ইভান, সের্গেই আর আমি
আমার সকাল আর বিকেল গড়িয়ায় কাটলেও, দুপুরগুলো কাটত রাশিয়ায়। মানে, যেদিন-যেদিন স্কুল ছুটি থাকত আর কী! এরকম নিশ্চয়ই সকলেরই হত, যারা সেই আটের দশকে কৈশোর কাটিয়েছি। যে যেখানেই থাক, নিঝুম দুপুরগুলোয় ঢুকে পড়ত রুশদেশে। বিকেলে হয়তো ক্রিকেট খেলব রাজা আর পিন্টুর সঙ্গে, কিন্তু দুপুরে বিচ্ছুমি করে বেড়ালাম ইভান আর সেরগেই-এর পিছু-পিছু। এমনই অনাবিল রূপকথার জীবন ছিল তখন আমাদের। রাশিয়া কত সহজেই যে হয়ে উঠতে পেরেছিল পাশের পাড়া! রুশ মানুষজন, তাদের জীবন, তাদের সাহিত্য, তাদের প্রকৃতি কত অনায়াসে হয়ে উঠতে পেরেছিল আমাদেরও, ভাবি এখন। এই বিশ্বায়নের মুঠোপারঙ্গমের যুগে আর এমন আত্মীয়তা সম্ভব কি? মনে হয় না।
সে যাই হোক, দুপুরগুলোয় আমরা, অন্তত আমি, মুখ ডুবিয়ে থাকতাম রুশদেশের গল্পগুলোয়। তখনও ম্যাক্সিম গোর্কি বা নিকোলাই গোগোল পড়িনি, কিন্তু ‘রুশদেশের উপকথা’ গোগ্রাসে গিলছি, পাশাপাশি ‘সার্কাসের ছেলে’ বা ‘দুই ইয়ারের যত কাণ্ড’র মতো ঝলমলে বইগুলো কতবার যে পড়ছি, তার ইয়ত্তা নেই। পড়তে-পড়তে তাদের রুটির আশ্চর্য গন্ধ এসে নাকে লাগছে, তাদের কেকে-র মিঠে ভাপে ভরে উঠছে আমার শীতকাল। যেন আমাদের ভাতের হাঁড়ি এসবের চেয়ে খুব বেশি দূরে নয়। তাই দেব সাহিত্য কুটিরের পাশাপাশি রাদুগা ছিল আমাদের ভরসা, ইন্দ্রজাল কমিকস-এর কাছাকাছি ভস্তককে চিনতাম আমরা।
এর মধ্যে ভূগোলেও পড়ছি রাশিয়ার কথা। তার শিল্পাঞ্চলের কথা, তার খনির কথা যেমন পড়ছি, তেমনই জানছি, ইউক্রেনকে পৃথিবীর শস্যভাণ্ডার বলা হয়। তার ক্ষেতে ফলানো সোনালি ও সুস্বাদু গমের জুড়ি পৃথিবীতে নেই। বাবা বাড়িতে আনতেন ‘সোভিয়েত দেশ’ নামক পত্রিকাটি। লম্বা-চওড়া, মসৃণ, রংচঙে সেই পত্রিকার পাতায় আমি দেখতাম ছবি। রাশিয়ার। সোভিয়েত রাশিয়ার। যে-রাশিয়া জুড়ে আমার বন্ধুরা থাকে, যাদের সঙ্গে আমি কথা বলি রোজ। যে-রাশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঠে নামলে জার্সির বুকে লেখা থাকে USSR।
কী অবাক কাণ্ড, সেই সোভিয়েত দেশে যাবার আমন্ত্রণ পেলেন মা, গান শোনানোর জন্য। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কালচারাল ডেলিগেশন পাঠানো হবে, তাতে যেমন থাকবেন বনশ্রী সেনগুপ্ত, মায়া সেন, ইমরাত খান সাহেব বা অমিতা দত্ত, তেমনই থাকবেন আমার মা-ও। বাবা যাবেন সঙ্গে, কেননা বাবা তখন মা’কে সঙ্গত করেন, হারমোনিয়ামে। আর এই গোটা দলের নেতৃত্ব দেবেন অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়। আমার স্কুল, পরীক্ষা, তাই যাওয়া হবে না। আমাকে থাকতে হবে মাসিদের কাছে। সে নয় হল, কিন্তু সত্যিই মা আর বাবা রাশিয়া যাচ্ছে? সোভিয়েত রাশিয়া? তখনও আমি লেনিন জানি না, নভম্বর-বিপ্লব জানি না, আইজেনস্টাইন বা পুডভকিন জানি না, কিছুই জানি না প্রায় রাশিয়ার। যা দিয়ে রাশিয়াকে দুনিয়া চেনে, তা তো আমার চেনা নয় তখনও। কিন্তু এটা ভেবেই অবাক লাগছিল যে, মা আর বাবা যাবে ইভান বা সেরগেইয়ের দেশে, ইউক্রেনের গমক্ষেতের দেশে, রাদুগা আর ভস্তকের দেশে। ঠিক কত দূর সেটা? কীভাবে যেতে হয়?
অবাককে সরিয়ে অবশ্য বিশ্বাসকেই জায়গা দিতে হল, যখন বাড়িতে এল পাতা দশেকের চকচকে টিকিট, Aeroflot-এর, যার এককোণে Moscow কথাটা জ্বলজ্বল করছে। আর এক সকালে হাসিমুখে পান চিবোতে-চিবোতে আমাদের একতলার ভাড়াবাড়িতে এলেন স্বয়ং অনিল চট্টোপাধ্যায়, সমস্ত পরিকল্পনা ঝালিয়ে নিতে। তখনও ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখিনি, ‘মহানগর’ দেখিনি, কিন্তু মানুষটাকে চিনি দিব্যি। রোববার টিভিতে সাদা-কালো বাংলা সিনেমায় বহুবার তাঁকে দেখেছি। তিনি, এই তো, কেমন রঙিন আর জ্বলজ্যান্ত সামনে বসে আছেন।
শুরু হল প্রস্তুতি। বাড়ি গমগম করে উঠল নানা রকম আড্ডা-আলোচনায়, গানে-গল্পে। রাশিয়ায়, বিশেষত সোভিয়েত দেশে কীরকম গানবাজনা সঙ্গে থাকলে মানুষজন একটু বেশি আত্মীয়তা বোধ করবেন, সেই নিয়ে ভাবনাচিন্তায় মেতে থাকলেন এঁরা সকলে। দফায়-দফায় নানা জনের বাড়িতে হতে থাকল মহড়া। আমাদের লাল মেঝের এককোণে গর্বে বুক ফুলিয়ে একটা ঢাউস সুটকেস উঠে দাঁড়াল একদিন, সেও রাশিয়া যাবে।
দিন পনেরোর সফর সেরে বাবা আর মা যখন ফিরে এল, যেন আমারই দুনিয়া বদলে গেল রাতারাতি। পুতুলের ভেতর পুতুল, তার ভেতর পুতুল, বইতে পড়া এই রুশ উপহার তখন আমার হাতে শোভা পাচ্ছে, আর বইয়ের তাকে ‘রুশদেশের উপকথা’র নতুন সংস্করণ, খোদ রাশিয়ান ভাষায়। কিচ্ছু বুঝি না তার, কিন্তু রোজ একবার খুলে বসা চাই। সেইসঙ্গে এল মস্কো অ্যানিমেশন স্টুডিও-র কিছু ইলাস্ট্রেশন প্লেট। আমার আঁকায় ভারি উৎসাহ ছিল বলে বাবা আর মা আমার জন্য নিয়ে এসেছে। কেমন ভাবে অ্যানিমেশন তৈরি হয় সেই নিয়ে একখানা বই, আর চমৎকার সব আঁকায় ভরে ওঠা স্বচ্ছ প্লেট। পর পর রাখলে বোঝা যায়, কীভাবে চলমান হয়ে ওঠে তুলির টান। এর চাইতে ভাল উপহার আমি জীবনে কমই পেয়েছি।
উপহারের সব মোড়ক একে-একে শেষ হলে খোলা হল ছবির খাম। রুশ দেশে তোলা ছবি। কোথাও মা গান গাইছে, কোথাও সকলে মিলে বরফ পেরিয়ে হাঁটছে, কোথাও লেনিন মূর্তির পাদদেশে জমায়েত, কোথাও বা জমজমাট বাজারে দরদাম করছেন সকলে। সাদা-কালো সেইসব ছবির মধ্যে দিয়েই আমি আমার চিরচেনা রুশদেশকে আরও একবার চিনতে পারলাম। মস্কো, কিয়েভ, ওডেসা, সেন্ট পিটার্সবার্গ, লেনিনগ্রাদ। এইসব শহরে অনুষ্ঠান করতে গেছিল মা আর বাবা। তাদের রাস্তাঘাট, দোকানপাট, গাছগাছালির ছবিতে ভরে উঠল আমাদের গড়িয়ার ভাড়াবাড়ি। ছোট-ছোট স্মারক, পুস্তিকা, আরও কত কী! যেন ছোটমোটো একখানা রুশদেশেই আমি থাকতে শুরু করলাম নতুন করে।
পরে, বড় হয়ে বুঝেছি, যতই চেষ্টা করি না কেন, আমার ছোটবেলার রুশদেশে চাইলেও আর যেতে পারব না। সোভিয়েত ততদিনে একটা মিথ, একটা ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন, একটা আধখাওয়া রুটির টুকরো। সেখানে আর ফেরা যায় না। মা আর বাবা সেই অলীক দেশ দেখে এসেছে, এটা ভাবতে যেমন ভাল লাগত, আমার কক্ষনও তা দেখা হবে না, কেননা দেশটাই নেই আর, এটা ভাবলে কষ্ট পেতাম। আর আজ যখন কিয়েভ-এর আকাশ ঝলসে উঠছে সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে উড়ে আসা মিসাইলে, যখন ইউক্রেন দখলের জন্য সেনা নামিয়েছে খোদ রাশিয়া, তখন নিজের ছোটবেলাটাকেই কেমন যেন অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে। এই শহরের নামগুলোর গায়ে লেগে থাকা রুটি আর কেকের গন্ধ বদলে যাচ্ছে বারুদ আর ছাইয়ের গন্ধে, এক জীবনে এও দেখতে হল! কেবল মনে হচ্ছে, আমার ছোটবেলার দুই বন্ধু, ইভান আর সেরগেই, ওদের ঠিকানা এখন কোথায়? রাশিয়ায়? না ইউক্রেনে? নাকি ওদের আর কোনও ঠিকানা নেই কোথাও? আমার ছোটবেলাই ওদের একমাত্র বসতবাড়ি? কে জানে…
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত