ভিড় নেই, যানবাহনও তুলনামূলক ভাবে কম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম মিরকাদিমের ঘোষপাড়ায়, যেখান থেকে শুনেছি মাঠা বিক্রি হয়। মাঠা হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের ঘোল। পরিবেশনের সময় এক খাবলা ননী দেওয়া হচ্ছে রেকাবীবাজারের রেওয়াজ। কলকাতার লায়ন্স রেঞ্জে লস্যিতে দইয়ের সর ভাসিয়ে দেওয়ার মতো অনেকটা আর কি! শুধু ঘোষপাড়াতেই প্রায় তিন হাজার হিন্দুর বাস। দেওয়ালে সংকীর্তনের পোস্টার আর বাড়ির ভেতর থেকে আসা শাঁখের আওয়াজ শুনতে-শুনতে এক সময় ভাবলাম, মাঠার খোঁজে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়িনি তো? জয়কে জিজ্ঞেস করতে সে খুব মজা পেল। ওর কাছে জানলাম মিষ্টি, তাঁতের কাপড় আর স্বর্ণালঙ্কার— এই তিনটে পেশায় মৌরসিপাট্টা এখনও হিন্দুদের হাতে। এই পেশার মানুষেরা অনেকেই দেশভাগের পরে বাংলাদেশে থেকে গিয়েছেন। কথা শুনতে শুনতে এদিক-ওদিক খুঁজতে-খুঁজতে এগিয়ে চলেছি, কিন্তু ও হরি, কোথায় মাঠা! জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, রমজান মাসে মাঠা বিক্রি হয় বড় মসজিদের সামনে, গোয়ালারা সেখানে গিয়ে বসেছে। ঘড়ির কাঁটা অনেকটাই ঘুরে গিয়েছে ইতিমধ্যে, মাঠা পাব কি না জানি না তবু দৌড়লাম, আর ভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলাম! সুস্মিতা এই স্থান-পরিবর্তন নিয়ে অভিযোগ জানাতে ওর পরিচিত বিজয় ঘোষ লাজুক হেসে জানাল, রমজান মাসে রোজা ভাঙার সময় স্থানীয় লোকে মাঠা খায়; এই সময় দিনে দেড় হাজার লিটার মাঠার প্রয়োজন হয়, শুক্রবার আরও বেশি; তাই এই সময়ে ওরা নিজেদের পাড়ায় না থেকে বড় মসজিদের সামনে চলে আসে সাধারণ মানুষের সুবিধের কথা ভেবে। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোনও গোলমাল হয় না?’ জোরে হেসে বিজয় উত্তর দিল, ‘আমরা এখানে সবাই মিলেমিশে থাকি দাদা! সবার দরকারে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধর্ম নিয়ে ঝামেলা এখানে এক্কেবারে নেই!’
ভাল গরম পড়েছে, তার ওপর সারা রাত জাগা, শরীর থেকে হলকা বেরোচ্ছে। হাতে মাঠার গ্লাস পেতে এক চুমুকে নিঃশেষ। অমৃত কেমন খেতে হয় জানি না, তবে মুন্সীগঞ্জের রেকাবীবাজারের চেয়ে খুব একটা তফাত হবে না, সেটা হলফ করে বলতে পারি। তিন গ্লাস খেয়ে থামলাম। কিন্তু তারপরে হল চিত্তির। পথে রয়েছি বলে ভয়ে সকালে চা অবধি খাইনি, কিন্তু মাঠা পেটে পড়তেই মাঝরাতে খাওয়া ইলিশ আর চিংড়ি বিদ্রোহ শুরু করল। নিশম আর জয় জানাল তাদেরও একই অবস্থা। লজ্জার মাথা খেয়ে সুস্মিতা সটান বিজয়ের কাছে। বিজয় আবার হেসে বলল, ‘এটা কোনও সমস্যা হল? আমি আছি তো! নিশ্চিন্তে আমার বাড়ি চলে যান। আমার বাড়িতে হাই কমোড আছে, আপনাদের কোনও সমস্যা হবে না।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমাদের দেশে যেরকম ওয়েস্টার্ন আর ইন্ডিয়ান টয়লেট, বাংলাদেশে তেমন হাই কমোড আর লো কমোড। বিজয়ের বাড়িতে প্রাতঃকৃত্য সারলাম একে-একে সবাই। ওর বাড়িতে অনেক মানুষ, তারা নতুন লোক পেয়ে বেজায় খুশি। আশেপাশের বাড়ির কচিকাঁচাও জুটেছে তাদের সাথে। কলকাতার সাথে তাদের যেটুকু পরিচয়, তা বাংলা ছায়াছবি মারফত। ফলে সবাই কলকাতার গল্প শুনতে চায়। কলকাতা আর পশ্চিমবাংলার বিষয়ে একরাশ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আর সাধ্যমত কৌতূহল মিটিয়ে যখন সেখান থেকে ছাড়া পেলাম, সকাল দশটা প্রায় বাজে। এবার ঢাকা ফেরত যাওয়ার পালা— তবে বাড়িতে নয়, আমরা যাব পুরানো ঢাকার চকবাজারের ইফতারের খাবারের মেলায়।
বনানি, গুলশান, ধানমণ্ডি থেকে উত্তরার প্রতিটি সেক্টরে— এমনকী বারিধারার মতো সুরক্ষাতে মোড়া এলাকাতেও রমজান মাসের সকাল থেকেই ইফতারের খাবারের পসরা নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে দোকানের ঢল নামে। স্টার বাদ দিয়ে বাকি নামী রেস্তোরাঁগুলোতে দুপুরের খাবার অবধি পাওয়া যায় না ইদানীং। সবাই ইফতারের খাবার বিক্রিতে এত ব্যস্ত! কিন্তু পুরানো ঢাকার চকবাজারের আভিজাত্য অন্যরকম। অনেকটা কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার মতো, শহরে বিভিন্ন কোণে যতই বইয়ের দোকান থাকুক, বইপড়ুয়ারা সুযোগ পেলে কলেজ স্ট্রিটে একবার ঢুঁ মারবেই! চকবাজার অঞ্চলটায় রমজান মাসে গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ তাই ঢাকা ফোর্টের সামনে গাড়ি রেখে হাঁটা শুরু করলাম। পৌঁছে চক্ষু চড়কগাছ! এটা কি রাস্তা না দেড়শো মিটার লম্বা এক প্রকাণ্ড বুফে কাউন্টার!
ঢাকার ইফতারি কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিটের বাজারের চেয়ে অনেক বেশি বাঙালি। এখানে সারাদিন রোজার পর খেজুর দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করার পরে দই-চিঁড়ে-কলা অথবা মুড়ি-পেঁয়াজি-চপ খেতে অনেকেই ভালবাসে। মাঠা বা ঘোলও খুব প্রিয় এখানে। সরু থেকে মোটা, ধবধবে সাদা থেকে প্রায় খয়েরি সবরকম। চকবাজারে চিঁড়ে আর মুড়িই দেখলাম প্রায় দশ রকমের। আর তার সাথে খাওয়ার জন্য পেঁয়াজু, হরেক কিসিমের চপ আর বড়া। নিরামিষ সিঙাড়া থেকে মাংসের পুর-ঠাসা সামুচা, মিনি সাইজের জিলিপি থেকে এক মিটার সাইজের তিন কিলো ওজনের জিলিপি, সুতলি কাবাব থেকে শিক কাবাব, টিকিয়া থেকে মুর্গ মুসল্লাম, হালিম থেকে হরেক রকম হালুয়া, বিভিন্ন রকমের আর স্বাদের জুস আর মাঠা— কী নেই সেখানে! ফলের সম্ভার কলকাতার ফলপট্টির চেয়ে কোনও ভাবে কম না, আর ফল কাটার কেরামতি? নামী হোটেলের শেফরাও এত অনায়াস-সাধ্য ভাবে ভিড়ের রাস্তায় বসে এইরকম শিল্পসৃষ্টি দেখে যেতে পারেন! আর আছে একশো বছর ধরে এই বাজারের অনন্য ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। নবাবি ইফতারির উদ্বৃত্ত আর উচ্ছিষ্ট থেকে শুরু হওয়া এই পদ কেনার জন্যে দূরদূরান্ত থেকে লোকে আসে। সুতলি কাবাব, গরুর ঘিলু, কিমা, সেদ্ধ ডিম, মুরগির গিলা-মেটে, ছোলার ডাল, মিষ্টি কুমড়ো, মুড়ি, আলু, ঘি, কাঁচা লঙ্কা, সর্ষের তেল আর কিছু মশলা হাত দিয়ে মেখে এই পদ তৈরি হয়। এক সময় বটপাতায় বিক্রি হত, এখন বিক্রি হয় কাগজের ঠোঙায়।
খাবারের এই মহামেলায় এসে এত রকম খাবারের পাঁচমিশালি এক গন্ধ কয়েক ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত নাকে ঢুকে পেট ভরিয়ে দিয়েছে— খাওয়ার রুচি একটুও নেই। আর খাওয়ার ঝুঁকিও নেওয়ার ইচ্ছে নেই, সুস্মিতার ছোট খালার বাড়িতে লম্বা দাওয়াত আছে। সন্ধের ইফতারে শুরু, ফজর-এর নামাজের আগে সেহ্রি-তে শেষ। জয় সেখানেই তার রোজা ভাঙবে। ইতিমধ্যে সূর্য পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়েছে। নিত্যি যানজটে ফেঁসে গিয়ে যেন ইফতারে পৌঁছতে দেরি না হয়! আমরা গুটিগুটি পায়ে খালার বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী