ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • অন্য বইমেলা


    সর্বজিৎ মিত্র (March 12, 2022)
     

    বহির্বিশ্বের কাছে বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্প শহরের পরিচিতি মূলত হিরে পরিশোধন ও পল কাটার জন্যে। এই পরিশোধনের কাজ শহরের যে-অঞ্চলে হয়ে থাকে, সেই অঞ্চলের পোশাকি নাম হল ‘ডায়মন্ড ডিসট্রিক্ট’। এই ডায়মন্ড ডিসট্রিক্টের থেকে হাঁটাপথ দূরত্বেই রয়েছে শহরের অন্যতম আকর্ষণ প্লান্ত্যাঁ-মোরেতাস জাদুঘর। বিশ্বের একমাত্র ইউনেস্কো তালিকাভুক্ত এই জাদুঘর আর পাঁচটা জাদুঘরের থেকে একটু ব্যতিক্রমী। কোনও রাজৈশ্বর্য নয়, পাঁচশো বছরের পুরনো এক ছাপাখানায় অবস্থিত এই জাদুঘরে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, ছাপা বই ও নথিপত্রের মাধ্যমে স্মরণ করা হয়েছে শহরের দুই মুদ্রাকরকে ও সেই সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে অ্যান্টওয়ার্প তথা পশ্চিম ইউরোপের মুদ্রণ-প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির বিবর্তনকে। আমাদের উপমহাদেশেও ছাপাখানার আবির্ভাব আর তার বিবর্তনের গল্পটি যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। যদিও সেই গল্পটি জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস সরকারি বা বেসরকারি তরফে আজও সেভাবে নেওয়া হয়নি। অথচ এই কলকাতা শহরেই প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে অনেকটা প্লান্ত্যাঁ-মোরেতাস জাদুঘরের ধাঁচেই একটি অস্থায়ী প্রদর্শনী ও বইমেলার মাধ্যমে বাংলা মুদ্রণ ও বইয়ের বিবর্তনের ইতিহাসটি তুলে ধরার প্রচেষ্টা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজিত এই বিশেষ বইমেলা ও প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়, বিশ্বভারতীর স্টল থেকে তাঁরই এক সময়ের শিক্ষক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় রচিত ‘শিল্পশিক্ষা’ বইটি কিনে। সে-বছর গিল্ড আয়োজিত বইমেলার কয়েকদিন পরেই এই বিশেষ প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে। ১৭৭৮-এ প্রকাশিত প্রথম ছাপা বাংলা বইয়ের দ্বিশতবার্ষিকীকে মাথায় রেখে এই প্রদর্শনীর আয়োজন ছিল সব দিক থেকেই অনন্যসাধারণ। পরবর্তী সময়ে বাংলা তথা দেশের মুদ্রণ সংস্কৃতি ও গ্রন্থচর্চাকে কেন্দ্র করে এত বড় আয়োজন আর কখনওই নেওয়া হয়নি। 

    বাংলা মুদ্রণের দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে এই প্রদর্শনী ও মেলার চিন্তা প্রথম মাথায় আসে নিখিল সরকার ওরফে শ্রীপান্থ-র। ১৯৬৩ থেকে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে যুক্ত শ্রীপান্থ-র ছিল বাংলার ইতিহাস, বিশেষ করে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য। বাংলার মুদ্রণের ইতিহাস নিয়ে প্রথম প্রামাণ্য কাজটিও তাঁরই। তাঁর ‘যখন ছাপাখানা এল’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। কাজেই এই নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার ভাবনা প্রথম তাঁর মধ্যে আসা খুবই স্বাভাবিক। এই প্রসঙ্গে চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখছেন, ‘১৯৭৮ সালে পুজোর পরে তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হতেই তিনি বললেন এ বছরটা তো বাংলা মুদ্রণের দুশো বছর পূর্ণ হল। এত বড় কথাটা ভুলেই আছি।… তারপর থেকে কয়েকদিন কেবল আলোচনা, এই দ্বিশতবার্ষিকী কীভাবে পালন করা যায়।’ এই আলোচনার ফলাফল পাওয়া যায় ‘সপ্তাহখানেক পরেই’। আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর তরফ থেকে স্থির করা হয় এক বড় প্রদর্শনী ও মেলার মাধ্যমে আদি যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বাংলা বইয়ের ইতিহাস দর্শকদের সামনে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরা হবে। তবে সেই প্রদর্শনীর আয়োজনের দিকটা সবিস্তারে দেখার আগে বাংলার ইতিহাসে ১৭৭৮ সালটির গুরুত্ব একবার ফিরে দেখে নেওয়া প্রয়োজন। 

    ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজিত এই বিশেষ বইমেলা ও প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়, বিশ্বভারতীর স্টল থেকে তাঁরই এক সময়ের শিক্ষক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় রচিত ‘শিল্পশিক্ষা’ বইটি কিনে। সে-বছর গিল্ড আয়োজিত বইমেলার কয়েকদিন পরেই এই বিশেষ প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে। ১৭৭৮-এ প্রকাশিত প্রথম ছাপা বাংলা বইয়ের দ্বিশতবার্ষিকীকে মাথায় রেখে এই প্রদর্শনীর আয়োজন ছিল সব দিক থেকেই অনন্যসাধারণ

    এই উপমহাদেশে প্রথম ছাপার উদ্যোগ নেওয়া হয় গোয়াতে। বই প্রকাশের কারণ ছিল মূলত ধর্মপ্রচার। ১৫৫৬ থেকে ১৫৬১ পর্যন্ত গোয়াতে পর্তুগিজ মিশনারিদের তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু বই ছেপে বেরোয়। একেবারে গোড়ায় মূলত পর্তুগিজ ভাষায় বই ছাপা হলেও, অচিরেই তামিল বা মালায়লম হরফের ব্যবহার হতে থাকে। প্রথম সম্পূর্ণ দক্ষিণী ভাষার বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায় ১৫৮৭ সালে। যদিও পশ্চিম উপকূল থেকে পূর্ব উপকূলে ছাপাখানার পৌঁছতে লেগে যায় প্রায় ২২২ বছর। বাংলায় ছাপা প্রথম বাংলা বই হল ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড রচিত A Grammar of the Bengal Language। বইয়ের শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট, বাংলাদেশে প্রথম বই প্রকাশের উদ্যোগ ঠিক ধর্মীয় কারণে নেওয়া হয়নি, এখানে কারণটা ছিল একান্ত ভাবেই রাজনৈতিক। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বিপর্যয়ের অব্যবহিত পরেই বাংলা শাসনভার সম্পূর্ণরূপে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়। ১৭৭২-এ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে রেগুলেটিং অ্যাক্টের মাধ্যমে ওয়ারেন হেস্টিংস-কে বাংলার গভর্নর ঘোষণা করা হয়। শাসনভার গ্রহণের ফলে, কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের ও আমলাদের বাংলা ভাষা শেখা একান্ত ভাবেই অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কোম্পানির ব্যবসার দিক থেকেও মূলত বাংলারই প্রাধান্য। অতএব হেস্টিংস উদ্যোগী হয়ে পড়েন ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা শেখানোর জন্যে। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কারণের বাইরে দেশীয় ভাষা ও রীতিনীতি নিয়েও আগ্রহ গড়ে উঠছিল। এই ভাষাচর্চার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে এশিয়াটিক সোসাইটির আত্মপ্রকাশও প্রায় এই সময়েই, ১৭৮৪ সালে। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাণপুরুষ স্যর উইলিয়াম জোন্সের ভাবশিষ্য ন্যাথানিয়েল হ্যালহেডের ওপরই ইংরেজ কর্মচারিদের জন্যে বাংলা ব্যাকরণ রচনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। হ্যালহেডের ওপর হেস্টিংসের এই নির্ভরতার অবশ্য একটি কারণ ছিল। হ্যালহেড ইতিপূর্বে হেস্টিংসের নির্দেশে সাফল্যের সঙ্গে রামগোপাল ন্যায়ালঙ্কার, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার এবং অন্যান্য সংস্কৃত পণ্ডিতদের সাহায্যে ‘মনুসংহিতা’ ও অন্যান্য সুপ্রাচীন হিন্দু আইন ও দণ্ডবিধির সংস্কৃত গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ তৈরি করেন। যদিও A Code of Gentoo Laws ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে ছাপা হয়, তার কারণ তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে ছাপাখানা ছিল না। 

    শ্রীরামপুরের ছাপা নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম বাংলা অনুবাদ
    ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহ থেকে হ্যালহেডের আবক্ষ মূর্তি

    ১৭৭৮-এ A Grammar of the Bengal Language বইটি ছাপানোর উদ্যোগ অবশ্য বাংলাদেশের হুগলিতে নেওয়া হয়। এর মুদ্রাকর ছিলেন কোম্পানিরই কর্মচারী চার্লস উইলকিন্স। হ্যালহেডের গ্রামার দিয়ে শুধু বাংলাদেশে ছাপার পত্তন হয় তাই নয়, এই বই দিয়ে বাংলা ছাপারও সূচনা। ব্যাকরণ বইটি মূলত ইংরেজিতে লেখা হলেও এতে উদাহরণ স্বরূপ কৃত্তিবাসী ‘রামায়ণ’, কাশীরাম দাশের ‘মহাভারত’, ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ থেকে ভুরি-ভুরি উদ্ধৃতি ছিল। হ্যালহেডের আগে ১৬৭৭ থেকে ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্তত আটটি বইয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে, যাতে বাংলা অক্ষরে কিছু-কিছু ছাপা ছিল। কিন্তু সেই সব বইয়ে ব্যবহৃত বাংলা অক্ষরগুলি সবই হাতে লিখে প্লেটে কেটে ছাপা হয়েছিল। উইলকিন্স প্রথম বাংলা অক্ষর এঁকে পাঞ্চ কেটে আলাদা-আলাদা ভাবে ঢালাই করে বাংলা ছাপার হরফের সাট তৈরি করেন। উইলকিন্স ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ, কাজেই এই কাজের জন্যে তাঁকেই উপযুক্ত বিচার করা হয়। উইলকিন্স এই বিরাট কাজ সম্পন্ন করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকারের সহায়তায়। এই কৃতিত্বের আর এক ভাগীদার ছিলেন জোসেফ শেফার্ড। শেফার্ড ছিলেন পেশায় খোদাইশিল্পী। শেফার্ডের ভূমিকার কথা যদিও পরবর্তী সময়ে উপেক্ষার আড়ালে চলে যায়। তবে হ্যালহেডের বই প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গেই যে বাংলা বই প্রকাশনায় জোয়ার এসেছিল, এ-কথা বলা যায় না। প্রথম সম্পূর্ণ বাংলা বই প্রকাশিত হয় ১৭৮৪ সালে, এবং এই বইটিও ছিল যাকে বলে কেজো বই। মফস্‌সল ও সদর দেওয়ানি আদালতের বিবিধ নিয়মকানুন লেখা ছিল জোনাথান ডানকান রচিত এই গ্রন্থে। প্রায় দু’দশকের মন্থরতা কাটিয়ে বাংলা বইয়ের প্রকাশনায় গতিবেগ আসে উনিশ শতকের একদম গোড়ায় শ্রীরামপুরে মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠার সঙ্গে। মিশন প্রেসেও উইলিয়াম কেরি-র সহায় হলেন ফের সেই পঞ্চানন কর্মকার। হ্যালহেডের ব্যাকরণের হরফের ভিত্তিতে পঞ্চানন ও তাঁর জামাই মনোহর পরে উইলিয়াম কেরির শ্রীরামপুর প্রেসের জন্যে বাংলা হরফ কাটেন। 

    ১৯৭৯-র প্রদর্শনীতে বাংলা বইয়ের আদিযুগ তো বটেই, উনিশ ও বিশ শতকের বই প্রকাশনার ইতিহাস তুলে ধরার দিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই প্রসঙ্গটি, মেলার কয়েকদিন পূর্বে শ্রীপান্থ-র ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’কে দেওয়া একটি বিবৃতিতে দ্রষ্টব্য। শ্রীপান্থ জানান, প্রদর্শনীর কর্মসমিতির তরফ থেকে প্রদর্শনীটি দু’ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ‘প্রথম ১৭৭৮ সাল থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় ১৮৭৮ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত। প্রথম বিভাগে উপবিভাগ ১৬টি, সেখানে থাকছে বাংলালিপির বিবর্তন, মুদ্রণের ইতিহাস, শ্রীরামপুরের বই, রামমোহন-বিদ্যাসাগর আমলের বই, বটতলার বই, পাঠ্যপুস্তক, পঞ্জিকা, সাময়িকপত্র ইত্যাদি। দ্বিতীয় বিভাগ শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথ থেকে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম বই ‘কবিকাহিনী’ প্রথম প্রকাশ ১৮৭৮ সালে।’ এখানে উল্লেখ করা দরকার এই সমিতির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, ঐতিহাসিক ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অধ্যক্ষ নিশীথরঞ্জন রায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, শিল্পী সুভো ঠাকুর প্রমুখ। কর্মসমিতির কাছে এই আয়োজনের সব থেকে চ্যালেঞ্জিং দিকটা ছিল প্রদর্শনীর জন্য উপযুক্ত বই, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করা। এই প্রসঙ্গে চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘প্রদর্শনীর জন্য বই সংগ্রহই প্রথম ও প্রধান কাজ। অনেক ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে এবং লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহ করতে হবে। এইজন্য পুরোনো লাইব্রেরি দেখতে হবে। নিখিলবাবুর সঙ্গে আমি একে একে উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি, শ্রীরামপুর কেরী লাইব্রেরি, শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরি ও কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন লাইব্রেরি ঘুরে দেখতে লাগলাম… বিচিত্র তাদের হরফ এবং বিচিত্র সব ছবি।’ এই শতাব্দীপ্রাচীন গ্রন্থাগারগুলির মধ্যে উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি বা শ্রীরামপুরের কেরি-র লাইব্রেরির সংগ্রহের কথা পণ্ডিতমহলে সুবিদিত। কিন্তু এই সংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজকরা বিশেষ ভাবে বিস্মিত হয়েছিলেন শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরির সংগ্রহ দেখে। তবে এই বিস্ময়ের সঙ্গে বেদনার রেশও জড়িয়ে ছিল। ‘এইসব মূল্যবান বই লোকচক্ষুর অন্তরালে অবহেলায় ধ্বংস হয়ে’ যাওয়া কর্মসমিতির সদস্যদের খুব স্বাভাবিক ভাবেই দুঃখিত করেছিল। 

    ‘শিশুশিক্ষা’ টাইটেল পেজ ১৮৬৪ সংস্করণ
    উড অথবা লিথোব্লক থেকে ছাপা ‘শিশুশিক্ষা’র ১৮৬৪ সংস্করণ থেকে স্বরবর্ণের পাতা

    তবে স্রেফ গ্রন্থাগারই নয়, আয়োজকদের একই ভাবে নির্ভর করতে হয়েছিল ব্যক্তিগত সংগ্রহের ওপর। প্রদর্শনীতে শুধু বই বা পত্রপত্রিকাই নয়, সেই সঙ্গে পুরনো প্রেস, ছাপার ব্লক, লেখার সরঞ্জাম, এমনকী বিখ্যাত লেখকদের হাতের লেখার নিদর্শনও প্রদর্শিত হয়েছিল। এখানে আলাদা ভাবে উল্লেখ্য, মেলাতে প্রদর্শিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’র প্রথম ভাগে ব্যবহৃত ছবির ব্লকটি। উনিশ শতকে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে ‘শিশুশিক্ষা’র গুরুত্ব প্রায় ‘বর্ণপরিচয়’-এর সমান। ১৮৪৯ থেকে ১৮৯০-র মধ্যে ‘শিশুশিক্ষা’র সংস্করণ হয়েছিল ১৪৯টি, সেখানে ‘বর্ণপরিচয়’-এর ১৫২টি। এই ব্লকটি পাওয়া গিয়েছিল প্রকাশকের পরিবারের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। সেই সঙ্গে বটতলার বইয়ের ছবির কাঠের ও ধাতুর একাধিক ব্লক প্রদর্শিত হয় মেলাতে। এইসব ব্লকে একদা ছবি ছাপা হয়েছে বটতলার নানা লোকপ্রিয় বইয়ে। এই ব্লকগুলি মূলত পাওয়া যায় চিৎপুরের বিখ্যাত প্রকাশক বাণেশ্বর ঘোষ অ্যান্ড সন্স-এর (প্রতিষ্ঠিত ১৮৭২) উত্তরাধিকারী মানিকলাল ঘোষের থেকে। তিনি তখনও পর্যন্ত সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ছাপাখানার এইসব ঐতিহাসিক স্মারকচিহ্ন। 

    কর্মকার পরিবারের সংগ্রহে রক্ষিত টাইপ-কাস্টিং মেশিন

    ছাপাখানার যন্ত্রপাতি দিয়ে আয়োজকদের বিশেষ সাহায্যে করেছিলেন বাংলা মুদ্রণের পথিকৃৎ শ্রীরামপুরের কর্মকার পরিবার এবং শ্রীরামপুর মিশন কলেজ। এই প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণই ছিল মিশন কলেজ প্রদত্ত ‘আগুনে কল’। ‘কারণ পেটে তার দাউ দাউ আগুন, চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের হয় অনর্গল।’ শ্রীরামপুর প্রেসে এক দুর্ঘটনার পরে উইলিয়াম কেরি স্বয়ং এই কলটি বিলেত থেকে নিয়ে এসেছিলেন উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। দেশের প্রাচীনতম বাষ্পচালিত কলের মধ্যে অন্যতম কাগজ তৈরির এই যন্ত্রটি, খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই সময়ে বিস্ময়ের সৃষ্ট করেছিল জনমানসে। প্রদর্শনীর কর্মসমিতির সদস্য ও উৎসাহদাতারাও পিছিয়ে থাকেননি নিজেদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ভাগ করে নেওয়া থেকে। সুভো ঠাকুরের স্রেফ নিজের বহুমূল্য দোয়াত সংগ্রহ তুলে দিয়ে থেমে থাকেননি, নিজের সংগ্রহ থেকে রামমোহনের রায়ের দলিল বা বঙ্কিমচন্দ্রের চিঠিও দিয়েছিলেন প্রদর্শনের জন্যে। প্রদর্শনীতে বিশেষ ভাবে কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল সত্যজিৎ রায়ের পাঠানো সুকুমার রায়ের খেরোর খাতা ও ম্যানচেস্টারে স্কুল অফ টেকনোলজি থেকে প্রাপ্ত মুদ্রণবিদ্যার শংসাপত্র।   

    বিড়লা তারামণ্ডলের বিপরীতে ক্যাথিড্রাল রোড ও কুইন্সওয়ের সংযোগস্থলে কলকাতা ময়দানে আয়োজিত এই প্রদর্শনী যে যথেষ্ট উৎসাহের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল তার সাক্ষ্য বহন করছে সেই সময়ে প্রকাশিত খবরের কাগজের রিপোর্ট ও ছবি। ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি অব্দি প্রদর্শনীর সময়সীমা নির্ধারিত থাকলেও, দর্শকদের উৎসাহের কথা ভেবে প্রদর্শনীর দিনক্ষণ পরে আরও দু’দিন পরে বাড়ানো হয়। প্রদর্শনীতে দর্শকদের সংগ্রহের জন্যে বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছিল ভারতবর্ষে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র হিকি-র ‘বেঙ্গল গেজেট’ ও প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’-এর সম্পূর্ণ সংস্করণের ফ্যাক্সিমিলি কপি। তবে এ-কথা মনে করলে ভুল হবে যে, প্রদর্শনীর এই প্রভাব সাময়িক উৎসাহতে সৃষ্টিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৭৯-র পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে বাংলার মুদ্রণ সংস্কৃতি ও গ্রন্থ-ইতিহাস চর্চার (book-history) এক নতুন ধারার উন্মোচন হয় বলে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। এই প্রদর্শনীর অনতিকাল পরেই প্রকাশিত হয় গ্রাহাম শ-র Printing in Calcutta to 1800 : a description and checklist of printing in late 18th-century Calcutta গ্রন্থটি। প্রদর্শনীর সময়ে কৃত দ্রষ্টব্য বই ও অন্যান্য সামগ্রীর ক্যাটালগ ও প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত দুটো বই পরবর্তী সময়ে বহু গবেষকের দিশার কাজ করেছে । আনন্দ পাবলিশার্স থেকে মেলা চলাকালীন, শ্রীপান্থ সম্পাদিত হ্যালহেডের গ্রামারের ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ ও চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন’ বইদুটি প্রকাশ করা হয়। এখানে বিশেষ করে দ্বিতীয় বইটির কথা উল্লেখ্য। দুঃখের বিষয় বাংলার মুদ্রণের ও গ্রন্থ-ইতিহাস চর্চার আকরগ্রন্থ স্বরূপ এই বইটি আজ বহু বছর ধরেই দুষ্প্রাপ্য। 

    আমরা এই আলোচনার শেষ করি যেখানে শুরু করেছিলাম সেখানেই। ১৯৭৯ সালের এই প্রদর্শনীর প্রায় পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত আর কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথম বাংলা বই প্রকাশনের আড়াইশো বছর পূর্তি, কিন্তু প্লান্ত্যাঁ-মোরেতাস জাদুঘরের ধাঁচের কিছু এখানে গড়ে তুলতে এখনও অব্দি আমরা সফল হয়নি। অথচ এখানকার বিপুল সম্ভাবনার কিছুটা আভাস আমরা ওপরের লেখাতেই পেয়েছি। সাম্প্রতিক সময়ে মুম্বইনিবাসী গ্রন্থ ঐতিহাসিক মুরলী রঙ্গনাথন একাধিক লেখায় তুলে ধরেছেন ভারতে একটি মুদ্রণ জাদুঘরের অপরিহার্যতার কথা। অনেকটা অ্যান্টওয়ার্পের প্লান্ত্যাঁ-মোরেতাস পরিবারের মতোই শ্রীরামপুরের কর্মকার পরিবার এখনও তাঁদের ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছেন। আশা করা যায় এই বহু প্রতীক্ষিত স্থায়ী প্রদর্শনীর সূচনা হবে অদূর ভবিষ্যতে সেই শ্রীরামপুরেই।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook