বেড়াতে গিয়ে, বহু জায়গার নাম আমরা অনেক সময়েই খেয়াল করে রাখি না। অপরিচিতের প্রেমে পড়লে যেমন ভাবি, নামে কী-ই বা আসে যায়? অস্তিত্ব প্রমাণ কিংবা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে মানুষের ভাষা যে আদতে অলঙ্কার বই কিছু নয়, সেই উপলব্ধি আরও জোরালো হয়।
সম্ভবত এই কারণেই, কিছুদিন আগে বাতাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে আমরা জায়গাটার নামের ইতিহাস নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনি।
পরিবারের কিছু সদস্য বাতাবাড়ির নামটা ক্রমাগত বিশ্ববিখ্যাত, বহুজাতিক চেক্ জুতো প্রস্তুতকারক সংস্থার আদলে ‘বাটা’বাড়ি বলে যাচ্ছিলেন; অন্য কিছুজন বাটা মাছের সঙ্গে এই নামের নাড়ির যোগ আছে বলে প্রায় ধরেই নিয়েছিলেন। শেষে জানা গেল, বাতাবাড়ির নামের উৎপত্তি ‘বাতা’ নামের এক ধরনের বাঁশ থেকে, যা এই অঞ্চলে ঘর-বাড়ি বানানোর কাজে এবং দৈনন্দিন, কার্যকরী সামগ্রীর ক্ষেত্রেও বহু-ব্যবহৃত।
এ-কথাটা আমরা জানতে পেরেছিলাম ঠিক বাতাবাড়ি পৌঁছনোর মুখে। একটা দিনের জন্য যে-জায়গাটা আমরা বুক করেছিলাম, সেখানে পৌঁছতে গেলে পেরোতে হয় একটা বাঁশের সাঁকো। গুরুতর আর্থ্রারাইটিসে ভোগা আমার মায়ের পক্ষে এই সাঁকোর উপর হাঁটা খুবই কষ্টকর হয়েছিল। অসমতল, এবড়ো-খেবড়ো বাঁশের পাত ঠুকে-ঠুকে বানানো এই সাঁকোটায় প্রতিটা পদক্ষেপ খুবই মেপে ফেলতে হত। বলা বাহুল্য, এই সাঁকো-পেরনো মায়ের হাঁটু আর পা যা শক্তি দাবি করছিল, তা তিনি বহু বছর আগে হারিয়েছেন। কষ্টে, দুঃখে মা আমাদের সঙ্গে আসা এক পরিচারককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এমন সাঁকো বানিয়েছো কেন?’
‘এটাই যে বাতাবাড়ির ‘বাতা’,’ তরুণ পরিচারক বলেছিলেন।
আমরা বাতাবাড়ি কেন এসেছি, তা আমি ভাবতে শুরু করি। মাসখানেক আগে, যখন বেড়াতে যাওয়ার আগ্রহটা আমাদের কথোপকথনে উঁকি-ঝুঁকি মারা শুরু করে আর আমরা কাছাকাছির মধ্যে বেড়িয়ে আসার জায়গা খুঁজতে শুরু করি – অবশ্যই শহুরে জীবনের ভিড় ছেড়ে পালিয়ে আসার প্রবল ইচ্ছেটার প্রভাবে – বাতাবাড়ির নাম কিন্তু খুব একটা উঠে আসেনি। ডুয়ার্সে অন্যান্য জায়গায় পর্যটনের কারণেই জনবসতি গড়ে উঠেছে, যার মধ্যে বাতাবাড়ির প্রতিবেশী লাটাগুড়ি অন্যতম; একরত্তি জায়গাটাই নাকি আজকাল শুধুই রিসর্ট। এত বেশি সংখ্যক হোটেলের কারণে লাটাগুড়ির কাছাকাছি জঙ্গলে তাই বোধহয় জন্তু-জানোয়ার আর বিশেষ দেখা যায় না।
উদলাবাড়ি আর মালবাজার পেছনে ফেলে আমাদের গাড়ি বাতাবাড়ির দিকে রওনা দিল, তখনও মনে এই আশা যে এখনও পর্যন্ত হাইওয়ের চারপাশে যা দেখলাম, বাতাবাড়ি তার চেয়ে বেশ কিছুটা আলাদা হবে। বাতাবাড়ি ঢোকার মুখে অবশ্য নিরাশই হতে হল। বাঁ-হাতে পরপর রিসর্ট আর তাদের ‘কটেজ’(মানে যেকোনো ধরনের বাড়ির উপরে টিনের ঢালু ছাদ হলেই হল)— শহুরে ফ্ল্যাটবাড়ির চেয়ে যা বিশেষ আলাদা নয়। অন্যদিকে ছড়ানো-ছেটানো চা-বাগান। মনুষ্যবসতির ছোঁয়াহীন পাহাড়-জঙ্গলের অভিজ্ঞতার আশায় বেড়াতে এসে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আশাভঙ্গ হল। ব্যাপারটা এখন একটা বিভ্রমের পর্যায় চলে গেছে, কেননা লোভী মানুষের হাতের নাগালের বাইরে বোধহয় আর কোনো জায়গাই বাকি নেই। তাই, কিছুটা মেকি হলেও, আমরা বোধহয় পয়সা খরচ করে ওই বিভ্রমটাকেই ধরে রাখতে চাই।
নামহীন ছোট নালাটা অবধি পৌঁছনোর আগে অবধি মনে হয়নি যে আমরা শহর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি।
আশেপাশে চাষের ক্ষেতগুলো থেকে মানুষের নিয়ন্ত্রণ-সর্বস্ব উপস্থিতি কিছুটা বোঝা গেলেও, ক্ষেতগুলো খুব একটা দেখা যাচ্ছিল না। শুধু একটা বাচ্চাকে একটা গাছে ওঠার চেষ্টা করতে দেখলাম।
যে ‘ফার্ম’-এ আমাদের বুকিং হয়েছিল, তার একদিকে বয়ে চলেছে এই নালাটা, আর অন্য পাড়ে চা-বাগান; গরু-ছাগল, মাছ-হাঁস-মুর্গি, সবই ছিল দৃশ্যমান। মাস্ক পরে থাকার নিষেধাজ্ঞা না থাকায় আমার ভাইপো আর ভাইঝি মাঠ জুড়ে দৌড়তে শুরু করে দিল। শিশির-ভেজা প্যান্টে, বিকেলের আধো-কুয়াশায় আমরা মাঠে বসে তাদের খেলা দেখতে লাগলাম। এর মধ্যে কোনও কিছুই আমাদের কাছে নতুন ছিল না, কিন্তু আমরা তা-ও ভান করলাম যেন আমাদের কাছে এই অভিজ্ঞতা একেবারে অভিনব।
লোডশেডিংটা হওয়া অবধি এই ‘ভান করা’ ব্যাপারটা চলছিল। তারপর… সব বদলে গেল। আমরা বাইরেই বসে ছিলাম; মা-কে একটা চেয়ারে বসিয়ে, বাকিরা কেউ বা নালার ধারে, কেউ বাঁশের সাঁকোয়, কেউ মাচানে বসে ছিলাম। বৈদ্যুতিক আলো চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মনে হল যেন শব্দও হারিয়ে গেছে। আমার তিন বছরের ভাইঝির তার দাদাকে ডাকা ছাড়া – ‘দাদা, কোথাও যাস না, বাঘ খেয়ে নেবে’— এমন একটা নৈঃশব্দ ঘনিয়ে এলো যা আমি বহু বছরে অনুভব করিনি। নৈঃশব্দ বলছি, কিন্তু প্রকৃত অর্থে শব্দের অভাব নয়, বোঝাতে চাইছি মানুষের ভাষার অনুপস্থিতি। এই অন্ধকারে, যা আমাদের গ্রহ থেকেই অবলুপ্ত হতে চলেছে, আমরা যে অভিজ্ঞতা চাক্ষুষ দেখতে এসেছিলাম, তা বোধহয় শুনতে পেলাম— এই পৃথিবীর আগের কোনও এক পৃথিবীর শব্দ, ব্যাং আর ঝিঁঝিঁপোকা আর বৃষ্টিহীন শীতে শুকিয়ে-আসা নালাটা যে সঙ্গীত রচনা করল, তা যেন বাতাবাড়ির নিজস্ব, অনন্য, বোধহয় গোটা ডুয়ার্সের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ভেবেছিলাম, বাতাবাড়িকে দেখতে এসেছি। নিশুতি মধ্যরাতের ওই অন্ধকারে উপলব্ধি করলাম, হয়তো আমরা বাতাবাড়িকে শুনতে এসেছি।
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত