‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। বিচিত্র তার জীবন। অদ্ভুত রহস্যময় তার গতিবিধি। কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর সুন্দর এক অন্তর। একা। টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না। কোথাও অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার দেখলে রুখে দাঁড়ায়। পদে পদে তার বিপদ-শিহরন-ভয় আর মৃত্যুর হাতছানি। আসুন,এই দুর্ধর্ষ, চিরনবীন যুবকটির সঙ্গে পরিচিতি হই। সীমিত গণ্ডিবদ্ধ জীবনের একঘেয়েমি থেকে একটানে তুলে নিয়ে যাবে ও আমাদের স্বপ্নের এক আশ্চর্য মায়াবী জগতে।
আপনি আমন্ত্রিত।
ধন্যবাদ।’
(মাসুদ রানার নির্ধারিত ফ্ল্যাপলিপি)
২.
‘হ্যালো, কিশোর বন্ধুরা আমি কিশোর পাশা বলছি, আমেরিকার রকি বীচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলেসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে, হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। যারা এখনও আমাদের পরিচয় জান না, তাদের বলছি, আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি, নাম তিন গোয়েন্দা। আমি বাঙালী। থাকি চাচা-চাচীর কাছে। দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান, ব্যায়ামবীর, আমেরিকান নিগ্রো; অন্যজন আইরিশ আমেরিকান, রবিন মিলফোর্ড, বইয়ের পোকা। একই ক্লাসে পড়ি আমরা। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহা-লক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরানো এক মোবাইল হোম-এ আমাদের হেডকোয়ার্টার।
তিনটি রহস্যের সমাধান করতে চলেছি
এসো না, চলে এসো আমাদের দলে।’
(তিন গোয়েন্দা ভল্যুমের নির্ধারিত ফ্ল্যাপলিপি)
৩.
১৯৫৮ সালে একখানা বিলেতি শিকারি রাইফেলের দাম কত হবে? হাজারখানেক? না তারও বেশি? জানা নেই। ২২ বছরের এক তরুণ সে-বছর ভাবছেন কী করে একটা ব্রিটিশ রাইফেল কেনা যায়। মনে-মগজে শিকারের নেশা। পিতা উপমহাদেশের বিখ্যাত আচার্য। গণিত, তথ্যগণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের কিংবদন্তি শিক্ষক, গবেষক এবং সাহিত্যিক। ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম চালিকা। কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠজন, যাঁকে নজরুল ডাকতেন ‘মতিহার’ নামে। তাঁর নাম বলাই বাহুল্য, কাজী মোতাহার হোসেন। তাঁর ছেলেমেয়ের সংখ্যা কম নয়, ১১জন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত আবাসনে বেড়ে ওঠা বহু যশস্বী পণ্ডিতের সঙ্গে এবং ছেলেবেলায় নজরুলের স্মৃতিধন্য ছিলেন কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন নবাব। কিছুটা ছোট করে কাজী আনোয়ার হোসেন। কাজী মোতাহার হোসেনের সন্তানদের মধ্যে কাজী আনোয়ার হোসেন লাজুক প্রকৃতির। তারই কিনা শিকারি হবার নেশা? বাবার কাছে পয়সা চাইতে লজ্জা, অন্য কোনও উপায়ে টাকা জোগাড়ের পন্থাও জানা নেই। একজন অন্তর্মুখী মানুষ যে-উপায় নিতে পারেন, কাজী আনোয়ার হোসেন তাই করলেন। কুয়াশা নামে একটা রহস্যভেদী চরিত্র তৈরি করে দুই খণ্ড রহস্যকাহিনি লিখলেন। শুরু হল প্রকাশকদের দুয়ারে-দুয়ারে ঘোরা। এক প্রকাশক দুই বইয়ের বিনিময়ে দুশো টাকা দিতে চাইলেন। কিন্তু দুশো টাকায় তো রাইফেল কেনার পয়সা উঠবে না। অতএব তিনি পাণ্ডুলিপি ফেরত নিয়ে এলেন। লেখালেখিতে আপাতত কিছুটা বিরতি। শিকারি হওয়া আর হল না। তবে, মাছ শিকারের নেশা ছাড়তে পারেননি সমস্ত জীবন। মাছ শিকার করতে তো আর বিলেতি রাইফেল লাগে না। শিকারি না হলেও অন্য কত কিছুই হতে পারতেন তিনি। তাঁর তিন বোন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন রবীন্দ্রসঙ্গীতের কালজয়ী শিল্পী। বিয়েও করেছিলেন আরেক শিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনকে (কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমিন ও নীলুফার ইয়াসমিনের বড় বোন)। তাহলে সঙ্গীতশিল্পী হওয়াটা কি তাঁর জন্য অসম্ভব ছিল? হয়েও ছিলেন। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। রেডিয়োতে গাইতেন, টেলিভিশনে গাইতেন, সিনেমায় প্লে-ব্যাকও করেছেন। তবে সে-সকল ছেড়ে দেন ১৯৬৭ সালে। সম্ভবত দুটি কারণ। পরবর্তী কোনও আড্ডায় জানিয়েছিলেন তিনি যেমন অন্তর্মুখী মানুষ, তাতে গান, রেডিয়ো, টেলিভিশনের জগৎ তাঁর জন্য অতটা আকর্ষণীয় ছিল না। আর দ্বিতীয় কারণটি ঘটে ১৯৬৩ সালে। বাবার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা নিয়ে পুরনো মুদ্রণযন্ত্র কিনে নিলেন ব্যবসা করবেন বলে। বাবার খুব সম্মতি ছিল না বোধহয়। বংশে কেউ ব্যবসা করেনি। তাছাড়া নিজে অত বড় পণ্ডিত তো বটেই, ছেলের বোনেরা এত ভাল পড়াশোনায় । তাও কিনা শুরু করল এমন এক ব্যবসা, যেটা বলতে গেলে এক প্রকার জলে ঝাঁপ দেওয়াই। তখন পেপারব্যাক বই প্রকাশ করত ঝিনুক প্রকাশনী। তারা অবশ্য ক্লাসিক বইপত্র ও রচনাবলিতেই মনযোগ দিয়েছিল বেশি। ১৯৬৪ সালে কাজী আনোয়ার হোসেন শুরু করলেন ‘কুয়াশা-১’ নাম দিয়ে পেপারব্যাক এক রহস্য সিরিজ। ঢাকার সেগুনবাগিচায় নিজেদের বাড়ির পাশের একটা টিনশেড বাড়িতে শুরু হল সেগুনবাগিচা প্রকাশনীর (পরবর্তীকালে সংক্ষেপে সেবা প্রকাশনী)। ঠিক দু’বছর পরে প্রকাশিত হল মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই ‘ধ্বংস পাহাড়’। অদ্ভুত এক প্রকাশনী। মোটে দুজন কর্মচারী। কাজী আনোয়ার হোসেন বলতে গেলে নিজেই লেখক, প্রকাশক, মেশিন অপারেটর, বইয়ের পরিবেশক, হকার! এরপর যা ঘটবে, সেটা ইতিহাস, সেটা দিগ্বিজয়। এ-পর্যন্ত পাঁচশোর কাছাকাছি মাসুদ রানা প্রকাশিত হয়েছে। পাঁচ প্রজন্মের অন্তত পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ এটা কমবেশি পড়েছেন, কয়েক কোটি লোক মাসুদ রানাকে চেনেন। প্রথম দিকের কয়েকটি মৌলিক বই ব্যতীত বাকি বইগুলি বিভিন্ন বিদেশি উপন্যাসের কাহিনি ধার করে (সেবা প্রকাশনীর ভাষায় বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে) রচিত। প্রথম বই ‘ধ্বংস পাহাড়’-এর উপাদানও গৃহীত হয়েছিল জেমস বন্ড সিরিজের ‘ডক্টর নো’ অবলম্বনে। অমন জটাজটিল কাহিনি বাংলাদেশের পটভূমিতে বাঙালি পাতে তোলা প্রায় অসম্ভব। সে-কাজের অভিজ্ঞতার জন্য সমস্ত চট্টগ্রাম আর কাপ্তাই অঞ্চল মোটর সাইকেল নিয়ে চষে বেড়িয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। মাসুর রানার অপাপর গল্পগুলো ইয়ান ফ্লেমিং, জেমস হেডলি চেজ, অ্যালিস্টার ম্যাকলিন, ডেসম-ব্যগলি, নিক কার্টার প্রমুখ জনপ্রিয় থ্রিলার লেখকদের বিভিন্ন কাহিনি অবলম্বনে লেখা। একা কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষে এতগুলো বই লেখা সম্ভবও নয়। আদতে তাঁর নামের আড়ালে ঘোস্ট রাইটাররা লিখতেন সেসব। তবে, চূড়ান্ত পরিকল্পনা, বাছাই, সম্পাদনা থাকত কাজী আনোয়ার হোসেনের হাতে। যার ফলে প্রতিটি লেখাই সমরূপ চেহারা পেত। তা বাংলা ভাষায় রহস্য কাহিনি নতুন কিছু নয়। সেই ‘বাঁকাউল্লার দপ্তর’, ‘সেকালের দারোগার কাহিনী’, ‘দারোগার দপ্তর’ এসব দিয়ে তার সূচনা, পাচকঁড়ি দে, দীনেন্দ্রনাথ রায়, হেমেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়ে তার বিকাশ, এবং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত বা সত্যজিৎ রায়ে এসে চূড়ান্ত সিদ্ধি। এমনকী যাঁরা সিরিয়াস বা সৃজনশীল সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাত, পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের প্রত্যেকেরই বলতে গেলে একটা করে গোয়ান্দা চরিত্র আছে। প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিমল কর, সমরেশ বসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, বুদ্ধদেব গুহ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার— এই নামগুলো স্মরণ করুন। এসব লেখকদের মধ্যে যাঁরা প্রাচীন, তাঁরা উদার ভাবে সহায়তা নিয়েছেন বিদেশি কাহিনির, আত্মীকরণ করেছেন। তাহলে কাজী আনোয়ার হোসেন নতুন কী করলেন? বাংলা সাহিত্যে সেবা প্রকাশনীর পূর্বে যা লেখা হয়েছে তা মূলত গোয়েন্দাকাহিনি কিংবা অভিযান। ব্যোমকেশ বাদ দিলে প্রাপ্তমনস্ক গোয়েন্দাও খুব বেশি নেই। যেসব হয়েছে, সেখানের কাহিনির পরিসর সীমিত, অভিযান কাহিনিতে খুঁটিনাটির চাইতে ফ্যান্টাসি বা কল্পনার আশ্রয় বেশি। মাসুদ রানা গোয়েন্দা বটে, মূলত এসপিওনাজ এজেন্ট। সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স নামক এক কাল্পনিক সংস্থার এজেন্ট। কমান্ডো। সাংকেতিক নাম এম আর নাইন (MR9)। প্রধান সমস্ত ভাষায় দখল, দুনিয়ার সমস্ত অস্ত্রে পারঙ্গম, ক্ষুরধার মস্তিষ্ক আর অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি। দুর্জয় সাহস, সুদর্শন ও প্রেমিক। জেমস বন্ডের আদলে তৈরি করা হলেও বন্ডের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য বাঙালি রুচিতে খাপ খাবে না। ফলে বন্ডের সকল দক্ষতা বিদ্যমান রেখে, মননে বাঙালি হৃদয়ের মিশ্রণই মাসুদ রানা। তাছাড়া বন্ডের কাহিনি-সংখ্যা বেশি নয় এবং একক লেখকের হাতে বিকশিত হওয়ায় বন্ডের বিবর্তন তেমন হয়নি। মাসুদ রানার কাহিনি ধার করা হয়েছে বহু লেখকের কাছ থেকে। ফলে রানাকে এত রূপে দেখা গেছে, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত প্রান্তে, এত রকম পরিস্থিতিতে, পৃথিবীর আর কোনও এসপিওনাজ এজেন্টের ভাগ্যে সেটা ঘটেনি। কাজী আনোয়ার হোসেনের সব থেকে বড় সক্ষমতা তাঁর নির্মেদ ঝকঝকে ভাষা। এসপিওনাজ কাহিনির টানটান উত্তেজনা, সেই সাথে সাহিত্যিক আমেজ, পরিপার্শ্বের নিখুঁত বর্ণনা সকল কিছুর এমন সুষম সিদ্ধি কাজী আনোয়ার হোসেনকে অতুলনীয় করে তুলেছিল, কী লেখক হিসেবে, কী সম্পাদনায়। ডিটেইলিং বা বর্ণনার নিখুঁত ধারাভাষ্যে, বিস্তারে সেবা প্রকাশনীর তুলনীয় কিছু বাংলা ভাষায় দেখা যায় না। বলা যায় মাসুদ রানার সঙ্গে আপনি প্যারিসে হাজির হলে, প্যারিসের ট্যুরিস্ট গাইড লাগবে না। আপনি জানবেন কী করে সেখানে সবথেকে দামি রেস্তোরাঁয় নির্দিষ্ট আদবকায়দা অনুসরণ করে আসন গ্রহণ করতে হয়, কোন খাবারের পরে কোন খাবারটা খেতে হয়, খাবারের রীতিই বা কী। কালাহারি মরুভূমি কিংবা দক্ষিণ সাগরের বিরূপ ভৌগোলিক আবহে মুহূর্মুহু কী পরিবর্তন ঘটে আবহাওয়ায়, কী করেই বা আকাশের তারা দেখে দিক ঠিক করা চাই, আর উত্তাল ঝড়ে জাহাজ চালানোর খুঁটিনাটি বিদ্যা, প্রথম মাসুদ রানাই শিখিয়েছিল আমাদের। হেন মোটরযান বা উড়োযান নেই, যেটা মাসুদ রানা আমাদের চালিয়ে দেখায়নি, এমন দেশ নেই যেখানে নিয়ে যায়নি, এমন অস্ত্র নেই যেটা সে শত্রুর ওপর প্রয়োগ করেনি। প্রতিটি অস্ত্রের কারিগরি খুঁটিনাটির বর্ণনা এমন ভাবে রয়েছে, মনে হবে, আপনি সিনেমা দেখছেন, নয়তো প্রত্যক্ষরূপে কোনো প্রশিক্ষকের কাছ থেকে শিখছেন। মাসুদ রানা তো সেবা-র একমাত্র সম্পদ নয়। সেবা-র প্রধান সম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে তিন গোয়েন্দা সিরিজ, ওয়েস্টার্ন সিরিজ (বুনো পশ্চিমের পটভূমিতে সব কাহিনি), অনুবাদ বিভাগ। এছাড়া, গোয়েন্দা রাজু, ভয়াল সিরিজ, সেবা রোম্যান্টিক এসবও কমবেশি পাঠকপ্রিয়। সেবা-র দ্বিতীয় জনপ্রিয় বিভাগ হল তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এক বাঙালি কিশোর, যার নাম কিশোর পাশা, থাকে আমেরিকার রকি বিচের পাশে, আরও দুই বন্ধু সহযোগে তাঁদের বিস্ময়কর সব গোয়েন্দাকীর্তির উদাহরণ এই তিন গোয়েন্দা। রবার্ট আর্থারের ইংরেজি সিরিজ Three Investigator অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সৃষ্টি। অনেকের মতেই সেবা-র সর্বোৎকৃষ্ট অবদান অনুবাদ বিভাগ। দুনিয়ার সমস্ত ক্লাসিক পূর্ণাঙ্গ কিংবা কিছুটা সংক্ষেপিত আকারে, অনেক সময় রূপান্তরিত করে বাংলাদেশের কিশোর পাঠকদের রুচি ও বই পড়বার সংস্কৃতি দৃঢ়ভাবে তৈরি করেছিল সেবা। পাড়ায়-পাড়ায় পাঠক-ক্লাব, সেবা-র গ্রাহক হয়ে চাঁদা তুলে সকলে মিলে বই কেনা, এটা এক সময় বাংলাদেশের শহর বা মফস্সলের নিয়মিত চিত্র হয়ে উঠেছিল। সেইসঙ্গে ছিল সেবা-র পাঠকের চিঠিপত্র বিভাগ, প্রতি বইয়ের শেষে পাঠকদের চিঠি ছাপা হত এবং সেসব চিঠির উত্তর দিতেন লেখকেরা। ‘সেবা বই, প্রিয় বই, অবসরের সঙ্গী’, এই কথাটা ব্র্যান্ডিং কোটের মতো করে প্রত্যেক বইয়ের পেছনে লিপিবদ্ধ থাকত। স্যার ওয়াল্টার স্কট, আলেকজান্ডার ডুমা, রবার্ট লুই স্টিভেনশন, সল বেলো, জুল ভার্ন, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, মার্ক টোয়েন, চার্লস ডিকেন্স-সহ শত-শত ক্লাসিক অনূদিত হয়েছে সেবা-র লেখকদের হাতে। আর সব বাদ দিলেও শুধুমাত্র রবিনহুড, পঞ্চ রোমাঞ্চ প্রভৃতি অনুবাদের জন্য কাজী আনোয়ার হোসেন অনুবাদ সাহিত্যে স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারতেন। সেবা-র আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা হচ্ছে ওয়েস্টার্ন সিরিজ ও রহস্য পত্রিকা। এই নিরীহ শ্যামল সজল দেশে, বুনো পশ্চিমের একরোখা জীবন নিয়ে একের-পর-এক অভিযান কাহিনি তৈরি, এ এক বিস্ময়! রহস্য পত্রিকা ছিল কিশোর ও তরুণ লেখক সৃষ্টির জায়গা। রহস্য-রোমাঞ্চকে ভিত্তি করে একটা সাময়িকী এতদিন দাপটের সাথে টিকে থাকার উদাহরণ বঙ্গভূমিতে বোধ করি নেই। সেবা কিছু গুরুত্বপূর্ণ নন ফিকশনও প্রকাশ করেছিল। স্বয়ং কাজী আনোয়ার হোসেন বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে ‘সঠিক নিয়মে পড়ালেখা’, ‘যৌন বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান’, ‘ধূমপান ত্যাগে আত্মসম্মোহন’ প্রভৃতি সে-সময়ের তুলনায় অনেক আধুনিক বই লিখেছিলেন।
এখনকার যুগে হয়তো অবিশ্বাস্য লাগবে, মফস্সলের বহু তরুণ ও কিশোরের সারা মাসের অপেক্ষা থাকত ডাকযোগে কবে সেবা-র বই আসবে। এমন উদাহরণ আমরা দেখেছি, শুধু সেবা-র বই সহজে পাওয়া যাবে বলে অধিকতর বড় শহরে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়েছে ছেলেমেয়েরা। কী দিয়েছিল সেবা প্রকাশনী সেইসব কিশোর ও তরুণদের?
সেবা-র সব থেকে শক্তিশালী দিক হল আমাদের পাঠককে বিশ্বমুখী করে তোলা। কিশোর বয়স থেকেই। শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে, আমাদের সাহিত্যে সাহিত্যিক বৈচিত্র ভালই রয়েছে, তবে বিষয়বৈচিত্র বিশেষত গল্পের মধ্যে ভৌগোলিক ও উপাদানগত ব্যাপ্তি খুব বেশি নয়। সেবা পড়েই আমরা কত সমুদ্র-পাহাড়-উপকূল-মরু-বরফে ঘুরেছি, এই অভিজ্ঞতা, বিশ্বভ্রমণের স্বাদ সেবা না হলে অন্তত আমার পাওয়া হত না। এটা দিয়ে জাহাজ চালনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যেমন জেনেছি, জেনেছি কেমন করে উড়োযান চালিয়ে নেন বৈমানিক, যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, অরণ্যের নিঃশব্দ রাত্রি, কত বিচিত্র দেশ, কত রকমের মানুষ, খাদ্যাভাস, প্যারিস, রোম, ভেনিস, ন্যু ইয়র্ক কত শত শহর, পাঁচ তারা হোটেল থেকে আফ্রিকার নির্জন প্রান্তরের ছোট্ট কুঁড়েঘর, তেজি অশ্বকে বাগিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো, নিঃশঙ্ক চিত্তে শত্রুর পিস্তলের সামনে দাঁড়ানো, ভাজা মাংসের সাথে প্রাচীন মদের তৃষ্ণা, নীলচে উপকূলে বসে সেঁকানো রুটিফল খেতে-খেতে ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা, ডলফিনের সাথে ঠান্ডা কোমল জলে ডুবসাঁতার, কত রকম আচরণ, উৎসব, পোশাক, রাজনীতি, অস্ত্র-কৌশল-রক্ত-মৃত্যু-জীবন, দেখেছি কীভাবে সূর্যের উদ্ভাসে চুরচুর করে ফাটছে বরফের চাঙড়, গলছে তুষার, পাইন আর মেপলের গাছে বসন্তের নতুন সবুজ পাতার কম্পন… ক্যাডিলাক, লিমুজিন, রোলস রয়েসের সাথে ছড়িয়ে আছে কত বিলাস, সহস্র বছরের পুরনো সভ্যতার গোপন ঐশ্বর্য, সাম্রাজ্যের নেশায় অন্ধ রাষ্ট্রনায়ক, কালচে ধূসর ব্ল্যাক ম্যাম্বা আর হিসহিসে ভয়াল পাইথন, ঘাসের জমিতে সিংহের হুংকার! অন্ধকার সমুদ্রে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকা নিঃসঙ্গ একাকী নাবিক, কয়েক কোটি বছরের পুরনো গুহায় কিচিমিচি বাদুড়ের আর্তনাদ, মরুভূমির বীভৎস রাত্রিতে রাতজাগা পাখির ডাকে জীবনের স্পন্দন, বিলুপ্তপ্রায় কালো জাগুয়ার, পাহাড়ের ওপর থেকে হঠাৎ ধসে পড়া পাথর, নীল-ধূসর-কালো-আয়ত লোচনা শ্বেত-কৃষ্ণ-বাদামি-লালচে রঙের সুন্দরীরা, গরমের ছুটিতে প্রজাপতির খামারের পাশে ক্যাম্পিং, মৃত্যুর সাথে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব-বুদ্ধি-যুক্তির বিস্তার, উড়ন্ত সীগালের দিকে তাকিয়ে হাতে বানানো চুরুটের ধোঁয়ার আয়েশি উৎক্ষেপণ, সব মিলিয়ে পৃথিবীব্যাপী জীবনের এক রঙিন কার্নিভাল! আর্থসামাজিক বা পরিবেশগত যে-কারণেই হোক না কেন, আমাদের বাংলা সাহিত্যে এ-বৈচিত্রের উদাহরণ কম। সেবা প্রকাশনীর লেখকেরা অন্য দেশের অন্যদের লেখা ধার করে আমাদের কাছে তুলে ধরেছে। তাতে অন্যায় যতটুকুই হোক, লাভ হয়েছে পাঠকের অনেকখানি। সেবা আমাকে কৈশোরের ঝিম-ধরানো দুপুরগুলোয় একটু-একটু করে চিনিয়েছিল পৃথিবী…
৪.
কাজী আনোয়ার হোসেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে, তিনি সেই ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের বলয়ের বাইরে বাংলাদেশভিত্তিক একটি প্রকাশনা ও পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। বইয়ের সম্পাদনায় তিনি যে-কোনও অর্থে শীর্ষমান অর্জন করেছিলেন। লেখা বা সম্পাদনার কথা যদি বাদও দিই, সেই ইন্টারনেটবিহীন যুগে গল্পের খোঁজে শত-শত বিদেশি বই খুঁজে বার করা অতিমানবীয় পরিশ্রম ও মনযোগের কাজ। এ-কারণে আমরা দেখেছি সেবা প্রকাশনীর অনেক লেখক সেবা প্রকাশনী ছেড়ে দিয়ে অন্য জায়গায় লিখলে পূর্বের মান বা প্রতিষ্ঠা বজায় রাখতে পারেননি। তাহলে নিশ্চয়ই সম্পাদনার একটা গুরুত্ব ছিল। সেবা যেমন পাঠক তৈরি করেছে তেমনি আলাদা মননশীলতা ও দক্ষতার একদল লেখকও তৈরি করেছে। স্বাধীনতার পূর্বে টালমাটাল অবস্থায় ও স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সেবা প্রকাশনীর পেশাদারী ছিল অনন্য। নিয়মিত প্রকাশনা, দেশব্যাপী বিপণন, প্রায় নির্ভুল ছাপা, লেখকদের সম্মানী অবিলম্বে প্রদান করা, সেবা প্রকাশনীর বৈশিষ্ট্য ছিল (হুমায়ুন আহমেদও তাৎক্ষণিক অর্থের প্রয়োজনে সেবা প্রকাশনীতে লিখেছেন)। কাজী আনোয়ার হোসেনের অন্তর্মুখী স্বভাবের কাঠামো সেবা প্রকাশনীকে সংক্রমিত করেছিল। কাজী আনোয়ার হোসেন সাক্ষাৎকার দিতেন না, ছবি ছাপতেন না, টেলিভিশনে আসতেন না। কিংবদন্তি হয়েও তিনি ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। বাংলাদেশের কোনও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার তো দূর, ছোট কোনও সাহিত্যিক সম্মাননাও তিনি পাননি, অথবা নিতে অস্বীকার করেছেন। যে-প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইয়ে সারা পৃথিবীর প্রায় প্রতি ইঞ্চি জায়গার কথা এসেছে, সেই প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেন নিজ দেশের বাইরে কখনও পা রাখেননি! সমস্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন একাগ্র ও ধারাবাহিক পঠনে। তিনি বলতেন, আমি যা হতে পারিনি তা-ই মাসুদ রানা। প্রিয় ব্যক্তির নাম বলতে তিনি নিতেন মাসুদ রানার নাম। বলতেন, ভাবো, ও না থাকলে এত কিছু আমাকে কে দেখাত! সেবা-র বাকি লেখকদের মধ্যেও এই আড়াল-প্রবণতা সুস্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান হয়। প্রাতিষ্ঠানিক কাজের চর্চাকে গুরুত্ব দিতেই হয়তো বহির্জগতের চতুর আলোকে তাঁরা দূরেই রেখেছেন।
৫.
অগ্রিম টাকা দিয়ে দলবেঁধে বই কিনছে বাঙালি, একটা নতুন বই বের হবার সঙ্গে-সঙ্গে ভিড় ঠেলছে দোকানে, ছোট্ট বাপ-মা তাড়ানো রেলস্টেশন থেকে শুরু করে অভিজাত বিপণিবিতান, টিফিনের পয়সা বাঁচানো ইংরেজি-কম-জানা উশখুশে ছেলে বা ঝাঁ-চকচকে পনিটেল, গাড়ি থেকে নামা ঝলমলে কিশোরী, এলভিস প্রিসলি বাজাতে-বাজাতে যে পড়ছে ঘড়ির গোলমাল; এসব কাজী আনোয়ার হোসেনের কৃতিত্ব হতে পারে, তবে শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব নয়।
কাজী আনোয়ার হোসেনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি আমাদের ছায়া-ছায়া নিভু-নিভু মফস্সলকে কসমোপলিটান করে তুলেছিলেন।
অনেক-অনেক দিন আয়ু যদি পাই, ফের যদি কোনওদিন শান্ত মফস্সলের বোকা-বোকা ছোট নদীর পাড়ে কোথাও ঠাঁই হয়, যেখানে জানালা দিয়ে কিউবার রোদ আর বাদামি ত্বকের কারো হাতে ধরা কারবাইন থেকে ছুটে আসা বারুদের গন্ধ ঢুকে পড়ে, রেডিয়োতে তখনও যদি নব্বই দশক বাজে, আর আমাদের বারান্দা জুড়ে থাকে কাকাতুয়া রহস্য, তাহলে ‘সেবা বই, প্রিয় বই, অবসরের সঙ্গী’, এই আমার অবসর যাপনের কল্পনা।
মারাদোনার মৃত্যু ছাড়া আর কারো মৃত্যুতে এতটা শৈশব হারাইনি। আমার শৈশব ছিল সেবা বই, আমার অবসর হয়তো হবে সেবা বই।
বাংলা সাহিত্য তার শ্রেষ্ঠ সম্পাদকদের একজনকে হারিয়েছে, বাংলাদেশ তার সফলতম প্রকাশককে হারিয়েছে। যার উত্তরাধিকার পূর্বে কেউ নেই, পরেও কেউ নেই। আমরা তাঁকে শিখে রাখিনি। বিদায় মায়েস্ত্রো, গুডবাই রানা, উই লাভ ইউ ম্যান। আপনি তো কেবল টানেন সবাইকে, বাঁধনে জড়ান না…
পুনশ্চ: ‘বিদায় রানা’, ‘আই লাভ ইউ ম্যান’, এ দুটো মাসুদ রানা সিরিজের অত্যন্ত জনপ্রিয় বই, অনেকের বিবেচনায় মাসুদ রানা সিরিজের ক্লাসিক হিসেবে খ্যাত।