ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মিহি মন্তাজ: পর্ব ১১


    শুভময় মিত্র (March 4, 2022)
     

    দে-জা-ভ্যু

    জাস্ট দেখলে দোষের কী আছে? রোজ একই দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকলে খারাপ দেখায়। তাই জায়গা বদল করি প্রত্যেকবার। যদিও আমাকে কেউ বকাঝকা করেনি কোনওদিন। উপেক্ষাও করেনি। সবটাই আমার ভয়। যদি কিছু বলে! বললে, ‘মিষ্টি একটা আর্ট, আপনার দোকান আমার কাছে মিউজিয়াম সম। থরে-থরে সাজানো এমন ঐতিহাসিক সম্ভার, দেখব না?’ এই কথা বলব ভেবে রেখেছিলাম। বড় দোকানে এক রকম। চকচকে খদ্দেরদের হম্বিতম্বি, কর্মচারীর ব্যস্ততার মধ্যে যেন খুব মন দিয়ে দেখছি, কী নেব ভাবছি, এই রকম মুখ করে তাকিয়ে থাকা যায় অনেকক্ষণ। হয় শুকনো, নয়তো রসের। মিষ্টিই তো! ছোটবেলার মতো, অসভ্য ছবির বই হাতে পেয়ে ক্রমাগত তাকিয়ে থাকাটা, কী যেন খোঁজাটা, এখনও চলছে। অমৃত্তি, সোনপাপড়ি, বোঁদে ছাড়া অন্য সব মিষ্টি দেখলে আমার ওই কথা মনে পড়ে। পাড়ার ছোট দোকানে প্রায় হারিয়ে যাওয়া জীবনের মিষ্টি-মিষ্টি ব্যাপার। ভেতরের তেলচিটে সবুজ দেওয়াল, ঘেমো ময়রা, বারকোশে ঠাসা ছানার পাক, শালপাতা চাপা ঝুড়ির তলায় রাধাবল্লভি। অদ্ভুত গন্ধ। একই গন্তব্যে পৌঁছনোর আগে ঘন কালো কড়াইতে আরও ঘন চিনির গরম সউনাতে রসগোল্লা,পান্তুয়া। ঘোলাটে কাঁচের শো-কেসের ওপরের তাকে এদের জায়গা হয় না। ওখানে মন্দাকিনী মধুবালা সন্দেশরা সেজেগুজে বসে থাকে কুচি দেওয়া কাগজের বাটিতে। গা ঘষাঘষি করে ক্ষীরকদম্ব, চমচমেরা। এরা প্রায় সবাই নিচুতলায় পাঠিয়ে দেওয়া অরিজিনালদের মেকআপ নেওয়া ভার্সন। এদের ফিগারগুলো ভাল। সকালে-বিকেলে সিঙাড়া কচুরির সঙ্গে ওপরের বাঙ্কে ওঠে জিলিপি। সব দেখেও খদ্দের জিজ্ঞেস করে, ‘কী হব্বেহ?’ যেই না বলা হল, ‘জলভরা নিন, এখন গুড়ের’, অমনি পরের প্রশ্ন, ‘টাটকা? চাড্ডি কড়াপাকের গুলি দাও বরং।’ আংটির মাপের সঙ্গে মানানসই বাক্সে সেটি দিতেই পরের মন্তব্য, ‘ক্লোজ রেঞ্জে দেগে দিলে লোক মরে যাবে। আজকাল সবেতেই ভ্যাজাল। এত শক্ত কেন বাপু?’ দোকানদারের মন বহুকাল ধরে কড়াপাকে বাঁধা। উত্তর নেই। সন্দেশের ওপর ছড়ানো মিথ্যে পেস্তার সবুজ গুঁড়ো দেখে, ‘শ্যামাপোকা সন্দেশ কত করে?’ এমন মন্তব্য করলে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। লেগেই থাকে এসব। শুনি। দেখি। একদিন ঠিক আমার মতো আর একটা লোককে পেয়ে গেলাম। 

    বয়েস ভালই, ময়লাপানা, ধুতি-শার্ট পরা। সেও দেখছে আমি যা দেখছি। মন্তব্য করছে। অন্য খদ্দের নিয়ে দোকানদার ব্যস্ত। মাথা দিচ্ছে না। পাড়ার চেনা লোক মনে হয়। উনি বিশেষ কিছু চাইছেন না। ভিড় কমতে ওঁকে ছোট ভাঁড়ে একটা পান্তুয়া তুলে দেওয়া হল। ‘রস দে, রোজ এক কথা বলতে হয়’ বলায় তাও দেওয়া হল। প্রায় উপচে পড়া রসভর্তি ভাঁড়টা সাবধানে টেনে নিয়ে উনি বেরিয়ে এলেন। পয়সা চায়নি কেউ। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। আমি যাতে দেখতে না পাই, তাই ঘুরে দাঁড়িয়ে চুমুক দিয়ে খেয়ে রসের লেভেলের বিপদসীমা সামলে উনি মূল মিষ্টিটা অত্যন্ত মন দিয়ে দেখতে লাগলেন। দোকান নয়, আমি ওঁকে দেখতে লাগলাম, লুকিয়ে। কোথায় যেন দেখেছি এঁকে। গপ করে একবারে খেলেন না। পিছন থেকে দেখে মনে হল খুঁটে-খুঁটে খাচ্ছেন। এক পা এগোলেন। আবার দাঁড়ালেন। ফলো করা গেলে ভাল হত। এই আমার এক বাজে স্বভাব। উলুখাগড়া লোক দেখলে তার পেছনে ধাওয়া করা। একবার খুব বিপদে পড়েছিলাম। ভাতের হোটেলে একটা লোকের সঙ্গে আলাপ হল, বাড়ির দালালি করে। শুনে তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললাম। সারাজীবন যে অন্যের স্বপ্নের বাড়ি খুঁজে বেড়ায় তার জীবনে অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতার অভাব হবে না। ওখানেই তো আমার আগ্রহ। এই কাজের নানা রকম রিস্ক, প্রফেশনাল হ্যাজার্ডের কথা সে বলেছিল আমাকে। মার্বেলওয়ালা বাগান ঘেরা বাড়ি চাই খবর পেয়ে সে নাকি অবাঙালি একজনকে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল দূর থেকে দেখিয়ে দশ টাকা পেয়েছিল। যাই হোক, বিশ্বাস করে সে আমাকে সঙ্গী করতে আপত্তি করেনি। ওকে সিঙাড়া-চা খাওয়াতাম ঘণ্টায় ঘণ্টায়। সেও বকে যেত। হাওড়াতে একটা খুব পুরনো বাড়ি দেখিয়ে বলেছিল যে, সেটা বিক্কিরির চেষ্টা চলছে ওর পৌরোহিত্য। হঠাৎ পাড়ার মাস্তানরা এসে কলার ধরে প্রায় মারে আর কি। ‘ও-বাড়ির মেয়েটা বড় হতেই তোদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। আবার আঙুল তুলে ঘর চেনাচ্ছ?’ 

    ধাওয়া করার দরকার পড়ল না। উনি নিজেই আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। চিয়ার্স বলার ভঙ্গিতে ভাঁড়টা রেইজ করে আমাকে দেখালেন। আমিও অদৃশ্য পাত্র শূন্যে তুলে প্রত্যুত্তর দিলাম। কত সহজে কানেক্টেড হয়ে গেলাম একটা অচেনা মানুষের সঙ্গে। এর মানে উনি আমাকে খেয়াল করেছেন। একটু খোশগল্প করা যাবে। আমার উপস্থিতিকে পাত্তা না দিয়ে এবারে ভাঁড় উল্টে বাকি রসটুকু মেরে দিলেন। তারপর রসে ভেজা মাটির ভাঁড়টা কুট-কুট করে ভেঙে-ভেঙে খেতে শুরু করলেন। আমার অবাক হওয়াটা আন্দাজ করে নির্লিপ্ত ভাবে বললেন, ‘ক্যাডবেরি এর ধারে কাছে আসে না।’ আমরা আস্তে-আস্তে হাঁটতে লাগলাম, পাশাপাশি।

    সারাজীবন যে অন্যের স্বপ্নের বাড়ি খুঁজে বেড়ায় তার জীবনে অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতার অভাব হবে না। ওখানেই তো আমার আগ্রহ। এই কাজের নানা রকম রিস্ক, প্রফেশনাল হ্যাজার্ডের কথা সে বলেছিল আমাকে। মার্বেলওয়ালা বাগান ঘেরা বাড়ি চাই খবর পেয়ে সে নাকি অবাঙালি একজনকে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল দূর থেকে দেখিয়ে দশ টাকা পেয়েছিল।

    এক-দু’পা এগোচ্ছেন, এটা সেটা বলছেন, শুনছি। ‘সায়েব বলতে এরা ব্রিটিশ বোঝে, ভুল। ফরাসিরা নেহাত এল না বলে। বাঙালি স্যুপ শিখল না। আজও সেই ঝালে-ঝোলে ডুবে মরছে। পর্তুগিজরা ছানা বানানো শিখিয়ে চলে গেল। এগুলো আজকালকার লোক জানেও না। কুকুরকে খাওয়াচ্ছে কুকি। নিজে খাচ্ছে লেড়ে বিস্কুট।’ ওঁর সব মন্তব্যই রাগী-রাগী। আমি সম্মতি জানাচ্ছিলাম। দেওয়াল, ল্যাম্পপোস্ট ধরে-ধরে এগোচ্ছেন উনি। বেশ কয়েকবার বিভিন্ন দেওয়ালে হাত মুছেছেন। অনেক বছর ধরে মুছছেন মনে হয়। বলা যায় না, জমে-জমে হয়তো চিনির আস্তরণ তৈরি হয়ে গেছে সেখানে। মনোহরা দেওয়াল। উনি কতদূর যাবেন জানি না। আমার সঙ্গ দেওয়াটা কতটা সমীচীন হবে তাও বুঝতে পারছি না। পরিস্থিতি বুঝে, ‘দেখা হয়ে ভাল লাগল, আজ আসি’ বলে কেটে পড়া যাবে। উনি থেমেছেন। গন্ধে বুঝতে পারছি কেন। ‘ব্রেস্ট আবার কী? কথাটা হল ব্রেইজড কাটলেট।‘ মাটন, চিকেন, ফিস ফ্রাই, ফিঙ্গার, ডিমের ডেভিল, ভেজিটেবল চপের দোকান। মেনুবোর্ডে একটা নতুন নাম দেখলাম, ‘প্যান্থারাস’। আমি ফস করে বলে বসলাম, ‘এটা কী ব্যাপার?’ ওঁর মুখ ঝলমল করে উঠল। এখানে ফ্রি-তে কিছু দেওয়া হয় বলে মনে হয় না। ‘বাজপাখির চোখ আপনার, ঠিক জিনিসটি দেখেছেন। আজকাল এসব কেউ করে না। ভাল কথা, কাসুন্দিটা এরা কিন্তু নিজেরা বানায়। টোকো বাজারি মাল নয়।’ বয়েস হয়েছে, এখনও খাওয়া-দাওয়ায় আসক্তি আছে। হয়তো আর সব হারিয়েছেন, এটি হজম করতে পারছেন। টাকাপয়সার অভাব আছে বোঝাই যাচ্ছে। এককালে হয়তো রমরমা ছিল। সঞ্চয়ের তলানিতে পৌঁছে, বেঁচে আছেন অতীত-স্মৃতি আর আজকের ভিক্ষাপাত্রের ভরসায়। এসব আমার ধারণামাত্র। আমার বাবার সম্পর্কে এক মামাকে দেখেছিলাম ছোটবেলায়। অবিকল এক চেহারা। রান্নার বাতিক। বই ছাপিয়েছিলেন। এক কপি আমাদের বাড়িতেও ছিল। সেখানে পিঠে পুলি নয়, পুডিং-এর দৌরাত্ম্য। সেভারির মধ্যে পাঁঠার দাপাদাপি। ঘি প্রায় সবেতেই। সে-যুগে হৃদয় বন্ধু তেল নিয়ে কারুর মাথাব্যথা ছিল না। মাঝে মাঝে চোখে পড়ত অয়েস্টার সস, উরসেস্টর সসের নাম। শেষ বয়েসে কর্পদকসশূন্য অবস্থায় মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে যায়। তখন শেক্সপিয়রের সনেট অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন। সম্ভবত ওই চাপ আর নিতে পারেননি।

    বেশ ভিড় দোকানে। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ভদ্রভাবে। ঠেলাঠেলি-চেঁচামেচি নেই। লোভী লাইন এগোচ্ছে একটু-একটু করে। হুমদো মতো একজন, হেলমেট খোলেনি, উদ্ভট দেখাচ্ছে, লাইনের আশেপাশে ছোঁকছোঁক করছে। ভাবগতিক সুবিধের নয়। এদিকে আমিও লাইনে দাঁড়িয়েছি। আমার লোকও আছেন, চলে যাননি। আমি যে কিছু একটা কিনব, ওঁকেও অফার করব বুঝতে পেরেছেন। আমাদের পরস্পরের মধ্যে একটা অদৃশ্য, অনথিবদ্ধ প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। হ্যাঁ, আমার মাথাতেও একটা আইডিয়া চুঁইয়ে-চুঁইয়ে নামছিল বইকি। অস্বীকার করি কী করে? কমতে-কমতে এখন আমার সামনে তিনজন। দ্বিতীয় জনের হাতে ক্রাচ। হেলমেট তার সামনে সেঁধিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ক্রাচ দিয়ে মাথায় এক বাড়ি পড়ল। মুহূর্তে সে লাইনের বাইরে। কাছে রাখা বাইকে উঠে ভট-ভট আওয়াজ করে চলে গেল। অভাবনীয়। ‘মানুষ হয়নি ঠিকমতো, এদিককার নয় ওটা’, জনগণ জানিয়ে দিল। গর্ভগৃহের সামনে পৌঁছতেই, ‘খাবেন তো’ জেনে নিয়ে কাগজের প্লেটে একটি প্যান্থারাস আমাকে ধরিয়ে দেওয়া হল মাস্টার্ড-সহ। অন্যটি কাগজের ঠোঙায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে শুনলাম, ‘উনি পরে খাবেন।’ তাই বলে একা খাব, ভাল দেখাবে না। ‘আমি সত্তর বছর ধরে খাচ্ছি, আপনি খান’ বলে নিজের ঠোঙাটি হাতে নিয়ে এগোতে শুরু করলেন। চলতে-চলতে আমার মাথায় সদ্য আসা ধান্দাকে একটা প্ল্যানে ছকে ফেললাম। সাবধানে কথা পাড়ব। রাজি হলে ভাল। রেগে গেলে ‘কিছু মনে করবেন না’ বলে চলে যাব। উনি এই পাড়ার লোক, বুঝতে অসুবিধে নেই। বাড়ির রকে দুজন দাবা খেলছে, পাশে কয়েকজন দেখছে মন দিয়ে। তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বোর্ড থেকে নজর না সরিয়ে একজন বলল, ‘কাকার হাতে কীইই?’ পানের দোকানে বলল, ‘আজকাল আর জোয়ান নিচ্ছেন না তো? অবিশ্যি আপনি কি না হজম করতে পারেন!’ দুজনকেই আদিরসে চোবানো উত্তর দিলেন। আমি কালা সেজে পিছন-পিছন।

    একজন ওপরে। একজন নীচে। দুজন অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা হচ্ছে আজ। যা কোনওমতেই হবার কথা নয়। দরজায় আবার ছায়া পড়েছে। এগোচ্ছে ছায়াটা। মেয়েটা ফিরে আসছে। ছায়া স্থির হয়ে রইল। হয়তো আমি চলে গেলে আসবে। ছেলেটার অনুরোধে আমি দাঁড়িয়ে গেছি। মেয়েটা কখন আসবে জানি না।

    আমার আন্দাজ নির্ভুল। যেখানে উনি থেমেছেন, তারপর অন্ধকার, ভীষণ সরু একটা গলিতে ঢুকেছেন, একটু এগিয়ে আবার একটা দরজায় দাঁড়িয়েছেন, ভেতরে ঢুকবেন, একে হানাবাড়ি বললে ভুল হবে না। এরকম অনেক দেখেছি। বেশির ভাগই ডিস্পিউটেড প্রপার্টি। কোথাও কর্পোরেশন ‘বিপজ্জনক’ লিখে সিল করে দিয়েছে। অনেক বাড়িতে শুধু দখলদার নয়, আসল মালিকও থাকে। সন্ধের পর একটা ঘরে টিমটিমে বালব জ্বলে। এখানে তাও চোখে পড়ল না। উনি আমাকে ভেতরে আসতে বলবেন ভাবার কোনও কারণ নেই। তাই সাবধানে, বিদায় নেবার আগে ওঁকে আমার ইচ্ছের কথা বললাম। উনি শান্ত ভাবে বললেন, ‘আর একটু সময় হবে কি আপনার? তাহলে একটু কথা হত। দেখেও নিতেন।’ রাজি না হবার কোনও কারণ নেই। প্রথমে একটা প্যাসেজ। ওঁর পায়ের আওয়াজ শুনে-শুনে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিনতলার বারান্দা ঘুরে একটা ঘরের সামনে দাঁড়ালাম। উনি দরজা খুলে, ভেতরে ঢুকে আল জ্বাললেন। এককালের সম্পন্ন বাঙালি বাড়ি। সিনেমার সেট যেন। মেহগনির উঁচু পালঙ্ক,  ভেতরে পাশবালিশ ঘুমোচ্ছে। পার্মানেন্ট ময়লা মশারি। মাঝখানটা চুড়ো করে সিলিং অবধি টেনে বাঁধা। তার ভেতর দিয়ে ছোট ফ্যান নেমেছে। গোল মার্বেলের টেবিল। ওপরে ডাঁই করা বই। কয়েক বছরের মধ্যে সেগুলো জায়গা বদলেছে বলে মনে হল না। কাচের আলমারিতে বিমর্ষ পরি পুতুল। টিনের তৈরি দুটো ভিন্টেজ গাড়ির মডেল। সোনালি জলের বর্ডার দেওয়া আদ্যিকালের কাপ ডিশ, কেটলি। দেওয়ালে বড়-বড় ছবির ফ্রেম, ভেতরে কিছু নেই। ঘরের একটামাত্র বালবের আলোতে সব কিছু মলিন দেখাচ্ছে। টেবিলের ওপর একটা নেপালি খুকরি। সব জানলা বন্ধ। উনি দরজার কাছে গিয়ে একটু ফাঁক করে গলা তুলে নিচে কাউকে বললেন, ‘চা।’  ফিরে এসে হাতের খাবারের ঠোঙাটা একটা তাকে তুলে রাখলেন। জানালেন, ‘তাহলে ওই কথাই রইল। ছাদও আছে। টাকাপয়সাটা বড় কথা নয়। এই যে আপনারা আমার বাড়িটাকে স্বীকৃতি দিলেন, এটা সম্মানের ব্যাপার। একদম নোংরা হয়ে গেছে দুনিয়া। মানুষের রুচি এত নীচে নেমেছে যে ম্যানহোলেরও শ্বাস আটকে গেছে… তা ভূতের ছবি করবেন বলছেন, ভূত লাগবে না?’

    পার্টি এত সহজে রাজি হয়ে যাবে, আমাকেই তোয়াজ করবে, ভাবতে পারিনি। লোকেশন ফিক্সার হিসেবে আমার এতদিন বিশেষ সুবিধে হয়নি। এবারে হবে। ওঁর পক্ষেও সেটা ভাল। রসলাগা ভাঁড় খেতে ভিক্ষে করতে হবে না। ‘বংশীদা আমাকে চিনতেন। মানিকবাবুর ছবিতে দুটো ভূত আমিই করেছিলাম। ডাবল রোল। একবার নেগেটিভ। একবার পজিটিভ। যখন ‘চারুলতা’ হল তখন এ-বাড়ি এমন ছিল না। এখানেই হবার কথা হয়েছিল। যাক গে, সে অন্য কথা। ভূত লাগলে বলবেন কিন্তু।’

    ওঠার সময় বলেননি, নামার সময় বললেন, ‘একটু সাবধানে, রেলিংটা নেই।’ তিনতলার ল্যান্ডিং অবধি পৌঁছনোর আগে থামতে হল। ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে দোতলার দরজা খোলা, সামান্য আলো আসছে। দরজার বাইরে দুজন। অন্ধকারে প্রায় এক হয়ে আছে। চোখ সয়ে আসছে। দুটো মাথা কখনও আলাদা হচ্ছে। আবার ডুবে যাচ্ছে অন্যের মধ্যে। এরা কারা? ভাড়াটে? নাকি ওঁর পরিবারের কেউ? এমন একটা জায়গায় ওরা রয়েছে যে, পাশ দিয়ে না দেখার ভান করে নেমে যাওয়া যাচ্ছে না। কী করা উচিত? মুখ ঘুরিয়ে ওপরে তাকালাম। উনি দাঁড়িয়ে আছেন। নীচে তাকালাম। একই পরিস্থিতি। কতক্ষণ অপেক্ষা করব আর? নামতে শুরু করলাম। ওরা কিছু একটা বলছিল। স্পষ্ট নয়। আমি কাছে এসে যাওয়ায় কথা বন্ধ হয়ে গেল। সামান্য সরল। একজন আর একজনকে দেওয়ালে ঠেসে ধরল। আমি দেওয়াল ধরেই নামছি। ঠান্ডা, ভিজে-ভিজে। এক জায়গা চটচটে। সেই রস না কি? এক জায়গায় পলেস্তারা খসে ইঁট বেরিয়েছে টের পেলাম। সেখানে ধুলো-ধুলো ভাব। বিছে, মাকড়সা কি এরকম ফাটলে বাসা করে? ‘ওঁকে একটু যেতে দাও মা’, ওপর থেকে এল কথাটা। আমি গলা খাকারি দিতেই একজন ছিটকে বেরিয়ে এল। মেয়েটা। দৌড়ে ঢুকে গেল ঘরে। তার মানে ছেলেটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার পক্ষে এগোনো আরও মুশকিলের হল। ওকে আমি দেখতে পাচ্ছি না তেমন, মাঝারি উচ্চতার মানুষ, এটুকু বুঝতে পারছি। নীচ থেকে কথা শুনলাম, ‘আপনি কাইন্ডলি ওয়েট করবেন একটু? ও আসবে। আমাদের আর একটু সময় লাগবে।’ উপায় নেই, দাঁড়াতেই হল। একজন ওপরে। একজন নীচে। দুজন অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা হচ্ছে আজ। যা কোনওমতেই হবার কথা নয়। দরজায় আবার ছায়া পড়েছে। এগোচ্ছে ছায়াটা। মেয়েটা ফিরে আসছে। ছায়া স্থির হয়ে রইল। হয়তো আমি চলে গেলে আসবে। ছেলেটার অনুরোধে আমি দাঁড়িয়ে গেছি। মেয়েটা কখন আসবে জানি না। ছেলেটা ভেতরে চলে গেলেই তো পারে। তারপর যা খুশি করুক না। এদেরই কাউকে কি চা দিতে বলা হয়েছিল? দেয়নি। মন শক্ত করলাম। নেমে যাব। ছায়াটা এখনও নড়ে নি। এক ধাপ নামলাম। আরও একটা। তারপর কোনও দিকে না দেখে ঝট করে দরজা পেরিয়ে, ছেলেটাকে পেরিয়ে নেমে গেলাম নীচে। খুব ইচ্ছে করছিল দরজার দিকে তাকানোর, তাকাইনি। কফির গন্ধ পেলাম। পাশ দিয়ে যাবার সময় মনে হল কান্না শুনলাম। পুরুষের গলা। নেমে এসেছি কয়েক ধাপ। মাথা ঘোরালাম। দরজার ভেতর থেকে আলোটা আসছে না। বন্ধ হয়ে গেল কি? আমার পায়ের শব্দে এরকম হল? উইংসের মধ্যে দিয়ে ভুল করে একটা মঞ্চে ঢুকে পড়েছিলাম। নাটকের গল্পটা আমাকে গিলে ফেলেছিল একটুও দেরি না করে। সংলাপ নেই। কিছু করতে নির্দেশও দেওয়া হয়নি। স্রেফ অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। যা আমি অমান্য করেছি। খুব ক্ষতি করে ফেলেছি কি? মঞ্চের সব কিছু আপাতত থমকে গেছে। এমন উদ্ভট পরিস্থিতির জন্য আমি কোনওভাবে দায়ী নই। আমার অধিকার আছে যেখান থেকে এসেছি সেখানে ফিরে যাওয়ার। শেষ স্টেপগুলোতে নামার সময় মনে হচ্ছিল ছেলেটার পায়ের শব্দ শুনছি। মনের ভুল। সদর দরজাতে আলো নেই। কিন্তু বাইরের সামান্য আলোতে দরজার আয়তক্ষেত্রটা দেখা যাচ্ছিল। এরপরেই তো প্যাসেজ। জীবনে আর কখনও এমন উল্টাপাল্টা জায়গায় যাব না। কোথায় আসলে কী হয়, কে কী করে, বেশি জানতে চাওয়ার দরকারও নেই। প্যাসেজে পড়তে রাস্তা দেখা গেল। কেউ একটা ঢুকছে সেখান দিয়ে। আর একদম দাঁড়ানো নয়। প্যাসেজের দেওয়ালটা অদ্ভুত গরম। ভেলভেটের মতো নরম, রোঁয়াওয়ালা কিছু একটার স্পর্শ পেলাম। জ্যান্ত মানুষের শরীরের মতো। শ্যাওলা হতে পারে। 

    ফেরার সময় প্যান্থারাসের দোকানের সামনে দিয়ে এলাম। দরজা বন্ধ, তার তলা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। রাতে কেউ শোয় নিশ্চয়ই। এখনও ঠান্ডার রেশ রয়েছে। মিষ্টির দোকানে গরম রাজভোগ সবে নেমেছে। নতুন বসন্তে তার চটচটে গন্ধে আমার মনে পড়ে গেল, শেষ যে ঢুকল তাকে আমি চিনি।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook