গরম চা আর ‘চায়ে গরম’— এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। নয়-নয় করে এক-ছোটবেলা দূরত্ব তো হবেই। ‘চায়ে গরম’-এ যতটা না গরম চা আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি আছে ট্রেনে করে দূরে বেড়াতে যাওয়ার হাতছানি, মাটির ভাঁড়ভর্তি ফুটন্ত জীবন। এমন তার উত্তাপ, ভারি সাবধানে ধরে রাখতে হয়, পাছে সে উত্তাপ চলকে গিয়ে নরম স্মৃতির আবেশ পুড়িয়ে দেয়!
দূরপাল্লার ট্রেনে আমাদের মতো ম্যাংগো-পিপলের যাতায়াত মানেই তখন নন-এসি থ্রি টিয়ার। যেথায় জানলা তোলা যায়, জানলা ভাঙা থাকে, হাতে জানলা পড়ে যায়, ছিটকিনি হাফ-রাস্তায় গিয়ে আটকে যায়, ফলে গরমে ভেপে গেলেও আসলে জানলা খোলা যায় না। একই উদ্যমে কখনও আবার খোলা জানলা দিয়ে ঢুকে আসে হাওয়া, হলকা, বিকেলের সানসেট, বিস্তর নোংরা, সামনের কামরা থেকে উড়ন্ত প্লাস্টিক, শীতকালের হাড়কাঁপানো হিমশীতল বাতাস— সব। আর আসে স্টেশনে-স্টেশনে ‘চায়ে গরম’ ডাক।
সকালের দিকে ট্রেন হলে চা-ওয়ালার চুস্তি-স্ফূর্তি খুব উচ্চতারে বাঁধা থাকে। গলার আওয়াজ বেশ বাজখাঁই। অন্তত একটি গোটা কামরার মানুষ যাতে শুনতে পায়। পড়ন্ত বেলায়, গলাও একটু পড়ে আসে। অবশ্য তাতে ক্ষতি নেই। এলাচ-আদা দেওয়া চা যেসব চা-ওয়ালাদের কাছে মিলত, তাদের জন্য স্টেশন আসার আগে থেকেই চাতকরা উসখুস করত। খুঁজেও নিত সেই বিশেষ-বিশেষ চা-ওয়ালাদের। দু’তিন স্টার যুক্ত কেটলি-মালিকরা ক্ষমা-ঘেন্না করে চা পান করাত যাত্রীদের। ঠোঁটের কোণে চিলতে দিগ্বিজয়ীর হাসি, পকেটে খুচরো, এক হাতে গরম কেটলি, অন্য হাতে ভাঁড়।
সময়ের সঙ্গে ‘চায়ে গরম’-এর রকমফের হয়েছে। আগে ‘চায়ে গরম’ মানেই দুধ চা। সঙ্গে এলাচ বা আদা। এখন অবশ্য লেবু-বিটনুন সহযোগে লিকার চায়ের কদর দেখি বেশি। এমনকী কফিরও। আগে দেখতাম জানলার বাইরের দৃশ্য যত বদলাত, ‘চায়ে গরম’-এর অস্তিত্বও বদলে-বদলে যেত। সেসব অবশ্য দূরপাল্লার ট্রেন হলেই বেশি বোঝা যেত। পশ্চিমবঙ্গ পেরোতে-না-পেরোতে প্রথম বদলাত ভাঁড়ের সাইজ। বেশ একটু বড়। চায়ের পরিমাণ বেশি, আর মশলা চায়ের প্রাধান্যও বেশি। দুধও খানিক বেশি। কিন্তু ট্রেন যেই মোগলসরাই বা গয়া জংশন পৌঁছত, ভাঁড়ের সাইজ বেশ বড় কাপের মাপের হয়ে যেত। সঙ্গে দুধের পরিমাণও বেড়ে যেত, এমনকী সৌভাগ্যবানের ভাঁড়ে ঈষৎ সরের ছায়া দেখা যেত। ভাঁড়ের রূপখানিও বদলে যেত, হালকা একটা ঘটির অবয়ব পাওয়া যেত। কেবলই মোটা দুধের চা। হরেক মশলা দেওয়া। কী যে ভাল লাগত খেতে! আর ভাল লাগার চেয়েও বড় কথা হল, বাঙালির বাকেট লিস্টে ওটা থাকত। টিক দিতেই হত। কেবল তাজমহল, দিল্লি-দর্শন করলে হবে? আগ্রার পেঠা, দিল্লির সোহন হালুয়া যেমন কিনতেই হত, তেমনই মোগলসরাইয়ের চা। তবে একটা কথা, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ভাঁড়ে গরম চা ঢেলে দেওয়ার সঙ্গে একটা মাটির সোঁদা গন্ধ পাওয়া যেত, সেটা অবশ্য উত্তরের দিকের ভাঁড়ে মিলত না। এখন অবশ্য সবটাই কাগজ বা প্লাস্টিকের কাপ। সুতরাং চায়ের গরমের ভাপ কেবল মগজেই জমা রাখতে হবে।
এই ‘চায়ে গরম’-এর মাহাত্ম্য খুবই ব্যাপ্ত। এই দিয়েই শুরু হয় অবান্তর আলাপচারিতা, যা থেকে কখনও-কখনও সখ্য গড়ে ওঠে ফ্যামিলিতে-ফ্যামিলিতে। যে-বছর চক্রবর্তীরা কেদার দর্শনে যাচ্ছিলেন, সে-বছরই ঘোষবাড়ি যাচ্ছিল নৈনিতাল। একই কামরা। দিল্লি অবধি একই গন্তব্য। ফিরে এসে কেদারের প্রসাদ-সহ আদান-প্রদান হয়ে গেল সম্বন্ধ অবধি। শুরু সেই ‘কী চা খাবেন নাকি?’, ‘তা, হলে মন্দ হয় না।’ চা-ওয়ালাটি যদি জানত তার চা খেয়ে এমন এক কাণ্ড ঘটে গিয়েছে, নির্ঘাত সিভি-তে লিখত: এক কাপ চায়ে, বিয়ে পাকা। এই ‘চায়ে গরম’-এ কমবার দৃষ্টি বিনিময়ও হয়নি! আপার বাঙ্কের তিরতিরে সুন্দরীকে লোয়ার বার্থের স্মার্ট বয় চা অফার করেছে, আর সুন্দরী মুচকি হেসে সম্মতি দিয়েছে চায়ের সঙ্গে গোটা ট্রেনে ফ্লার্ট করার। আর স্মার্ট বয়ের পাশে যে মধ্যবয়সি ভদ্রলোক ‘এই চায়ে গরম, এই চায়ে গরম, আমায় এক কাপ…’ হেঁকে গলা ফাটালেন, তাঁকে ওভারটেক করে পাশের শুকনো-গলা নন-বেঙ্গলি ভদ্রমহিলার, ‘চায়ে গরম ভাইয়া, ইধার পাঁচটো চায়ে দেনা, মাম্মিজি, আপ লোগে? আচ্ছা তো ছে চায়ে দে দো’ অনুরোধ কাম অর্ডার কীভাবে যে জিতে গেল, কে জানে! ট্রেনটি ছাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মধ্যবয়সি ভদ্রলোক বুঝলেন, আরও অন্তত ঘণ্টাদুয়েক চায়ের জন্য ছটফট করতে হবে। অতএব এই ‘চায়ে গরম’-এর যে কী ডিমান্ড বিভিন্ন বয়সে, বিভিন্ন মানসিক স্তরে, তা বোঝার জন্য একজীবন ভ্রমণ অন্তত চাই-ই!
আরও একটা জিনিস আমি লক্ষ করতাম। তা হল, যাঁরা জানলার ধারে বসেন, তাঁদের থেকে বেশি চা পান করার টান ভেতরদিকে বসা লোকের। অর্থাৎ কিনা, ‘চায়ে গরম’ ডাক শুনলেই জানলা থেকে দূরবর্তী মানুষেরা তৃষিত হয়ে এদিক-ওদিক তাকান গলা বাড়িয়ে। অতঃপর চা-ওয়ালাকে দেখতে পেয়ে অত্যন্ত ব্যালেন্স সহকারে ট্রেনের জানলার দুটি শিকের মাঝখান দিয়ে যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করে ভাঁড়ের পর ভাঁড় চা রিলে রেসের মতো সাপ্লাই করে যান অন্যান্য যাত্রীদের বা ফ্যামিলি মেম্বরদের। এর মধ্যে উজিয়ে ওঠে জানলার ধারে বসে থাকা যাত্রীর বিরক্তি, আর মাথায় রাখতে হয় এক হাতে শেষ ভাঁড়টি ধরে অন্যহাতে পয়সা দেওয়া এবং ফেরত থাকলে তা নেওয়ার কায়দা। এবং ঠিক এই মোক্ষম সময়েই ট্রেনটি দুলে-দুলে চলতে শুরু করে, ফলে চায়ের ভাঁড় হাতে নিজের ব্যালেন্স যদি বা কষ্টেসৃষ্টে রাখা যায়, চায়ের তরলতা সে-কথা মানে না, চলকে পড়ে জানলার ধারের যাত্রীটির প্যান্টে বা পাজামায় বা শার্টে। বিকট রাগত চাউনি গিলে নিয়ে চা-খোর ভদ্রলোকটি অপরাধী হয়ে ‘সরি, হেঁহেঁ, সরি’ বলতে-বলতে নিজের সিটে কোনওমতে গিয়ে বসেন।
দিনমানে ‘চায়ে গরম’-এর আবেশ, মাহাত্ম্য, টান— যা-ই বলি, কিছুটা হলেও চাপা পড়ে যায় বাকি কোলাহলে। ঝালমুড়িওয়ালার হাঁক, কখনও স্টেশনের পুরি-তরকারির স্টল আর তার পাশে ম্যাগাজিনের স্টলে সিডনি শেলডনের সঙ্গে একই সারিতে টাঙানো হিন্দি মায়াপুরী পত্রিকার বিক্রেতার ডাক, কুলিদের ছোটাছুটি, অ্যানাউন্সমেন্টের হিড়িক, যাত্রীদের উদ্বিগ্ন ডাকাডাকি, সব কিছুতে। কিন্তু রাতের স্টেশনের ‘চায়ে গরম’-এর মৌজই আলাদা। রাত মানে বেশ রাত, যখন স্টেশন ফাঁকা হয়ে যায়, যখন চেঁচামেচি কমে যায়, যখন টিকিট কাউন্টারের লোক বাড়ি চলে যায়, যখন টিকিট-চেকার স্টেশন রোড থেকে বাড়ি ফেরার রিকশা ধরেন, যখন স্টেশনের সব দোকান ঝাঁপ ফেলে দেয়, তখন এক চা-ওয়ালা কোণের বেঞ্চিতে বসে ঢোলে। নিশুতি রাতে একটামাত্র দূরপাল্লার ট্রেন থামে, আর সিগনাল না পেলে কখনও-সখনও অন্যান্য ট্রেনও ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। যাত্রীদের ওঠা-নামার মাঝে একটাই মৃদু ডাক স্টেশনকে একটা অস্তিত্ব দেয়— ‘চায়ে গরম’। উনুনের ওপর বসানো চায়ের কেটলি নিয়ে কামরা থেকে কামরায় একজন হেঁকে যায় অভয়বাণী। স্টেশনের মলিন টিউবলাইট আর রাতের তারার নরম আলো সঙ্গে নিয়ে একটা ছোট্ট স্টেশন পাহারা দেয় ‘চায়ে গরম’। যেন ওটা তার দায়িত্ব। নিভু-নিভু স্টেশনের অস্তিত্ব ঘোষণা করার একমাত্র আইডেন্টিটি কার্ড। যেসব জায়গার নাম আমরা রেডিওতে শুনতাম ‘বিনাকা গীতমালা’ কিংবা ‘ফৌজি ভাইয়ো কে লিয়ে’ অনুষ্ঠানে, সেই বরকাকানা, ভাটাপাড়া, এটাওয়া, ঝুমরিতালাইয়ার স্টেশন আগলে বসে থাকত এই রাতের ‘চায়ে গরম’। আধোঘুমে, জড়ানো গলায় সে ডেকে যেত ট্রেনের কামরায়-কামরায়, যদি কেউ কেনে। তবে, সত্যি চা বিক্রি করার জন্য কি হাঁকে সেই চা-ওয়ালা, না কি ট্রেনের অস্তিত্ব, যাত্রীদের নিশ্চিন্ততা, স্টেশনের ঐতিহ্য— এসব রক্ষা করার দায়িত্ব সে কাঁধে নিয়েছে বলে, হেঁকে-হেঁকে বেড়ায়— ‘চাআআআয়ে গঅঅঅরঅঅঅঅমমমম!’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র